‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
দেবাংশু নিজের ফার্ম হাউজে বার সাইডের টেবিলে মাথা নীচু করে বসে আছে হাতে একটা ড্রিংকের গ্লাস। একটা সময় সে উঠে বসে ড্রিংকের গ্লাসটা হাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
দেবাংশু: (মনে মনে — আমি আজ দুইবার ওর সাথে কথা বলতে গেলাম আর দুইবারই ও এমন কিছু বললো যে আমি আর কিছু বলতেই পারলাম না। বলবোই বা কীভাবে কাজটাই এমন করেছি আমি।)
নিজের উপর বিরক্ত হয়ে দেবাংশু হাতের কাছে থাকা মদের বোতলটা ভেঙে ফেললো। ভাঙা কাঁচের অংশ কিছুটা দেবাংশু হাতে ধরে রইলো আর বাকিটা মেঝেতে পরে গেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেবাংশুর বার বার নিজের অতীতটা মনে পরছে এবং তারপরেই ওর এটা মনে পরছে এই অতীতের জন্যেই দেবাংশু খারাপ, বলা ভালো জঘন্য কিছু কথা দিয়ারাকে বলেছে। যাঁর চোখে জল দেখতে দেবাংশুর ভালো লাগে না তাঁকেই দেবাংশু কাঁদিয়েছে। ধীরে ধীরে দিয়ারার অর্জুনের সাথে থাকার দৃশ্যগুলো দেবাংশুর চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। এবার ওর মনে পরে ওর সাথে থাকলে দিয়ারা চুপচাপ থাকে অপরদিকে মনে পরে অর্জুনের সাথে থাকলে দিয়ারা হাসে। পরক্ষণে দেবাংশুর মনে পরে ও দিয়ারাকে কাঁদিয়েছে আর অর্জুন দিয়ারাকে সবসময় খুশি রাখে।
দেবাংশু: আমি যেই কথাগুলো ও’কে বলেছি সেটা আমার জায়গায় অর্জুন থাকলে কখনও ও’কে বলত না। ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলেছি আমি। এইজন্যই হয়তো দিয়ার আমার সাথে থাকতে ভালো লাগতো না। ঠিকই করেছে ও, অর্জুন ওর জন্য একদম পারফেক্ট। অনেক ভালো রাখবে ও দিয়াকে। আর আমি তো সেটাই চাই, আমি ও ভালো থাকুক। যেটা আমার সাথে থাকলে ও থাকে না, খারাপ থাকে ও। ঠিক করেছে দিয়া, এইবার আমিও একটা ঠিক কাজ করবো। ওর চোখের সামনে যাতে জীবনে ভুল করেও আমাকে না আসতে হয় সেই ব্যবস্থাটাই করতে হবে আমায়। আমি তো ভুল করিনি যে আমাকে ক্ষমা করে দেবে, অপরাধ করেছি। একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলেছি, তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত করেছি। আমার মুখ নেই ওর সামনে দাঁড়ানোর তাই যাতে ওর সামনে আমার যেতে ইচ্ছা না হয় সেই ব্যবস্থা করবো আমি। আমি যাতে ওর সামনে যাওয়ার যোগ্যই না থাকি সেই ব্য…
__দেবববব!!
নিজের নামের চিৎকার শুনে দেব জানো বাস্তবে ফিরে এলো আর ওর হাত থেকে সঙ্গে সঙ্গে বোতলটার ভাঙা অংশটা পরে গেলো। দেবাংশু সামনে তাকিয়ে দেখলো সিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে।
দেবাংশু: সিয়া তুই এখানে কি..?
সিয়ারা: পাগল হয়ে গেছিস তুই? কি করছিলি কোনো খেয়াল আছে? তাকিয়ে দেখ কতোটা কেটে গেছে হাতটা। রক্ত বেরোচ্ছে দেব! (দেবাংশুর হাতটা ধরে)
সিয়ারার কথা অনুযায়ী নিজের হাতের দিকে তাকাতেই দেবাংশু দেখলো সত্যি তাঁর হাতের কব্জির কাছে শিরার জায়গায় অনেকটা কেটে গেছে। হয়তো আঘাতটা গভীর হয়নি তবে রক্ত ভালোই বের হচ্ছে। যখন দেবাংশুর মাথায় ভাবনাগুলো চলছিলো তখনই হাতে থাকা কাঁচের বোতলের ভাঙা ধারালো অংশটা দেবাংশু নিজের কব্জির কাছে শিরার উপরে রাখে। ধীরে ধীরে চাপটা গভীর হতে শুরু করে, যদি আরেকটু গভীর হতো দেবাংশু কাঁচে টান দিতো তাহলে হয়তো একটা অঘটন সত্যি ঘটে যেতো। দেবাংশু যে নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়েই অঘটনটা ঘটিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলো এটা বুঝতে ওর আর বাকি রইলো না।
সিয়ারা: কি করতে যাচ্ছিলিস তুই দেব? আরেকটু দেরী হলেই কত বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে যেত বল তো? পাগল হয়ে গেছিস তুই? বিষয় এতো দূর গড়িয়ে গেছে যে নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছিলি তুই? (উত্তেজিত হয়ে)
দেবাংশু: সিয়া রিল্যাক্স। তেমন কিছুই না। আমি নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছিলাম না।
সিয়ারা: ওহ আচ্ছা তাই? তাহলে এটা কীভাবে হলো হ্যাঁ? কতটা কেটে গেছে দেখেছিস? না জানি কতোটা গভীর ক্ষতটা…
দেবাংশু: অনেকটা গভীর। (আনমনে)
সিয়ারা: তাহলে তো আমাদের ডক্টর ডাকা উচিত। আমি এক্ষুনি কল করছি ওয়েট।
দেবাংশু: (তারাহুরো করে সিয়াকে আটকে) আর সিয়া রিল্যাক্স। তোকে বললাম তো তেমন কিছুই হয়নি। একেই এই জায়গার স্কিন পাতলা হয় আর তাঁর মধ্যে ধারালো কাঁচ ছিলো তাই একটু চাপ দিতেই কেটে গেছে।
সিয়ারা: এই তো বললি অনেক গভীর ক্ষতটা। মজা করছিস তুই আমার সাথে?
দেবাংশু: (অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে) আব..আব, আরে আমি বলছিলাম কাঁচটা আমি অনেকটাই জোর দিয়ে গভীর ভাবে চাপ দিয়েছিলাম তাই এতটা রক্ত বের হচ্ছে। তাছাড়া কাঁচে চামড়া কাটতে সময় লাগে না সেখানে এটা ধারালো কাঁচ ছিলো তাই সহজেই কেটে গেছে। ক্ষতটা যদি খুব গভীর হতো তাহলে তো শিরা কেটে যেত আর এতক্ষণে আমি সেন্সলেস হয়ে যেতাম। সেটা কি হয়েছে? অযথা এতো চিন্তা করছিস। পাগলি একটা! (হালকা হেসে)
সিয়ার আর কিছু না বলে চলে গেলে দেবাংশু বুঝতে পারলো ও ফার্স্ট এইড বক্স আনতে গেছে। তাচ্ছিল্য হেসে দেবাংশু নিজের জায়গায় বসে। ভাবে, “সব ক্ষতের, সব যন্ত্রণার ওষুধ ফার্স্ট এইড বক্স বা ডক্টরের কাছে থাকে না। কিছু ক্ষত, যন্ত্রণার ওষুধ মানুষও হয়। তফাৎ একটাই, নামের! একটা শারীরিক আর একটা মানসিক!”
সিয়ারা: কি হয়েছে তোর? সত্যি করে বল আমায়। (ওষুধ লাগাতে লাগাতে)
দেবাংশু: (মনে মনে — দিয়াকে হারিয়ে ফেলেছি, এখন তোকে যদি সবটা বলি তাহলে যাঁরা আমার কাছে বাকি আছে তাঁদের সবাইকে হারিয়ে ফেলবো। তবে সত্যিটা আমি বলবো, নিশ্চয় বলবো।) তেমন কিছু না। কি আবার হবে আমার? (মিথ্যে হেসে)
সিয়ারা: আমার থেকে লুকানোর চেষ্টা করিস না দেব। কিছু যদি না’ই হতো তাহলে তোর এরকম অবস্থা হতো না। যে কেউ বুঝে যাবে তোর কিছু একটা হয়েছে সেখানে তো আমি তোর বন্ধু। চুপচাপ বল, কি হয়েছে?
দেবাংশু: বললাম তো কিছু হয়নি আমার। কি এমন অবস্থা দেখতে পাচ্ছিস তুই আবার? (অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে)
সিয়ারা দেবাংশুর পাশে একটা চেয়ারে বসে বললো,
সিয়ারা: আচ্ছা? তাহলে ড্রিংক, স্মোক কেন করছিস তুই? এসবের নেশা কবে থেকে হলো তোর আবার? ছেড়ে দিয়েছিলিস না তুই অনেক বছর আগে এসব? যেই ছেলেটা কখনও কোনো কিছু নিয়ে মাথাই ঘামায়নি, কোনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস হয়ে ভাবেইনি তেমন সে আজ ভাবনার জগতে এতটাই মগ্ন ছিলো যে নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছিলো। তার মানে এমন কিছুই…
দেবাংশু: না না। তেমন কিছু কেন ভাববো? আমি তো..
সিয়ারা: আবার মিথ্যে বলছিস তুই আমাকে? আমি খুব ভালো ভাবেই জানি বিষয়টা দিয়াকে নিয়ে।
দেবাংশু চমকে ওঠে সিয়ারার কথায়। দিয়ারা যে ও’কে কিছু বলেনি সেটা দেবাংশু বুঝে গেছে কারণ যদি বলতো তাহলে হয়তো সিয়ারা ও’কে এসে বাঁচিয়ে এতো ভালো ভাবে কথা বলত না। দেবাংশু আর না পেরে বললো,
দেবাংশু: আমি, আমি অনেক বড়ো একটা অপরাধ করে ফেলেছি। (মাথা নীচু করে)
সিয়ারা: (মনে মনে — এমন কি করেছে দেব যে, ভুল বা অন্যায় না বলে অপরাধ বলছে?) কি করেছিস?
দেবাংশু: দিয়ার ফীলিংস, ইমোশান কে মিসটেক বলেছি। খেলেছি। না জেনে বুঝে ও’কে অসন্মান করেছি। … কিন্তু বিশ্বাস কর আমার এমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমি বুঝতে পারিনি দিয়া আমাকে ভালোবাসে। ও তো ওই অর্জুনের সাথে সারাক্ষণ ভালো ভাবে কথা বলে, ওর নাম শুনলেই ওর মুখে আপনাআপনি হাসি চলে আসে। এদিকে আমার সাথে? আমার সাথে সবসময় চুপচাপ। তাছাড়া তুই তো জানিস? আমি এসবে বিশ্বাসী নই, আমি ও’কে এটা জানাতে পারিনি।
সিয়ারা দেবাংশুয়ে শেষের কথায় কর্ণপাত করলো না। ওর কানে শুধু অর্জুনকে নিয়ে কথাগুলোই বাজতে লাগলো। দেবাংশু ঠিক কতটা রেগে, উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলেছে সেটা সিয়ারা বুঝতে পেরেছে। কই প্রথমে কথা শুরুর সময় তো এভাবে কথা বলছিল না দেবাংশু। দেবাংশুর কথার ধরণ ঠিক কি অর্থ বহন করে তা সিয়ারার ভালো ভাবে জানা কারণ সে নিজেও একসময় একজনের থেকে এরকম ব্যবহার পেয়েছে এবং এখনও পায়।
সিয়ারা: ওহ তুই যখন জানতে পেরেছিস দিয়া তোকে ভালোবাসে তখন থেকেই তোর অর্জুনকে নিয়ে প্রবলেম তাই তো?
দেবাংশু: না! তার আগে থেকেই। দিয়ার অর্জুনকে নিয়ে আগে থেকেই মাতামাতি। দার্জিলিংয়ে তুই দেখিসনি ভিকি ওর নাম নিতেই কীভাবে ব্লাশ করছিলো? ডিসগাস্টিং! আর তারপর সেদিন যখন আমি ও’কে বললাম আমার সাথে থাকতে ও কি বললো? ওর নাকি শরীর ভালো লাগছে না বাড়ি যাবে। এদিকে দেখি উনি অর্জুনের সাথে ক্লাবে চলে গেছেন। হাসছেন, নাচ করছেন। আমার সাথে থাকার বেলাই শরীর ভালো না। (ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে নিতে)
সিয়ারা বুঝতে পারল দেবাংশু ধীরে ধীরে রেগে যাচ্ছে, উত্তেজিত হয়ে পরছে। অর্থাৎ তাঁর তীরটা সে সঠিক নিশানাতেই মেরেছে।
সিয়ারা: আচ্ছা, তাহলে দিয়া শুধু অর্জুনের সাথে ভালো ভাবে কথা বলে কিন্তু তোর সাথে ভালো কথা বলে না সেইজন্য তুই রেগে ছিলি তাই আজে বাজে কথা বলে দিয়েছিস ও’কে?
দেবাংশু: না, শুধু অর্জুন কেন? আমি বাদে সকলের সাথে ওর কথা বলতে ভালো লাগে। দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পথে তো ওই অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর টা ও’কে খারাপ নজরে দেখছিলো সেটারও কোনো প্রতিবাদ করেনি। বরং ও নিজেও ওনার দিকে তাকাচ্ছিলো মাঝে মধ্যেই। কিন্তু আমার বেলায়? আমার দিকে একবারও ঘুরেও তাকায় না।
সিয়ারা: আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু তোর এতে কেন এত রাগ হচ্ছে? দিয়া তোর দিকে তাকাক না তাকাক, তোর সাথে ভালো ভাবে কথা বলুক না বলুক তাতে তোর কি যায় আসে দেব?
দেবাংশু: আমার যায় আসে সিয়া! আমার যায় আসে। (জোর দিয়ে) আমার ভালো লাগে যখন দিয়া আমার সাথে থাকে। ওর সাথে থাকলে আমি সবকিছুর থেকে ডিটাচড হয়ে স্ট্রেস ফ্রি হয়ে যাই। ওর কথা শুনতে, ও’কে হাসাতে, ওর সবকিছুকে, ও’কে ভালো লাগে আমার, ভালো রাখতে মন চায় আমার। আর আমিও ভালো থাকি ওর সাথে, আমার নিজের সবকিছু ওর সাথে শেয়ার করতে মন চায় কিন্তু ও? সবসময় আমার থেকে পালিয়ে বেড়ায়। এটা খুব কষ্ট দেয় আমাকে, ও বোঝে সেটা? কখনও বোঝেনি। ওর নাকি ইচ্ছাই করে না আমার সাথে থাকতে, এদিকে নাকি আমাকে ভালোবাসে। (অভিমানের সুরে)
সিয়ারা: এইসব কিছুই তোর রাগের কারণ তাই তো?
দেবাংশু: আমি যখন ও’কে ওসব বলেছি তখন শুধু আমার মাথায় ওর অর্জুনের সাথে ক্লোজ হওয়ার দৃশ্যটা মাথায় আসছিলো…আমার অতীতের দৃশ্যগুলোর পর।
সিয়ারা চমকে উঠলো যখন দেবাংশু একটু থামার পর কথাটা বললো। সিয়ারা উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো,
সিয়ারা: কতোটা ক্লোজ ছিলো দিয়া অর্জুনের?
দেবাংশু: প্রথমে তো ফাস্ট যেদিন পার্টিতে আমি দিয়াকে দেখেছিলাম সেদিনই আমি ও’কে অর্জুনের সাথে ক্লোজ ভাবে কথা বলে একটা ঘরের দিকে যেতে দেখেছিলাম। সারা শরীর জ্বলে গেছিলো বিশ্বাস কর। তারপর যখন ব্যাপারটা একটু ভুললাম তখন বারে ওদেরকে ক্লোজ হয়ে ড্যান্স করতে দেখলাম। (উঠে দাঁড়িয়ে পরলো) সাহস হয় কি করে অর্জুনের দিয়ার এতো কাছে যাওয়ার? কে ও’কে এই অধিকার দিয়েছে হ্যাঁ? পারলে ওখানেই শেষ করে দিতাম ওই অর্জুনকে আমি।
সিয়ারা: দিয়া অর্জুনের সাথে ক্লোজ না হয়ে যদি অন্য কোনো ছেলের সাথে ক্লোজ হতো তাহলে তুই মেনে নিতি?
দেবাংশু: নেভার!! (জোর দিয়ে) কাওর কোনো অধিকার নেই দিয়াকে স্পর্শ করার। কোন সাহসে, কোন অধিকারে দিয়াকে স্পর্শ করবে অন্য কে…
সিয়ারা: তুই কোন অধিকারে এই কথাটা বলছিস দেব? অন্য কোনো ছেলের স্পর্শ করার অধিকার আছে না আছে সেটা দিয়া ঠিক করবে। তুই কে হোস দিয়ার? কি হিসেবে তুই এত অধিকার বোধ দেখাচ্ছিস ওর উপর? অন্য কোনো ছেলের যদি অধিকার না থাকে তোর কি অধিকার আছে দিয়ার উপর? তোরও কোনো অধিকার নেই দেব।
সিয়ারা দাঁড়িয়ে কথাটা বলতেই দেবাংশু দমে গেলো। পিছিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে পরলো কারণ ওর মনে পরে গেছে ঠিক এভাবেই দিয়ারা ও’কে বলেছিলো, “কিসের এত অধিকার বোধ দেখাচ্ছো তুমি আমার উপর? কোনো অধিকার নেই আমার উপর তোমার বুঝেছো?” দেবাংশুর চোখটা জলে ভরে উঠে, জল গাল গড়িয়ে পরে। যা দেখে সিয়ারা অবাক তো হয়, সাথে ওর চোখেও জল চলে আসে।
সিয়ারা: আর কতদিন এভাবে নিজের অনুভূতিকে অস্বীকার করবি দেব? (দেবাংশুর কাঁধে হাত রেখে)
দেবাংশু সিয়ারার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালে সিয়ারা দেবাংশুর চোখের জলটা নিজের আঙুল দিয়ে মুছে দেয়।
সিয়ারা: তোর আর দিয়ার মাঝে ঠিক কি কথা হয়েছে তা আমি জানি না দেব। তুই ও’কে কি বলেছিস সেটাও জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি তুই যা করেছিস তার জন্য তুই অনুতপ্ত। নিজের অনুভূতি না বুঝেই তুই হঠকারিতার বশে ভুল করেছিস, অপরাধ নয়। অপরাধ মানুষ জেনে বুঝে করে, তুই জেনে বুঝে করিসনি। আজ যদি তুই দিয়ার প্রতি তোর কি অনুভূতি সেটা বুঝতে পারতিস তাহলে হয়তো ওরকম খারাপ কিছু বলতে গেলে ভাবতিস। তাছাড়া, তোর অতীত তোর উপর প্রভাব ফেলেছে সেই অতীতের কারণেই প্রভাবিত হয়ে তুই খারাপ কিছু বলে ফেলেছিস। এটা অপরাধ নয় দেব, এটা ভুল।
দেবাংশু: আমি ও’কে হারিয়ে ফেলেছি সিয়া। ও আর কখনও আমাকে দেখতে চাইবে না, আমার সাথে কথা বলতে চাইবে না। স..সব শেষ, সব শ..শেষ হয়ে গেছে আমার।
কথা জড়িয়ে যাচ্ছে দেবাংশুর। একটা ঢোক গিলে নিজের কষ্টটা জানো গিলে নিলো সে। সিয়ারা চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস নিয়ে নিলো। তারপর চোখ খুলে বললো,
সিয়ারা: এখনও কিচ্ছু শেষ হয়নি দেব। তুই চাইলেই হয়তো সবটা ঠিক হয়ে যাবে। একটু নিজের অনুভূতিটা বোঝার চেষ্টা কর তুই। কেন তোর দিয়ার সাথে থাকতে ভালো লাগে? কেন তুই ওকে ভালো রাখতে চাস? কেন ও’কে অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখলে তুই সহ্য করতে পারিসনা? আগেও তো তুই অনেক মেয়েকে অন্য ছেলের সাথে ঘুরতে, মিশতে দেখেছিস তোর সাথে কথা বলাকালীন। কই তখন তো তোর এত রাগ হয়নি? বরং আমাকে এসে মজা করে কথাগুলো বলতিস, যায় আসতো না তোর। তাহলে দিয়ার ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম? ওই মেয়েগুলোর বেলায় কি তোর অতীত ছিলো না নাকি? ছিলো তো?
দেবাংশু: (হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো)
সিয়ারা: তাহলে কেন দিয়াকে অন্য ছেলের ক্লোজ হতে দেখেই তোর এত রাগ হলো, এতো খারাপ লাগলো যে তুই ওকে খারাপ কথা শুনিয়ে দিলি? অন্য কোনো মেয়েকে তো তুই কথা শুনাসনি? কারণটা কি দেব? জানিস তুই?
দেবাংশু: না, আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। (দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে)
সিয়ারা: কারণটা হলো তুই দিয়াকে হারানোর ভয় পাস দেব। একটু আগেই তুই বললি সেটা, যে তুই দিয়াকে হারিয়ে ফেলেছিস। অতীতে যেই কষ্টটা তুই পেয়েছিস সেই কষ্টটা তুই দিয়ার থেকে পেতে চাসনি। তাই অতীত পুনরাবত্তি হচ্ছে এটা তুই মেনে নিতে পারিসনি, ভয় পেয়েছিস তুই। সেই ভয়ে, রাগে, কষ্টে তুই ও’কে খারাপ কিছু বলেছিস।
দেবাংশু তৎক্ষণাৎ সিয়ারার দিকে তাকালো হতবাক হয়ে কারণ ও বুঝতে পারলো ওর নিজের অবচেতন মনের কথাটাই সিয়ারা ওকে বলে দিলো যেটা এতক্ষণ ওর মনে ঘুরতে থাকলেও সেটাকে ও সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারছিলো না। এই কথাটাই ওর মনে হচ্ছিলো কিন্তু কোনো ভাবনার রূপ পাচ্ছিলো না। এই কথাটা, এই কথাটাই দিয়ার বিষয়টা অন্যান্য মেয়েদের থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। দেবাংশু আবার মাথাটা নীচু করে নিলে সিয়ারা আবারও বলে ওঠে,
সিয়ারা: কিছুক্ষণ আগে তুই কি বললি? “সব শেষ” কেন বললি দেব? দিয়া তোর জীবনে না থাকলে, তোর সাথে না কথা বললে কেন তোর সব শেষ হয়ে যাবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর একটাই! সেটা তুই নিজে খুঁজবি।
দেবাংশু সিয়ারার কথা শেষ হলে ওর দিকে তাকিয়ে আবার নীচের দিকে তাকালে সিয়ারা দেবাংশুর বুকের মধ্যে আঙুল রেখে বললো,
সিয়ারা: তোর এখানে যেই যন্ত্রণাটা হচ্ছে না? সেটার ওষুধ একজনের কাছেই আছে দেব। সময় থাকতে নিজের অনুভূতিটা বোঝ নাহলে দেব থেকে দেবদাস হতে সময় লাগবে না।
সিয়ারা আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে মেইন গেটের দিকে হাঁটা ধরলো আর বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
সিয়ারা আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে মেইন গেটের দিকে হাঁটা ধরলো আর বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। বেরিয়ে একটা বড়ো নিশ্বাস ছাড়ল সে। এমনি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে নিজের গাড়ির কাছে চলে গেলো। গাড়িতে উঠবে এমন সময় সিকিউরিটি গার্ড সিয়ারাকে জিজ্ঞেস করলো,
__সিয়া মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
সিয়ারা: হ্যাঁ কাকা বলো না। কেমন আছো তুমি?
__আমি ভালো আছি। কিন্তু দেব বাবা কি ভালো আছে? না কয়েকদিন ধরে দেখছি কেমন উদাসীন হয়ে রয়েছেন, নেশা করছেন। আগে তো কখনও এভাবে দেখিনি ওনাকে। তারপর সেদিন তো একজন ম্যাডামও এসেছিলেন, অনেকটা আপনার মত দেখতে।
সিয়ারা: (অবাক হয়ে) আমার মত দেখতে? আচ্ছা সে কি কিছুদিন আগে এসেছিলো?
__হ্যাঁ। দেব বাবা অনেক রেগে, নেশায় এখানে ফিরেছিলেন। তারপরেই উনি এসেছিলেন আর..
সিয়ারা: আর?
__ইয়ে মানে…(ইতস্তত বোধ করে)…উনি সেদিন রাতটা হয়তো দেব বাবার সাথেই ছিলেন।
সিয়ারা তৎক্ষণাৎ নিজের ফোন বার করে গ্যালারি থেকে একটা ছবি খুলে সেটা ওনাকে দেখায় আর জিজ্ঞেস করে,
সিয়ারা: দেখতো কাকা, এটা কি সেই ম্যাডাম যাঁর কথা তুমি বলছো? (ভয়ে ভয়ে)
__(কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে) হ্যাঁ। এটা তো সেই ম্যাডাম। কেয়ারটেকার আমাকে বললো দেব বাবা নাকি অনেক রেগে ছিলেন তাই নিজের ঘরে গিয়ে ভাঙচুর শুরু করেন। সেই আওয়াজ শুনে ম্যাডাম উপরে যেতে গেলে ও বাঁধা দেয় কিন্তু ম্যাডাম সাহস করে ওর ঘরে যায়। তারপর থেকে ভাঙচুর করার আওয়াজ আসেনি। সত্যি আমার মনে হয় ওই ম্যাডাম আমাদের দেব বাবাকে সামলাতে পারবেন। এর আগে তো কখনো দেব বাবার সাথে অন্য মেয়েকে আসতে দেখিনি।
সিয়ারা: তুমি যেই ম্যাডামের কথা বলছো সে আমার বোন হয় কাকা। দিয়ারা, দিয়ারা সান্যাল।
__সে কি? ওই জন্যেই তোমাদের মুখের মিল আছে?
সিয়ারা: (হালকা হেসে) হ্যাঁ। এক বাবার মেয়ে, মুখের মিল তো থাকবেই তাই না? আচ্ছা আজ আমি আসি বুঝলে অনেক রাত হলো।
__হ্যাঁ মা, সাবধানে যেও।
সিয়ারা সরে আসে ওখান থেকে নিজের ফোন ভাইব্রেট হতে শুরু করলে। সরে এসে দেখে আধভিক ফোন করেছে। সিয়ারা মনে মনে একটা ঢোক গেলে কারণ সে জানে তাঁকে এখন অনেক কিছু শুনতে হবে।
সিয়ারা: হ্যাঁ, বলো।
আধভিক: ফাইনালি আমার কল রিসিভ করার সময় হলো তোমার। আমি তো ভেবেছিলাম এইবারও রিং হয়ে যাবে কারণ তুমি তো এখন ভীষণ ব্যস্ত! (শান্ত ভাবে, টিজ করে)
সিয়ারা: (চোখ বুজে, জিভ কেটে) বিশ্বাস করো ফোনটা সাইলেন্ট ছিলো। জেনারেল মোড করতে ভুলেই গেছিলাম আমি। সরি!
আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) আমাকে একবার কল বা টেক্সট করার কথা মাথাতেই আসেনি তাই না সারাদিন? সেটা করতে নিশ্চয় ফোন জেনারেল মোড করতে হয় না?
সিয়ারা: আভি আমি আসলে…
আধভিক: কোথায় আছো এখন?
সিয়ারা: বাড়ি ফিরবো। তুমি আমার…
আধভিক: সাবধানে বাড়ি ফিরবে। আর পারলে তখন একটা টেক্সট করে দিও। গুড নাইট।
সিয়ারা: আভি আমার…(“টুট টুট টুট”) যাহ! কেটে দিলো? মশাইয়ের ভালোই গোসা হয়েছে। যদি সবটা শুনতো তাহলে ঠিক বুঝতো কিন্তু এখন ও’কে এসব বিষয়ে কিছু বলবো না। আগে বিষয়টা একটু শিথিল হোক। থ্যাংক গড মেয়েটা দিয়া, আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। আমার মনে হয় এই জন্যেই বিষয়টা এতটা জটিল হয়েছে, এখন বুঝতে পারছি দেব ঠিক কোন বিষয়টা মিসটেক বলেছে।
সিয়ারা দেবাংশুর বাড়ির দিকে ঘুরে তাকালো আর একটা হতাশার নিশ্বাস ছাড়ল। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
সিয়ারা: আশা করছি দেব এইবার পুরো ব্যাপারটা বুঝে যাবে। কিন্তু দিয়া? দেব যেটাকে মিস্টেক বলেছে সেটা ভাবা এবং বলা যে ওর সবথেকে বড়ো মিস্টেক এইটা কি দিয়া বুঝবে? দেব না হয় বুঝে যাবে। না না, আমাকে দেখছি এইবার দিয়ার সাথেও কথা বলতে হবে। দেবের এমন বলার পিছনে, করার পিছনে যে কারণ আছে সেটা তো দিয়া জানে না। কোথাও না কোথাও গিয়ে দেবকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না, ও নিরুপায় ছিলো। সেটা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। সব জেনেও ও কীভাবে ভাবলো আমিও ও’কে ভুল বুঝবো? সব মিটুক, তারপর এটা নিয়ে সেন্টু খাবো ব্যাটার কাছে। (হালকা হেসে) ওরে বাবা, এখন আবার ওই মহারাজের মান ভাঙাতে হবে। উফ! আমার হয়েছে মহাজ্বালা! একদিকে বরকে সামলাও, অন্যদিকে বন্ধুকে সামলাও তো আরেক দিকে বোনকে সামলাও। এদের সামলাতে সামলাতেই জীবন চলে যাবে আমার।
সিয়ারা গজগজ করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলো আর বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই আধভিককে ভিডিও কল করলে সে কল রিসিভ করে না। দ্বিতীয়বার কল যখন প্রায় শেষের দিকে তখন সেটা রিসিভ হয়।
সিয়ারা: আই অ্যাম সরি আভি। আজকে অনেক কিছু হয়েছে তাই জন্যে আমি আর তোমাকে কল বা টেক্সট করতে পারিনি তুমি কল করার পরে। প্লিজ রাগ করো না নাহলে সবটা জানার পর তোমারই খারাপ লাগবে।
আধভিক: হম, আল্টিমেটলি সব দোষও আমার বের হয় আর খারাপও আমারই লাগে। এ আর নতুন কি?
সিয়ারা: আভিইই!!(বাচ্চাদের মত করে) আর হব্বে না! আই লা বিউ! (বিনয়ী সুরে, পাপ্পি ফেস করে)
আধভিক: (হালকা হেসে) কি হয়েছে আজকে?
সিয়ারা: আব, সেটা এখন বলা যাবে না।
আধভিক: (ভ্রূ কুঁচকে) এনিথিং সিরিয়াস সিয়ু? আমরা কিন্তু প্রমিজ করেছিলাম একে অপরের থেকে কিছু লুকাবো না। যা করবো একসাথে করবো?
সিয়ারা: ডোন্ট বি হাইপার আভি! বিষয়টা অন্য, যেমনটা তুমি ভাবছো তেমন নয়। আগে বিষয়টা একটু স্টেবেল হোক তারপর আমি তোমাকে ডিটেইলসে সবটা জানাবো। (আশ্বস্ত করে)
আধভিক: ঠিক আছে। তোমার কাজ কত দুর? আর দিয়া? তার কি খবর? সে তো আজকাল আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না অর্জুন চ্যাটার্জীকে পেয়ে।
সিয়ারা: আমার কাজ ঠিকঠাক চলছে। আর দিয়াও নিজের পারফরম্যান্স এর জন্য খুব হার্ড ওয়ার্ক করছে।
আধভিক: আর দেব আর দিয়ার পারফরম্যান্স কেমন চলছে লাভ? দেবকে ওখানে পাঠিয়ে কিছু কি সুবিধা হয়েছে?
সিয়ারা: মনে তো হয় হয়েছে। বাকিটা সময় বলবে। (মনে মনে হেসে)
এরপর ওরা দুজন ধীরে ধীরে নিজেদের প্রেমালাপে ব্যস্ত হয়ে পরে এবং রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সেটা আরো গভীর হয়। একটা সময় পর সিয়ারা কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পরলে আধভিকও হেসে কল যেতে ঘুমিয়ে পরে।
পরেরদিন,
দিয়ারা সময় মতো এসে পরলেও ওর চোখ দেবাংশুকে খুঁজতে থাকে চারিদিকে। কিন্তু কোথায় সে আজ? দেরী তো সে করে না কখনও, তাহলে আজ কি হলো?
__কাওকে খুঁজছো নাকি দিয়া দি?
দিয়ারা: আব, আমাদের ক্যামেরাম্যান কোথায়?
__দেবদা? আজকে হয়তো আসবে না। নাহলে দেরী তো দেবদা করে না খুব একটা। অসুবিধাও তো নেই, এখন তো মডেলরা রাম্প ওয়াক প্র্যাকটিস করছে।
দিয়ারা: হ্যাঁ তাও ঠিক।
দিয়ারা আর কোনো কথা বাড়ালো না। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেলো। ক্যান্টিনে থাকাকালীন লাঞ্চ ব্রেকের পর হঠাৎই দিয়ারার মনে হয় কেউ ও’কে দেখছে। পিছন ফিরতেই দেবাংশুকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পায় দিয়ারা। দুজনের আই কনট্যাক্ট হয়ে গেলে দিয়ারা চটজলদি আবার সামনে ঘুরে যায়। একটু কিছুক্ষণ আবার পিছন দিকে পুরোপুরি না ঘুরে আড় চোখে তাকালে দেবাংশুকে আর দেখতে পায় না। তখনই পুরোপুরি ঘুরে যায় দিয়ারা আর বিড়বিড় করতে থাকে,
দিয়ারা: কোথায় গেলো? এই তো এক্ষুনি এখানেই ছিলো! কোথায় যেতে পারে এখন? স্টুডিও তে?
__এই দিয়া? কি এতো বিড়বিড় করছিস? এইদিকে দেখ, এই পোজটার কথা বলছিলাম আমি তোকে।
দিয়ারার বান্ধবী দিয়ারাকে সামনের দিকে ফিরিয়ে নিজের কথা বলতে শুরু করে এবং কিছু ছবি দেখাতে শুরু করে। দিয়ারা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর মন অন্যদিকে থাকে।
এদিকে,
দেবাংশু ক্যান্টিন থেকে দিয়ারাকে একবার দেখে নিয়ে স্টুডিওতে এসে চুপ করে বসেছিলো। সবাই লাঞ্চ করতে যাওয়ায় এখন কেউ নেই সেখানে। দেবাংশুকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। নিজের চোখটা বন্ধ করতেই দেবাংশু নিজের নাম শুনতে পেলো একটা পুরুষালি কণ্ঠে। তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে সেদিকে তাকিয়ে দেবাংশু উঠে দাঁড়ালো এবং অপেক্ষা করতে লাগলো কখন সে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হবে। সে সামনে এসে দাঁড়াতেই দেবাংশু বললো,
দেবাংশু: অর্জুন, তুই কি আমার লেট হওয়ার জন্য বলতে এসেছিস? আমার শরীর ভালো ছিলো না তাই লেট হয়েছে। তাছাড়া আজকে তো…
অর্জুন: কি করেছিস তুই দিয়ার সাথে?
দেবাংশু চমকে উঠলো অর্জুনের প্রশ্নে। মনে মনে এটাই ভাবতে লাগলো যে দিয়ারা অর্জুনকে কি সবটা জানিয়ে দিয়েছে?
দেবাংশু: কি বলতে চাইছিস?
অর্জুন: আমি কি বলতে চাইছি সেটা তোর থেকে ভালো কেউ জানে না। আমি গত কয়েকদিন ধরে দেখছি দিয়া ডিস্টার্ব হয়ে আছে। আর সেটা যে তোর জন্য সেটা আমি খুব ভালো ভাবে জানি। কি করেছিস তুই ওর সাথে?
দেবাংশু: তুই একটু বেশিই ভাবছিস না দিয়াকে নিয়ে অর্জুন? তোর এত কিসের মাথা ব্যথা ও’কে নিয়ে?
অর্জুন: ও’কে নিয়ে মাথা ব্যথা করছি তোর জন্য দেব। এটা তো তোকে মনে করানোর কথা নয় আমার। তুই কি ভুলে গেছিস কিছুদিন আগে তুই আমাকে কি চ্যালেঞ্জ করেছিলি? তুই আমাকে কনট্র্যাক্ট পেপার সাইন করার আগে চ্যালেঞ্জ করে বলে ছিলি,”এইবারও তোকে আমার ব্যবহার করা জিনিসই তোকে দেবো।” এটার কি মানে দাঁড়াচ্ছে দেব? তুই দিয়াকে ইউস করেছিস? তাই জন্য দিয়া মন খারাপ করে আছে? কথা কেন বলছিস ড্যাম ইট? স্পিক আপ! ওদিকে কি…
অর্জুন যখন কথা বলছিল তখন দেবাংশু নীচের দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু যখন চ্যালেঞ্জের কথাটা অর্জুন উল্লেখ করলো তখনই দেবাংশু হতবাক হয়ে অর্জুনের দিকে তাকায় এবং তারপরেই ওর চোখ যায় পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ারার দিকে। দেবাংশু নিজের চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠো করে নেয়। দেবাংশুর দৃষ্টি অনুসারে অর্জুন পিছন ফিরতেই দেবাংশু নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়।
অর্জুন: দিয়া তুমি এখানে..??
অর্জুনকে থামিয়ে দেয় দিয়ারা নিজের হাত সামনে এগিয়ে দিয়ে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেবাংশুর সামনে দাঁড়ালো দিয়ারা। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
দিয়ারা: আ..আমাকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ক..করেছিলে তুমি? অর্জুন য..যেই কথাটা বললো সেটা স..সত্যি?
দেবাংশু: (হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো)
দিয়ারা: তুমি, তুমি আমাকে ইউজ করেছো? আমাকে…আমাকে…
দিয়ারা পিছিয়ে গেলো। দেবাংশু কিছু বলতে এগোলে দিয়ারা ওকে থামিয়ে দেয় আর নিজেই এক কথা বার বার বলতে থাকে।
দেবাংশু: দিয়া আমি…
দিয়ারা: (হাত দিয়ে থামিয়ে) ইউজ, ইউজ করেছো তুমি আমাকে। ইউজ করেছো। ম.. মিস্টেক ছিলো না ওটা, ওটা প্রি-প্ল্যানড ছিলো। প্রি-প্ল্যানড..প্রি-প্ল্যানড…(অনবরত চোখের জল ফেলে)
দিয়ারা পিছতে পিছতে নিজের চোখের জল মুছে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্জুন একবার দেবাংশুর দিকে রেগে তাকালো তারপর দিয়ারার পিছু নিতে গেলেই দেবাংশু অর্জুনের বাহু ধরে ও’কে যাওয়া থেকে আটকালো।
অর্জুন: হোয়াট দ্যা হেল! নিজে তো গেলি না এখন আমাকেও যেতে দিচ্ছিস না। আমাকে না আটকে দিয়াকে আটকানো উচিৎ ছিলো তোর দেব! ছাড় আমাকে। (রেগে নিজের হাত ছাড়িয়ে)
দেবাংশু: অর্জুন! ও’কে…ও’কে ভালো রাখিস।
অর্জুন অবাক হয়ে গেলো দেবাংশুর কথা শুনে। অর্জুন ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও ওর দৃষ্টি দিয়ারার যাওয়ার দিকে।
দেবাংশু: আমি জানি তুই ও’কে ভালো রাখবি। তোর সাথে থাকলেই ও ভালো থাকে।
অর্জুন: (তাচ্ছিল্য হেসে, দাঁতে দাঁত চেপে) মেয়েদের মন নিয়ে খেলতে তোর একটুও বাঁধে না জানতাম, তাই বলে যাকে ছোটো থেকে চিনিস, যে তোর বাবার বন্ধুর মেয়ে, তোর বন্ধুর বোন, তাঁর মন নিয়ে খেলতেও তোর বাঁধলো না? এক্ষেত্রেও তোর নিজেকে দ্যা গ্রেট দেবাংশু গাঙ্গুলি প্রমাণ করতে হলো? যে কি না কখনও নিজের চ্যালেঞ্জ হারে না। অন্তত এক্ষেত্রে নিজের আসল রূপটা না দেখালেও পারতিস। ছিহ!
দেবাংশু হেসে ফেললো অর্জুনের কথায়। যাতে অর্জুন আরো রেগে গেলো। একটা নিশ্বাস ছাড়ল এইভেবে যে আর কিছু বলার মতো ভাষা নেই ওর কাছে। এতো কিছুর পরেও দেবাংশু হাসছে। দেবাংশু অর্জুনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
দেবাংশু: জীবনে প্রথমবার হয়তো নিজে কি চ্যালেঞ্জ নিয়েছি সেটা ভুলেই বসেছিলাম। কারণ যেটা করেছিলাম সেটা জেদের বশে আগে পিছে না ভেবে আর এটা আগে কখনও হয়নি। দেবাংশু গাঙ্গুলি কখনও না ভেবে চিন্তে কোনো কাজ করেনি। এই ফার্স্ট টাইম কোনো কিছু না ভেবে চিন্তেই, আবেগের বশে অনেক কিছু বলে ফেলেছি, করে ফেলেছি। দ্যা গ্রেট দেবাংশু গাঙ্গুলির মধ্যে আবেগের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সে কখনও হৃদয় দিয়ে ভাবেনি, সবসময় মাথা দিয়ে ভেবেছে। (কপালের পাশে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে) তাছাড়া আমার অতীত টা এতো সুন্দর যে প্রতিটা ভুল স্টেপের পিছনে তার অবদান অনেক। আর রইলো বাকি হারার কথা? (তাচ্ছিল্য হেসে) সে তো সবসময় আমি হেরে এসেছি, হারিয়ে এসেছি…তোর কাছে! আজ না হয় আর একবার হারলাম, হারালাম। তোর কথা অনুযায়ী বললে, আজ জিতে গিয়েও হেরে গেছি আমি। (হেসে দিয়ে)
দেবাংশু নিজের নাকটা হালকা টেনে একটা ঢোক গিললো আর চোখের কোণে আঙুল দিয়ে কিছু একটা আড়াল করলো যা সম্ভবত চোখের জল, অর্জুন তা স্পষ্ট দেখতে পেলো।
দেবাংশু: (একটা নিশ্বাস নিয়ে অর্জুনের বাহুতে হাত রেখে) আসছি আমি। (দিয়ারা যেদিক দিয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে বললো) ভালো রাখিস ও’কে। নিজের ভালোবাসা দিয়ে পারলে আমার অস্তিত্বটা পুরোপুরিভাবে মুছে দিস। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। সরি ফর এভরিথিং।
দেবাংশু আবারও নিজের চোখের কোণে আঙুল দিয়ে চোখের জল আড়াল করতে করতেই বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। অর্জুন এখনও দেবাংশুর যাওয়ার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
এইসব কি হয়ে গেলো পাঠকগণ? এমন কি হওয়ার কথা ছিলো?🙃