এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব -০৩

#এটা_গল্প_হলেও_পারতো
পর্ব—-০৩
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

লকেটের ভেতরে দুটো ছবি,একটা রাত্রির বাবার আরেকটা রাত্রির মায়ের।এটা সেই লকেট যে লকেট তাদের বাচ্চার গলায় ছিলো,আর সে মাত্র এক মাস বয়সে হারিয়ে যায়…তারপর আর ভদ্রমহিলার কোনো বাচ্চা হয় নি।চার বছর পরে এই লোকটার থেকে রাত্রিকে কিনে নেয় তারা।

তবে কি রাত্রি কোনোভাবে এদেরই হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়ে…কথাটা ভাবতেই বুক মোচড় দিয়ে উঠলো তাদের…মূহুর্তেই মাথায় যেন গোটা আকাশ ভেঙ্গে পড়লো…..

—-কি হলো,আপনাদের দুজনকে এরকম বিচলিত লাগছে কেন,কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
বৃদ্ধ লোকটা রাত্রির বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

—-নাহ!আমরা ঠিক আছি।আচ্ছা,একটা কথা বলুন,আপনি রাত্রিকে প্রথম ঠিক কোন জায়গায় খুঁজে পেয়েছিলেন।

—-আমার বাড়ির কাছেই,আমি ময়লা পরিস্কারের কাজ করতাম তখন।রাস্তার ময়লা সংগ্রহ করে গাড়িতে নিয়ে যাওয়াই আমার ডিউটি ছিলো।একদিন সকালবেলা কাজ করার সময় আমার এক লোক প্রথম রাত্রিকে ডাস্টবিনে পড়ে থাকতে দেখে।তারপর আমি ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাই।আমার স্ত্রীর কোলে তুলে দেই।সেদিন আমার স্ত্রী কি পরিমাণ খুশি হয়েছিলো বলে বোঝাতে পারবো না।কিন্তু দূর্ভাগ্য দেখুন তার কিছু বছর পরেই আমার স্ত্রী মারা যায়।বড্ড একা হয়ে পড়ে রাত্রি।আমিও কাজের জন্য সময় দিতে পারতাম না ওকে।এরপর সিধান্ত নেই ওর এমন একটা ব্যবস্থা করবো যাতে ও সারাজীবন সুখে থাকতে পারে।এরপর আপনাদের সাথে পরিচয় হয় আমার,যেহেতু আমি ওর আসল বাবা ছিলাম না তাই দত্তক দেয়া সম্ভব হয় নি আমার জন্য, আপনারাই এক প্রকার জোর করে মোটা টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যান ওকে।আমার কিন্তু টাকার বিষয়ে চরম আপত্তি ছিলো তখন,যদি চান আমি টাকাটা এখনো ফেরত দিতে পারি নি।কারণ আমি কখনোই চাইনি আমার মেয়েকে অন্য কারো কাছে বিক্রি করতে।

রাত্রির বাবা-মায়ের বৃদ্ধ লোকের কথায় তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই।এক গভীর ভাবনার জগতে ডুবে আছে দুজন।তাদের মুখে কোনো কথা নেই।বৃদ্ধের এদের হাবভাব একদম ভালো লাগলো না।

—আচ্ছা,রাত্রি কোথায়,ওকে একটি বার দেখা যাবে।

—কেন,তার সাথে দেখা করে কি কাজ আপনার?

—বাহ!এতো বছর পরে এসেছি মেয়েটাকে দেখবো না!ও কি বাড়িতে আছে?

—না এখন কারো সাথে দেখা হবে না।আপনি চলে যান দয়া করে।

—আমি জানি আপনাদের ভয়টা ঠিক কোথায়,বিশ্বাস করুন আমি ওকে কিছুই বুঝতে দেবো না।

—আপনাকে বলছি তো দেখা হবে না।আর এটা ভুলে যাবেন না,মেয়েকে দান করেননি আপনি, মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন।আপনার জোর খাটানোর জায়গা এটা নয় বুঝতে পেরেছেন আশা করি,দয়া করে চলে যান।

বৃদ্ধ বুঝতে পারলো,এদের সাথে কথা বলা বেকার।অগ্যতা উঠে চলে গেলো সে।এদিকে রাত্রির বাবা-মা বিমর্ষ হয়ে বসে আছে।তারা এখনো জানে না,রাত্রি সত্যিই তাদের মেয়ে কিনা,শুধুমাত্র একটা লকেট যথেষ্ট প্রমাণ হতে পারে না।লকেটটা তাদের মেয়ের গলা থেকে কোনোভাবে অন্য কারোর গলায়ও চলে যেতে পারে।আর এই বৃদ্ধ লোকটাই যে সব সত্যি বলছে তার কি প্রমাণ।সবকিছু মিলিয়ে একটা গোলকধাঁধার ভেতরে পড়ে গেলো দম্পতি।
একটু পরে তাদের কাছে একটা ফোনকল আসে… স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে আজকের ক্লাইন্টের নম্বর।এটা দেখে বুক ধড়ফড় করতে লাগলো তাদের।কাঁপা কাঁপা হাতে রাত্রির মা ফোনটা রিসিভ করলো।

—-হ্যাঁ,বলুন,

—শুনুন,কিছু কথা আছে আপনাদের সাথে?

—কি কথা,

—আমি কিন্তু সন্ধ্যার পরেই আসবো।বেশী রাত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।মেয়েকে যেভাবে হোক আটটা-নয়টার ভেতরে রেডি করে রাখবেন।

—এটা কি বলছেন আপনি,এটা তো খুব চাপের হয়ে গেলো।

—আমি এতো কিছু জানি না,যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে রাখবেন।টাকা নেবার সময়ে একেকটা নোট কতোবার করে গুনে নিয়েছিলেন মনে আছে নিশ্চই,

লোকটা এই বলে কলটা কেটে দিলো।
ফোনটা হাতে ধপাস করে সোফার ওপরে বসে পড়লো রাত্রির মা।

—এটা তুমি কি করলে,লোকটাকে কেন মুখের ওপরে না করে দিলে না।
(রাত্রির বাবা ছুটে এসে তার স্ত্রীকে বলে)

—না,করবো?কিভাবে না করে দিতাম আমি।এডভান্স দশ হাজার টাকা নিয়েছি ভুলে গেছো।এখনো কিকরে এই টাকা ফেরত দেবো আমরা, সেই উপায় আছে??

—আমি এতো কিছু জানি না রাত্রির মা,কিন্তু একটি বার ভেবে দেখো রাত্রি যদি সত্যি আমাদের মেয়ে হয়ে থাকে তখন নিজেদের কিভাবে ক্ষমা করবো আমরা।আমাদের দুজনের ডুবে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না তখন।

—-সেই চিন্তা কি আমার নেই,কিন্ত এখন কি করবো আমরা তুমিই বলো।দেখো ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।এ কোন বাজে অবস্থায় ফাঁসিয়ে দিলো আল্লাহ আমাদের তিনিই ভালো জানেন।

—আমি লোকটাকে না করে দেবো,ফোন লাগাও তুমি, নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে এভাবে খেলতে পারবো না আমি।আগে না হয়,না জেনে অনেক পাপ করেছি,কিন্তু এখন জেনেশুনে নিজের মেয়ের এই সর্বনাশ করতে পারবো না।হ্যাঁ,আমি জানি না রাত্রি সত্যি আমাদের মেয়ে কিনা।কিন্তু সন্দেহের বশে হলেও এই কাজ করতে পারবো না আমি।

—ঠিক বলেছো,আমি ফোন করে না করে দিচ্ছি। আর টাকা যেভাবে হোক ফিরিয়ে দেবো আমরা,

রাত্রির মা ক্লাইন্টের নম্বরে ডায়াল করতেই হতাশ হয়ে পড়ে।নম্বরটা বার বার আনরিচেবল বলছে।তার মানে লোকটা ফোন বন্ধ করে রেখেছে।

এবার দম্পতি আরো বেশী চিন্তায় পড়ে গেলো।এই মূহুর্তে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ অবস্থা তাদের।এমনিতেই তাদের কাজটা চরম বেআইনী।এগুলো নিয়ে ক্লাইন্টদের সাথে একেবারেই বাড়াবাড়ি করা যাবে না,আবার মেয়েকেও সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।সারাদিন তাদের এই চিন্তার ভেতরে কেটে গেলো।



বিকেলবেলা বারান্দায় বসে দুজন নিজেদের ভেতরে আলোচনা করছে।

—রাত্রির মা,আমি একটা উপায় খুঁজে পেয়েছি।যদিও জানি না সেটা কতটা সফল হবে।

—কি উপায়,

—আমরা রাত্রিকে ওই লোকটা মানে ওর পুরাতন বাবার কাছে রেখে আসি কিছুদিনের জন্য।ওনার কাছেই রাত্রি সবথেকে বেশি নিরাপদ থাকবে।এখানে আমাদের দুজনের ওপরে যতোই ঝড় বয়ে যাক না কেন,তার আঁচ অন্তত মেয়েটা পর্যন্ত পৌঁছবে না।

—এটা ভালো কথা বলেছো,কিন্তু আজ সকালে লোকটার সাথে যে ব্যবহার করছি দুজনে।এখন কোন মুখে যাবে তার কাছে সাহায্য চাইতে।

—সেটা নিয়ে তুমি ভেবো না এখন,উনি রাত্রিকে এখনো অনেক ভালোবাসেন।আমরা সাহায্য চাইলে না করতে পারবে না।

—ঠিক আছে,তাহলে তাই যাও।এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো।কথা বলো ওনার সাথে।যদি রাজি হয় রাতের অন্ধকারে রাত্রিকে রেখে আসবো তার কাছে।

—রাজি হবে আমি জানি,কিন্তু আমাদের উচিত একটিবারের জন্য হলেও ওনার কাছে যাওয়া।ওনার অনুমতি নেয়া।

রাত্রির বাবা মা চায় রাত্রিকে এই ক্লাইন্টের থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে রাখতে।এছাড়া কোনো উপায় নেই। ইতিমধ্যে এক ডজনের ওপর ক্লাইন্ট বুক করে রেখেছে তারা।এতো বড়ো ধকল সামলাতে রাত্রিকে সবার ছায়া থেকে দূরে পাঠানোর বিকল্প নেই।এই ভেবে রাত্রির বাবা বৃদ্ধের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।



তার বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো।দীর্ঘ পনেরো বছর পরেও এখানের সমস্ত পথঘাট জলের মতো পরিষ্কার ভদ্রলোকের কাছে।গাড়ি থেকে নেমে কিছু পথ হেঁটে যেতে হয়।চিপা গলি দিয়ে বৃদ্ধের বাসার উদ্দেশ্যে পা চালাতে লাগলো সে।একপর্যায়ে পৌঁছেও গেলো।দরজার কাছাকাছি আসতেই ভেতর থেকে একটা মেয়ে কন্ঠস্বর ভেসে আসলো তার কানে।হঠাৎ সে তার পা জোড়া থামিলে দিলো।জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে বৃদ্ধের ঘরের ভেতরে কে আছে।কারণ তার জানামতে বৃদ্ধ এখানে একাই থাকে।তার ঘর থেকে মেয়েদের গলার আওয়াজ ভেসে আসা অস্বাভাবিক।
জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরের দৃশ্য ভালো করে অনুধাবন করা যাচ্ছে না।তবুও সে আপ্রান চেষ্টা করছে কিছু দেখার জন্য।

মেয়েটা কথা বলতে বলতে এক সময়ে জানলার সামনে চলে আসলো।তাকে এক ঝলক দেখেই ভদ্রলোক চমকে উঠলো,ভয়ে দুপা পেছনে সরে গেলো সে।

—-হে খোদা!এটা কি দেখছি আমি।এতো আমার মেয়ে রাত্রি,যাকে বাড়িতে রেখে এসেছি আমি..!!!😱কিন্তু রাত্রি ওর পুরাতন বাবাকে, তার ঠিকানা জানলো কিকরে,আর ও এইসময়ে এখানেই বা কি করছে?দেখে তো এদের বহুদিনের পরিচিত মনে হচ্ছে।যদি তাই হয় এই বৃদ্ধ সকালে সব অস্বীকার করলো কেন?

(নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রাত্রির বাবা)আতংক আর বিষ্ময়ে গলা শুকিয়ে যেতে লাগলো তার।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here