#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-০৯
১৪.
গত চব্বিশ ঘন্টা ধরে পৃথী নিঁখোজ!পৃথীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।নুহার সাথে সেই যে ভার্সিটির পথে ধরে মেয়েটি হাঁটা দিলো তারপর আর বাসায় ফেরে নি।রহিমা এখন পাগল প্রায়।পাগলের মতো একবার এদিক একবার ওদিক ছোটাছুটি করছেন আশপাশের কেউই পৃথীর সন্ধান দিতে পারছে না।তারা অনেকে আবার পৃথীকে চিনেও না এরকম বলে।রহিমা এখন কি করবেন, কোথায় যাবেন,কার কাছে যাবেন কিছুই মাথায় আসছে না।ব্যর্থ মনে বেলকনির ফ্লোরের উপর ধপাস করে বসে যান।পাশে পিয়ারা বেগম,নুহা এবং কিছু প্রতিবেশী মানুষও আছেন।তারা সবাই ই বলতেছে পুলিশের কাছে যেতে। থানায় একটা জিডি করতে।পুলিশরা পৃথীকে খুঁজে দিবে!কিন্তু রহিমার পুলিশের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না।তার মনে হয় পুলিশদের কাছে যেয়েও তেমন কোনো লাভ হবে না। তারা প্রথমে দুই একটা নীতিবাক্য শুনাবে।তারপর একগাদা একটা মোটা অংকের টাকা হাঁতিয়ে নিয়ে চার দুইদিন বাদে এসে বলবে,”দুঃখিত আপা,আপনার মেয়েকে খুঁজে পেলাম না!”
বাংলাদেশে অসংখ্য এমন অহরহর ঘটনা আছে।রহিমা নিজ চোখেই তার প্রমাণ পেয়েছে।সেই ত সাতবছর আগে তার চোখের সামনে থেকে তার চাচাতো ভাইটা কিভাবে উধাও হয়ে গেল।পরে কত থানা কেইস,পুলিশ কেইস,মামলা-মকদ্দমা আরো কত কি করেছে।কাজের কাজ কিছুই হলো না,মাঝখান দিয়ে টাকাগুলো জলে গেলো।এখনো তার চাচাতো ভাইটাকে পেলো না।যদি পৃথীরও তাই হয়?রহিমা মুহূর্তে অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে উঠে।নুহা আলতো হাতে রহিমার কাঁধ চাপড়ে ধরে বলে,
“প্লিজ আন্টি কাঁদবেন না।একটুও কাঁদবেন না!আল্লাহ ভরসা আমরা পৃথীকে খুঁজে পাবোই।আল্লাহই পৃথীকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিবে।”
বলেই নুহা এবার পিয়ারা বেগমের দিকে তাকায়,
“নানু,আর দেরী করা যাবে না।চলেন!”
“চল!”
রহিমা বুঝছে নুহা এখন পিয়ারা থানায় যাবার কথা বলছে।রহিমা ওমনি গাল মুছে দাঁড়িয়ে বলে,
“থানায় যাওয়া লাগবে না।পুলিশ আমার মেয়েকে খুঁজে দিতে পারবে না।আমার মেয়েকে একজনই খুঁজে দিতে পারবে!”
“তুই অয়নের কথা বলছিস?”(পিয়ারা)
রহিমা পিয়ারা বেগমের কথার প্রতিত্তর করলো না।পড়নের ময়লা কাপড়টা শরীরে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে উড়াধুরা ছুটা ধরে অয়নের বাড়ির দিকে।অয়নের বাড়ির গেটে বরাবর আসতেই গেটের কলিংবেলে চাপের উপর চাপ দিতে থাকে।কয়েক মিনিট পর একজন লোক এসে শিকের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে।লোকটি দারোয়ান ই হবে।সে বলে,
” কাকে চাই?”
“জ্ জ্বী অয়নকে!”
“কেন?”
“উনাকে আমার একটু প্রয়োজন ছিল। উনি কি এখন বাসায় আছেন?”
“হুম বাসায় ই।”
“আমি উনার সাথে একটু দেখা করতে চাচ্ছি।”
“এখন দেখা করে যাবে না। স্যার তার ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং এ বসছেন।”
“আমি খুব বিপদে পড়ে এসেছি ।প্লিজ একটু চেষ্টা করে দেখুন!”
” একবার বললাম ই ত পারবে না।স্যার খুবই সময়ানুবর্তিতা। স্যার বর্তমানের কাজটা শেষ না করে আগামটা মাথায় চাপে না।কাজেই খামোখা বিরক্ত করবেন না।ওই বটগাছের নিচে যেয়ে অপেক্ষা করুন।পরে স্যারের মিটিং শেষ হলে আপনার কথা গিয়ে বলবো।”
“আসলে আমার এখনই উনাকে খুব প্রয়োজন!”
“প্রয়োজন হলেই কি বড় মানুষদের সাথে যখনতখন দেখা করার নিয়ম আছে?”
“আসলে উনাকে আমার পরিচয়টা দিলে উনি আমাকে চিনতে পারেন!”
“তো চিনলে?”
“আপনাকে আমি এতকিছু খুলে বলতে পারবো না।যা বলার উনাকে বলবো।”
“আপনাদের এসব আবেগী ক্যাঁচরব্যাঁচর শুনতেই কি এখানে দাড়িয়ে থাকি নাকি?অপেক্ষা করতে পারলে করেন।আর না পারলে বিদায় হোন!”
বলেই দারোয়ান তার বিরক্তি মাখা বিরক্তি মুখ নিয়ে রহিমার সামনে থেকে চলে যায়।মুহূর্তে রহিমার দুই চোখের কোণা বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।তা কাপড় টেনে মুছে নিয়ে দারোয়ানের কথা মতো বটগাছের নিচে গিয়ে দাড়য়।আর অয়নের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।অপেক্ষা করতে করতে আধা ঘন্টা পার হয়।তারপর আবার গেটের দিকে তাকায়।নাহ কাউকে আসতে দেখছে না।তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকে।এভাবে একঘন্টা শেষ হয়।রহিমা এবার হাঁপিয়ে ওঠে।তাহলে শেষপর্যন্ত তার এখানেও আশা নেই!?তার পৃথী.. তার পৃথী মাকে হারিয়ে…!ভেবেই রহিমা আবারো কেঁদে ওঠে।ঠিক সেই সময় অয়ন তার ক্লায়েন্টদের সাথে সবে মিটিং শেষ করে সিসি ফুটেজের দিকে হালকা একটু চোখ রাখে।ওমনি সিসিতে ফুঁটে ওঠে তার বাড়ির সামনের বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে একজন আধা বয়সী মহিলা বারবার কাপড়ের আঁচল টেনে চোখের জল মুছছেন।মহিলাকে কেনজানি খুব চেনা মনে হচ্ছে।আগে কোথাও যেন একবার দেখেছে।কিন্তু কোথায় দেখেছে তা এই মুহূর্তে খেয়াল করতে পারছে না।অয়ন উঠে দাঁড়ায়।ক্লায়েন্টদের সাথে বিদায়ের হ্যান্ডশেক করে দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নামে।গেইটের বাইরে এসে গলা ছেড়ে দিয়ে বলে,
“এক্সকিউজ মি?”
রহিমা তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে তাকায়।দেখে তার সামনে একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে।যুবকটি যে অয়ন এটা রহিমার বুঝতে এক সেকন্ডও সময় লাগে নি।সে অয়নকে সরাসরি কখনো না দেখলেও মোবাইল,টেলিভিশন এবং পত্রিকায় বহুবার দেখেছে।আর তার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার পর থেকে আরো একটু বেশিই চিনে তাও খুব আপন আপন অনুভূতিতে।রহিমা আর দেরী না করে দ্রুতগতিতে অয়নের সামনে এসে ধপাস করে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ে।দুই হাত উঁচিয়ে বলে,
“একবার তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে।তারজন্যে তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে খুব দোয়া করেছি তোমাকে।এবার তোমাকে তোমার একজন মা বয়সী মহিলার একটা আবদার রাখতে হবে।পারবে বাবা?”
অয়ন কি বলবে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না।সে খুব অসংযোতে পড়ে যায়।অসংযোতের প্রধান কারণ মহিলাটি তার মা বয়সী এভাবে তার সামনে মাথা নিচু করে বসাটা সে মেনে নিতে পারছে না।আর দ্বিতীয় কারণ সে এই মহিলার প্রাণ বাঁচালো কিন্তু কীভাবে!
“প্লিজ আন্টি আপনি দাঁড়ান।আপনি এভাবে বসে থাকবেন না।আমার অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ লাগছে।প্লিজ!”
“আমি তোমার সব কথা শুনবো।আগে বলো আমার মেয়েকে এনে দিতে পারবে?”
“আচ্ছা বলছি পরে। আপনি প্লিজ দাঁড়ান।”
“না আগে কথা দাও!”
অয়ন পড়লো বিপাকে।মহিলা কি পাগল নাকি?মানুষের পাগলামোরও ত একটা সীমা থাকে!কিন্তু এই মহিলা সীমা ছাড়া পাগলামো করছে।মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও পরে আর উপায়ন্তর না পেয়ে বলে,
“আচ্ছা,বাঁচাবো।”
“প্রমিস?”
“জ্বী,প্রমিস।”
রহিমা দাঁড়িয়ে যায়।
“বাবা? বাবা গো আমার পৃথী।পৃথী আমার মেয়ে।সে চব্বিশটা ঘন্টা ধরে নিঁখোজ।কত জায়গায় খুঁজলাম।কত জায়গায় গেলাম। কোথাও মেয়েটার কোনো সন্ধান পেলাম না ।আমি এখন দিশেহারা,আমি এখন পথহারা,আমি উন্মাদ!আমার মেয়েকে একটু খুঁজে এনে দাও বাবা।তোমার কাছে এই আরেকটা চির কৃতজ্ঞতা হয়ে থাকবো।”বলেই রহিমা আবারো বিভোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
” আর ওই যে কি বললেন আমি আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছি এটার মানে ঠিক বুঝলাম না।”
“আমি হার্ট এ্যাটাক করেছিলাম আর তুমি আমাকে সাতলক্ষ টাকা দিয়েছিল অপারেশনের জন্যে মনে আছে?”
“পৃথী”এবং অপারেশন দুইটা শব্দেই অয়ন এবার পুরোপুরি ক্লিয়ার।তারমানে এখন তার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তিনি পৃথীর মা।ভদ্রমহিলাকে সেদিন হাসপাতালে একজনর দেখেছিল অয়ন।সেই দেখায় এতদিনে চেহারাটা মস্তিষ্কে প্রায়ই ঝাপসা হয়ে গেছে।আজ আবার হঠাৎ সিসিতে দেখায় সেই ঝাপসা টা মাথাচাড়া দিয়েছে।এই কারণেই ভদ্রমহিলাকে সিসিতে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল!অয়ন লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
” আন্টি এভাবে বাইরে দাড়িয়ে কথা বলতে আপনার অসুবিধে হচ্ছে। প্লিজ আপনি ভেতরে আসুন।”
“নাহ বাবা এখন যাবো না।তোমাকে এখানেই সব বিস্তারিত বলতেছি…।”
“নাহ আন্টি এখানে বললে আমি কিন্তু একদম শুনবো না।”
তারপর বাধ্য হয়ে রহিমা অয়নের সাথে ভেতরে যায়।রহিমা সোফায় বসার সাথে সাথেই এক গ্লাস চা,ঠান্ডা পানীয় বোতল আরো অনেক খাবার টি-টেবিলের উপর জড়ো করা হয়।অয়ন টেবিল থেকে জুশের গ্লাসটা উঁঠিয়ে রহিমাকে বলেন,
“আন্টি ঠান্ডা জোশটা আগে একটু খেয়ে নিন তারপর আমরা কথা শুরু করি।আপনি কথা বলার সময় আমার ক্লিয়ারলি বুঝতে সমস্যা হয়।”
রহিমা জোশের গ্লাসটা হাতে নেয়।তারপর কিছুটা খেয়ে তা টেবিলের উপর রাখে।এবার অয়ন স্থির হয়ে বসে।
” পৃথীর কীভাবে নিঁখোজ হলো?প্লিজ আন্টি আমাকে প্রতিটি বিষয় একটু সুন্দরমতো খুলে বলুন।”
রহিমা অয়নকে সবগুলো বিষয় সুন্দরভাবে খুলে বলে।অয়ন সবগুলো বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ শুনে।শুনার পর রহিমাকে সুদৃঢ় কন্ঠে বলে,
“আন্টি,আপনি একদম টেনশন নিবেন না।আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে আছি।পৃথীকে আমি খুঁজে বের করবই!”
আশাতে রহিমার দুই চোখে মুহূর্তে পানি চলে আসে।ঝাপসা চোখদুটোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,
“বাবা তোমাকে কীভাবে যে ধন্যবাদ দিব তা আমার জানা নেই।তবে তোমার প্রতি মহান আল্লাহর কাছে রইলো আমার অনেক দোয়া।”
“আন্টি বাকি খাবার গুলো শেষ করুন।”
“নাহ বাবা এখন আমাকে ফিরতে হবে।বাসায় অনেকেই আছে।তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো হলো।প্রথম ত ভাবলাম তোমার সাথে আমার দেখাই হবে না।”.
” আপনাদের জন্যে আমার দরজা সবসময় খোলা।”
তারপর রহিমা অয়নকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।রহিমা যেতেই অয়ন এবার চোখমুখ শক্ত করে গলা উঁচিয়ে দারোয়াকে ডাকতে থাকে,
“আমির চাচা?আমির চাচা?”
আমির কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে এসেই হাজির হয়।
“জ্বী স্যার,বলুন?”
” মাত্র আমি যেই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বললাম উনাকে আপনি বাইরে কত সময় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন?”
আমির জবাব দেয় না।অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে ফেলে!
“জবাব দিচ্ছেন না কেন?”
“এক ঘন্টা ..!”
“একঘন্টা! আমি এই আদেশ দিয়েছি কোনো ব্যক্তি অনেক বড় বিপদে পড়ে আমার কাছে আসতে চাইলে তাকে গেইট বন্ধ করে বাইরে আঁটকে রাখতে?”
আমির এবারও জবাব দেয় না।অয়ন চোখবুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।শ্বাসটা রাগেরই প্রকাশ। কিন্তু এই মুহূর্তে এদের সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।।
” নেক্সটবার যেন এরকম আর না দেখি…!!”
বলেই অয়ন উপরে চলে আসে।এসেই রুমের দরজা বন্ধ করে।তারপর বিছানার উপর গিয়ে নৈঃশব্দের বসে।এতক্ষণে বুকের বাম পাশে চেপে রাখা ব্যথাটা তার এবার ধু ধু করে জ্বলে উঠে।প্রচন্ড উত্তপ্ত ভাবে জ্বলে উঠে। এই ফিলটা রহিমার সামনেও হয়েছিল কিন্তু তা প্রকাশ করেনি এবং এখনও করছে না।আর তা করতে প্রয়োজন বোধও করে না।এখন শুধু তার প্রয়োজন পৃথীকে খুঁজে বের করা।
চলবে….
(ভাবলাম বোনাস দিব।কিন্তু ঈদের ব্যস্ততায় তা মনে হয় পারবো না।)