এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১৮+১৯

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৮
বিগত কয়েকদিনে আনভীরের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি আমি। উনি যেন আগের তুলনায় আরও বেশি পজেসিভ হয়ে গিয়েছেন আমায় নিয়ে। আমি উনাকে এড়িয়ে চললেই উনি যেন আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমি কখন কোচিং যাচ্ছি, কি পড়ছি, কি খাচ্ছি সবকিছুর ব্যাপারেই উনার খেয়াল রাখতে হবে। প্রথম কিছুদিন এগুলো আমাকে তেমন একটা ভাবায়নি, তার ওপর ছিলো পড়াশোনার ব্যস্ততা। মেডিকেল এক্সামের আগে কোচিংয়ে এবারই আমার লাস্ট টেস্ট ছিলো, তাই উনাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে নিজের সর্বস্ব সময়টুকু পড়ালেখায় দিয়েছি। আর কিছুদিন পরই আমার মেডিকেল এডমিশন টেস্ট। চিন্তা, পড়াশোনা, ভয় সবকিছু একসাথে জেঁকে বসেছে মনে। সেই সাথে আনভীরের হঠাৎ পরিবর্তনও।
অদ্ভুত কারনে আমাদের এগ্রিমেন্ট নিয়ে উনি কোনোরূপ কোনো কথা বলেননা এখন। বরংচ আমি বললেই উনি এক ধমকে আমায় থামিয়ে দেন। আমি তাই এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াইনি। আপাতত এই সময়টুকু আমার পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করাটা বেশি প্রয়োজন। কোনোমতে ডিএমসিতে সুযোগ পেয়ে গেলেই হবে, তাহলে আমি জানি যে আমায় কি করা উচিত।
.
.
সন্ধ্যাবেলা কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে রাতে শিউলি ভাবির সাথে কিচেনে কফি খাচ্ছি আর গল্প করছি আমি। যদিও এ সময়টাতে আনভীর বাসায় থাকলে নিজ দায়িত্বে আমায় কফি বানিয়ে দিতেন তবুও আজকে উনি বাসায় ছিলেন না। উনার ভার্সিটির কিছু প্রফেসরদের সাথে কি যেন একটা ছোট পার্টি আছে, সেখানেই গিয়েছেন। নুড়ী আপা তখন রুটি বানাচ্ছেন মায়ের জন্য। মা’র ডায়বেটিস আছে বলে উনি স্বভাবতই রাতে ভাত খান না। শিউলি ভাবি কথার এক প্রসঙ্গে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,

-‘তোমার আব্বু কল দিয়েছে এই কয়েকদিনে?’

আব্বুর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার হাসি মুখটিতে নিমিষেই অন্ধকার ছেয়ে গেলো।বিগত সময়গুলোতে আমার আব্বু একমুহূর্তের জন্যও ফোন করেনি আমায়, চাচা চাচি তো দূরের কথা। আমি তো এতগুলো বছর আপদ ছিলাম উনাদের মাঝে,আপদ যেহেতু বিদায় হয়েছে তাহলে এখন আমার সাথে যোগাযোগ করবে কেনো? শিউলি ভাবি হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন আমার মুখ দেখে। যদিও উনি আমার অতীত সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানেন না তাই আগবাড়িয়ে কিছু বলতেও পারছেন না খুব একটা। গ্যাসে খাবারগুলো গরম করতে করতে বললেন,

-‘মাঝে মাঝে খারাপ লাগে যখন আপনজনেরাই নিজের আপনজন না হয়। অনেকের কাছে কন্যাসন্তান মানে বিরাট এক বোঝা। তাকে যতদ্রুত সম্ভব বিদায় দিলেই পরিবারের একজন আপদ কমে যায় ভেবে তারা শান্তি পায়।কিন্ত তারা বুঝে না গো আহি, তারা একটা কহিনূরকে হারিয়ে ফেলে এমন করার জন্য।’

আমি মৌনিভাবে কফির মগে চুমুক দিলাম এবার। শিউলি ভাবি যে এগুলো কোন দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন তা আমি ভালোমতই জানি। নুড়ী আপা রুটিগুলো তাওয়া থেকে নামিয়ে ভাবিকে বললেন,

-‘ঠিক কইসেন আফা। এল্লেগাই তো মাইয়্যা মাইনসে গো নো নিজ পায়ে খাড়ানোর দরকার। আমি কোনো ট্যাকা রুজি করতাম না দেইখ্যা আমার সোয়ামি বহুত পিটাইসে আমারে। শেষমেষ ছাড়াছাড়ি কইরা অন্য বেডির লগে ভাইগ্গা গেলো। এহন আমি টাকা রুজী করতে পারি, তাই এলাকায় দামও বেশি। চাইলেও কেউ আমার লগে উচু গলায় কথা কইতে পারবো না। যদি কাম না করতাম,তবে ডরে ডরে দিন পার করবার লাগত।’

নুড়ী আপার কথাগুলো আমার ভালোলাগলো বেশ। ভাবি মিহি হেসে বললেন,

-‘মেয়েদের নিজ পায়ে দাঁড়ালে অনেক সম্মান পাওয়া যায় সমাজে। অনেক শ্বশুড়বাড়িতেই তো বিয়ের পর বউকে কাজ করতে দেয় না, পড়ালেখা করতে দেয় না। এদিকে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। কারন আমি পড়ালেখা শেষ করেই বিয়ে করেছি। এখন চাইলে চাকরিও করতে পারবো যদি ইচ্ছে থাকে। বাবা-মা বা আজরান কেউই দ্বিমত করবে না। আবার আহিকেই দেখোো। পরিস্থিতির চাপে অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও বাবার কথামতো আনভীর ওকে পুরো সুযোগ দিয়েছে পড়ালেখা করার। মাও রাজি আছে এতে। আহির কি দরকার না দরকার সবকিছুর খেয়াল আছে আনভীরের। একটা মেয়ে যতটাই ওর পরিবারের কাছে বোঝা থাকুক না কেন,,,,, যদি নিজের হাজবেন্টের কাছে এত প্রায়োরিটি পেয়ে থাকে এর বেশি কি তার আর কিছু দরকার সুখে থাকার জন্য?’

শিউলি ভাবির কথায় শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠলো আমার,,,,,অনুভূতিটা আনভীরকে নিয়ে। উনি যদিও মুখে অনেক কথাই বলেছেন রাগের বশে, কিন্ত ওগুলো সবই কি সত্যি? বিয়ের প্রথম উনি আমার সাথে যেরকম ব্যবহার করতেন, এখনকার ব্যবহারের সাথে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। উনাকে কড়াকড়ি ভাবে ইগ্নোরর করার পর থেকেই উনি যেন আমার প্রতি আরও ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছেন। কিন্ত আমি জানি এগুলো সবই উনার দায়িত্ব,,,,,শুধু একপ্রকার দায়িত্ব। এছাড়া আর কিছুই না।
.
.
________

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি টিভি দেখছি সোফায় বসে। টিভি দেখছি বলে ভুল হবে , নুড়ী আপা টিভিতে কি দেখছে সেটাই দেখছি আমি আর ভাবি। এসময় জি বাংলা চ্যানেলে ‘মিঠাই’ নামের একটা নাটক হয়,নুড়ী আপা কখনোই এই নাটকটা মিস করেন না।আমার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে যে এই নাটকটার মধ্যে আছে কি , আজ তাই উনার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে দেখছি আমি। হঠাৎ দরজায় শব্দ পড়াতে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি উঠতে নিলেই ভাবি বললো,

-‘আমি দেখছি।’

আমি তখনও টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একটা বিশেষ সিন চলছে।হঠাৎ আমার পাশে আনভীর বসে পড়লেন দ্রুতসময়ে। শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘দুদিন পর তোমার পরীক্ষা আর এখন বসে বসে নাটক দেখছো তুমি?’

আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম উনার দিকে। আনভীর চোখজোড়া হালকা কুচাকানো । মসৃন কালো চুলগুলো কপালে পড়ে লাগাতে সুন্দর লাগছে। সবুজ শার্টের ওপর ধূসর রঙের টাইটা একটু ঢিল করে রেখেছেন ক্লান্তির জন্য। ওপরের একটি বোতাম খুলে থাকার জন্য গলায় চিকচিক করা সূক্ষ্ণ ঘাম দৃশ্যমান আমার কাছে। আমি উনার এমন দৃশ্য দেখে একপ্রকার থমকে গিয়েছিলাম কিছুটা। ইসসস! এই মানুষটা আমার বর?উনি তাজ্জব হয়ে বললেন,

-‘রাতে ভাত খাওনি? এখন বসে বসে আমায় খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে যে এভাবে চোখ দিয়ে গিলছো আমাকে?’

আমি অবাকমিশ্রিত চাহিনী নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। ড্রইংরুমে শিউলি ভাবি,নুড়ী আপার সাথে আজরান ভাইয়াও ছিলেন। আনভীরের কথায় তিনজনেই মিটমিটিয়ে হাসছেন এবার। লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। মনে মনে একশো এক টা গালাগাল দিলাম উনাকে। ব্যাটা ঠোঁটকাটা এটা তো আগেই জানতাম, তাই বলে মানুষের সামনেও যে এমন বেফাঁস কথা বলবে সেটা সম্পর্কে আমার আগেই ভাবা উচিত ছিলো। আমি ততক্ষণে উনার কাছ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। ভাবি এবার বললেন,

-‘থাক আনভীর! মেয়েটাকে আর লজ্জা দিতে হবে না।’

আনভীর কিছু বললেন না এবার। আমি উনার আর আজরান জন্য কিচেন থেকে দুই গ্লাস পানি নিয়ে আসতেই দুজনে তা শেষ করে সামনের টেবিলে রেখে দিলেন।আজরান ভাইয়া এখন বললেন,

-‘আনভীর ! আহির পরীক্ষার পর কি প্ল্যান আছে তোমার?

অবাক হলাম আমি। সাথে আনভীরও। তাই জিজ্ঞেস করলেন,

-‘আমার আবার কি প্ল্যান হবে?’

-‘আহা! এতটুকুও জানো না? বিয়ে হলো তো বেশ সময় আর হয়নি। নিউলি ম্যারিড কাপল তোমরা। একটু হানিমুন টানিমুন করতে যাবে না?’

আমি এবার অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম আজরান ভাইয়ের এমন কথায়। হয়তো আনভীরও। কিন্ত উনার চেহারা দেখে মনে হলো না যে উনি কোনোরূপ কোনো বিস্ময়ে আছেন। মুখের ভাব স্বাভাবিক। চশমার মধ্য দিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে থাকলেন আজরান ভাইয়ার দিকে। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম,

-‘হ-হ-হানিমুন? হানিমুন কেনো ভাইয়া? আমরা এভাবেই ঠিক আছি।আগে নাহয় পরীক্ষাটা দিয়ে নেই। তারপর ওসবের কথা ভাবা যাবে।’

আমার কথায় আজরান ভাইয়া যেন সন্তুষ্ট হলেন না। বলে ওঠলেন,

-‘এটা কোনো কথা বললে আহি? কেনো এসব পরে ভাববে? আমি যেহেতু ঘরের বড় তাই তোমাদের ঘোরাফেরার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে না? এই ছেলে তো শুধু স্যারগিরি করে দেখায়, একটু বই-খাতার বাইরে বউয়ের সাথে ঘুরাফিরাও তো করতে হবে। তাই না?’

আমি যদি আজ আনভীরের বউ না হতাম আমিও তুমুল গলায় বলতাম হ্যাঁ। কেননা এই মানুষটা আসলেই বই-খাতার বাইরে কিচ্ছু বুঝে না, রোম্যান্সের বেলায় তো বোধহয় আকডুম বাকডুম। কিন্ত ব্যাপারটা যেহেতু আমার সাথে আর আমি উনার ওয়াইফ তাই অগত্যাই চুপ থাকতে হলো আমায়। আনভীর এবার আজরান ভাইয়াকে বললেন,

-‘আমি কি বলেছি যে আমরা হানিমুনে যাবোনা?’

উনার কথা শুনে আরও একদফা অবাক হলাম। বলছেনটা কি উনি? বাহির থেকে গাজা-টাজা খেয়ে এসেছেন নাকি ! আজরান ভাইয়ার চোখে চমক দেখা গেলো হঠাৎ। বললেন,

-‘তাহলে কবে যাবে তোমরা? আর টেনশন নট। এবার সব খরচ আমি দিবো।’

আনভীর মিহি হেসে বললেন,

-‘ওর পষীক্ষাটা আগে শেষ হোক , তারপর।’

আমার রীতিমতো মাথা ঘুরাচ্ছে উনার কথা শুনে। যেদিকে আমায় বউ মানতেই উনার শত বাধা তাহলে হানিমুন এর কথা আসলো কিভাবে?এদিকে আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবিও রীতিমতো প্রেশার দিচ্ছে কোথায় যাবো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আমার এতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ফেলে আনভীর বাঁকা হেসে আমার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলেন রুমে।এই হাসিটা কেমন যেনো ভালো লাগলো না আমার। এই পাগল লোকটা সত্যিই তবে পরীক্ষার পর আমায় হানিমুনে নিয়ে যাবে?ও মাই গড!
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৯
-‘আপনি এটা বললেন কেনো যে আপনি আমার সাথে হানিমুনে যেতে চান?’
রুমে এসেই আমি আনভীরকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলাম বিক্ষোভে। উনি খাটের একপাশে হেলান দিয়ে মোবাইল স্ক্রলিং করছিলেন। আমার কথা শুনে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে আড়চোখে তাকালেন । আমি রাগে রীতিমতো ফোস ফোস করছি। আনভীর খাট থেকে উঠে খানিকটা কাছে এসে দাঁড়ালেন আমার। বলে ওঠলেন,

-‘তো তুমি কি চাও যে আমি অন্য কারও সাথে হানিমুন করতে যাই?’

আমি ভড়কে গেলাম উনার এমন কথায়। আনভীর ঠোঁটজোড়া হালকা চাপিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এতে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। নিজেকে শান্ত রাখতে হবে আহি, মানুষটার ঠোঁট কাটা কথা শুনে এতটাও অস্থির হলে চলবে না। আমি মৃদুস্বরে বললাম,

-‘আমি কেন সেটা চাবো?’

-ওহ! তাহলে তো তুমি আমার সাথে হানিমুনে যেতে চাও রাইট?

বলেই ঠোঁটজোড়ায় এক বাকা হাসি ফুটালেন তিনি। চোখে মুখে রম্যতার ছাপ। মহা জ্বালায় পড়েছি তো! হ্যা বললেও দোষ আবার না বললেও দোষ। উফ! এই লোক ৃনে হয় জন্মই নিয়েছে আমায় বিভ্রান্ত করে তোলার জন্য। আমি আক্ষেপ সুরে বললাম,

-‘জ্বি না। আমি মোটেও এমন কিছু চাচ্ছি না। আপনি কি জানেন না যে আমি ঠিক কিসের ইঙ্গিত করছি?

-‘না তো!’

উনি না জানার ভান করে বলে ওঠলেন এবার। আমি তাই বলি,

-‘আপনি এখনই আজরান ভাইয়াকে গিয়ে বলুন যে আমার এডমিশন টেস্টের পর কোথাও যাচ্ছি না আমি আপনার সাথে। আমাদের এগ্রিমেন্ট এর কথা ভুলে গিয়েছেন?’

আনভীর রম্যতা থামিয়ে সিরিয়াস হলেন এখন৷ আমি একটা জিনিস গভীরভাবে খেয়াল করেছি যে ‘এগ্রিমেন্ট’ এর নাম শুনলেই উনি কিছুটা রেগে যান। উনার মুখমন্ডলে ঠিক একটা চাপা আভাস ফুটে ওঠে যেমনটা বিয়ের প্রথমরাতে ‘এগ্রিমেন্ট’ কথাটি শুনে আমার হয়েছিলো। তবে উনার এমন মুখ দেখে ভালো লাগে আমার। মাঝে মাঝে উনি রেগে যাওয়া সত্বেও শুধুমাত্র নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য বহুবার এই শব্দটা উনার সামনে বলেছি। এখনও ঠিক তাই হয়েছে।আনভীর ট্রাউজারের পকেটে হাত গুজে গহীন চোখে তাকালেন আমার দিকে । বললেন,

-‘আমি তখন হ্যাঁ বলেছি এই কারনে যাতে আজরান ভাইয়া আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই বুঝতে না পারে। নাহলে একজন মানুষ যদি এত অনুরোধের পরেও আমরা না করে দিলে কেমন দেখায় ব্যাপারটা? আমি যদি তখন সরাসরি বলে দিতাম যে আমরা যাবো না তবে প্রশ্ন করে মাথা খেয়ে ফেলতো আমার। এন্ড এক্সাটলি আমি সেটা মোটেও চাচ্ছিনা । পেয়েছো তোমার উত্তর?’

উনার কথাটি যুক্তিযুক্ত মনে হওয়াতে আমি কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বললাম না তাই।আনভীর এবার বললেন ,

-‘ইদানীং আমার প্রতি কিউরিসিটিটা একটু বেশি না তোমার? তোমায় আমি শুরু থেকেই বলছি যে ভালোমতো পড়ালেখা করো আর কি করছো তুমি? যত্তসব আজগুবি ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছো। ওসব হানিমুন-টানিমুনের ভাবনা বাদ দিয়ে ঘুমাতে যাও চুপচাপ। এতদিন যা পড়েছো এখন পড়ার হার আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দেবে যেহেতু আগামী পরশু তোমার পরীক্ষা। ঠিকাছে?’

উফফফফ! আবারও পড়া আর পরীক্ষা। দোষটা আসলে আমারই । এই লোকটার কাছ থেকে মিষ্টি খুনশুটিময় কথা আশা করা নিতান্তই বেকার। নিজে তো রাতদিন পড়েছে , এখন আমার জীবনটাও পড়া-প্যারা নামক জালে আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম প্রতিউত্তরে।আনভীর কিছু বললেন না এবার। শুধু আমার হাত টেনে বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন।

____________________________

কোচিংয়ে আজকেই আমার লাস্ট ক্লাস। দুদিন বাদে যেহেতু মেডিকেল পরীক্ষা তাই আজকে কোচিংয়ের স্যাররা পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু টিপস শেয়ার করছে আমাদের সাথে। সত্যি কথা বলতে এতদিনে শুধু আজকের ক্লাসটাই বেশ আনন্দময় মনে হলো আমার। কোচিংয়ে আজ এতদিন হলো আসছি শুরু থেকেই স্যাররা শুধু পড়া আর নোট দিয়েই আমাদের মগজভর্তি করে ফেলেছে। দু’মিনিট পড়াশোনার বাইরে একটা কথাও বলেননি যাতে স্টুডেন্টসরা একটু রিফ্রেসমেন্ট ফীল করে। আজকে কোনো পড়াশোনা হয়নি, কোনো নোট সংক্রান্ত প্যারা মাথায় চাপেনি, শুধু বসে বসে স্যারদের কথা শুনেছি। ক্লাস শেষে সবার সাথে আরও একদফা কুশল বিনিময় করলাম আমি। কয়েকজন সিনিয়র স্যার থেকেও দোয়াও চেয়ে নিলাম। এখন বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি আনভীরের।

মূলত সেই দিনে উনার প্রতি আমার ব্যবহারের আকষ্মিক পরিবর্তন দেখে এখন কিছুতেই উনি আমায় একা ছাড়েননা । প্রতিদিন আমায় নিজ দায়িত্বে কোচিং নিয়ে আসেন তারপর ভার্সিটিতে উনার একটা লেকচার কমপ্লিট করিয়ে আবার নিজ দায়িত্বে আমায় বাসায় রেখে আসেন। উনি মাঝে মাঝে সময় না পেলে আজরান ভাইয়াকেও বলে দেন আমায় নিয়ে আসতে। তবুও কোনোক্রমেই উনি আমায় একা ইনসিকিউর রাখবেন না। উনার এসব কান্ড থেকে মাঝে মাঝে আমি যেন ভেবেই পাইনা আসলে বলবোটা কি।
এখন কোচিং শেষে আনভীরের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি কিন্ত মানুষটার যেন কোনো হদিস নেই। হঠাৎমোবাইলে নোটিফিকেশনের শব্দে মোবাইল চেক করে দেখি উনি ছোট্ট একটা টেক্সট দিয়েছেন,

-‘পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। আমি আসছি।’

আমি তপ্তশ্বাস ফেলে মোবাইল ব্যাগের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। আশেপাশে লোকমানব আগের তুলনায় প্রায় কমে গিয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে একজন পুরুষালি গলায় বললো,

-‘এখনও বাসায় যাওনি?’

পেছনে ফিরে দেখি ধ্রুব ভাইয়া। মেইবি এখানকার ডিউটি শেষ করে বাড়ির জন্য ফিরছে। আমি তাই বলি,

-‘আনভীরের জন্য অপেক্ষা করছি। উনি আসবেন কিছুক্ষণ পর।’

-‘বাসা তো কোচিং থেকে বেশি দূরে না, তাহলে একা চলে যাও ? এটা খালি রাস্তা, তারওপর একা মেয়ে এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা কি মানায়? আনভীর কখন না কখন আসে!’

ধ্রুব ভাইয়ার কথায় একটু ভয় ঢুকলো মনে। হুট করে মনে পড়লো অপূর্ব ভাইয়ার কথা। গতকাল রাতে চাচী অপূর্ব ভাইয়া সম্পর্কে কি যেন বলতে চেয়েছিলো আমায়। কিন্ত আমি তা না শুনেই কল কেটে দিয়েছিলাম ভয়ে। ওই পাষাণ, হৃদয়হীন মানুষটার ছায়াও আমি পুনরায় মারাতে চাই না। আমার কৈশর জীবন তো সে এককথায় শেষ করে দিয়েছিলো। এখন যদি সেদিনকার মতো আবার এখানে আসে? ধ্রুব ভাইয়া হয়তো আমার ভয় পাওয়াটা দেখতে পেয়েছেন। তাই বললেন,

-‘আচ্ছা, আমি একটা রিক্সা নিয়ে দিয়ে আসি তোমাকে? এতে তোমার কোনো প্রবলেম হবে?’

ভাইয়ার এ কথাটা আশার আলোর মতো মনে হলো আমার কাছে। কিন্ত আমার ভয় হচ্ছিলো আনভীরের ব্যাপারে। তবুও হ্যাঁ বললাম আমি। আনভীর কি বলুক না বলুক এটা আমার দেখার বিষয় হওয়ার কথা না। এখন এখানে উনার অপেক্ষা করাটা আসলেই আমার জন্য কিছুটা বিপদজনক।
.
.
রিক্সা আনভীরদের কলোনির দিকে এগিয়ে চলছে। আমার পাশে খানিকটা দুরত্ব নিয়ে বসা ধ্রুব ভাইয়া। আমি কোনো কথা না বলে ঠোঁট কামড়ে এটাই ভাবছি যে আনভীর ঠিক কতটা রেগে যাবে। এর মধ্যে ধুব ভাইয়া আচমকা জিজ্ঞেস করলো,

-‘এগ্রিমেন্ট শেষ হলে কোথায় যাবে তুমি?’

আমি চমকে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। উনি যে হঠাৎ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে এটা আমার ধারনা ছিলো না। ভাইয়া আবার বললেন,

-‘আমি ক্যাজুয়েলি জিজ্ঞেস করলাম তোমায়। আফটার অল এগ্রিমেন্টের পর তুমি আর আনভীর তো আর একসাথে থাকবে না। আর আনভীরও এর আগে যা বললো, তোমার ফ্যামিলি বলতেও তেমন কেউ নেই। তো থাকবে কোথায়?’

-‘কে বলেছে আমার ফ্যামিলি নেই। এই পৃথিবীতে এখনও একজন আছে যে মায়ের পর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আমাকে। তার কাছেই যাবো, এগ্রিমেন্ট শেষে না, এই পরীক্ষাটি দেওয়ার পর।’

ধ্রুব বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

-‘কে উনি?’

-‘আমার মামু।’

শীতল কন্ঠে বললাম আমি। ধুব ভাইয়া নিশ্চুপ। আমি তাই বললাম,

-‘একটা লম্বা সময় মামুর সাথে যোগাযোগ ছিলো না আমার। কিন্ত আমার মামুই এমন একজন মানুষ যে এতটা বছর আমার জন্য চিন্তা করেছৃন। মায়ের মৃত্যুর পর মামু বহুবার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন আমায় এডপ্ট করবেন বলে। কিন্ত চাচা-চাচি রাজি হননি। রাজি হবেনই বা কেন, আমি চলে গেলে তো উনাদের বিনে পয়সার দাসিও চলে যেতো।’

বলেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। ধ্রুব ভাইয়া এবার বললেন,

-‘থাক! ওসব ভুলে যাও। অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যেও। যদি কখনও আমার প্রয়োজন পড়ে , অবশ্যই আমাকে ডাকবে কিন্ত।’

আমি মৌনতা বজায় রেখেছি এবার। শুধু আর কিছুদিন, এই এগ্রিমেন্ট শেষ হওয়ার পূর্বেই আনভীরের কথামতো উনাকে ছেড়ে চলে যাবো আমার মামুর কাছে।
.
.
.
________________

এখন আমি বসে আছি একটি হাসপাতালের বেডে। পায়ের মধ্যে কিছুক্ষণ আগে ডক্টর ড্রেসিং করিয়ে দিয়েছেন। আসলে তখন রিক্সা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে আমার আর ধুব ভাইয়ার। ধ্রুব ভাইয়ার তেমন একটা ক্ষতি না হলেও আমার পায়ের অংশটুকু ভালোভাবে ছিলে গিয়েছে। রক্তও গড়িয়ে মাখামাখি অবস্থা প্রায়। পরে ধ্রুব ভাইয়াই আমায় হাসপাতালে নিয়ে আসলো। পায়ে ব্যান্ডেজ করাতে চুলকাচ্ছে অনেক। কিন্ত ডাক্তার ওই অংশটুকু ধরতে সাফ মানা করে দিয়েছে। আমি ভাবলাম একবার আজরান ভাইয়া বা বাবাকে ফোন করে বলা দরকার। আনভীরকে তো মোটেও বলবোনা, পরে আবার কি তুলকালাম কান্ড করে বসে আল্লাহ মালুম।

তবে কথা আছে না, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়!’, আমার সাথে সেরকমই এক ব্যাপার ঘটেছে। বাইরে আমি কারও উচ্চস্বরে কথা বলার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তখনই নার্সের বারন করা সত্বেও দরজা খুলে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়লেন আনভীর। উনার চোখমুখ রীতিমতো লাল হয়ে গিয়েছে উত্তেজনায়, শার্টের অবস্থা অগোছালো। উনি কোনো কথা না বলে হুট করে আমায় কোলে তুলে নিতেই আমি যেন হতভম্ব হয়ে গেলাম। নার্স ডাক্তার এমনকি ধ্রুব ভাইয়াও চমকে গিয়েছে এমন করাতে। আনভীর ধ্রুব ভাইয়াকে বললেন,

-‘থ্যাংক ইউ ওকে হেল্প করার জন্য। এখন আহির জন্য আমিই যথেষ্ট আছি। নিজের মেডিসিনগুলোও ঠিকমতো নিও। আমি ওকে নিয়ে গেলাম।’

বলেই হনহন করে উনি করিডোরের দিকে ছুটলেন। জেলাসি কি তবে এটাকেই বলে যে একজন মানুষ আমায় হেল্প করলো তারপরও উনি এরকম ইমম্যাচিউর বিহেভ করলেন? এদিকে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। তুই শেষ আহি! এই লোক তোকে লজ্জায় মাটিতে পুতে ফেলবে!
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here