এখানে কোন বৃষ্টি নেই পর্ব ৭

গল্পঃ এখানে কোনো বৃষ্টি নেই
পর্ব ০৭
ভর্তি হবার কিছুদিনের মধ্যেই অামি নতুন জগতে সবার মাঝে খুবই
মুখ হয়ে গেলাম।
পরিচিতিটা হলো, মাথায় সমস্যা অর্থাৎ স্ক্রুঢিলা মেয়ে হিসেবে।
তাঁর কারণও অভি। কারণ যার সাথেই অামার দু-এক ক্লাস পাশাপাশি বসা হয়, তাঁকেই অামি ইনিয়ে বিনিয়ে অভির গল্প বলি। গল্পটাতে সবাই মজা পায়, অভিকে দেখতে অাগ্রহ নিয়ে বলে,
———দেখি, ও’র একটা ছবি দেখাও তো…..
.অামি তখন গম্ভীর মুখে বলি,
———-ও’র কোনো ছবি নেই অামার কাছে।ও’অামার চোখের ভেতরেই অাছে,
ভালো করে তাঁকিয়ে দেখো, দেখতে পাবে।
———-একটা ছেলেকে তুমি পাগলের মতো ভালোবাসো, তাঁর কোনো ছবি তোমার কাছে নেই?? অাশ্চর্য! থাকে কোথায় সে??
———ঢাকায়ই!
———ঢাকায় থেকেও একবারও তোমার কলেজে এলোনা???
———-না, ও খুব লাজুক তো…..
কেউ অামার অভির গল্পটা ঠিকঠাক বিশ্বাস করতো না। তাতে কি?? অভি অামার ভেতরেই তো বাস করে…….
তবে এই মাথা খারাপিটার জন্য অামার বড় অাপুরা অামায় খুব অাদর করতো।
এদিকে
মেডিক্যাল কলেজে হোস্টেলে উঠে একটা ব্যাপার অামার কাছে খুবই অ্যাবনরমাল চোখে পড়তে লাগলো, সেটা হলো অামার পিরিয়ডের টাইমটা যেনো অন্য মেয়েদের থেকে বেশি।
সেটাও বুঝতে পারলাম, রুমমেট অাপুদের থেকে।
যেমন, অামার পিরিয়ডে ব্লিডিং চলতো অাট -নয়-দশ দিন ধরে। যেখানে অামার রুমমেট অাপুদের দেখতাম, চার-পাঁচ দিনে শেষ। হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, পিরিয়ডের মত সেনসিটিভ ব্যাপার কিভাবে বুঝলাম?? কারণ এই সময়টা মেয়েদের প্রার্থনার মত পবিত্র ব্যাপারগুলো বন্ধ থাকে বলে।
অামার পরিবারে অামি এক সন্তান। অামার মায়ের সাথেও অামার সহজ সম্পর্ক ছিলোনা। কারণ ইনি ছিলেন অামার বাবার দ্বিতীয়া স্ত্রী। সুতরাং এইসব ব্যাপার নিয়ে কখনোই খোলামেলা কথা হয়নি!
শারীরিক পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো নিয়ে অামি একা একা বড় হয়েছি।
কৌতুহল বশত অামি একদিন অামার সিনিয়র অাপুকে বললাম,
তিনি অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাঁকিয়ে থেকে বললেন,
———ব্লিডিং কি রকম হয়???
——–প্রচুর…..
———-ফ্লোটা কি একই থাকে নাকি ভেরিয়েশন অাছে???
———-লাস্ট ডে পর্যন্ত একই। কমবেশি নেই…..
———–এবনরমাল সিম্পটমস গুলো বলো….
তারপর উনি খুব মনোযোগ দিয়ে অামার সমস্যা শুনলেন। কিন্তু অামাকে কিছুই বললেন না।
একদিন প্রায় খামখেয়ালী করে উনি বললেন,
———অামাদের একজন ম্যামের সাথে অামি তোমার কথা অালাপ করেছি।
ডাঃ শীলা। তুমি কি একবার কথা বলবে উনার সাথে???
অামি ও খামখেয়ালি করে বললাম,
———অাচ্ছা।
যেহেতু মেডিক্যাল কলেজেই পড়ছি, অাশেপাশে ডাক্তার অার ডাক্তার।
অাপুর কথাতেই অামি শীলা ম্যাডামের সাথে দেখা করি। তিনি কিছু টেস্ট দিলেন করতে। এবং পিরিয়ডের সময়ে খাবার জন্য কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করলেন। অামি ঔষধ কিনলাম, কিন্তু টেস্ট করালাম না।
ঔষধ গুলো খাওয়ার পর নতুন সমস্যা দেখা দিলো, পিরিয়ডে যোগ হলো, তীব্র ব্যাথা অার জ্বর! হাই টেম্পারেচার! একশ দুই-তিন জ্বর!
সেই জ্বরের মধ্যে অামাকে অবাক করে দিয়ে অভি এলো দেখা করতে।
———-হাহা… পরী! ডাক্তারী পড়তে এসেই জ্বর! ডাক্তার হবে কিভাবে??
———-ডাক্তাররা বুঝি মানুষ না??
———-তাও তো… তুমি কি জানো পরী?? মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েও অামি পড়িনি, এইসব অসুখ -বিসুখ নিয়ে ঘাটাঘাটি। ছিঃ। অাই হেইট দিস। এইসব মেডিক্যাল কলেজে পড়ার ফেইস ভেলুটা যাস্ট ফাউ।
———-তো এখানে কেনো এলেন?? অামাকে দেখতে??
———-না, না….. তোমাদের টিচার অাছেনা, ডাঃ সাজ্জাদ। উনার মেয়ে, সিঁথি অামার ক্লাসমেট। ও টাকা নিতে এসেছে বাবার কাছে।
সিঁথিই ধরে নিয়ে এলো অামাকে।
অামি গোঁমড়ামুখে বললাম,
———ও….
অভি কিছুক্ষণ চুপচাপ অামার পাশেই বসে রইলো।
অামি ও কিছু বলছিলাম না।
হঠাৎ করেই অভি বললো,
———-জ্বর গায়ে তোমায় দেখতে ভালো লাগছেনা পরী। ইট ইজ হিটিং মি। ইট ফিলস মি পেইন!
প্লিজ টেইক কেয়ার অফ ইওরস! অামি ভাবতেই পারিনা, অামি কখনো বাসায় ফিরে দেখবো তুমি জ্বর গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে শুঁয়ে অাছো… ওহ…..
অামি প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম।
———-অাপনি কি করছেন???
——-এই তো পড়ছি! অামরা তো ভাই তোমাদের মত প্রফেশনাল স্টাডিজে ছিলাম না, তাই এখন পড়তে পড়তে ভুত হয়ে যেতে হচ্ছে।
অামি হাসলাম।
———অঞ্জন ভাই, ভালো অাছে???
———অামি কি অঞ্জন ভাই’র সাংবাদিক??
———রেগে যাচ্ছেন কেনো??অাপনার বন্ধু……
অভি অাবার চুপ করে গেলো।
অামিও চুপ। কিছু বলার মত মানসিক শক্তি ছিলোনা অামার। কিছু একটা সব কালো করে যে অামার জীবনে অাসতে যাচ্ছে, স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম অামি।
অভি চলে যাবার সময় ও কিছু বললো না। অনেকটা চলে গেলো,
তারপর অাবার ফিরে এসে বললো,
———তোমার জ্বর শুনে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। অাই ডোন্ট নো হুয়াই… বাট ইট মেইকস মি ডিস্টার্বড। যে মানুষটাকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে অামার অাগ্রহ হয়নি, সেই মানুষটা অসুস্থ হবার পর থেকে অামার মন কেমন করছিলো… তাঁকে দেখার জন্য।
তোমার অসুস্থতা অামার ভালো লাগছেনা পরী!অাই হেইট ইওর ইলনেস।
তারপর অাচমকাই
অভি অামায় এই প্রথম জড়িয়ে ধরলো। অামি বুঝতে পারছিলাম সে কাঁপছে। ভীষণ…. ঘাবড়ানো গলায় বললো,
———-তুমি কি অামাকে একটা চুমু খাবে পরী???
অামার এই প্রথম অভির সংস্পর্শে এসে ভয় লাগলো।প্রচন্ড ভয়।
তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
———-জ্বরের চুমু খুব তেঁতো হয়! ইয়াক……
অভি হেসে ফেললো।।
সেদিনের পর অামার জীবনে অভিকে ভয় করতে লাগলো। অভি কি ভেঙে গেছে???
এর মাঝে এই অসুস্থতায়,অভির সাথে যোগাযোগ অামি বন্ধ করে দিলাম। অভি যাতে কোনো খবর না পায়, কেয়ারফুল হয়ে গেলাম।
অামার অতটুকু বয়সে ওরকম অসুখ সামাল দেওয়ার মানসিক শক্তি হয়তো ছিলোনা। কিন্তু জোর চেষ্টা অামি করছিলাম।
অামার রুমমেট অাপু অনেকটা জোর করেই অামার টেস্ট গুলো করান।টেস্ট করানোর পর তিনি নিজেই রিপোর্ট গুলো শীলা ম্যামকে দেখান।অামাকে প্রায় ধরেই সাথে নিয়ে যান।
ডাঃ শীলা অামার রিপোর্ট দেখে খুবই থমথমে মুখ করে বললেন,
——–অাফসানা,
খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।তুমি একজন হবু ডাক্তার। মানুষের শরীর ব্যাপারটাই হবে তোমার কাজ করার সাবজেক্ট। সেই শরীরটা হচ্ছে একটা কারখানার মেশিনের মত….
অাপু অামার মাথায় হাত বুলালেন তখন।
অামি খুব স্বাভাবিক গলায় বললাম,
———ম্যাম অামি ভয় পাচ্ছি না।অাপনি সোজাসুজি বলুন প্লিজ!
ডাঃ শীলা উঠে এসে অামার কাঁধে হাত রাখলেন,
———- তোমার ইউটেরাসে একটু সমস্যা অাছে। অামার ধারণা সমস্যাটা খুবই সামান্য। অামি সাসপেক্ট করছি, ফাইব্রয়েড….
সেটা বুঝবার জন্যই তোমার বাবার সাথে একটু কথা বলার দরকার। তুমি কি তাঁকে একটা ফোন করবে??
ডাঃ শীলা চেয়ারে গিয়ে বসলেন অাবার।
নতুন নতুন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেও অামি ডাক্তারদের ভাষা বুঝি। মেডিকেল সাইন্সে বেশিরভাগ ডক্টররা একটা কমন থিওরি মেনে চলেন, তা হলো পেশেন্টের কোনো সমস্যাই তাদের কাছে সমস্যা না। এর সমাধান তাদের কাছে অাছে।অন্তত বিজ্ঞান এর সলিউশন রেডী করে রেখেছে।
অামি কঠিন গলায় ম্যাডামকে বললাম,
———ম্যাম, অামার মা মারা যান জরায়ুর ক্যান্সারে। অামি অামার মাকে, জীবনের কঠিন সময়টা কিভাবে কাটিয়েছেন খুব কাছ থেকে দেখেছি। অামার এই ডাক্তারী পড়বার পেছনে অামার মায়ের অসুস্থতাই মূল রিজন ছিলো। মাকে নিয়ে ডাক্তারদের কাছে এত ধরনা দিতে হয়েছে যে, মায়ের মৃত্যুর পর বাবা তখনি ঠিক করেন, অামাকে ভালো ডাক্তার হতে হবে…….
ডাঃ শীলা অবার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে অামার মাথায় হাত রাখেন।
——–তুমি এত কেনো ভয় পাচ্ছো পরী??তোমার সমস্যাটা খুবই ছোট। অামি সাসপেক্ট করছি ফাইব্রয়েডটার বয়সও খুব অল্প!
হয়তো একটা ছোট্ট সার্জারি করতে হতে পারে…….
মেয়েদের জন্য জরায়ু ব্যাপারটা সেনসিটিভ। গর্ভধারণের মত বিশাল একটি চ্যাপ্টার তাদের পাড় করতে হয় বলে…..
এখন
তুমি নিজে দেশের টপ মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট হয়েও যদি এমন ভেঙে পড়ো, তাহলে কিভাবে হয় পরী???
সেদিন শীলা ম্যামের কাছ থেকে ফিরে হোস্টেল অবধি হেটে অাসার শক্তি যেনো অামার ছিলোনা। এত ভয়ংকর কিছু অামার জন্য কেনো অপেক্ষা করছিলো??
জরায়ু ব্যাপরটা হলো, গর্ভধারণ কালে ফিটাস এর ভেতরেই পূর্ণাঙ্গ হয়! ফাইব্রয়েডে অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়, অামি এটা জানি….. যাদের ফ্যামিলি কমপ্লিট তারা তো এটাই করেন। শুধু অামার তো…………
(চলবে)
লেখিকা: তৃধা আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here