#এটা_গল্প_হলেও_পারতো
পর্ব—-০২
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো রাত্রি।হঠাৎ চোখজোড়া মনের অজান্তেই বিছানার চাদের ওপরে পড়লো।দেখতে পায় তার ওপরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে…..
এটা দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় সে।এতো পরিমাণ রক্তের উৎস কি হতে পারে জানা নেই।এরপর বিছানা থেকে নেমে এলো রাত্রি।মেঝেতে পা রাখা মাত্রই ব্যথায় সারা শরীর কেঁপে উঠলো তার।দুই পায়ের জয়েন্টে ভীষণ পেইন হচ্ছে।যার কারণে হাঁটা মুশকিল হয়ে পড়ছে।কিন্তু যেকরেই হোক বাথরুমে যে যেতেই হবে তাকে।পায়ে ভর দিয়ে কোনোমতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
এদিকে রাত্রির বাবা-মা তাদের ঘরে।দুজন একটা বিষয়ে গম্ভীর আলোচনা করছে।
—-আমরা প্রতিদিন মেয়েটার সাথে কি ঠিক করছি এটা…..??(রাত্রির বাবা)
—-মানে,কি বলতে চাইছো তুমি?
—-বলছি ওকে কয়েকদিনের জন্য ছাড় দেয়া যায় না,পরে না হয় আবার।
—বাবাগো বাবা….বলছি এতো দরদ কোথা থেকে আসে তোমার,একবার ভেবে দেখেছো এই যে ভালো থাকতে পারছো,ভালো খেতে পারছো এসব কিসের জন্য।
—সে সব বুঝি আমি…কিন্তু একটা কথা বলো তো,রাত্রি যদি আমাদের নিজেদের মেয়ে হতো এটা করতে পারতে কিছুতেই….??
ভদ্রলোক কথাটা বলাটা মাত্রই রাত্রির মা তার মুখটা চেপে ধরলো।
—-মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেলো তোমার, এইকথা মুখ থেকে কিকরে বের হলো তোমার।
—কেন ভুল কিছু বললাম,
—রাত্রি যদি জানতে পারে আমরা ওর বাবা মা নই তবে কি ঘটবে একবার কল্পনা করে দেখো।এই কথা একবার বলেছো ভালো কথা আর যেন ভুলেও মুখ থেকে বের না হয়।মনে থাকে যেন।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
—শোনো একটা ভালো ক্লাইন্টের সাথে কথা হয়েছে গতকাল।তাকে আজকের ডেট দিয়েছি।বয়স খুব একটা না এই তেইশ চব্বিশ হবে।বুঝতেই পাচ্ছো এদের থেকেই বেশী টাকা হাতানো যায়,আমি প্রথমবার যে রেট দিয়েছি তাতেই এক কথায় রাজি হয়ে গেছে।
—তাই নাকি,সে তো খুব ভালো কথা।
—হ্যাঁ,ভালো তো হবেই।টাকার কথা শুনেছো এখন আমার কথা তো ভালোই লাগবে।
রাত্রির বাবা চুপ হয়ে গেলো।
—দেখো আমি যদি ফের ঐ বেওয়ারিশ মেয়েটার প্রতি দরদ উতলে উঠতে দেখছি তোমার,সেদিন তোমার একদিন কী আমার একদিন।একদম আমার কাজে ঝামেলা করার চেষ্টা করবে না।
—ওর প্রতি দরদ কে দেখায়।আসলে শুধু টাকার কথা ভাবলেই হয়,তার মেশিনটারও যত্ন নিতে হয় মাঝে মাঝে।নয়তো দেখবে একদিন সে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
—-ভাট বকা বন্ধ করো।থামো এবার।
অগ্যতা ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর কাছে নতিস্বীকার করলো।এই প্রথম নয়,যখনই সে নিজের স্ত্রীকে কোনো পরামর্শ দিতে আসে,সে নিজের যুক্তি দিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে।নিজের স্ত্রীকে প্রচুর ভয় পায় রাত্রির বাবা,তার ভেতরে কিছুটা হলেও রাত্রির জন্য সিমপ্যাথি কাজ করে,কিন্তু স্ত্রীর সামনে সেটা প্রদর্শন করার সাহস হয় না তার। সবসময় ভয়ে চুপসে থাকতে হয়।
–
–
–
এদিকে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে ফিরে আসলো রাত্রি।মা নাস্তা নিয়ে এলো ওর জন্য।সাথে একটা ওষুধ।
—-নাস্তাটা কর মা,আর এটাও খেয়ে নে।
—কিসের ওষুধ এটা?
—তোর ব্যথার!আর কি,
—তুমি জানলে কিকরে আমার এখন ওষুধ প্রয়োজন।আমি কিছু বলিনি তো তোমায়,
—আরে মা আমি তোর।মায়েরা সব বুঝতে পারে।তাদের বলতে হয় না।এতো বকবক করে না করে খেয়ে নে।
রাত্রি তার মায়ের সামনে খাবার খেতে লাগলো।রাত্রির মা রাতেই ক্লাইন্টকে দেখে আন্দাজ করতে পেরেছিলো সে বাড়াবাড়ি করে ফেলবে।তাই নিজে থেকেই ওষুধ নিয়ে এসেছে।না, মেয়েকে ভালোবেসে নয়।মেয়ে ওষুধ খেয়ে সুস্থ না হলে রাতের কাজ হবে কিকরে।আর কোনোকিছুর টেনশন না থাকলে এই টেনশন সবসময় মাথায় ঘোরে তার।মেয়েকে ভালো খাইয়ে পরিয়ে তাকে ক্লাইন্টদের জন্য প্রস্তুত করে রাখতে একচুলো কার্পন্যতা করে না সে।
একটু পরে,ড্রয়িং রুম থেকে রাত্রির বাবার কন্ঠস্বর ভেসে ভেসে আসলো।সে তার স্ত্রীকে ডাকছে।মা রাত্রিকে তার রুমে রেখেই নিচে নেমে আসলো।
ড্রয়িং রুমে একজন বৃদ্ধ লোক বসে আছে।রাত্রির মা তাকে দেখেই চমকে উঠলো।
—একি আপনি….আপনি আমাদের বাসায় কেন এসেছেন?আর তুমি এনাকে কিছু বলছো না কেন?
(মহিলা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে)
—-আরে ইনি আগে কি বলতে চায় সেটা তো শোনো,
—-এতো বছর পরে আমাদের আবার কোন দরকার পড়লো,কেন এসেছেন বলুন,
—আপনি ভয় পাবেন না।আমি থাকতে আসেনি এখানে…
—-তো কেন এসেছেন,দেখুন এমনিতেই অনেক টাকা দিয়েছি আপনাকে।এখন কিন্তু আর কিছু দিতে পারবো না,
—আমি টাকা চাইতে আসি নি,কিছু দিতে এসেছি।যা অনেক আগেই দেয়া উচিত ছিলো আমার,
—দিতে এসেছেন,কি দিতে এসেছেন?
—-আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে,
—হ্যাঁ,পনেরো বছর আগে বিশ হাজার টাকা দিয়ে আপনার থেকে একটা মেয়ে বাচ্চা কিনেছিলাম।তার কিছুই ভুলিনি আমরা,
—-আপনি বড্ড বেশী কথা বলেন।আগে আমাকে আমার কথা শেষ করতে দিন।
ভদ্রমহিলা চুপ হয়ে গেলো।
—-আমি যখন আমার চার বছরের মেয়েকে বিক্রি করি আপনাদের কাছে,ওর ব্যবহৃত সমস্ত জিনিস সাথেই দিয়ে দিয়েছিলাম।কিন্তু তখন আমার একটা ভুল হয়ে যায়।একটা দামী জিনিস আমি দিতে ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন। আজ সেটা ফেরত দিতে এসেছি।
—-কি জিনিস,,
বৃদ্ধলোকটা তার পকেট থেকে একটা সোনার লকেট বের করলেন।
—-এই যে এটা,আপনাদের আমি তখন বলিনি,রাত্রি আমার নিজের মেয়ে নয়।ওকে ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম আমি।এরপর নিজের কাছেই রেখে দেই।লালন পালন করি।একদিন সুযোগ বুঝে বিক্রিও করে দিয়েছিলাম আপনাদের কাছে।কারণ আমি সবসময় ভালোই চেয়েছি ওর।আমি জানতাম আমার থেকে আপনাদের কাছেই ও অনেক ভালো থাকবে।আর এই নিন ওর জিনিস,যা ওর গলার সাথে পেয়েছিলাম আমি।এটা নিন আর আমাকে দায়মুক্ত করুন।
—সব বুঝলাম,কিন্তু এতোদিন বাদে নিজের কর্তব্যের কথা মনে পড়লো আপনার,বিষয়টা খটকা লাগলো।
—আসলে আমি লকেটটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।বহুবছর পরে গতকাল খুঁজে পাই।তাই আর দেরি করি নি।নয়তো অনেক আগেই ফেরত দিতাম।
বৃদ্ধিলোক রাত্রির মায়ের হাতে লকেটটা দিলো।লকেটটা হাতে পেয়েই তারাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে।এরপর ধীরে ধীরে লকেকটা খুলতে থাকে…
ভেতরের দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠে দুজনেই…
লকেটের ভেতরে দুটো ছবি,একটা রাত্রির বাবার আরেকটা রাত্রির মায়ের।এটা সেই লকেট যে লকেট তাদের বাচ্চার গলায় ছিলো,আর সে মাত্র এক মাস বয়সে হারিয়ে যায়…তারপর আর ভদ্রমহিলার কোনো বাচ্চা হয় নি।চার বছর পরে এই লোকটার থেকে রাত্রিকে কিনে নেয় তারা।
তবে কি রাত্রি কোনোভাবে এদেরই হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়ে…কথাটা ভাবতেই বুক মোচড় দিয়ে উঠলো তাদের…মূহুর্তেই মাথায় যেন গোটা আকাশ ভেঙ্গে পড়লো…..
চলবে…..