#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
জুঁইকে নিজের করে নেয়ার পূর্ণ বাসনা চেপেছে নাফিসের মনে । জুঁইকে দেয়া সব কষ্টের অবসান ঘটাতে এক পা এগিয়ে দিয়ে জীবনকে আবার আরেকটা সুযোগ দিতে চায় নাফিস । ইফসির মাথার উপর থেকে এতিম নামক শব্দটা ঘুচিয়ে দিতে চায় সে । এই কচি বয়সের জুঁইয়ের অঙ্গের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা শাড়িকে রঙিন শাড়িতে বদলে দিয়ে জুঁইয়ের পাশে দাড়াতে চায় নাফিস ।
এইসব ভাবতে ভাবতে সিগারেট শেষ করেছে প্রায় ১০ টার মত । এমন সময় শান্তা নাফিসের রুমে প্রবেশ করে । রুমে এসেই সিগারেটের ধোঁয়া আর গন্ধে বুঝে গেছে সিগারেটের সাথে তার ভাইয়ের অন্তর পুড়ছে । কাছে গিয়ে বসে শান্তা । ভাইয়ের খুব কাছের সে । দুজনের সব টুকু সুখ দুঃখ শেয়ার করে দুজনে মিলে ।
– মনের কষ্টকে সিগারেটের ধোঁয়ায় বিলীন করছিস ভাইয়া ?
বোনের কথায় ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকায় নাফিস । শান্তা পাশে দাঁড়িয়ে আছে । ভাইয়ের হাতটা ধরে বিছানায় ইশারা করে শান্তা ।
– আয় বিছানায় বস ,
– হু
– কি হয়েছে বল তো ? আজকে কয়েকদিন যাবত একদম চুপ হয়ে গেছিস যে ?
– আমি কি আগেও কথা বলতাম , চুপ তো আমি সেদিনই হয়ে গেছিলাম যেদিন কাদম্বরীকে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছিলাম ।
– গত তিনটা বছরে তোকে হাসতে দেখি নি আমি ।
– সে চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার হাসি টাও নিয়ে গেছে রে ।
– অনেক কেঁদেছিল সেদিন সে ।
– আমার পা জোড়া ধরে রেখেছিল , খুব ভালোবাসতো আমায় ।
– হু
– মজার কথা কি জানিস ? এখন আমায় ঘেন্না করে খুব ঘেন্না করে । কারণ আমি যে কথা দিয়েও ফিরি নি ।
– মানে ?
তারপর শান্তাকে সব খুলে বলে নাফিস । জুঁইয়ের সাথে দেখা হওয়া , জুঁইয়ের সাথে এক অফিসে জব করা , জুঁইয়ের মেয়ের কথা , জুঁইয়ের বিধবা হয়ে যাওয়া সব কিছুই খুলে বলে সে । সব শুনে শান্তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । এত ভালো একজন মানুষের সাথে এত অঘটন কিভাবে ঘটে যেতে পারে । তাই ভাবছে শান্তা । আপনা আপনি চোখের পানি গুলো বেয়ে পড়ছে তার চোখ থেকে ।
– কাঁদিস না রে , আর কাঁদিস না । দেখিস না আমার কাঁদি না ।
– ভাইয়া ,,,,,,?
শান্তা তার ভাইয়ের চোখে লেগে থাকা চিকচিক পানি গুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে । কোন পুরুষ কাঁদতে পারে , তার জানা ছিল না । সে তার ভাইকে আগেও কাঁদতে দেখেছে তবে তা গোপনে । আর আজ তার ভাই তার সামনেই চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে । পুরুষ মানুষ তখনই কাঁদে যখন সে সব থেকে অসহায় হয়ে যায় । আর তার ভাইয়ের অসহায়ত্ব হচ্ছে কাদম্বরী । কলিযুগের কাদম্বরী যাকে তার ভাই ভালোবেসেও বলতে পারে নি । যাকে তার ভাই রাখতে চেয়েও রাখতে পারে নি । কাদম্বরীর সাথে সাথে তার ভাইও হারিয়ে গেছে ।
– কাঁদতে চাস ভাইয়া ? কান্না কর ভাইয়া , কান্না কর । আমার সামনে কেঁদে নে ।
নাফিস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি । দুইহাত মুখে নিয়ে কেঁদে দেয় সে । শান্তার বুক ছিড়ে যাচ্ছে ভাইয়ের এমন দুঃখে । বোন হয়েও তার হাত পা বাঁধা ।
– আমাকে আমার কাদম্বরী এনে দিবি ? এনে দে না প্লিজ , আমার কাদম্বরীকে লাগবে ।
নাফিসের এমন কথায় এইবার মনে হয় রুহটা বেরিয়ে যাবে শান্তার । তবুও অনেক কষ্টে ভাইকে শান্ত করে সে । জুঁইয়ের বাসার ঠিকানা নেয় শান্তা । এক ফাঁক করে একদিন দেখা করে আসবে সে । হয়তো কোন এক নতুন কিছু সূচনার পথে পা বাড়াবে সে নিজেও ।
অন্যান্য দিনের মত আজকেও জুঁইকে অফিস করতে হচ্ছে । ক্লান্ত শরীর আর ব্যর্থ মন নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে নিজের সাথে , লড়াই করতে হচ্ছে পরিস্থিতির সাথে । তার আর এই জীবনে সুখের মুখ দেখা হবে বলে তার মনে হচ্ছে না ।
ইফসি পাশে বসে খেলা করছে । কাজের ফাঁকে ফাঁকে একবার করে মেয়েকেও দেখা লাগে তার । সব দিকেই নজর রাখতে হয় জুঁইকে ।
অফিস টাইমে পিওন এসে দরজায় নক করে ,
– ম্যাডাম আসবো ?
– জ্বি আসুন ,
– ম্যাডাম বিকেল ৪ টায় মিটিং আছে ?
– আজ বিকেলে ?
– জ্বি , স্যার বললেন জানাতে আপনাদের ,
– আচ্ছা ।
– জ্বি ,
– রহমান ভাই ,,,,,,,?
– জ্বি ম্যাডাম ,
– ইফসিকে নিয়ে একটু বাহিরে যেতে পারবেন ? মানে কেবিনের বাহিরে আর কি । তখন থেকে যেতে চাচ্ছিলো ।
– এইটা আবার বলতে , আসো ইফসি আম্মু ,,,
পিওন রহমান এর কথায় ফিক করে হেসে দেয় ইফসি । ঝুটি নাড়িয়ে মায়ের দিকে বলে ,
– আমি তাই(যাই) আমি তাই (যাই)
– আচ্ছা আম্মুন যাও । কাউকে জ্বালিও না , কেমন ?
পিওন রহমান রুমের মধ্যে এসে ইফসিকে কোলে করে রুমের বাহিরে নিয়ে যায় । আর এই ফাঁকে জুঁই বাকি ফাইল গুলোর কাজ করা শুরু করে দেয় ।
অন্যদিকে , নাফিস তার রুমে কিছু ফাইল নিয়ে ব্যস্ত । বস মাহবুব সাহেব নাফিসের উপরে কিছু দায়িত্ব দিয়েছে যার পুরো দায়িত্বটাই তাকে যথার্থভাবে পালন করতে হবে । তা নিয়ে খুব ব্যস্ত সে । নাফিসের একটা দিন প্রশংসা করার মত । সে তার ব্যাক্তিগত দিক আর প্রফেশনাল দিক সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা করে রাখে । ব্যাক্তিগত জীবনে যা কিছুই হয়ে যাক না কেন প্রফেশনাল সময়ে সে সব সময় স্ট্রং থাকতে পারে ।
এদিকে ইফসি পুরো অফিস জুড়ে খেলছে দৌড়াচ্ছে । এর ডেস্কে যায় তো তার ডেস্কে যায় । অফিসের সবাই ইফসিকে খুব আদর করে । রীতিমত এখানে সবার নয়নের মনি সে । এর কলম ধরে তো তার পি সি তে প্রেস করে । কেউ বিরক্ত হয় না বরং আনন্দিত হয় । তাদের মধ্যে একজন আছে মোহি নামের এক ভদ্রমহিলা । তিনি ইফসিকে ডাক দেয় ,
– ইফসি ,,,,,, মাম্মাম এইদিকে আসো তো ?
ইফসি দৌড়ে তার কাছে চলে যায় । সবাই তাকিয়ে থাকে ইফসির দিকে । মোহি ইফসিকে কোলে তুলে নিয়ে বসায় ।
– মাম্মাম এই ড্রেসটা কে দিয়েছে ?
– আম্মুন আম্মুন ,
– তাই ?
– হু ,
– ইফসি সোনা একটু নাচো তো । আমরা সবাই তোমার নাচ দেখি ।
ইফসি নাচতে পারে না । এইটুকুন বাচ্চা আর কিই বা নাচবে৷। তবে গান তার খুব পছন্দের । কারণ জুঁই সব সময় রবীন্দ্রসংগীত শুনে । আর ইফসিও মায়ের সাথে শুনতে শুনতে সেই সব গান পছন্দ করে ফেলেছে । গান শুনলে সে হাত পা নাচায় এটাই সবার কাছে নাচ হয়ে গেছে । ইফসি এমন এক বাচ্চা যাকে দেখলে শয়তানেরও মায়া লেগে যাবে । আর এখানে তো সবাই মানুষ । তারপর মোহি তার মোবাইলে আমারও পরাণ যাহা চায়া গানটা চালিয়ে দেয় আর ইফসি তার হাত পা গুলো নাচাতে থাকে আর খিল খিল করে হাসতে থাকে । ইফসির সাথে অফিসের বাকি স্টাফরাও হাসছে । এমন সময় মাহবুব সাহেব আর নাফিস তাদের কেবিন থেকে বেরিয়ে তাকিয়ে ইফসিকে দেখছে । তারাও হাসছে ইফসির সাথে । নাফিস মুগ্ধ নয়নে দেখছে ইফসিকে । যেন ছোট কাদম্বরীকে দেখছে সে । এরই মধ্যে ইফসি নাফিসকে দেখে ফেলে । তারপর দৌড়ে নাফিসের কোলে উঠে যায় । আর নাফিসও কোলে তুলে নিয়ে গালে চোখে কপালে চুমু দিতে থাকে । আর ইফসিও নাফিসের গলা জড়িয়ে ধরে হাসে । অফিসের সবার চোখে এই জিনিসটা সহজেই লেগে যায় । নাফিসের অবশ্য ওইদিকে নজর নেই । এরই মাঝে মোহি বলে উঠে ,
– মনে হচ্ছে যেন , এরা বাবা আর মেয়ে । আমাদের ইফসি মাম্মাম কিভাবে নাফিস স্যারের আদর খাচ্ছে ।
এই কথা শুনে কয়েক মিনিটের জন্যে স্তব্ধ হয়ে যায় নাফিস । মোহি হয়তো ঘুরিয়ে বললেও কথাটা মন্দ বলে নি । নাফিস মন থেকে ইফসিকে কেন জানি নিজের সন্তান ভেবে নিয়েছে । খুব আদর করতে মন চায় তার ইফসিকে । ইফসিকে নিজের কোলে নিলে কেমন একটা অনুভূতি জাগে নাফিসের মনে । এ যেন এক পিতৃস্নেহের অনুভূতি ।
বিকেল ৪ টা ,
মিটিং রুমে সবাই বসে আছে । মাহবুব সাহেব এসে সবার সামনে বসে যায় ।
– আপনাদের সবার সাথে আমার কিছু কথা আছে ।
তখন নাফিস বলে ওঠে ,
– জ্বি স্যার বলুন ,
– দেখুন কোম্পানি আলহামদুলিল্লাহ ভালো চলছে এখন । তা আপনাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে । এর জন্যে আমি সত্যিই আপনাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ ।
তখন আরেক স্টাফ বলে ওঠে ,
– স্যার অফিসে আসার পর আপনার এই অমায়িক ব্যবহার পেয়ে আমরাও সন্তুষ্ট । অফিস না মনে হয় নিজের বাড়িতেই আছি আমরা ।
– ধন্যবাদ । স্টিল প্রজেক্টটা সাইন হয়ে গেছে ।
শুনেছেন তো সবাই ।
– জ্বি স্যার ,
– সেই উপলক্ষে ছোট খাটো পার্টি রাখা হয়েছে
– তাই নাকি স্যার ,
– জ্বি , আপনারা সকলেই সেখানে আমন্ত্রিত ।
মাহবুব সাহেব দেখলেন যে নাফিস আর জুঁই চুপচাপ বসে আছে । তখন তিনি নিজে থেকেই বললেন ,
– নাদিরা , আপনি কিছু বলুন ?
স্যারের কথা শুনে একটু নড়ে বসে জুঁই ।
– স্যার যেভাবে ভালো হয় ।
– আচ্ছা আর নাফিস সাহেব আপনারও কি একই মত ।
– জ্বি স্যার ।
নাফিসের কথা শুনে জুঁই মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে ফ্লোরের দিকে । নাফিসও চুপচাপ । তখন মাহবুব সাহেব বললেন ,
– বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টায় পার্টি । আমি সবার উপস্থিতি আশা করছি ।
তখন সবাই মিলে বলে ওঠে ,
– ওকে স্যার ।
মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে জুঁই নিজ কেবিনের দিকে পা বাড়ায় । আর তখনই নাফিস তাকে আটকে ধরে ।
– দাড়াও জুঁই ,
– জ্বি স্যার কিছু বলবেন ?
– এতটা ইগনোর করছো আমাকে যে স্যার বলা শুরু করে দিয়েছো ?
– নাফিস এটা অফিস ,
– জানি অফিস , তাই তো নরমাল আছি ।
– আমি বড্ড বেশি অগছালো হয়ে গেছি নাফিস , গুছাতে এসো না । না হয় তুমিও অগছালো হয়ে যাবে । পিছু ডেকো না ।
এই বলে জুঁই চলে যায় । আর নাফিস সেখানে দাঁড়িয়ে রয় । দূর থেকে মোহি সবটাই লক্ষ্য করে । তার মনে এখন অন্য ভাবনার উদয় ঘটেছে ।
.
.
চলবে…………………….