#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২০
হাসপাতালে সবার সামনে নির্বিকারে আমায় পাজাকোলে তুলে বাহিরের দিকে ছুটে যাচ্ছেন আনভীর। আমি যেহেতু জেনারেল ওয়ার্ডে ছিলাম তাই এখানকার পেশেন্টসহ রীতিমতো নার্সরাও ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।আমি অস্বস্তি আর লজ্জায় রীতিমতো লাল-নীল বেগুনি হয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্ত কথা বলার মতো টু শব্দ করলাম না। আনভীরের চোখমুখ রক্তিম লাল, এটা কি জেলাসির জন্য নাকি আমার ওপর রেগে থাকার জন্য তা আমার জানা নেই। তবে মানুষটাকে পাগল পাগল লাগছে দেখতে। উনি এবার হসপিটালের কাউন্টারের সামনে যেতেই একজন রিসেপশনিস্ট বলে ওঠলো,
-‘আপনি আপনার ওয়াইফকে খুঁজে পেয়েছেন তাহলে?’
-‘হ্যাঁ।’
আনভীরের প্রতিউত্তর শুনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো মেয়েটি। বললো,
-‘থ্যাংক গড। আমি তো ভেবেছিলাম উনাকে না পেয়ে আপনাকে নিজেও বোধহয় হসপিটালে ভর্তি হতে হবে।’
মেয়েটির কথা শুনে ভ্রু কুচকালাম আমি। অতঃপর কিছু মানুষের ফিসফিসানির কথার ধরন দেখে বুঝলাম আমি জেনারেল ওয়ার্ড থাকায় এতমানুষের ভীড়ে আমায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না উনি। আর তাই এখানকার রিসেপশনিস্ট ,নার্সদের উনি রীতিমতো পাগল করে ফেলেছেন। আমি হঠাৎ দেখলাম মেয়েটা আর তার অদূরে থাকা তিন-চারজন নার্স আমায় দেখছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। লজ্জায় আমার নাক-কান রীতিমতো লাল হয়ে গেলো। আনভীর আমায় কেবিন থেকে রিজাইন করিয়ে ইতিমধ্যে বেরিয়ে এসেছেন হসপিটাল থেকে। আজ আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো আমিও এমন পাগল মানুষটার উদ্ভট কাজকর্ম দেখে হাসতাম, বরং হাসিতে লুটোপুটি খেতাম। তবে এই চরিত্রে যেহেতু আমি আছি তাই আমার হাসি কম, লজ্জার চোটে কান্না আসছে বেশি। উহ্! তখন উনার কথা শুনে পাঁচমিনিট ওয়েট করলেই হতো। এবার যে এই মানুষটা বাসায় আমার সাথে কি করবে আল্লাহ জানে!
____________________________
ড্রইংরুমে আমি কাচুমাচু হয়ে বসে আছি। আমার পাশে বসে শিউলি ভাবি আমার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। আমার ঠিক বরাবর নীরবে বসে আছেন মা। আসলে মা’র সামনে আমার হঠাৎ পুতুলের মতো বসে থাকাতে অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে আনভীর ডোরবেল বাজানোর সময় যখন নুড়ী আপা দরজা খুললো তখন আনভীরের কোলে আমাকে দেখে উনার স্বভাবমতো ঘর তুলে দিয়েছিলো। উনি শুধু পারছেন না আমার এ অবস্থা আশেপাশের ফ্ল্যাটের সব মানুষদের জানাতে। আনভীর বারবার আপাকে না করছিলেন এভাবে চিল্লাফাল্লা করতে কিন্ত কে শোনে কার কথা ! শেষমেষ মা বাধ্য হলো সদর দরজার সামনে আসতে যে হয়েছেটা কি। আর উনি আসাতে আমি আর আনভীর দুজনেই একটু না ; বলতে গেলে অনেকটাই বিব্রত অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। কে জানে উনি আবার কি ভাবছেন !
আনভীর এবার আমতা আমতা করে বললেন,
-‘আহা! আপা এবার থামুন তো!’
-‘ক্যামনে থামুম ভাই? ছোড আফারে এমনে দেখলে ভয় পামু না? সবাইরে তো বলতে হইবো যে আফা পায়ে……..’
মা এবার নুড়ী আপাকে চোখ রাঙানি দিতেই আপা চুপসে গেলেন। সেই সাথে নিঃশ্বাস ফেললাম আমিও। মা এবার বললেন,
-‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? জলদি ভিতরে নিয়ে আয় আহিকে?’
আনভীর এবার কোনোমতে জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলেন এবার। আমার ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বললেন,
-‘আসছি আমি, আমি না আসা পর্যন্ত এক পাও নড়বে না এখান থেকে।’
বলেই উনি আবার বড়ো বড়ো পা ফেলে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেলেন। মায়ের আড়চাহিনীতে আমার লজ্জা ক্রমশ যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে।উনি এবার শিউলি ভাবিকে বললেন দ্রুত আমার জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে আসতে।ভাবি যাওয়ার পর উনি মিহি কন্ঠে আমায় বললেন,
-‘তোমার প্রতি আমার এই পাগল ছেলেটাকে ওভার পজেসিভ দেখে আমার কিন্ত বেশ ভালোই লাগছে আহি। শেষপর্যন্ত তোমাদের দুজনেরই তবে একটা পরিনতি হলো।’
আমি বিস্ময়ে তাকালাম মায়ের দিকে। উনার ঠোঁটকোণে ভেসে ওঠেছে এক সুক্ষ্ণ হাসি। এই মানুষটিকে বড্ড কমই হাসতে দেখেছি আমি। তবে এর মানে এই নয় যে উনি রাগী ধরনের মানুষ। শুরু থেকেই উনার প্রতি আমার এক অন্যরকম টান অনুভব হতো। তবে উনি আমায় আর আনভীরকে নিয়ে যা বলেছেন সেটা আরও যেন ভাবিয়ে তুললো আমায়। তবে আনভীরের এই আকস্মিক পরিবর্তন উনারও চোখে পড়েছে?আমি কিছু বলতে যাবো তখনই দরজা দিয়ে আবার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলেন আনভীর। হাতে ফার্মেসীর প্যাকেট। সম্ভবত আমার পায়ের আঘাতের জন্য স্যাভলন , ক্রিম এগুলো নিয়ে এসেছেন।
আমায় পাশে বসতে বসতে উনি মাকে বললেন,
-‘এই পিচ্চি যেনো রান্নাঘরে এক পা না বাড়ায় সেদিকে খেয়াল রেখো মা। এমনিতেও পায়ের বারোটা বাজিয়ে আমার আগামী দুইরাতের ঘুম হারাম করবে, আমি চাইনা আমার বাকি ঘুমটুকুও হারাম করুক!’
মা সুক্ষ্ণ হাসি হেসে সম্মতি জানালেন। আমি সরু গলায় বললাম,
-‘আমার পা জাস্ট ছিলে গিয়েছে আনভীর , পা ভেঙে গুড়াগুড়া হয়ে যায়নি।’
আনভীর আমার ডান পা সোফায় উঠিয়ে ব্যান্ডেজ খুলতে খুলতে থমথমে গলায় বললেন,
-‘না ভাঙলে এখন ভেঙে গুড়োগুড়ো করে দেবো। এমনিতেও আমার কথা অমান্য করার মতো ভয়ঙ্কর কাজ করেছো তুমি আহি। এর শাস্তি তো তোমায় পেতেই হবে।’
এই কথাগুলো উনি খুবই মিহিস্বরে বললেন যাতে মা শুনতে না পায়। কিন্ত আমার মুখ ক্রমেই যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মানুষটার এত ভয়ঙ্কর কথাবার্তা শুনে। আনভীর একটা বাকা হাসি দিয়ে পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ক্ষত স্থানে সাবধানে তুলো আর স্যাভলন দিয়ে সাফ করতে থাকলেন এবার।আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-‘ডক্টর তো এগুলো ক্লিন করে দিয়েছে।’
-‘সো হোয়াট? আমার সামনে তো করেনি যে আমি দেখবো?করেছে তো ওই ধ্রুবের সামনে।’
দাঁতে দাঁত চেপে বললেন উনি। আমি এবার তপ্ত শ্বাস ফেলে সোফায় শরীর এলিয়ে দিলাম। এর সাথে কথা বলা নিতান্তই বেকার। তাই কথা না বলাটাই ভালো হবে। পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে উনি আমায় কোলে তুলে নেয়ার চেষ্টা করতেই আমি বললাম ,
-‘হসপিটালে অনেক সাউথ ইন্ডিয়ান মুভির সিন করেছেন। এটা বাসা। এখানে কাইন্ডলি জলসার সিন করতে আসবেন না।’
উনি আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কোলে তুলে আমায় রুমে নিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস ইতিমধে মা নিজের রুমে চলে গিয়েছিলো। নাহলে এই অসভ্য লোকটার জন্য নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে লজ্জায় পড়তে হতো আমার!!
___________________
আমায় রুমে রাখার পরই উনি ভার্সিটিতে চলে গেলেন ক্লাস করানোর জন্য। সম্ভবত উনি একটা গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ রেখেই ফিরে আসেন, তাই হয়তো আমায় কোচিং থেকে নিয়ে আসার সময় একটু লেট হবে বলে টেক্সট করেছিলেন।উনি চলে যাওয়ার পরই আমি একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই কিছুসময়ের ব্যবধানে আনভীর উপস্থিতি লজ্জায় আমায় যেন গ্রাস করে ফেলেছে। তবে একটি বিষয় ভেবে ভয়ও জমলো মনে৷ উনি অলরেডি আমায় হুমকি দিয়ে গিয়েছেন শাস্তি দেওয়ার।
হয়তো এখন আনভীর ভার্সিটি না গেলে এখনই শাস্তি দিতে পারতেন তবে আমি নিশ্চিত, সন্ধ্যার পর বা রাতে, যখনই উনি বাড়িতে ফিরে আসুক না কেন, আমায় জব্দ না করে উনি ঘুমাবেন না। তাই এখন ঠান্ডা মাথায় একটা পরিকল্পনা করতে হবে তোকে আহি! নাহলে এই লোক থেকে কিছুতেই ছাড় পাওয়া যাবে না!
.
.
.
________________________________
রাতে পরিবেশে সবসময় একটা ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজমান থাকে। কিন্ত আমার মধ্যে কাজ করছে একপ্রকার তুমুল উত্তেজনা। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইতিমধ্যে শিউলি ভাবির রুমে বসে আছি। আজ আজরান ভাইয়া বাসায় আসবেন না। ব্যবসায়িক কাজে বাবা চট্টগ্রাম পাঠিয়েছে তাকে।
এই সুযোগটা সুবর্ণ সুযোগ মনে হলো আমার কাছে। আনভীরের শাস্তি থেকে দূরে থাকার জন্য এখন হয়তো শিউলি ভাবিই আমার একমাত্র পথ।
পরিকল্পনামতো আজ শিউলি ভাবির সাথে ঘুমাবো আমি। আনভীর আমায় খোঁজার আগেই আমি এসে পড়লাম ভাবির রুমে যাতে পরে আনভীর জোরাজোরি করতে না পারেন।শিউলি ভাবি মিহি হেসে বললেন,
-‘আনভীরকে জানিয়ে এসেছো তো?’
-‘উনাকে কি বলবো ভাবি?আমার আজ তোমার সাথে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে আমি ঘুমাবো, ব্যস। উনি না বলার কে?’
ভাবি মুচকি হেসে কিছু বললেন না এখন। আমি বালিশ নিয়ে ইতিমধ্যে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আচমকা দরজা ঠেলে রুমে আসলেন আনভীর। আজরান ভাইয়ার টেবিল থেকে একটা ফাইল নিতে নিতে আমার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বললেন,
-‘রুমে আসছো না কেনো আহি? জলদি কথা শেষ করে আসো।’
-‘আমি আজ ভাবির সাথে ঘুমাসবো।’
আমি পরোয়া না করে বললাম। আনভীর ফাইলটা রেখে সরু চোখে তাকালেন আমার দিকে। তারপর ভাবির উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘ওরে ভাং টাং দিয়েছো নাকি ভাবি? কিসব আবোল তাবোল বলছে?’
আমি ভাবিকে এবার বললাম,
-‘দেখেছো ভাবি কি বললো? তুমি উনাকে বলে দাও, আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাসবো।’
-‘আহা! আজকে আহি আমার সাথে থাকুক আনভীর?’
আনভীর আমার হাত টেনে উঠালেন খাটের থেকে। ভাবির উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘সরি ভাবিমণি, আমি বউ ছাড়া ঘুমাসতে পারি না। ‘
বলেই আমায় টেনে নিয়ে আসলেন রুম থেকে। আমি উনার কথা শুনে লজ্জার চরম শিখরে চলে গেলাম। কি অসভ্য কথাবার্তা রে আল্লাহ! রুমে আসতেই আমি কড়া গলায় বললাম,
-‘আপনি কি বললেন ওখানে? ‘
-‘আবার শুনতে চাও?’
উনার কড়া গলা। আমায় চুপ থাকতে দেখে একপর্যায়ে উনি এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। আমার চোখমুখ রীতিমতো ফ্যাকাসে হয়ে এলো, তাই তটস্থ গলায় বললাম,
-‘এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?’
-‘তোমায় পার্নিশমেন্ট দিতে হবে না! ‘
আনভীরের ঠোঁটেকোলে দুষ্টু হাসি। আমি বিছানায় পড়ে যেতেই উনি খানিকটা ঝুঁকে দুহাতে ভর দিয়ে উবু হয়ে পড়লেন আমার দিকে। আমার দমবন্ধ হয়ে এলো এবার। বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দটা ক্রমাগত যেন বেড়েই চলছে। উনি এবার আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
-‘তো তোমায় কেমন পার্নিশমেন্ট দেওয়া যায় আহি? অনন্ত জলিলের মতো ডেন্জেরাস টাইপ নাকি ইমরান হাশমির মতো একটু হটি-নটি টাইপ?’
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২১
-‘তো তোমায় কেমন পানিশমেন্ট দেওয়া যায় আহি? অনন্ত জলিলের মতো ডেন্জেরাস টাইপ নাকি ইমরান হাশমির মতো একটু হটি-নটি টাইপ?’
এমন গম্ভীর ফিসফিসালো কন্ঠ রীতিমতো আমার সারা দেহে এক শীতল হাওয়া ছাড়িয়ে দিলো। আনভীর তীক্ষ্ণ চাহিনী নিবদ্ধ করে ঝুঁকে রইলেন আমার দিকে, এমন ভাব করছেন যেন উনার বলা কথাটা একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্ত উনার এসব ভয়ঙ্কর কথা শুনে অস্থির লাগছে আমার , শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বুক উঠানামা করছে ক্রমাগত। আমি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলাম,
-‘দ-দেখুন আ-আনভীর,এবারের মতো ছেড়ে দিন আমায় প্লিজ!’
আনভীর হেসে দিলেন আমার কথায়। বলে ওঠলেন,
-‘আমার জন্য আর পাঁচ মিনিট ওয়েট করলে তোমার এমন অবস্থা হতো না আহি। তার ওপর আমার বারবার বারণ করা সত্বেও ধ্রুবের সাথে কথা বলার স্পর্ধা দেখালে… এখন তো এই সুইট হ্যান্ডসাম হাজবেন্ট থেকে শাস্তি পেতেই হবে।’
এই লোক সুইট এন্ড হ্যান্ডসাম কম মেন্টাল বেশি। তবে কথাটি আমি পেটের ভেতরেই ঢুকিয়ে রাখলাম। উনার লাল মুখশ্রী দেখে কথাটি বলার আর সাহস রইলো না। এদিকে উনি যেভাবে আমার শরীরে ভর দিয়ে আছেন আমার তো মনে হয় আজ চ্যাপ্টা হয়ে শেষপর্যন্ত মরেই যাবো। কিন্ত আমি শান্ত রাখলাম নিজেকে। বললাম,
-‘ওয়ান্স এগেইন আনভীর, আপনি বিয়ের রাতেই আমায় বলে দিয়েছেন যে এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আপনি আমায় কোনোরূপ কোনো জোর করবেন না। আর যেদিকে আপনার ইগো হার্টের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আমায় ঘৃণা করেন তাহলে ধ্রুব ভাইয়ার সাথে দেখলে এত পজেসিভ হয়ে যান কেনো? এট এনি চান্স আপনি জেলাস না তো?’
আমি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলাম উনাকে। আমি নিশ্চিত এবার উনি বিভ্রান্ত হবেই হবে। তারপর সেই সুযোগেই আমি দূরে সরে যাবো । কিন্ত আমায় চরম মাত্রার অবাক করে দিয়ে উনি শান্ত চাহিনী নিয়েই তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। অতঃপর আড়ষ্ট গলায় বললেন,
-‘আমি জেলাস নাকি ওভার পজেসিভ সেটা তো তোমার দেখার বিষয় না আহি ! আমি কি করবো না করবো তার কৈফিয়ত কি তোমায় দিতে হবে?’
-‘এক্সাকলি আমিও সেম প্রশ্নটা করতে চাচ্ছিলাম। আপনি আমায় কৈফিয়ত দিতে বাধ্য না তবে আমি কেনো আপনাকে কৈফিয়ত দিবো? লিসেন, ধ্রুব ভাইয়া জাস্ট আমার একজন টিউটর। উনি আমায় পড়াবেন, আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলবেন , দরকার পড়লে হাতে হাত ধরে ঘুরবেন, আপনার কি? তাছাড়া উনি তো আপনারাই বন্ধু।’
-‘ধ্রুব আমার জাস্ট ক্লাসমেট। এছাড়া কিছু না।’
উনার থমথমে কন্ঠ। আমি শক্ত গলায় বললাম,
-‘আপনার ক্লাসমেট হোক বা সোলমেট হোক আমি কেয়ার করি না। এখন দূরে সরুন আমার কাছ থেকে। আপনার ঘেষাঘেষি রীতিমতো বিরক্ত করছে আমায়।’
আমি উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলেও একবিন্দু সরাতে পারলাম না। উনি বাকা হেসে বলে ওঠলেন,
-‘পানিশমেন্ট না দিয়ে তোমায় ছাড়ছিনা আমি। তো বলো , কেমন টাইপ পানিশমেন্ট দেবো? ডেন্জেরাস বলো কিংবা হটি-নটি টাইপ , দুটোর জন্যই আমি কিন্ত রেডি আছি।’
-‘কিন্ত আমি রেডি নাই।’
দম ফেলে বললাম আমি।উনি ঠোঁটে ডেভিল স্মাইল ঝুলিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘পানিশমেন্ট ইজ পানিশমেন্ট আহি। তুমি রেডি থাকো বা না থাকো, তা তো ভোগ করতেই হবে।’
বলেই উনি আচমকা আমার পাশে শুয়ে পড়ে নিজের কাছে টেনে নিলেন একেবারে। আমি হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম। কেননা এতদিন আমাদের দুজনের মাঝখানেই একটা বিরাট কোলবালিশ ছিলো। এককথায় বাংলাদেশ ভারত বর্ডার বললেও চলবে। আমি তটস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ক-ক-কি করছেন আ-আপনি?’
-তোমার খুব শখ না আমার কাছ থেকে দূরে থাকার?তাই আজকে আমার একেবারে কাছাকাছি ঘুমাতে হবে তোমায়। নো কোলবালিশ , নো বর্ডার।
উনি একথা বলেই আমার দিতে কাত হয়ে চোখ বুজে ফেললেন। নিজের হাত রেখে দিলেন আমার পেটের ওপর। আমার হার্টবিট ক্রমান্বয়ে যেন মিস হয়ে গেলো উনার এমন স্পর্শে। আল্লাহ ! এই শাস্তি তো বোধহয় আমার প্রাণ কেড়ে নিবে। উনি ঘুমুঘুমু গলায় বললেন,
-‘পানিশমেন্ট শেষ হয়নি মিসেস ওয়াইফ! কালকে ভোর পাঁচটায় উঠে আমার লাইব্রেরি সাফ করবে। ঘুম থেকে উঠে সেখানে গিয়েই আমি যেন দেখি সব পরিষ্কার।’
আমি মনে মনে এই অসভ্য, ইতর, ফাজিল লোকটাকে সহস্র গালাগাল দিলাম। মনে মনে বললাম,
-‘আল্লাহ ! এই লোক যেমনে আমারে ধরসে চোখ বন্ধ করলেই তো খালি ইমরান হাশমির নাউযুবিল্লাহ মার্কা সিন গুলো মনে পড়বে। কি যে এক জ্বালায় পড়লাম।’
.
.
______________________________
পরশুদিন মেডিক্যাল পরীক্ষা আমার। সেই সুবাদে পড়াশোনার প্রচন্ড চাপ। কোচিং যেহেতু অফ তাই নাকে মুখে পড়ছি আমি। বইয়ের পাতাগুলো দেখে মাথা ঘুরাচ্ছে আমার। সকালে আনভীর ভার্সিটি যাওয়ার আগে আমার পড়ার একটা রুটিন করে দিয়ে গায়েছেন। বললেন বাসায় ফিরে সব উনি রিচেইক করবেন। আমি এখন উনার রুটিম মাফিক সব কাজ করে যাচ্ছি। সারাদিন পড়াশোনা আর ব্যস্ততার পর একটা লম্বা ব্রেক নিলাম সন্ধ্যার সময়।
মাথাটা যন্ত্রনায় ভোঁ ভোঁ করছিলো। তাই ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা অ্যাপেল জুস নিয়ে বারান্দার ডিভানে বসে পড়ি। ফুরফুরে হাওয়ার সাথে অ্যাপেল জুস নিমিষেই আমার মানসিক চাপটা দূর করে দিলো। আনভীর বাসায় ফিরেন নি এখনও। রিসার্চের কাজগুলোর জন্য ইদানীং বাসায় কমই থাকেন উনি। হঠাৎ ডিভানের পাশে ফোনটা বেজে উঠতেই আমি স্ক্রিনে তাকালাম। প্রথমে ভেবেছিলাম আনভীর কল করেছেন। কিন্ত চাচীর নম্বর দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছি অনেকটা। আনভীর বাসায় নেই। তাই কিছু না ভেবেই ফোন রিসিভ করে বললাম,
-‘হ্যালো চাচি?’
-‘কেমন আছিস রে আহি?’
উনার ব্যবহারের বিরাট পরিবর্তন দেখে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। রূঢ়স্বরে বললাম,
-‘যেমনটা রেখেছিলে, ঠিক তেমনটাই।’
ওপাশে মলিন শ্বাস ফেললেন উনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কল দেওয়ার প্রয়োজনটা কি জানতে পারি?’
-‘অপূর্বর জন্য।’
অপূর্ব ভাইয়ার নাম শুনে আরও একদফা স্থির হয়ে গেলাম।যদিও আমি জানতাম যে ভাইয়া দেশে ফিরেছে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে আমার সাথে কিন্ত চাচিও যে এভাবে তৎপর হয়ে পড়বে তা আমি ভাবতে পারিনি। চাচি কাদো কাদো গলায় বললো,
-‘ছেলেটা আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে রে মা। সারাদিন শুধু তোর নাম মুখে জব্দ করে রাখে। তোর রুমে ২৪ ঘন্টা দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। একদিন তোর নম্বর নেওয়ার জন্য তো দোলার গায়ে হাত তুলতে গিয়েছিলো।’
-‘তো কি চাও আমায় কাছ থেকে?’
-‘তুই একবার শুধু দেখে যাস না ছেলেটাকে? ওর অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছিনা।’
আমি রূঢ়স্বরে বললাম,
-‘অসম্ভব। ভাইয়ার সামনে একবার গেলে আমায় মেরে ফেলবে সে। আগে তো কম যন্ত্রণা দেয়নি। এখন এত পাগল হয়ে যাচ্ছে কেনো?’
-‘এই অভাগা মায়ের কথা রাখ না আহি?’
চাচি অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে ওঠলো এবার। আমি যেন গোলকধাধায় পড়ে গিয়েছি এতে। অপূর্ব ভাইয়া সত্যিই এমন করছে আমার জন্য? কিন্ত আমি উনার মুখোমুখি হলে সে তো আমায় মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না। এমন চাচাতো ভাই থাকার থেকে না থাকাটাও যে ভালো? আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই পেছন থেকে কেউ শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো,
-‘কার সাথে কথা বলছো আহি?’
আমার শিরদাড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো এবার।উনার উত্যপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার ঘাড়ে। অজানা আতঙ্ক আমায় ঘিরে ধরলো এতে।মানুষটা আনভীর ছাড়া আর কেউই না। এর আগে বাবার সাথে কথা বলেছি বিধায় আমার সাথে কি জঘণ্য আচরণটাই না করেছিলো। এবার যদি জানে যে চাচি ফোন দিয়েছে, তাহলে কি করবেন উনি?
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
} ]