ওয়েডিং_স্টোরি পর্ব ৩৭+৩৮

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” হ্যাই, রাত্রি! ”
পিছন থেকে পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আভা আর আহনাফ দুজনই পিছন ফিরলো। কে ডাকলো আভাকে?
কিন্তু, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলের দিকে তাকিয়েই আহনাফের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। চোখে ঝিলিক দিলো, সুপ্ত রাগের আভাস! আভা নিজেও চিনতে পারলো না সেই শ্যামবর্ণের ছেলেকে! ছেলেটা মৃদ হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। আহনাফের দিকে একনজর তাকিয়ে আভার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” হ্যাই, আমি নুহাশ। মিনহাজের বন্ধু। ”
‘ মিনহাজের বন্ধু ‘ কথাটা শুনে আভা তেমন অবাক না হলেও, অবাক হলো আহনাফ। নুহাশের দিকে তাকালো আহনাফ। চোখে প্রশ্নের ছাপ! জিজ্ঞেস করলো,
— ” তুই মিনহাজের বন্ধু? ”
নুহাশ হেসে উত্তর করলো,
— ” কেনো? হতে পারি না? ”
আহনাফ আর ব্যাপারটা ঘাটালো না। আভার দিকে চেয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল,
— ” এখান থেকে চলো, আভা। আমার তোমার সাথে কথা আছে। ”
আভা আহনাফের চোখে তাকিয়ে বুঝলো, আহনাফ এই মুহূর্তে মারাত্মক রেগে আছে। তাকে এখন হাবিজাবি প্রশ্ন করা মানেই বিপদ! আর সিংহের রাগের কাছে বরাবরই আভা পরাজিত। তাই, নুহাশের দিকে চেয়ে সৌজন্যসুলভ বললো,
— ” আপনি কোল্ড ড্রিংকস নিবেন? ওদিকটায় আছে। ভাইয়াও আছে সেখানে। এনজয়! ”
নুহাশ হেসে উত্তর করলো,
— ” থ্যাংক ইউ, সুইট লেডি। ”
‘ সুইট লেডি ‘ শব্দটা আহনাফকে রাগানোর জন্যে যথেষ্ট ছিল। সে দাতে দাত চেপে আভাকে বললো,
— ” চলো আমার সাথে। ”
অতঃপর আভাকে টেনে নিয়ে আসলো নুহাশের সামনে থেকে।

ছাদের একপাশে এসে দাঁড়ালো আহনাফ। আভাকেও টেনে নিজের সামনে দাড় করালো। আভা এখনো আহনাফের রাগের কারণ ধরতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফের এমন ধোঁয়াশা ব্যাবহার তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আভা ভয় ভয় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আপনি তখন..? ”
— ” অ্যাই লাভ ইউ! ”
আচমকা আহনাফের বলা কথা শুনে আভা থতমত খেয়ে গেল। তবে, অন্যদিনের মত অস্বস্তি হলো না। বরং, উত্তর দিতে মন চাইলো এই বাক্যের। তবে, কোথাও যেন একটা সংকোচ রয়ে গেলো। গলার মাঝেই বাঁধা পড়ে গেলো বহু প্রতীক্ষিত উত্তরটার। আহনাফ আভার দিকে এগিয়ে এসে আভার দুবাহু খামচে ধরলো। আভার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
— ” তুমি খুব ভালো করেই জান, আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার উপর কেউ নজর দিক, সেটা আমার মোটেও পছন্দ না। নিজেকে কখনোই অন্যের জন্যে এভেইলেবল করে দিবে না। কারণ তুমি আহনাফের চয়েজ। আর আহনাফের চয়েস সবসময় অমূল্য, দুর্লভ! গেট ইট? ”
আভা হতবম্ভের মত আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের মুখে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা এই প্রথম শুনেনি ও। এর আগে বহুবার আহনাফ বলেছে সেই শব্দ। তবুও, আজকের বলা শব্দটা অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। একদম আলাদা। আভার মনে হচ্ছে, তার কান স্বার্থক! একটা ছেলে তাকে পাগলের মত ভালবাসে, এক মেয়ের কাছে এর চেয়ে বড় পাওনা আর কি থাকতে পারে পারে? আহনাফ আভার চুপ থাকা দেখে আবারও বললো,
— ” সে সামথিং? ”
আভা কাপা কণ্ঠে উত্তর করলো,
— ” কি বলব? ”
— ” তুমি কি এখনো আমায় ভালোবাসতে পারো নি, বউফ্রেন্ড? ”
আভা কেপে উঠলো। আহনাফের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। যা ওর মধ্যে থাকা সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। আভা এবার কোনো উত্তর করলো না। কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছে, আহনাফের প্রতি আভা দুর্বল হয়ে গেছে। ততটা দুর্বল, যতটা দুর্বল হলে আহনাফ নামক মানুষটা আভার আকৃষ্টে পরিণত হতে পারে। আভাকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ একটু কষ্ট পেলো। সে আভার বাহু ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরলো। কোমরে এক হাত রেখে আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে শান্ত সুরে বললো,
— “জাস্ট, ফরগেট ইট। কেউ তোমাকে ডাকছে। যাও, দেখে আসো। ”
আভা ছলছল চোখে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ কি তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন? আর কতই বা সহ্য করবেন? একটা মানুষ তোমাকে পাগলের মত ভালবাসে, কিন্তু তার সেই ভালোবাসার বদৌলতে তুমি প্রতিদান স্বরূপ শুধু কষ্টই দিয়ে গেলে।এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে?

— ” আভা, গো ফ্রম হেয়ার। একটু একা থাকতে চাই আমি। প্লিজ। ”
আভা দু একবার ঢোক গিলে কান্না আটকালো। তবুও, এক চিকন জলের রেখা গড়ালো তার চোখে বেয়ে। দুহাত দিয়ে চোখ মুছে আভা চলে এলো সেখান থেকে।
________________
— ” তুই মেয়ে, নাকি? এখনো জিজুকে ভালোবাসি বলিস নি। হাও রুড, ইয়ার! ”
আভা মুখ ভার করে বসে রইলো চেয়ারে। কি বলবে? কিছুই বলার নেই তার। সিনথিয়া এবার বলে উঠলো,
— ” তাহলে,এখন গিয়ে বলে দে। বলে দে যে, আহনাফ তোমাকে দেখলে আমার মনে কুচ কুচ হোতা হে,, কিয়া কারো হাই, কুচ কুচ হোতা হে! ”
সিনথিয়ার ফাটা গলায় গান শুনে রুম জুড়ে হাসির ধুম পড়ে গেলো। তবে, আভা হাসলো না। সেই মুখ ভার করেই বসে রইলো। সাথী উঠে এসে আভার পাশে দাড়ালো। আভার কাধে হাত রেখে ভাবুক গলায় বললো,
— ” একটা প্ল্যান করা যেতে পারে। ”
‘ প্ল্যান ‘ সবাই উৎসুক হয়ে তাকালো সাথীর দিকে। সাথী আভার দিকে চেয়ে হেসে বললো,
— ” একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করলে কেমন হয়? ”
সবার চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো। তারা তাচ্ছিল্যের সহিত বলে উঠলো,
— ” আমরা আর সারপ্রাইজ প্ল্যান? ভুলে যা সেসব।সেসব ক্রিয়েটিভ আইডিয়া আমাদের দ্বারা হবে না। ”
তারার কথা শুনে সবাই মুখ লটকালো। আভা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। ভেজা গলায় বললো,
— ” উনি কষ্ট পেয়েছেন আজ। শুধুমাত্র আমার জন্যে। আমার খুব খারাপ লাগছে,ইয়ার। ”

— ” সব কষ্টের দিন শেষ হোক। আহনাফের বউফ্রেন্ড আবার হেসে উঠুক! ওয়ে হয়ে, চাম্মাকচালো! ”
দরজার সামনে থেকে এক পুরুষালি কণ্ঠ শুনে রুমের সব মেয়েরা তাকালো ওদিকে। নুহাশ হাতে বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। নুহাশকে দেখে আভার মনে পড়ে গেলো, আহনাফের কথা। আহনাফ ইন্ডিরেক্টলি বলেছিল, নুহাশ থেকে দূরে থাকতে। আভা মুখ ফিরিয়ে নিলো। তাকালো আবারও জানালার দিকে। নুহাশ এসে বসলো সোফাতে। বিরিয়ানি চামচ দিয়ে খেতে খেতে বলল,
— ” অ্যাই হেভ অ্যা গ্রেট সারপ্রাইজ প্ল্যান, গাইস! ”
আভা এবার তাকালো নুহাশের দিকে। বাকি সবার চোখ একে একে নিবদ্ধ হলো নুহাশের উপর। নুহাশ বিরিয়ানি প্লেট একপাশে রেখে সবার দিকে ঝুঁকে এলো। ফিসফিস করে বললো,
— ” সমুদ্রের তীর ইজ দ্যা বেস্ট প্লেস ফর লাভার। তোমাদের যা করতে হবে….”
আর শোনা গেলো না কিছু। নুহাদের ফিসফিস আওয়াজে ভাটা পড়লো সমস্ত কথা।
______________________
আজ বিয়ে মিনহাজের। স্টেজে শেরওয়ানি পরে বসে আছে মিনহাজ। তার পাশে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আরোহী মাথা নিচু করে আছে। আজ আরোহীর উপর থেকে চোখ সরানো দায় হয়ে পড়ছে মিনহাজের। আরোহীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এতে আরোহী লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জায় রীতিমত আলুথালু হয়ে আছে। মিনহাজ এমন করে তাকিয়ে আছে কেনো? তার লজ্জা লাগে, জানেনা সে? মিনহাজ সবার অগোচরে আরোহীর কোমর জড়িয়ে ধরলো। আরোহী কেপে উঠলো তাতে। মিনহাজ আরোহীর দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
— ” ভয়ানক লাগছে আজ। এখন শুধু টুপ করে গিলে ফেলার অপেক্ষা, সুন্দরী! ”
ইশ! মিনহাজ কি বলে? একদম যা তা! আরোহী কি গিলে ফেলার জিনিস? মুখে একদম লাগাম নেই। কিন্তু, সবার সামনে মিনহাজকে কিছু বলতেও পারছে না। একদম পুতুল হয়ে বসে আছে স্টেজে। আর মিনহাজ সেই সুযোগটাই লুটছে।

আহনাফ একপাশে দাড়িয়ে আছে। হাতে কোল্ড ড্রিংকস। চোখ ঘুরিয়ে বারবার আভাকেই লক্ষ্য করছে ও। নুহাশ এখানে আছে, তারমানে আভা বিপদে। তাই, আভার উপর সর্বদা নজরদারি করছে ও।

— ” হ্যাই ব্রো! ”
আহনাফের পিঠে এক চাপর মেরে বললো নুহাশ। আহনাফ রক্তচুক্ষ নিয়ে তাকালো নুহাশের দিকে। নুহাশ আভার দিকে চেয়ে বলল,
— ” কেনো মিছেমিছে আভার পিছনে পড়ে আছ, ব্র! আভা তোকে ভালবাসে না। ”
আহনাফ নুহাশের দিকে তাকালো। চোখ বেয়ে যেনো লাভা গড়াচ্ছে। রাগ নিয়ে বললো,
— ” আভা আমাকে ভালোবাসলো কি বাসলো না, সেটা তোকে চিন্তা করতে হবে না। যা, নিজের কাজ কর গিয়ে। ”
নুহাশ হাসলো। বাঁকা হাসি। রিলাক্স হয়ে বললো,
— ” একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাক, তাহলে। তুই আজ আভাকে সমুদ্রের তীরে বিয়ের জন্যে প্রপোজ করবি। আভা যদি তোর প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করে তবে বুঝবো তোর প্রতি আভার ফিলিংস আছে।আর যদি না করে, তবে…বুঝিসই তো! ”
আহনাফ জানে আভার উত্তর কি হবে! তাও, নুহাশকে এক শিক্ষা দিতে সে রাজি হলো এই চ্যালেঞ্জ-এ।
‘ শোনো মেয়ে, আজ আমার পছন্দের রঙে সাজো তো! হোটেলের বাইরে তোমার জন্যে গাড়ি রাখা। আমিময় হয়ে টুপ করে সে গাড়িতে উঠে পড়বে। অ্যাই অ্যাম ওয়েটিং! ‘
বেডের উপর রাখা এমন চিরকুট দেখে আভা হতবাক। আজ আভার সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিলো আহনাফকে। কিন্তু, আহনাফ কি করতে চাইছেন? আভা বুঝতে পারছে না। তবে, আভা আর কালবিলম্ব করলো না। সেদিনের আহনাফের পাঠানো কালো রঙের জামদানি, কালো কাঁচের চুড়ি পড়লো। চুলগুলো একটু স্ট্রেট করে ছেড়ে দিলো। ঠোঁটে দিলো, খয়েরী লিপস্টিক! আভা রেডি হয়ে আয়নার দিকে তাকালো। ইশ! ভালোই লাগছে। আহনাফের চয়েজ আছে, বলতে হবে। আভা রেডি হয়ে নিচে নামলো।
নিচে এক গাড়ি রাখা। সাদা গাড়ি কালো রঙের গোলাপে সাজানো। খুব মোহনীয় লাগছে দেখতে। আভা মুচকি হেসে গাড়িতে উঠলো।

গাড়ি থামলো সমুদ্রের কিছুটা দূরে। আভা চারপাশে তাকালো। এখন রাত! তাই, চতুর্দিকে রাতের কালো রঙে ঢাকা। কি অদ্ভুত! আজ আভাও কালো রঙে সেজেছে। আভা গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। হাঁটা ধরবে সামনে, তার আগেই এক মেয়ে এসে থামালো আভাকে। মেয়েটা অত্যন্ত বিনয়ের সহিত বললো,
— ” ম্যাম, স্যারের অর্ডার অনুযায়ী আপনাকে চোখে কাপড় বেধে দিতে হবে। ক্যান আই? ”
আভা কিছুটা অবাক হলেও দিরুক্তি করলো না। বরং, হেসে সম্মতি দিলো। মেয়েটা এক কালো রঙের কাপড় বেধে দিলো আভার চোখে। অতঃপর, আভার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো সামনে।

— ” আমরা পৌঁছে গেছি, ম্যাম। আর ইউ রেডী টু সি? ”
আভা হেসে মাথা নাড়লো। একটু পর হাতের ছোঁয়া পেল আভার মাথার পিছনে। হাতের ছোঁয়া খুব গভীর, স্নিগ্ধ! আভা জানে এটা কার হাত। আভার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। মানুষটা আভার চোখের কাপড় খুলে দিলো। আভা তাকালো ধীরে ধীরে।
আভা অবাক! যতটা অবাক হলে, দুনিয়া ভুলে যাওয়া যায় ততটাই অবাক আভা। আভার সামনে রাখা অসংখ্য মোমবাতি। সমুদ্রের তীরে যেনো আজ মোমবাতির রাজত্ব! আভার সামনে মোমবাতির দিয়ে লেখা ‘ AVANAF ‘। আভা খুশিতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো। চমকে তাকালো পাশের মানুষটার দিকে। আহনাফ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আভার দিকে। আভা কাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” এসব আমার জন্যে? ”
আহনাফ আভার গাল টেনে দিয়ে হেসে বললো,
— ” উহু, আমাদের জন্যে! ”
আভা হেসে ফেললো। আহনাফ আভার এক হাত নিজের হাতর মুঠোয় পুড়ল। আভা সেদিকে তাকালে আহনাফ বললো,
— ” আরো বাকি, ম্যাডাম। এখনই এত অবাক হলে চলে? চলুন, সামনে যাওয়া যাক! ”
আভা হেসে পা বাড়ালো আহনাফের সাথে।

আভা ও আহনাফ এসে থামলো এক জায়গায়। সে জায়গায় শুধু লাভ শেপের অনেকগুলো বেলুন। আভা অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ বললো,
— ” কোথাও যেন শুনেছি, বেলুন ফোটানো তোমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। সো, হেয়ার ইউ গো! ”
আভা একপলক আহনাফের দিকে তাকালো। চোখে জল জমছে তার। মানুষটা এত ভালো কেনো? আহনাফ আভার চোখে জল দেখে আঙ্গুল দিয়ে খুব যত্নসহকারে জল মুছে দিলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” আজ কোনো কান্না না। ওনলি এই মোমেন্টটাকে এনজয় করো। ”
আভা আহনাফের চোখের দিকে খানিক তাকালো। কিন্তু, সবসময়ের মত এবারও আহনাফের ওমন নেশালো চোখে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরালো। এগিয়ে গেলো সামনে।
ঠুস, ঠুস, ঠুস। বেলুন ফুটানোর আওয়াজে মুখরিত সমুদ্রের তীর। আহনাফ দুর থেকে আভার একেকটা উচ্ছল কাজ দেখছে। আজ ও নিজেও অনেক খুশি। একসময় আভা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো মাটিতে। আহনাফ এগিয়ে গেলো। নিজেও আভার মাটিতে বসলো না। সোজা শুয়ে পড়লো। সমুদ্রের তীরের মাটি একদম ঠান্ডা। আর রাতের বেলায় তো হিম জমে। আহনাফকে শুইয়ে থাকতে দেখে আভা নিজেও শুয়ে পড়লো আহনাফের পাশে। আহনাফ আকাশের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
— ” আজ আমাবস্যার রাত, জানো? ”
আভা মাথা নাড়লো। যার অর্থ, জানে সে। আহনাফ ঘাড় হালকা কাত করে আভার দিকে তাকালো। আভার দিকে মোহময় চোখে চেয়ে বলল,
— ” আজ আকাশের রংও কালো, রাতের রঙও কালো।আর আমার পাশে আমার কালো হুরপরী। এর চেয়ে বেস্ট ফিলিংস আর হতেই পারে না। ”
আভা লজ্জা পেলো। আহনাফ আবারও আকাশের দিকে তাকালো। আভা কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারে না। বারবার, সংকোচরা তাকে আটকে নেয়। কিন্তু না। এবার ও বলবেই। মনের কথা বলতে লজ্জা কিসের? আভা আকাশের দিকে তাকালো। সমস্ত সংকোচ, জড়তার সুতো ছিন্নভিন্ন করে নরম কণ্ঠে বলল,
— ” একটা কথা বলি।
— ” হুম, বলো। ”
আভা এক ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। আহনাফের দিকে ফিরে তাকালো। আহনাফ নিজেও আভার দিকে তাকালে আভা বলে উঠলো,
— ” ভা.ভা.ভালোবাসি আপনাকে। ”
আহনাফের কানে আভার বলা কথাটা প্রবেশ করতেই সে যেন হাজার ভোল্টেজে কেপে উঠলো। তার কান ঠিক শুনলো তো? আহনাফ চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। নিস্পলক চোখে চেয়ে আছে আভার দিকে। আভা আহনাফের ওমন তাকানো দেখে চোখ নামালো। আহনাফের বিস্ময়ভরা চাওনি তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহনাফ একলাফে উঠে বসলো। কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আরেকবার বলো ত? ”
আভা আরো একবার বলল,
— ” ভা.ভালোবাসি! ”
— ” ওয়ান্স মোর, প্লিজ! ”
— ” অ্যাই লাভ ইউ, মিস্টার রাগিনাফ! ”
আভার কণ্ঠ এবার আর কাঁপলো না। ভালোবাসার মানুষকে নিজের অনুভূতি জানাতে এত সংকোচ কিসের? নাহ! কোনো সংকোচ থাকতে নেই। আহনাফের চোখ থেকে এখনো অবাকের রেশ দুর হয়নি। আজ সে স্বার্থক! তার বউফ্রেন্ড তাকে ভালবাসি বলেছে, আর কি চাই তার? আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। আহনাফকে দাঁড়াতে দেখে আভা নিজেও দাঁড়ালো।
আহনাফ সমুদ্রে নামলো। হাঁটু অব্দি পা ভিজিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আভা এখনো আহনাফের এমন অদ্ভুত কাজের কারন বুঝতে পারছে না। বোকার মত তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফ আকাশের দিকে চেয়ে আভার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” থ্যাংক ইউ, বউফ্রেন্ড! আমার জীবনে আসার জন্যে। থ্যাঙ্ক ইউ, ফর লাভিং মি। অ্যান্ড থ্যাংক ইউ ফরেভার, ফর বিং উইথ মি হামেশা, হামেশা! ”
আভা হাসলো। পাগল একটা!
সমুদ্রের পানি দুজনের হাঁটু অব্দি ভাসমান। হঠাৎ আহনাফ আভার দিকে তাকালো। তার চোখে যেনো আকাশ সমান আদর! আভা ডুবে যাচ্ছে আহনাফের ওমন চাওনিতে। তবুও, অন্যদিনের মত চোখ সরালো না। তাকিয়েই রইলো! আহনাফ আভাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আভা কেঁপে উঠলো খানিক। আহনাফ বললো,
— ” আকাশের দিকে তাকাও আর আমার কথা শুনো।মন দিয়ে শুনবে। ”
আভা মাথা নেড়ে সায় দিলো। আহনার বলতে শুরু করলো,
— ” জানো, আমি সবসময় ভালোবাসা মানে বুঝতাম, শুধুমাত্র মা-বাবার ভালোবাসা। আর সব ভালোবাসা আমার কাছে মিথ্যে, স্বার্থের ছিলো। কিন্তু, তোমাকে দেখার পর আমার সেসব চিন্তা নির্মূল হয়ে গেলো। বারবার মনে হচ্ছিল, এই মেয়েকে নিজের সাথেই না বাঁধতে পারলে আমি নিঃশেষ! আমার ধংস নিশ্চিত। আজ দেখো, তুমি আমার সামনে। আমার একান্ত নারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। বিয়ের জন্যে অবশ্য আরো তিন বছর বাকি আছে। তবুও আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, উইল ইউ ম্যারি মি, মিস বউফ্রেন্ড?”

আভা বিয়ের কথা শুনে হেসে উঠলো। খিলখিলিয়ে হাসি। আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
— ” আপনি আমার আসক্তি, মিস্টার রাগিনাফ। আর আসক্তিকে কখনোই দূরে রাখতে নেই। ভয় হয় যে। তাই কাছে রাখার জন্যে বিয়ে ত করতেই হবে। তাইনা? ”
আভার উত্তর শুনে আহনাফের মনটা খুশিতে যেনো নেচে উঠলো।

— ” সরি ফর ডিস্ট্রাবিং, গাইস! ”
পিছন থেকে নুহাশের কথা শুনে আভা এক ছিটকে আহনাফের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। আহনাফ নিজেও এতে বিরক্ত হলো। নুহাশ এগিয়ে এলো ওদের দিকে।
আহনাফ রাগ নিয়ে বললো,
— ” তুই এখানে? ”
নুহাশ উত্তর করলো,
— ” তোর একবারও মনে হয়নি যে সবকিছু এত সহজ কি করে হয়ে যাচ্ছে? মানে তুই কি করে এত সহজে আভাকে পেয়ে গেলি, হাও ইজ ইট পসিবল? ”
আহনাফ আভার দিকে তাকালো। আভা প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে নুহাশের দিকে। আহনাফ বললো,
— ” আভা সবসময় আমারই ছিলো। তাই ভয় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। গেট ইট? ”
— ” আভা তোরই ছিল, সেটাই তোর জন্যে প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু এসবের মাঝখানে একটা টুইস্ট আছে, বস। ”
— ” মানে? ”
— ” আমি এত সহজে হার মানার ছেলে নই সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। কিন্তু, আমি নিজে থেকেই তোদের থেকে দূরে সরে গেছি, আহনাফ। ”
— ” যা বলবি সোজাসুজি বল। টাইম ওয়েস্ট করিস না আমার। ”
নুহাশ এক নিঃশ্বাস ফেললো। ভারী নিঃশ্বাস! অতঃপর আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
— ” ওয়ান্স অপন অ্যা টাইম, আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। কিন্তু আমার হিংসা, আর জেদ আমাদের দুজনকে শত্রু বামনিয়ে ফেললো। তুই আমার সাথে শত্রুর মত ব্যাবহার করলেও আমি সেদিন জানলাম আমি তোর জন্যে কি ছিলাম। মনে আছে সেই রাতের পার্টির কথা। নিউ ইয়ারের পার্টি? সেদিন তোর সামনে আমার নামে কজন খারাপ কথা বলেছিল। আমি তখন ছিলাম না ঠিকই। কিন্তু তুই? তুই ওদের কি বলেছিলি, ‘ ও আমার শত্রু ঠিকই, কিন্তু আমি আগে যেমন আছে ওর নামে কোনো বাজে কথা সহ্য করিনি, এবারও করবো না। বেস্ট ফ্রেন্ড হয় ও আমার। ফারদার, ওকে অপমান করে কথা বললে তোদের জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। ‘ বিশ্বাস কর দোস্ত! আমি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারিনি। আমারই দোষ ছিল। তোকে চিনতে পারি নি। তাই প্রতিদান স্বরূপ, আভার পিছু আমি ছেড়ে দিয়েছি। যা, আভাকে নিয়ে জমিয়ে প্রেম কর। বেস্ট অফ লাক, বোথ অফ ইউ! ”

এতক্ষণ এত সব কথা শুনে আভা হতবাক। ওর পিছন পিছন এত কিছু হয়ে গেছে, আর সেটা ও জানেই না। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নুহাশের দিকে। নুহাশ চোখের জল আঙ্গুল দিয়ে মুছে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” ওকে, বাই দেন। এনজয়! ”
নুহাশ পা বাড়ালো সামনে।
— ” নুহাশ? ”
হঠাৎ পিছন থেকে আহনাফের কণ্ঠ শুনে নুহাশ থেমে গেলো। আহনাফ দৌঁড়ে গেলো নুহাশের দিকে। নুহাশ ভ্রু কুচকে আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ আচমকা জড়িয়ে ধরলো নুহাশকে। নুহাশ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। একসময় আহনাফ বললো,
— ” সরি রে! ”
এক শব্দ শুনে নুহাশের কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল। মুচকি হেসে নিজেও জড়িয়ে ধরলো আহনাফকে। বললো,
— ” আমিও ডাবল, ট্রিপল সরি। ”

দূর থেকে দুজন বন্ধুর এমন মিলন দেখে নিজের অজান্তেই আভার চোখ ভিজে এলো। তবে, সে আঙ্গুল দিয়ে জলটুকু মুছে নিয়ে ঝাপসা চোখে তাকালো ওদের দিকে। সব বন্ধুত্ব চির অম্লান থাকুক, আজীবন সজীব থাকুক। আমিন!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here