‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬৮||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
দেবাংশুদের বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।আজকে দেবাংশু আর সিয়ারার রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। প্রথমে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হবে তারপর আচার অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে। সিয়ারা নিস্তেজ হয়ে বসে আছে নিজের ঘরে সেটাই দেখতে পান সুধাংশু বাবু ঘরে ঢুকে। উনি সিয়ারার পাশে বসে, ওর মাথায় হাত রাখেন। সিয়ারা আড় চোখে দেখে নেয় সুধাংশু বাবুকে, তাই আর ওনার দিকে ফেরে না, একভাবেই বসে থাকে।
সুধাংশু বাবু: আমি জানি তুই এই বিয়েতে মন থেকে রাজি হোসনি। তুই যে ভিকিকে কতোটা ভালোবাসিস সেটা আমি জানি।
সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) একতরফা ভালোবাসা আমার।
সুধাংশু বাবু: নাহ মা, ভিকিও তোকে ভালোবাসে। আমি ছোটো থেকে ভিকিকে চিনি। তুইই ওর প্রথম আর তুইই ওর শেষ ভালোবাসা।
সিয়ারা: আমিও এতদিন এটাই ভাবতাম। কিন্তু ও আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছে।
সুধাংশু বাবু: তুই চলে যা মা এখান থেকে। পালিয়ে যা তুই, করতে হবে না এই বিয়ে।
সিয়ারা অবাক নয়নে সুধাংশু বাবুর দিকে তাকালো। হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
সিয়ারা: এসব তুমি কি বলছো আংকেল? তোমার ছেলের বিয়ে আজকে। তুমি তোমার ছেলের বউমাকে পালিয়ে যেতে বলছো?
সুধাংশু বাবু: হ্যাঁ বলছি। কারণ তুই আগে আমার কাছে আমার মেয়ে, বউমা এখনও হোসনি। আমি সবার আগে তোর ভালো থাকাটা নিয়ে চিন্তিত। আমি বলছি তোকে, পালিয়ে যা তুই। আমি ভিকিকে খুঁজে বার করবো।
সিয়ারা: না আংকেল, না। আমি আর পালাবো না। পরিস্থিতির সাথে মুখোমুখি হতে চাই আমি। আগের বার ঠিক এভাবেই বিয়ের মণ্ডপ ছেড়ে আমি পালিয়ে গেছিলাম, এইবার আর সেই একই ভুল আমি করবো না।
সুধাংশু বাবু: কিন্তু…
সুধাংশু বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই দেবাংশু সেই ঘরে এসে উপস্থিত হলো। দেবাংশুকে দেখে সুধাংশু বাবু চুপ করে গেলেন। সিয়ারা একটু অবাক হলো এটা দেখে তাও কিছু প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে সুধাংশু বাবুকে বললো,
সিয়ারা: কোনো কিন্তু না আংকেল। তুমি যাও, গিয়ে একটু রেস্ট নাও। আমি ঠিক আছি। আমাকে তৈরী হতে হবে এবার।
সিয়ারা কথাটা শেষ করতেই ওর ঘরে দিয়ারা ঢুকলো। দিয়ারা ঘরে প্রবেশ করতেই দেবাংশু দিয়ারার দিকে তাকালো কিন্তু দিয়ারা সেদিকে না তাকিয়ে সিয়ারাকে সরাসরি বললো,
দিয়ারা: এখনও তৈরী হোসনি দি? উকিল বাবু এসে পরবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি সাহায্য করবো তোকে?
সিয়ারা করুন ভাবে নিজের বোনের দিকে তাকায়। চোখ মুখটা শুকিয়ে গেছে। ওর বোন কলকাতার টপ মডেলদের মধ্যে একজন, তাঁর এমন দশা সিয়ারার সহ্য হয় না। রাগ নিয়ে দেবাংশুর দিকে তাকায় যে নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে সিয়ারা দেবাংশুর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
সিয়ারা: দেব তুই আমাকে বলেছিলি, দিয়া ছাড়া তুই অন্য কাওকে নিজের জীবনে আসতে পর্যন্ত দিবি না। মেনে নেওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু এখন? এখন কি করছিস তুই এটা? আংকেলের কথা শুনে বুঝলাম আংকেল এই বিয়েটা চাইনি তাহলে? তুই কি নিজের ইচ্ছায়…
আর ভাবতে পারে না সিয়ারা। দেবাংশু সুধাংশু বাবুকে নিজের সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দিয়ারা দরজা বন্ধ করার আগে দেবাংশুর দিকে একবার তাকায় তারপর চোখ নামিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগে দেবাংশু হাত দিয়ে দরজাটা আটকে দেয়।
দেবাংশু: এই প্যাকেটে সিয়ার শাড়ি আর গয়না আছে। পরিয়ে দিস।
দিয়ারা প্যাকেটটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সিয়ারার পাশে গিয়ে বসে। সিয়ারার হাতে প্যাকেট দিয়ে জোর করেই একপ্রকার চেঞ্জ করে আসতে বলে। সিয়ারা চেঞ্জ করে আসলে, দিয়ারা ও’কে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে সাজাতে শুরু করে।
সিয়ারা: তুই কীভাবে এসব মেনে নিচ্ছিস দিয়া? আজকে আংকেল আমাকে বললো, আমি যাতে এই বিয়েটা না করি। চলে যাই, পালিয়ে যাই আমি এখান থেকে।
কথাটা শুনতেই দিয়ারার হাত থেমে গেলো। সিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে দিয়ারার দুই বাহুতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
সিয়ারা: তুই যে আমাকে বলেছিলি আংকেলের জন্য যাতে বিয়েটা করতে রাজি হয়ে যাই? আংকেল তো চায়ই না বিয়েটা হোক।
দিয়ারা: তো তুই কি চাইছিস এখন? পালিয়ে যাবি? ঠিক যেমন আগের বার পালিয়ে গেছিলি?
সিয়ারার হাত আলগা হয়ে যায় দিয়ারার কথায়। মুখ গম্ভীর করে উত্তর দেয়,
সিয়ারা: না।
দিয়ারা: তাহলে আর এসব ভেবে লাভ নেই। বিয়েটা হচ্ছে এটাই আসল কথা। আয়, রেডি হয়েনে।
সিয়ারা: (চোখে জল নিয়ে) আমাকে ক্ষমা করিস বোন। আজ আমি না চাওয়া সত্বেও তোর ভালোবাসাকে কেড়ে নিচ্ছি আজকে।
দিয়ারা: সবই কর্মফল দি। একসময় আমি তোর ভালোবাসা কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম। তুই আমার হাতে তাঁকে তুলে দিয়েছিলি। তখন যেমন আমি সেটা চাইনি, এখন তুইও সেটা চাস না। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করে অনেক কিছু করতে। আমি ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে ভাবিস না।
সিয়ারা নিজের বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। দিয়ারার চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পরছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে সিয়ারাকে সোজা করে দাঁড় করায় দিয়ারা। চোখের জল মুছিয়ে বলে,
দিয়ারা: তোর বোন সবসময় তোর পাশে আছে। একদম কাঁদবি না। আজকের পর থেকে তুই সুখে থাকবি আর কোনো কষ্ট তোকে ছুঁতে পারবে না দেখিস।
সিয়ারা: আর তুই?
দিয়ারা: আমার জন্য ভগবান যা ঠিক করে রেখেছেন তাই হবে। আবার কি? (হেসে)
দিয়ারা সিয়ারাকে আবার বসিয়ে ভালো করে সাজাতে শুরু করলো। কাঁদতে বারণ করে দিলো সিয়ারাকে। সাজ কমপ্লিট হয়ে গেলে দিয়ারা নীচের দিকে তাকিয়ে থাকা সিয়ারাকে আয়নায় তাকাতে বললো।
দিয়ারা: খুব সুন্দর লাগছে তোকে দি। দেখ একবার নিজেকে।
নীচের দিকে তাকিয়ে থেকেই তাচ্ছিল্য হাসলো সিয়ারা।
সিয়ারা: আমার জীবনের সব সুখ, সাজ, রং, সৌন্দর্য নিয়ে একটা মানুষ আমাকে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেছে দিয়া। আমার আর এখন এসব ভালো লাগে না।
সিয়ারা উঠে গিয়ে বিছানায় বসে পরলো। দিয়ারা আর কিছু না বলে নীচে চলে গেলো। নীচে গিয়ে দিয়ারা দেখলো উকিল বাবু এসে গেছেন আর দেবাংশু তাঁর সাথে কথা বলছে। সোফায় সুধাংশু বাবু মনমরা হয়ে বসে আছেন। সেই সময় আভাস বাবু সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। প্রথমেই উনি দিয়ারার দিকে তাকালেন। দিয়ারা হালকা হাসলে উনিও জোরপূর্বক একটু মিথ্যে হাসলেন। সুধাংশু বাবুর পাশে গিয়ে বসতেই সুধাংশু বাবু ওনাকে বললেন,
সুধাংশু বাবু: তুই তো বিয়েটা আটকানোর চেষ্টা করতে পারতি আভাস? সিয়ারাকে বলতে পারতিস যাতে এই বিয়েটা ও না করে। তুই তো জানিস ভিকি আর সিয়া মা একে অপরকে কতটা ভালোবাসে? সিয়া মা যে এখনও ভিকিকে ভালোবাসে সেটা জানিস না তুই?
আভাস বাবু: হ্যাঁ, সঙ্গে এটাও জানি যে আমার ছেলে সিয়া মার এতো ভালোবাসার প্রতিদান ও’কে একা রেখে চলে যাওয়া দিয়ে দিয়েছে। কোন মুখে আমি সিয়া মাকে গিয়ে বলতাম বিয়েটা করতে না? আমার সেই মুখ কি রেখেছে আমার ছেলে? আমিও জানি না ভিকি কোথায়। আমার মনে হয় দেবাংশু সিয়া মাকে অনেক ভালো রাখবে। আর তুইও তো আছিস।
সুধাংশু বাবু আর কোনো কথা বললেন না। চুপ করে গেলেন। দেবাংশু উকিল বাবুকে বসতে বললেই উনি বললেন,
উকিল বাবু: পাত্রীকে নিয়ে এসো। পেপার্স আমি রেডি করেই এনেছি।
দেবাংশু: দিয়া, যা গিয়ে সিয়াকে নিয়ে আয়।
দেবাংশু কথাটা বলেই সোফায় গিয়ে বসলো চুপচাপ। দিয়ারা কিছুক্ষণের মধ্যেই সিয়ারাকে নীচে নিয়ে এলো। আভাস বাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো সিয়ারাকে পাথরের ন্যায় হয়ে যেতে দেখে। দিয়ারা সিয়ারাকে নিয়ে গিয়ে দেবাংশুর পাশে বসিয়ে দিলো। উকিল বাবু দেবাংশুকে সাইন করতে বললে দেবাংশু পেপারটা নিজের দিকে নিয়ে একবার পুরো চোখ বুলিয়ে নেয়। সেটা দেখে উকিল বাবু বলে ওঠেন,
উকিল বাবু: চিন্তা করো না পেপার একদম ঠিক আছে। তুমি সাইনটা করে ফেলো।
দেবাংশু একটু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তারপর দিয়ারার দিকে তাকালো। দিয়ারা একভাবে দেবাংশুর দিকে চেয়ে ছিলো, একবার চোখের পলক ফেলতেই দেবাংশু সাইন করে দিলো। দিয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এইবার পালা সিয়ারার। সিয়ারার হাতে দেবাংশু পেনটা দিতেই সিয়ারার চোখে জল জমতে শুরু করে। চোখের সামনে আধভিকের মুখটা বারবার ভেসে ভেসে উঠছে। আগেও একবার আধভিককে ছেড়ে এসেছিলো সে, এইবার হয়তো সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবে। কাঁপা কাঁপা হাতে সিয়ারা সাইন করতে যায়। অবাক ভাবে চোখ খোলা থাকা অবস্থাতেও সিয়ারার চোখের সামনে আধভিকের সঙ্গে কাটানোর মধুর স্মৃতি ভাসছে। সিয়ারা সাইনটা করবে এমন সময় সিয়ারার কানে একটা আওয়াজ গেলো,
“সিয়ু!”
সিয়ারার হাত থেমে গেলো। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো আধভিক দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ারার চোখের জল এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো, হাত থেকে পেনটা পরে গেলো। আভাস বাবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন আধভিককে দেখে।
আভাস বাবু: ভিকি?
আধভিক: কি হচ্ছে এখানে? সিয়ু তুমি বিয়ে করছো? কীভাবে তুমি…
আভাস বাবু: কীভাবে মানে? ঠিক যেভাবে তুমি ও’কে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছো সেভাবেই ও বিয়ে করছে। তুমি যদি নিজের কথা ভাবতে পারো তাহলে ও কেন ভাবতে পারবে না?
সুধাংশু বাবু: আহঃ আভাস, এইসব কি বলছিস তুই। তোর ছেলে ফিরে এসেছে।
আভাস বাবু: তাতে কি হয়েছে? এতদিন কোথায় ছিলো ও যখন এই মেয়েটা কাঁদছিলো ওর জন্য? এখন যেই দেখলো সিয়া মা নিজের ভালো থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে, ওমনি ফিরে এসেছে। সিয়া মা, সাইনটা কর তুই। এই ছেলেটার জন্য আর এক মুহুর্ত নষ্ট করবি না। সাইনটা কর!!
আভাস বাবুর কথা শুনে আধভিক ছল ছল চোখে সিয়ারার দিকে তাকালো। সিয়ারাও ভেঁজা চোখে পেনটা আবার হাতে নিতেই আধভিক পিছিয়ে যেতে শুরু করলো। সিয়ারা সাইন করার জন্য ঝুঁকতেই আধভিক ওখান থেকে চলে গেলো। সিয়ারা আধভিকের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো,
সিয়ারা: (মনে মনে — একটা বার বাঁধা দিলে না আমাকে বিয়েটা করতে? একটাবার না? বলতে পারলে না, সিয়ু আমি ফিরে এসেছি। তোমার আভি তোমার কাছে ফিরে এসেছে। এই বিয়েটা তুমি করবে না, তুমি আমার সিয়ু। তুমি শুধু আমার! …. বললে না তুমি এমনটা, চলে গেলে। ঠিক আছে, তুমি যখন আমাকে চাও না তাহলে আমিও আর জোর করবো না।)
সিয়ারা জেদ নিয়ে সাইনটা করতে গেলেই কেউ ওর হাত ধরে ফেলে। সিয়ারা সেই হাতের দিকে তাকিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে দেবাংশু সিয়ারার হাত ধরে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ও তাকাতেই বলে ওঠে,
দেবাংশু: জেদের বশে কোনো কাজ সঠিক হয় না সিয়া। তার উপর তুই নিজের মনকে জোর করছিস। সেটাও ঠিক নয়।
সিয়ারা চোখ নীচে নামিয়ে নিলে দেবাংশু বলে ওঠে,
দেবাংশু: এতো কষ্ট করে তোর ভালোবাসাকে তোর কাছে এনে দিলাম কি এই জন্য? যাতে তুই তাঁকে আপন না করে ফিরিয়ে দিস?
সিয়ারা অবাক হয়ে দেবাংশুর দিকে তাকাতেই দেবাংশু হাসলো আর বললো,
দেবাংশু: ভালোবাসা বার বার সুযোগ দেয় না সিয়া। তুই দ্বিতীয়বার পাচ্ছিস এই সুযোগটা, এটা হারিয়ে ফেলিস না। তাহলে হয়তো সত্যি আর কখনই নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পাবি না তুই। সুযোগ যখন পেয়েছিস তখন সেটা যেতে দিস না।
সিয়ারা দেবাংশুর কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলতেই আধভিকের মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোখ খুলে দেবাংশুর দিকে তাকাতেই দেবাংশু চোখ দিয়ে বাইরের দিকে ইশারা করে যেতে বলে। সিয়ারা আর অপেক্ষা না করে ছুটে বেরিয়ে যায় আধভিকের পিছনে। ঘটনাচক্রে সবাই অবাক হয়ে দেবাংশুর দিকে তাকিয়ে থাকলে দেবাংশু ক্যাবলা হাসি দেয়। তারপর দিয়ারার দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করতেই দিয়ারা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
দেবাংশু: মনেই হচ্ছিলো ডুবাবে আমাকে। তাই বলে যে মনে হওয়াটা সত্যি হবে ভাবি নাই। এইবার কি হবে? সবাই আমাকে চার্জ করবে এবার। (বিড়বিড় করে)
আভাস বাবু: দেব! এসব তোর প্ল্যান ছিল?
দেবাংশু: (উঠে দাঁড়িয়ে) হ্যাঁ আংকেল। পুরোটাই আমার প্ল্যান ছিলো তোমার গুণধর ছেলেকে এখানে টেনে আনার জন্য।
আভাস বাবু: এইটা তুই একদম ঠিক কাজ করিসনি দেব। ভিকির জন্য তুই শুধু শুধু দিয়াকে কেন কষ্ট দিলি? কতটা কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা এই কদিন তোর কোনো আইডিয়া আছে?
দেবাংশু কিছু বলতে যাবে তার আগেই সুধাংশু বাবু উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
সুধাংশু বাবু: দিয়াকে কষ্ট দিয়েছে মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?
আভাস বাবু অবাক হয়ে একবার দেবাংশুর দিকে তাকায় একবার দিয়ারার দিকে। দিয়ারা অসহায় হয়ে দেবাংশুর দিকে তাকিয়ে আছে আর দেবাংশু নীচের দিকে।
সুধাংশু বাবু: কি হলো? কিছু বলছিস না যে? দিয়ারার সাথে দেবুর এমন কি সম্পর্ক যে দিয়ারা কষ্ট পাবে ওর এই প্ল্যানে?
অন্যদিকে,
আধভিক হঠাৎই এগোতে এগোতে পায়ের নূপুরের শব্দ পায়। তাতেই আধভিকের পা এক জায়গায় জমে যায়। ধীরে ধীরে বাড়ছে নূপুরের শব্দটা, জানো কাছে এগিয়ে আসছে! খুব কাছে। নূপুরের শব্দটা থামতেই আধভিক ধীরে ধীরে পিছন ফেরে আর সঙ্গে সঙ্গে একজন ওর গলা জড়িয়ে ধরে দু হাতে। আধভিকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য যখন প্রথমবার ওর ভালোবাসা ঠিক এভাবেই ওর কাছে এসেছিলো। এসে জানিয়ে ছিলো সেও ও’কে ভালোবাসে।
আধভিক: সিয়ু!
আধভিক সিয়ারার কোমরটা জড়িয়ে ধরে একটু উপরে তুলে নেয়। কারণ সিয়ারা পা উঁচু করে আধভিককে এসে জড়িয়ে ধরেছিল। আধভিকের গলা জড়িয়ে ধরতে গেলে সিয়ারাকে এই পদ্ধতিই প্রয়োগ করতে হয় প্রথম থেকেই।
আধভিক: আমি এসে গেছি, কাঁদছো কেন? সব ঠিক আছে।
সিয়ারার কানের কাছে আস্তে করে কথাটা বলতেই সিয়ারার মনে পরে গেলো সবকিছু। এতক্ষণ নিজের মান-অভিমান ভুলে সিয়ারা আধভিককে আটকানোর জন্য ছুটে এসেছিলো কিন্তু এখন? এখন সে কিছুতেই এতো সহজে সব মেনে নেবে না। ঝট করে সিয়ারা আধভিকের কাছ থেকে দূরে সরে এসে ধাক্কা মারে আধভিককে পিছনে ঠেলে দেয়। আধভিক একটু অবাক হয়ে যায়।
সিয়ারা: তোমাকে আমি কখনও ক্ষমা করবো না মিস্টার আধভিক রায় চৌধুরী! মজা পেয়ে গেছো তুমি আমাকে, আমার ভালোবাসাকে তাই না? তোমাকে ভালোবাসি দেখে ভেবে নিয়েছো যখন যা ইচ্ছা তাই করবে? আমি তোমাকে আটকেছি আংকেলের জন্য। আর কিচ্ছু না।
সিয়ারা নিজের কথাটুকু বলেই চোখ মুছে বাড়ির দিকে দৌঁড় দেয়। আধভিক কিছু বলার সুযোগ না পাওয়ায় ছুটে যায় সিয়ারার পিছনে। ওরা দুজন পর পর ড্রয়িং রুমে গিয়ে হাজির হলেই শোনে সুধাংশু বাবু দেবাংশু আর দিয়ারার কি সম্পর্ক তা নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। সেই সময় উকিল বাবু জিজ্ঞেস বলে ওঠেন,
উকিল বাবু: এখন এই রেজিস্ট্রি পেপার্সের কোনো মূল্যই নেই।
দেবাংশু: মূল্য আছে।
উকিল বাবু: দেব তোমার বিয়ে যখন হচ্ছে না তাহলে এই পেপার্সের মূল্য কীভাবে থাকে? এটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আরেকটা পেপার্সের সেট এনেছি। সেটাতেই না হয়…
দেবাংশু: সেটাতে ভিকি আর সিয়ার বিয়ে হবে আংকেল। এইটা আমার বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার।
সুধাংশু বাবু: আভাস, তুই আগে আমাকে উত্তর দে তুই তখন কি বলছিলি? কেন বলছিলি? কি সম্পর্ক দেবুর সাথে দিয়ারার?
দেবাংশু: হবু স্ত্রীর সম্পর্ক পাপা! (উঁচু গলায়)
দিয়ারাসহ সবাই চমকে ওঠে দেবাংশুর জোর গলায় কথা বলা নিয়ে। আজ অবধি দেবাংশু কখনওই সুধাংশু বাবুর সাথে গলা উঁচু করে কথা বলেনি।
দেবাংশু: আমি ভালোবাসি দিয়ারাকে আর ও’কেই নিজের জীবনসঙ্গিনী, নিজের স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই।
দেবাংশু দিয়ারার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সুধাংশু বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে উকিল বাবুকে বলে,
দেবাংশু: এই পেপার্সে আমার সাইনের পাশে দিয়ারা সাইন করবে। প্রথম থেকে এটাই হওয়ার ছিলো সেটা ভিকি আসুক বা না আসুক। আমি কখনও আমার জীবনে নিজের স্ত্রীয়ের জায়গায় দিয়ারা ছাড়া অন্য কাওকে আসতে পর্যন্ত দেবো না সেখানে মেনে নেওয়া দূরে থাক। কেউ যদি ভেবে থাকে আমাকে তাঁর ইচ্ছা মত পরিচালিত করবে তাহলে সে ভুল ভাবছে। আর এই নাটকটা সম্পর্কে প্ল্যান করার পরে সবার প্রথম আমি দিয়ুকেই জানিয়েছি। ও সবটা জানতো, আফটারঅল নিজের ভালোবাসার মানুষকে জেনে বুঝে কষ্ট দেওয়ার মতো কাজ আমি এটলিস্ট করবো না। আমি দিয়ুকে যেমন কথা দিয়েছিলাম ও’কে কাঁদতে দেবো না, নিজেকেও কথা দিয়েছিলাম। জেনে বুঝে আমি ও’কে কোনো কষ্ট দিইনি। আশা করছি সবাই সবার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।
দেবাংশুর কথা শেষ হতেই সুধাংশু বাবু একবার আধভিক আর সিয়ারাকে দেখে নিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের উদ্দ্যেশ্যে। ওনাকে ওভাবে চলে যেতে দেখে দিয়ারা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় দেবাংশুর হাত থেকে যাতে দেবাংশু ভ্রু কুঁচকে দিয়ারার দিকে তাকায়। দিয়ারা না বোধক মাথা নেড়ে ওখান থেকে চলে গেলে দেবাংশুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। আভাস বাবু দেবাংশুর পিঠ চাপড়ে কাঁধে হাত দিয়ে বলেন,
আভাস বাবু: ওয়েল ডান ইয়াং ম্যান! আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার সাহস দেখে। ভালো যেমন বেসেছো, স্বীকারও তেমন করেছো। কাওকে ভয় পেয়ে নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটা কোনো প্রেমিক করতে পারে না। যাঁরা করে তাঁরা কাপুরুষ, প্রেমিক নয়।
আভাস বাবুর কথা শুনে দেবাংশু আর সিয়ারা দুজনেই আধভিকের দিকে তাকালো। আধভিক নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়ারা দেবাংশুকে জানালো,
সিয়ারা: আজকে এখানে যদি কোনো বিয়ে হয় তাহলে সেটা তোর আর দিয়ার হবে দেব। আর কাওর না। আমি বিয়ে করবো না, এই মানুষটাকে তো না’ই।
সিয়ারা নিজের ঘরে চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে উঠে। আভাস বাবু আধভিকের দিকে তাকালেন পর্যন্ত না, দেবাংশুকে বলে সুধাংশু বাবুর ঘরে চলে গেলেন। দেবাংশু আধভিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
দেবাংশু: এত দেরী হলো কেন আসতে তোর? সকালে তো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠিস বলেই জানি। আমি তো ভেবেছিলাম সাত সকালে এসে হাজির হবি।
আধভিক: সাত সকালেই এসে হাজির হতাম! নেহাত কালকে ডোজটা একটু…
দেবাংশু: (চোখ সরু করে) ডোজ মানে? কিসের ডোজ ভিকি? তুই আবার…
আধভিক: ঘুমের ওষুধ ভাই আমার। ঘুমের ওষুধের ডোজ বেশি হয়ে গেছিলো।
দেবাংশু: উপরে যা, দেখবি ডোজ বেশি হওয়া কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিস।
আধভিক: তোকে এইসব করতে কে বলেছিলো বল তো? এমনিই ফিরে আসতাম, তাহলে এখন এই দিন দেখতে হতো না। (অসহায় ভাবে)
দেবাংশু: যাঁর জন্য চুরি করি সেই বলে চোর? তোর জন্য আমি এতো কিছু করলাম যাতে তোরা এক হতে পারিস আর এখন বলছিস কেন করলাম? বাহ ভাই বাহ! তোর সংসার বাঁচাতে গিয়ে নিজের সংসার উজরে যাচ্ছে আমার। (করুন ভাবে)
আধভিক: (হাসিমুখে) যা গিয়ে আগে দিয়ার সাথে কথা বল তারপর স্যারের সাথে কথা বলবি। আমি যাই, বিয়েতে রাজি করাই।
আধভিক চলে যেতে নিলে দেবাংশু ও’কে বাঁধা দিয়ে দাঁড় করায়। তারপর কাছে গিয়ে আধভিককে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে আস্তে করে বলে,
দেবাংশু: তোর অসম্পূর্ণ কাজ আমি সম্পূর্ণ করে দিয়েছি।
দেবাংশু হেসে দিয়ারা যেদিকে গেছে সেই দিকে চলে যায় আর আধভিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দেবাংশুর যাওয়ার দিকে। সিয়ারার কথা মাথায় আসতেই আধভিক এই বিষয়ে আর না ভেবে উপরে সিয়ারার ঘরে চলে যায়।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
দিয়ারা একটা ঘরে এসে থাই গ্লাসের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সময় ও দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলো কানে কিন্তু সেদিকে তাকালো না। কারণ ও জানে কে এসেছে ঘরে।
দিয়ারা: আমি আজকে বিয়েটা করতে পারবো না অংশু।
দেবাংশু দরজা বন্ধ করে দিয়ারার দিকে এগিয়ে আসছিলো কিন্তু দিয়ারার কথাটা শুনতেই দেবাংশুর পা থেমে গেলো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
দেবাংশু: কি?
দিয়ারা: হ্যাঁ, আমি বিয়েটা করতে পারবো না।
দেবাংশু: কিন্তু কেন? তুই সবটা আগে থেকে জানতিস দিয়ু। তারপরেও এই কথাটা কোথা থেকে আসছে? আমি এই প্ল্যানটার সম্পর্কে সবার আগে তোকে জানিয়েছিলাম। তোকে ইচ্ছা করে কোনো কষ্ট দিইনি আমি। যে কদিন আমাদের মধ্যে কথা হয়নি সেই কদিন আমি নিজে সময় পাইনি ব্যস্ত ছিলাম। তার মানে এই নয় যে আমি কোনো কষ্ট পাইনি। যা করেছি প্ল্যানের স্বার্থে করেছিস আর ইচ অ্যান্ড এভরিথিং তুই জানিস।
দিয়ারা: আমি বলিনি আমি জানি না কিন্তু…
দেবাংশু: কিন্তু কি ড্যাম ইট? মজা করছিস তুই আমার সাথে? তুই আমাকে বিয়ে করতে পারবি না? তো কি চাইছিস টা কি তুই? আমাকে ছেড়ে দিতে চাইছিস শুধুমাত্র পাপা মানবে না বলে? খুব খারাপ হয়ে যাবে দিয়া। (দেয়ালে হাত দিয়ে একটা ঘুষি মেরে) আমি কিন্তু …
দিয়ারা দেবাংশুকে অতিরিক্ত রেগে গিয়ে দেয়ালে ঘুষি মারতে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ওর কাছে এসে ও’কে জড়িয়ে ধরলো। দেবাংশু নিজেকে ছাড়াতে চাইলে দিয়ারা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যাতে দেবাংশু শান্ত হয়ে যায়। দেবাংশু একটু একটু করে শান্ত হয়ে দিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দিলে, দিয়ারা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। সোজা হয়ে দেবাংশুর গালে হাত রেখে বলে,
দিয়ারা: এতো রাগ করছো কেন তুমি? আগে আমার পুরো কথাটাতো শোনো।
দেবাংশু: আমি শুধু জানতে চাই তুই..তুই আমাকে বিয়ে করবি হ্যাঁ কি ন..না?
দেবাংশুর গলাটা একটু কেঁপে যেতে দেখেই দিয়ারা দেবাংশুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
দিয়ারা: হ্যাঁ..
দিয়ারা মাথা উঠিয়ে দেবাংশুর দিকে তাকালে দেবাংশু কিছু বলার আগেই দিয়ারা নিজের কথা শেষ করে,
দিয়ারা: তবে সেটা সুধাংশু আংকেলের অমতে নয়। তুমি গিয়ে আগে আংকেলের সাথে কথা বলবে। অংশু, উনি তোমার বাবা হন। যেখানে তুমি নিজের অতীতের জন্য এতটা প্রভাবিত ছিলে সেখানে উনি প্রভাবিত হবেন না? ওনার স্ত্রী ওনার সাথে প্রতারণা করেছে, উনি কখনও চাইবেন না ওনার সাথে যেটা হয়েছে সেটা ওনার ছেলের সাথে ঘটুক। তোমার মনে আছে তুমি কি বলেছিলে আমাকে যখন আমি তোমার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম?
দেবাংশুর মনে পরে গেলো দেবাংশু দিয়ারাকে ওর জীবন থেকে চলে যেতে বলেছিলো। সেটা মনে পরায় দেবাংশু দিয়ারার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। দিয়ারা হাসিমুখে বললো,
দিয়ারা: আমি তোমাকে অনেক ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা বুঝিয়ে ছিলাম অংশু। তোমাকেও সেটাই করতে হবে। আর আংকেল তো আমাকে ছোটোবেলায় দেখেছেন, আমাকে চেনেন। আমার মনে হয় না তুমি যদি ওনাকে ঠিকভাবে বোঝাও তাহলে উনি অমত করবেন বলে।
দেবাংশু: তো এটা কেন বললি যে বিয়ে করতে পারবি না আমাকে? শুধু শুধু মাথা গরম করাস তুই আমার। (অন্যদিকে তাকিয়ে)
দিয়ারা: (হাসি চেপে) আমার দোষ নেই। আমি বলেছি আজকে আমি বিয়েটা করতে পারবো না। তোমাকে বিয়ে করবো না এটা কি বলেছি?
দেবাংশু: দিয়ু তুই একদম কথার জালে আমাকে ফাঁসাবি না।
দিয়ারা: আচ্ছা? (একটু দূরে সরে এসে) তো কি করবো হ্যান্ডসাম? যেটাতে লাইফটা ফিল্মি মনে হবে? তোমার নিজেকে লাকি মনে হবে?
দিয়ারার হাসিমুখে কথাটা শুনতেই দেবাংশুর মুখটা শুকিয়ে গেলো। একট শুকনো ঢোঁক গিলে একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলো।
দিয়ারা: কি হলো হ্যান্ডসাম? (নকল করে) গার্লফ্রেন্ড তো তোমার নাম কে ভাস্তে, যাঁকে বিয়ে করবে তাঁর জন্য তো অনেএএক কিছু করতে হবে।
দেবাংশু: কথাটা মনে হচ্ছে মিলে গেলো। এইবার সত্যিই অনেএএক কিছু করতে হবে। (বিড়বিড় করে)
দিয়ারা: কিচ্ছু করতে হবে না। করবো না তোমাকে বিয়ে আমি। যাও গিয়ে যাঁর সাথে ফ্লার্ট করছিলে তাঁর সাথে গিয়ে বিয়ে করো। আমি তো নামকে ভাস্তে তাই না? তোমার তো অন্য মেয়েদেরকেই পছন্দ। দরকার কি তাহলে আমাকে বিয়ে কর…অংশু!
দিয়ারা কথা শেষ করার আগেই দেবাংশু হাতটা আবার দেয়ালে মারতেই দিয়ারা আঁতকে উঠলো। দিয়ারা একটু দূরে গিয়ে দেবাংশুর থেকে পিছন ফিরে কথাটা বলছিলো। সামনে ফিরতেই এসব দেখে দিয়ারা সাথে সাথে দেবাংশুর হাতটা গিয়ে ধরলো।
দিয়ারা: রাগ আমার দেখানোর কথা সেখানে তুমি রাগ দেখাচ্ছো?
দেবাংশু: আমি কি বলেছি আমি তোমার উপর রাগ দেখাচ্ছি?
দিয়ারা: এমনিতেই দুদিন আগে হাত কেটেছো, এখন এর উপর বার বার আঘাত করলে আবার রক্ত বেড়াবে অংশু।
দেবাংশু: (তাচ্ছিল্য হেসে) ক্ষত জায়গাতেই বার বার আঘাত করা হয় আমাদের। কারণ যে আঘাত করে সে জানে সেখানে ক্ষত আছে তাই ওখানে আঘাত করলেই যন্ত্রণাটা বেশি হবে।
দেবাংশু দিয়ারার হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবে তার আগেই দিয়ারা পিছন থেকে দেবাংশুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
দিয়ারা: স্যরি, সেদিন আমি সবটা দেখেছিলাম। তারপর তো কথাই হয়নি তোমার সাথে, তুমিই বলনি। তাই খারাপ লেগেছিলো আমার, তখন তো কিছু জানতামও না।
দেবাংশু দিয়ারার দিকে ঘুরে দেখলো দিয়ারার চোখটা জ্বলে ভরে উঠেছে। দেবাংশু দিয়ারার কপালে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
দেবাংশু: আজকেই সবটা জানতে পারবে কেন আমি এসব করেছি। আমি কখনও জেনে শুনে তোমাকে কষ্ট দেবো না।
দিয়ারা: উফ, এই ছেলেটার এতো রাগ কেন কে জানে? আজকে মুডটা ঠিক নেই মনে হচ্ছে। ঠিক ভাবে তো মানাতেও পারলাম না, চলে গেলো। না জানি আংকেলের সাথে কীভাবে সবটা ম্যানেজ করবে।
দেবাংশু দিয়ারার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দিয়ারা দেবাংশুর শেষের কথা ভাবলেও পরক্ষণে ওর মাথায় আসে দেবাংশু সুধাংশু বাবুর সাথে কথা বলতে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় সুধাংশু বাবুকে বোঝাতে পারবে তো ও? এই চিন্তাটা কুরে কুরে খেতে লাগলো দিয়ারাকে।
অন্যদিকে,
সিয়ারা নিজের ঘরে এসে নিজের গয়নাগুলো সব খুলছে গায়ের জোরে। আধভিক ঘরে আসতেই সেই দৃশ্য দেখতে পেলো। একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে আধভিক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সিয়ারা সেটা বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে বললো,
সিয়ারা: এখান থেকে চলে যান মিস্টার চৌধুরী! আমি আপনার সাথে কোনো কথা তো কি, আপনার মুখোমুখিও হতে চাই না।
আধভিক: আমি জানি সিয়ু…
সিয়ারা: (হাত তুলে আধভিককে থামিয়ে) একদম আমাকে ওই নামে ডাকবেন না। যাঁকে আপনি ওই নামে ডাকতেন সে মরে গেছে।
আধভিক সিয়ারার কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। দুই বাহু শক্ত করে ধরে বললো,
আধভিক: জাস্ট শাট আপ সিয়ু! আগে আমার কথাটা তো শোনো। তখন থেকে তুমিই বলে যাচ্ছো।
সিয়ারা: বললাম তো আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনার মুখটা পর্যন্ত দেখতে চাই না আমি। (হাত ছাড়িয়ে নিয়ে)
আধভিক: আমি মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু…
সিয়ারা: আপনি ভুল করেননি। ভুল আমি করেছি। আপনার মত একটা মানুষকে ভালোবেসে আমি ভুল করেছি। যে কখনও আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই ছিলো না। না না, আবার ভুল করছি আমি। আমি, আমি তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না। তাই তো আমার এতো ভালোবাসা পাওয়ার পরেও সে আমাকে কখনও ভালোবাসেনি। শুধুমাত্র আমার একটা ভুলের জন্য আমার উপর এইভাবে প্রতিশোধ তুলেছো তুমি তাই না আধভিক? এতদিন অভিনয় করেছো আমাকে ক্ষমা করে মেনে নেওয়ার। আসলে তো তুমি আমাকে মেনেই নাওনি, তাই তো এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে…
আধভিক: আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি সিয়ারা। এখানেই ছিলাম আমি!! সর্বক্ষণ তোমার আশে পাশেই ছিলাম। (রেগে)
সিয়ারার প্রথম কথাগুলো আধভিকের মনে ক্ষত সৃষ্টি করলেও আধভিক তা মুখ বুজে মেনে নিচ্ছিলো। কিন্তু সিয়ারার শেষের কথাগুলো জানো ওই আগুনে ঘী ঢালার মতো কাজ করলো। আধভিক আর সহ্য করতে না পেরে করে চিৎকার করে কথাগুলো বললো সিয়ারাকে যার ফলে সিয়ারা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আধভিকের কথাগুলো মাথায় যেতেই সিয়ারা হেসে উঠলো। তা দেখে ফুঁসতে থাকা আধভিকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো কারণ ও জানে সিয়ারা ওর কথাগুলো ভুল ভাবে নিয়ে আরো ভুল বুঝবে ও’কে।
সিয়ারা: ইচ্ছা করেই সব করেছো তুমি তার মানে। সবটা তোমার প্ল্যান ছিলো, আমাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। আগেই বোঝা উচিত ছিল এটা আমার। …. আসলে আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো, তুমি আমার কথা শুনবে। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোইবাসোনি, ভালোবাসলে এভাবে দূরে সরিয়ে দিতে পারতে…
আধভিক: আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দিইনি। আমি…
আধভিক থেমে যায়। সিয়ারা সেটা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে। তারপর আধভিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
সিয়ারা: এতো ভালো অভিনয় করতে পারো তুমি সেটা আমি জানতাম না। তোমার প্রোডিউসার না হয়ে অ্যাক্টর হওয়াই উচিত ছিল। আমার তো মনে হচ্ছে যেই অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছিলো সেটাও তোমার একটা অভিনয় ছিলো। সেই অ্যাকসিডেন্টের দোহাই দিয়েই তুমি দূরে যেতে চেয়েছিলে যেহেতু পারোনি, আমি চলে এসেছিলাম তাই সেদিন আমাকে ওখানে থাকতে দাওনি। …. এতো বড়ো অভিনয়টা আমার সাথে না করলেও পারতে আধভিক। তুমি এতটা খারাপ সেটা আমি ভাবতেও পারিনি।
সিয়ারা কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে পরলে আধভিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সিয়ারার দিকে। কেরে আঙুল দিয়ে নিজের চোখের কোণ থেকে জলটা মুছে নিয়ে সিয়ারার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। সিয়ারা তাকায় না আধভিকের দিকে, মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে।
আধভিক: আমি যে কতটা খারাপ সেটা তুমি এখনও জানো না মিস সিয়ারা সান্যাল। জেনে যাবে, ধীরে ধীরে সব জেনে যাবে। আজকেই আমাদের বিয়ে হবে। তৈরী হয়ে নাও।
সিয়ারা: আমি তোমাকে বিয়ে করব না। কখনও না।
আধভিক: করবে! তুমি আমাকেই বিয়ে করবে। সেটা তোমার ইচ্ছাতে হলে ভালো, আর আমাকে জোর করতে হলে আরও ভালো। তোমার জন্যে ভালো না হলেও আমার জন্য ভালো। আসলে কি বলো তো? আমি তো খারাপ তাই জোর করতে ভালোবাসি।
সিয়ারা: কি করবে তুমি?
আধভিক: (সিয়ারার দিকে এগোতে এগোতে) প্লিজ সিয়ারা, আমার খারাপ রূপটা দেখতে চেয়ো না। আমি তোমাকে আমার লাভি ডাভি হাসব্যান্ড রূপটাই দেখাতে চাই। এতদিন যেমন বয়ফ্রেন্ড রূপটা দেখিয়েছি।
আধভিক উঠে পিছন ফিরে দাঁড়ালে সিয়ারাও উঠে দাঁড়ায়।
আধভিক: রেডি হয়ে নাও, আমি দিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সিয়ারা: আমি তোমার এই হুমকিতে ভয় পাইনা আধভিক। আমি জানি তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।
আধভিক: (সিয়ারার দিকে ফিরে) একদম ঠিক বলেছো। আমি তোমার কিচ্ছু করতে পারবো না, করতে চাইও না মাই ডিয়ার উড বি ওয়াইফ! কিন্তু তোমার মা…সে জানো কোথায় বেশ? (ভ্রু কুঁচকে ভাবার ভান করে)
সিয়ারা: (আঁতকে উঠে) আধভিক! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি নিজের জেদের জন্য আমার মায়ের ক্ষতি করবে?
আধভিক: আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য এই পৃথিবী ধ্বংস করতে পারি মাই ডিয়ার! ইউ নো না? আমি অন্যদের মত নই। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো তোমার তীরের কথাগুলো শুনে আঘাতে জর্জরিত হয়ে অভিমান করে দূরে সরে যেতো। কিন্তু এটা আমি, আধভিক রায় চৌধুরী! এতো ছোটো বিষয়ে তোমার থেকে দূরে সরে যাবো না আমি। তোমার খারাপ কথা শুনে তোমাকে ছেড়ে দেবো এটা যদি ভেবে থাকো তাহলে তুমি ভুল ভাবছো মাই লাভ। তুমি আমার! তোমার ভালো কথা যখন গ্রহণ করতে পারি, খারাপটাও গ্রহণ করতে পারি আর এখানে তো আমার দোষও আছে। তাই যতই তোমার কথাগুলো আমার বুকে তীরের ন্যায় বিঁধে যাক, রক্তক্ষরণ হোক তাও আমার তোমাকে চাই। আমি চাই, তুমি আমার সাথে সারাজীবন থেকে আমাকে এই কথাগুলো শুনিয়ে আঘাত দিতে থাকো এতে আমার শাস্তি পাওয়াও হবে আবার তোমার সাথে থাকাও হবে। তোমার যা ইচ্ছা তুমি আমার সাথে থেকেই করবে।
কথাটুকু বলে হেসে দরজার দিকে এগোতে থাকে আধভিক। সিয়ারা নীচের দিকে তাকিয়ে আছে এমন সময় হঠাৎ আধভিক দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে ওঠে,
আধভিক: তুমি এখন নিশ্চয় ভাবছো যে সেদিন আমি অ্যাকসিডেন্টে মরে গেলেই ভালো হতো! তাই না? ভাবাই উচিত। কারণ অমনটা হলে আমার তোমার থেকে দূরে সরে যাওয়াও হতো আবার তোমাকে এসব সহ্য করতেও হতো না। এমনিতেও তো তুমি কষ্টই পেয়েছো এতদিন আমার থেকে দূরে থেকে। আমি মরে গেছি জানলে হয়তো কষ্টটা একটু কম হতো। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) কি করবো বলো? মৃত্যুর আমার সাথে বন্ধুত্ব আছে, এতো সহজে আমাকে হারাতে চাইছে না। তাই তো এতকিছুর পরেও বেঁচে আছি। (তাচ্ছিল্য হেসে) বেঁচে যখন আছি তখন তোমাকে আমায় সহ্য করতে হবে এখনও অনেক, কিছু করার নেই। আমি মনে করি আমার থেকে দূরে থেকে কষ্ট পাওয়ার থেকে আমার সাথে থেকে কষ্ট পাও এটাই বেশি ভালো হবে। আমার সাথে থেকে আমাকে শাস্তি দিতে তোমার খারাপ লাগবে না। … আমি তো অভিনয় করেছি, তুমি তো ভালোবেসেছো তাই না?
আধভিক বেরিয়ে যায় ঘরের থেকে। সিয়ারার বুকের ভিতরটা কেমন জানো মোচড় দিয়ে ওঠে আধভিকের মরে যাওয়ার কথাটা শুনে। আর শেষের কথাটা? সিয়ারার বুকে গিয়ে বিঁধেছে। জানো এরপরের কথাটা আধভিক বলতে গিয়েও বললো না। জানো সে বলতে গিয়েও বলতে পারলো না, কীভাবে ভাবলে আমি তোমার থেকে ইচ্ছা করে দূরে সরে যাবো সিয়ু? অভিনয় করবো তোমার সাথে? কীভাবে ভাবলে তুমি? সিয়ারা শব্দ করে কেঁদে ওঠে কথাটা মনে করে। আধভিক যে নিজের কথার মাধ্যমে অন্যভাবে নিজের কথা বুঝিয়ে গেছে সিয়াট সেটা বুঝতে পারে। আধভিকের প্রত্যেকটা কথা মনে করে সিয়ারা কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পরে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৭০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
দেবাংশু সুধাংশু বাবুর ঘরে ঢুকবে তার আগেই দেখলো আভাস বাবু ঘর থেকে বেরোচ্ছেন। আভাস বাবু হতাশ হয়ে দেবাংশুর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
আভাস বাবু: আমি ড্রয়িং রুমে যাচ্ছি। উকিল বাবু মনে হয় একা আছেন। তুই একবার কথা বলে দেখ।
আভাস বাবু চলে গেলে দেবাংশু ঘরে ঢোকে। সুধাংশু বাবু সোফায় বসে আছেন চুপ করে। দেবাংশুকে ঘরে আসতে দেখে সুধাংশু বাবু উঠে দাঁড়ালেন দু হাত পিছনে করে। দেবাংশু এসে পিছনে দাঁড়িয়ে বললো,
দেবাংশু: তখন ওভাবে বলার জন্য আই অ্যাম স্যরি পাপা।
সুধাংশু বাবু: তুমিও শেষমেষ আমি যেই ভুলটা করলাম সেটাই করলে দেবু?
দেবাংশু: আমি ভুল করিনি পাপা। দিয়ারাকে তুমি যেমন ভাবছো তেমন মেয়ে ও নয়।
সুধাংশু বাবু: আমি সেসব কিছু শুনতে চাই না। আমি শুধু জানি দিয়ারা একজন মডেল। এমন তো কোনো কথা নেই যে বিয়ের পর ও নিজের কাজ ছেড়ে দেবে? কাজ ছেড়ে দিলেও বা কি, পরিচয় তো ওর অনেকের সাথেই আছে।
দেবাংশু: তুমি কি মিন করতে চাইছো পাপা? এইসব বলার মানে টা কি?
সুধাংশু বাবু: মানে এটাই যে আমি কোনো মডেলকে তোমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। আমি তোমাকে নিয়ে কোনরকম কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আমার কাছে সব মডেল সমান…
দেবাংশু: ব্যাস পাপা! অনেক বলে ফেলেছো তুমি। আর একটা কথাও আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে শুনতে চাই না। তুমি ও’কে নিজের স্ত্রীয়ের সাথে তুলনা করছো? যে কি না কখনও তোমাকে ভালোই বাসেনি। তুমি বুঝতেই পারোনি সে কেমন, শুধু ভালোবেসে গেছো।
সুধাংশু বাবু: আর তুমি কীভাবে বুঝলে যে সে তোমাকে ভালোবাসে?
দেবাংশু: (তাচ্ছিল্য হেসে) আমিও তোমার মতই ও’কে ওই মহিলাটার সাথে তুলনা করেছিলাম। বিনা দোষে ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলেছিলাম, ওর আত্মসন্মানে আঘাত করেছিলাম। কারণটা ছিলো ও আমার মায়ের মত একজন মডেলার আর অর্জুন ও’কে পছন্দ করে তাই ও’কে হারিয়ে ফেলার ভয়। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আমাকে একটা সজোরে থাপ্পর মেরে আমাকে ছেড়ে চলে যেতো। কিন্তু ও সেটা করেনি, ও’কে অমন কথা শোনানোর পরেও ও এসে আমাকে বলেছিলো ও বিশ্বাস করে আমি এইসব কোনো একটা কারণে করেছি। জিজ্ঞেস করেছিলো সেই কারণটা কি। সবটা জেনে বিন্দুমাত্র কথা না শুনিয়ে আমাকে বুঝিয়েছিল আমাকে আমার অতীতের ভয় থেকে বেরোতে হবে। বুঝিয়েছিল আমি ও’কে ভালোবাসি, তাই তো অন্য কোনো ছেলের সাথে ও’কে দেখে আমি অতটা রিয়্যাক্ট করিনি যতটা অর্জুনের সাথে দেখে করেছি কারণ আমি ও’কে হারানোর ভয় পেয়েছি আমার মায়ের মত অর্জুনের কাছে।
দেবাংশু থেমে গিয়ে সেই মুহূর্তটার কথা মনে করলো চোখ বন্ধ করে যখন দিয়ারা ও’কে বুঝিয়েছিল ওর অতীত ওর মস্তিষ্কর উপর শাসন হারাচ্ছে।
দেবাংশু: আমি ও’কে বলেছিলাম আমার জীবন থেকে চলে যেতে। বলেছিলাম আমার অতীত আমার মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলছে যার জন্যে আমার মস্তিষ্ক আমায় নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলেই আমি ও’কে কষ্ট দিয়েছি আর ভবিষ্যতেও হয়তো দেবো আবার কোনোভাবে। ও যায়নি পাপা, এটা শোনার পরেও ও আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমাকে বলেছে যদি তাইই হয় তাহলে কেন আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম, আমি চাইলেই ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারতাম। পারিনি তার কারণ ওর থেকে দূরে গিয়ে আমি ভালো ছিলাম না আর না ভালো থাকবো। মাঝে কয়েকদিন আমি ফার্ম হাউসে গিয়ে ছিলাম এই কারণেই পাপা। শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আর কয়েকদিন ওভাবে যদি চলতো, দিয়ু যদি আমাকে সত্যি ছেড়ে যেতো আই সুয়্যার আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম।
সুধাংশু বাবু: দেবু!! তুমি ওই মেয়েটার জন্য নিজেকে শেষ করবে?
দেবাংশু: ইয়াহ বিকজ আই লাভ হার পাপা! আই রিয়েলি রিয়েলি লাভ হার। দিয়ু ছাড়া অন্য কাওকে আমি আমার লাইফে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবো না। কারণ ও’কে ছাড়া, ওর ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। আমি অসম্পূর্ণ পাপা ও’কে ছাড়া।
সুধাংশু বাবু: আর যদি ও তোমার মায়ের মত বে…
দেবাংশু: (হাত তুলে থামিয়ে) প্লিজ পাপা! প্লিজ। আমি তোমাকে আগেও বললাম আবার বলছি দিয়ুর সাথে ওই মহিলার তুলনা করবে না। যেই ভুলটা আমি নিজে একবার করেছি সেটা আমি আর কাওকে করতে দেবো না। ও আমার দিয়ারা পাপা! সবার থেকে আলাদা ও।
সুধাংশু বাবু: তার মানে এখন আমার থেকেও বেশি ওই মেয়েটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে তাই তো? আমি যদি এই বিয়েতে অমত করি তাও তুমি ও’কে বিয়ে করবে? আমি তোমার জন্য যেই মেয়েকে বেছে আনবো সে দিয়ারার থেকেও ভালো হবে দেবু! আমাকে বিশ্বাস করো না তুমি?
দেবাংশু: শি ইজ নট মাই অপশন পাপা, শি ইজ মাই চয়েজ। আমি বললাম না? দিয়ুকে ছাড়া আমি অন্য কাওকে নিজের জীবনে আসতে পর্যন্ত দেবো না সেখানে মেনে নেওয়ার দূরের কথা।
সুধাংশু বাবু: আচ্ছা? তাহলে আমি যদি বলি যেকোনো একজনকে বেছে নাও! নয় আমাকে আর না হয় ওকে। তখন কি করবে তুমি?
দেবাংশুর চোখটা জলে ভরে ওঠে। দেবাংশু হাত মুঠ করে মাথা নীচু করে নেয়। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই দিয়ারার বলা কথাগুলো মনে পরে যায় আর চোখ দিয়ে টুপ করে জল পরে যায়। মাথা উঠিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
দেবাংশু: এটা সত্যি যে দিয়ুকে আমি আমার জীবনে চাই, খুব করে চাই। ওর সাথে থেকে, ওর ভালোবাসায় নিজের বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। জানোই তো, মায়ের ভালোবাসা কখনও পাইনি আমি তাই দিয়ুর মতো একজন জীবনসঙ্গিনীর ভালোবাসা আমি পেতে চাই।
সুধাংশু বাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দেবাংশু পড়ে কিছু বলবে এই আশায়। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেবাংশু বললো,
দেবাংশু: তবে সেই জন্য আমি আমার কর্তব্যকে ভুলে যেতে পারি না। তাই তোমাকেই বেছে নেবো আমি। তাছাড়া দিয়ু চায় না তোমার অমতে আমি তোমাকে বিয়ে করি। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমি তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবো। আমাকে সে বিষয়ে জোর করো না ঠিক যেমন আমি তোমাকে জোর করছি না। যদি জোর করো তাহলে নিজের ছেলেকে সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলবে তুমি পাপা।
দেবাংশু বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে চোখ মুছতে মুছতে। সুধাংশু বাবু কিছু বললেন নির্বাক একজন শ্রোতা ও দর্শক হয়ে নিজের ছেলেকে দেখলেন এবং তাঁর কথা শুনলেন।
সিয়ারার ঘরে,
দিয়ারা ঘরে এসে দেখলো সিয়ারা এলেমেলো হয়ে শুয়ে আছে। দিয়ারা সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সিয়ারাকে তুলে বসালো। উত্তেজিত হয়ে সিয়ারাকে জিজ্ঞেস করলো,
দিয়ারা: কি হয়েছে দি? তোকে এমন লাগছে কেন?
সিয়ারা দিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো। দিয়ারা ধীরে ধীরে সিয়ারার পিঠে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
দিয়ারা: এমন কেন করছিস তুই দি? ভিকিদা তোকে ভালোবাসে আর তুই ভিকিদাকে। তাহলে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায় তোর?
সিয়ারা: কেন করবো আমি ও’কে বিয়ে? সব ওর মর্জি মতো? আমার ইচ্ছার কোনো দাম নেই তাই না? আমার কথা শোনার কোনো প্রয়োজন মনে করে না ও। করবো না আমি এমন মানুষকে বিয়ে। (চোখ মুছে)
দিয়ারা: পারবি তো ভিকিদাকে ছেড়ে থাকতে?
সিয়ারা চুপ করে থাকলে দিয়ারার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু সেটা পরক্ষণে গায়েব হয়ে যায়। মলিন ভাবে জিজ্ঞেস করে,
দিয়ারা: ভিকিদা যদি সত্যি সত্যি তোর জীবন থেকে হারিয়ে যায় তুই বাঁচতে পারবি দি?
সিয়ারা: দিয়া? এসব কি আজে বাজে কথা বলছিস তুই?
দিয়ারা: ভিকিদা তোর অনুপস্থিতিতে কখনও নিজেকে শেষ করতে যায়নি। তিলে তিলে নিজেকে শেষ করেছে। অপরদিকে তুইও কিন্তু একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলি। তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস দি, পারবি না দুজন দুজনকে ছাড়া। মানছি ভিকিদা ভুল করেছে তাই বলে বিয়েতে অস্বীকার করিস না দি। প্লিজ!
সিয়ারা: (চোখের জল মুছে) তুই সব জানতিস তাই না?
দিয়ারা উঠে গিয়ে গয়নাগুলো নিয়ে এলো সিয়ারার জন্য। সিয়ারাকে তৈরী করতে করতে বললো,
দিয়ারা: অংশু যে প্ল্যান করেছিলো তার মধ্যে ভিকি দা আমাকে ফোন করলে আমাকে কি বলতে হবে অংশু শিখিয়ে দিয়েছিলো ভয় দেখিয়ে। তারপরেই প্ল্যান সম্পর্কে জেনেছি আমি।
ফ্ল্যাশব্যাক………………………..
দিয়ারা দেবাংশুদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে চোখের জল ফেলছে। আজকে দেবাংশুর কথাটা শুনে নিমিষে মনটা খারাপ হয়ে গেছে দিয়ারার। একটাই কথা বারবার ওর মনে হচ্ছে, একবারও ও’কে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলো না দেবাংশু যে, দিয়ারা কি চায়? কীভাবে করলো এমনটা সে? শব্দ করে কেঁদে উঠলো দিয়ারা। সেই সময় হঠাৎ করেই কেউ দরজা নক করলো। দিয়ারা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো যতটা সম্ভব পারলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেবাংশুকে দেখে অবাক হয়ে গেলো দিয়ারা।
দেবাংশু: দাঁড়িয়ে না থেকে সর, আমাকে ভিতরে আসতে দে।
দিয়ারা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে দেবাংশু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় আর বলে,
দেবাংশু: ভালো করে যা বলছি মনে রাখবি। আধভিক যদি তোকে ফোন করে তোকে তাহলে তুই বলবি সিয়া আর আমি দুজনেই এই বিয়েতে নিজের ইচ্ছাতে রাজি হয়েছি।
দিয়ারা: তোমারটা না হয় মানলাম যে তুমি নিজের ইচ্ছায় বিয়েটা করতে রাজি হয়েছ কিন্তু আমার দি? ওর নামে মিথ্যে কেন বলবো?
দেবাংশু: তোকে প্রশ্ন করতে বলিনি আমি। যেমনটা বললাম তেমন…
দেবাংশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই দিয়ারার ফোন বেজে উঠলো। দেবাংশু টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো ফোনের স্ক্রিনে “ভিকি দা” নামটা ভেসে উঠছে। দিয়ারাকে টেনে এনে টেবিলে বসিয়ে দেবাংশু বলে,
দেবাংশু: যেমন বললাম তেমন বল নাহলে পরিণাম ভালো হবে না। আমি স্পিকারে দিচ্ছি।
দেবাংশু কল রিসিভ করে স্পিকারে দিয়ে দিলেই ওপাশ থেকে আধভিকের গোলা ভেসে আসে।
আধভিক: সিয়ু দেবকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে দিয়া?
দিয়ারা: ….
দিয়ারা আধভিকের গলার স্বর শুনতেই ভয়ে ভয়ে সামনে তাকালো। ওর সামনে দেবাংশু বসে আছে। হাতে রয়েছে একটা ধারালো ছুরি। আধভিকের প্রশ্নে দিয়ারা আবার আধভিকের কথায় মনোযোগ দিলো।
আধভিক: দিয়া চুপ করে থাকিস না।
দিয়ারা: ভ..ভিকি দা তুমি?
আধভিক: হ্যাঁ আমি। সত্যিটা বল আমাকে? সিয়ু সত্যিই রাজি হয়ে গেছে?
দিয়ারা একবার ছুরির ধার পর্যবেক্ষণ করতে থাকা দেবাংশুর দিকে তাকালো আর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
দিয়ারা: হ..হ্যাঁ। একবার ব..বলতে না বলতেই দি র..রাজি হয়ে গেছে।
আধভিক স্তব্ধ হয়ে গেলে দেবাংশু উঠে দাঁড়াতেই দিয়ারা ভয়ে পিছিয়ে যায়। দেবাংশু ঝুঁকে টেবিলে স্পিকারে দেওয়া দিয়ারার ফোনটা দেখে কল মিউট করে দিয়ে বলে,
দেবাংশু: ভয় না পেয়ে ক্লিয়ারলি কথা বল। দ্বিতীয়বার বলতে জানো না হয়। (শাসিয়ে)
দিয়ারা শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। আধভিক আবার প্রশ্ন করলো,
আধভিক: দেব? দেব রাজি এই বিয়েতে?
দিয়ারা: ওরা দুজনেই রাজি ভিকি দা।
আধভিক: তুই কীভাবে দেবকে বিয়েটা করতে দিচ্ছিস দিয়া? তুই তো দেবকে ভালোবাসিস তাই না?
দিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) আমি ভালোবাসলেই কি হবে ভিকি দা? অপরজনকেও তো ভালো বাসতে হবে তাই না? সে তো আমাকে কখনও ভালোবাসেনি। তাছাড়া দিও তোমাকে ভালোবেসেছিলো, তুমি কি প্রতিদান দিয়েছো? ও’কে একা ফেলে চলে গেছো। এখন যখন ও নিজের ভালো বুঝতে শিখেছে, ভালো থাকতে চাইছে তখন ফোন করছো তুমি? এতদিন কোথায় ছিলে তুমি যখন…
দেবাংশু চোখ রাঙাতেই দিয়ারা থেমে গেলো। নিজেকে সংযত করে বললো,
দিয়ারা: দেবদা ও দি একে অপরকে বিয়ে করতে চায়। ওরা নিজের ইচ্ছায় রাজি হয়েছে বিয়েতে। আগামীকাল ওদের বিয়ে।
দেবাংশু ঝট করে ফোনটা কেটে দিলো। দিয়ারা ভয় পাচ্ছে, আধভিককে বিয়ের দিন জানিয়ে ফেলেছে সে। দেবাংশু ছুরিটা হাতে নিলেই দিয়ারা আঁতকে ওঠে। দেবাংশু ছুরিটা হাতে নিয়ে একভাবে তাকিয়ে থেকে দিয়ারার দিকে ঝুঁকতে লাগলে দিয়ারা পিছিয়ে না গিয়ে স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকে দেবাংশুর দিকে। হঠাৎ করেই দিয়ারার পিছন থাকা ফ্রুট বোল থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে দেবাংশু সরে আসে। আপেলটা দু ভাগ করে এক ভাগ দিয়ারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো……
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]