কথা দিয়েছিলে ফিরবে পর্ব ৮

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রাত প্রায় ২ টা । ঘুম নেই জুঁইয়ের চোখে । বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে । আজ কেন জানি বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছিল । আর সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েছে সন্ধ্যার পর পরই । এখন অবদি বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে । আজ মনে হয় বৃষ্টিও জুঁইয়ের চোখের পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ঝরে যাওয়ার শপথ নিয়েছে । জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর শ্রাবণ ভরা চোখে বাহিরের বর্ষণ দেখছে জুঁই । হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় তার । দিন টি ছিল শুক্রবার । বিকেলে দুজনে মিলে বেরিয়ে টি এস সি তে গিয়েছিল । আর সেখানে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছিল ।

– এই শুনছো , আমি ভিজে গেলাম তো ?
– কাদম্বরীর ভিজে যাওয়া স্নিগ্ধ শরীরটা দেখলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না , কি বলো ?
– আর যদি কাদম্বরীর ঠান্ডা লেগে যায় ?
– ফার্মেসি আছে তো ।
– অসভ্য
– উহু , আমি তোমাতেই উন্মাদ ।
– পুরো ভিজে গেছি নাফিস ,
– আমার বুকে আসো , ঝাপটে ধরে রাখি তোমায় ।
– তোমার বুকটা আমার চাই , বুঝলে ?
– তাই তো রাখতে চাইছি ।

সেইদিন পরম নিভৃতে জড়িয়ে নিয়েছিল নাফিস তাকে । সেইদিনের সেই স্পর্শে ছিল না কোন নোংরামি ছিল না কেন অশ্লীলতা । যা ছিল তা শুধুই ভালোবাসা আর যত্ন ।

– আম্মুন , আম্মুন ,,,,

মেয়ের ডাকে ধ্যান ভেঙে যায় জুঁইয়ের । পিছনে ফিরে দেখে ইফসি উঠে গেছে । দৌড়ে মেয়ের কাছে যায় জুঁই ।

– জ্বি আম্মুন বলো,,,,,,,?
– হিসি হিসি

ইফসিকে হিসি করিয়ে দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে । ইফসির ঘুমের মাঝে হিসি পেলে সে উঠে যায় । তাকে জুঁই সেইভাবেই তৈরি করেছে । মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে মেয়ের দিকে একদিকে চেয়ে আছে জুঁই ।

বাচ্চা নিয়ে নাফিস আর তার অনেক স্বপ্ন ছিল । নাফিস বরাবর চাইতো বিয়ের পর তাদের মেয়ে হোক । তা নিয়ে একদিন দুজনের মাঝে ঝগড়াও হয়ে যায় ।

– মেয়েই হবে দেখে নিও ।
– তুমি কিভাবে জানো আমাদের মেয়েই হবে ?
– হবে হবে , দেখে নিও । আমার কাদম্বরীর কোল জুড়ে আরেক ছোট্ট কাদম্বরী আসবে ।
– তুমি বড্ড বেশি অগ্রিম ভাবো ।
– হয়তো ,

ইফসির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখের পানি গুলো গড় গড় করে পড়ে যাচ্ছে চোখ দিয়ে । কি অন্যায় ছিল সেদিন তার । কোন অপরাধের শাস্তি দিয়েছিল নাফিস তাকে । পাগলের মত ভালোবাসতো সে নাফিসকে । বুকের ভেতর সব ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে তার । মেয়ের পাশ থেকে উঠে দৌড়ে সামনের রুমে বেতের সোফায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে জুঁই । কুশন মুখে চেপে চাপা চিৎকার করে কাঁদছে জুঁই ।

– নাফিস কি অন্যায় করেছিলাম আমি ? কোন অপরাধের শাস্তি দিয়েছিলে সেদিন আমায় ? আমার ভালোবাসার মাঝে কি কোন খাদ ছিল ? কেন এমন হলো নাফিস ? কেন আমায় এত কষ্টের মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছিলে নাফিস ? আজ তবে কেন আবার আমার আশেপাশে চলে এলে ?

জুঁই জানে এর উত্তর নেই । নাফিস উত্তর দিতে পারবে না । নাফিসের কাছে সেদিনও উত্তর ছিল না আজও নেই । নাফিস শুধু মিথ্যা অযুহাতে নিজেকে আর তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে ।

অন্ধকার ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে নাফিস । আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না তার । বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে । গলা থেকে কেন যেন আজ কথা বের হচ্ছে না তার । বার বার জুঁইয়ের মুখটা ভেসে উঠছে । এইটুকুন বয়সে এত কিছু সামলে নিয়েছে । কিভাবে ? প্রশ্নটা বার বার মাথায় ঘুরছে তার । একার জুঁই মুখটা আবার একবার তার মেয়ের মুখটা বার বার ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে ।

– কাদম্বরী তোমায় একা করে দিয়েছিলাম আমি । হাত ধরতে চেয়েও ধরতে পারি নি সেদিন । এক রকম ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম নিজের জীবন থেকে তাকে । এখন উপলব্ধি করতে পারি আমার কাদম্বরীকে আমার জীবনে প্রয়োজন ছিল ।

এইসব ভাবছে আর বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে নাফিস । বড্ড বেশি অভিমান হয় নিজের উপর , অভিমান হয় আরও একজনের উপর যার জন্যে আজ এত কিছু ।

শুক্রবার দিন , অফডে আজ । আজ মেয়েকে নিয়ে বের হবার কথা ভাবছে জুঁই । ঢাকাতে এসেছে প্রায় ১ মাসের বেশি হয়ে গেছে । কাজের প্রেশারে , বাসা দেখা , বাসায় উঠা , সব গুছানো , নিয়মিত অফিস করা এইসব করতে গিয়ে সে ভুলেই গেছে যে সেও একজন মানুষ , কোন যন্ত্রাংশ নয় । তাই আজ ভেবেছে মেয়েকে নিয়ে বিকেলের দিকে বের হবে । অনেকদিন হয়ে গেছে ইফসির জন্যে কেনাকাটা করে নি জুঁই । সেই কবে করেছিল তাও মনে নেই । নিজে কোন রকম চালিয়ে নিবে কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকটা জামা কাপড় কিভাবে পরাবে সে ।

অন্যদিকে ,
নাফিস নাস্তা করতে বসেছে । টেবিলে নাফিসের বাবা মা আর ছোট বোন বসা । শুক্রবার দিন টা সবাই একসাথেই নাস্তা করে । এমতাবস্থায় , রেহানা পারভিন মানে নাফিসের মা আবারও সেই একই প্রসঙ্গে কথা তুলে দিয়েছেন ,

– নাফিস ,
– বলো ,
– তোর ছোট খালার মেয়ে আছে না , রিন্তি
– হ্যাঁ , তো ??
– আমি ভাবছি ও-কেই তোর বউ করে আনবো এই ঘরে ।
– বিয়ে করে বউ আনার কি প্রয়োজন মা ?
– কি প্রয়োজন মানে , নিজের দিকে দেখেছিস , ঠিকঠাক মত বিয়ে করলে আজ একটা নাতি পুতি হতো ।

এমন সময় শান্তা মানে নাফিসের ছোট বোন মায়ের কথার উপর নিজের কথাটাও ছেড়ে দেয় ,

– ঠিকঠাক মত তো বিয়ে করতে চেয়েছিল তখন যখন আপত্তি করে কসম দিয়ে ছেলের পা আটকে রাখতে পেরেছো , তাহলে এখন আর ওর বিয়ের প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি ।

শান্তার কথায় আনিস বেপারি মুচকি হাসি দেয় আর রেহানা পারভিন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ।

– এক চড় মেরে সোজা করে ফেলবো , চিনিস তুই আমাকে ।
– না চিনার তো কিছু নেই , এই ভাইয়া তুই বিয়ে করিস না । দায়িত্ব বলেও জিনিস থাকে ভুলে যাস না । এক বোনকে সবে নামাতে পেরেছিস । আমায়ও নামাতে হবে ভুলে যাস না । তারপর আমাদের মায়ের জন্যে একটা আলিশান ফ্ল্যাট কিনবি । বউ আসলে তো আর এইসব পারবি না । তাই বলছি বিয়ে আর করবি কেন ?

এইসব বলে পার্স হাতে শান্তা বেরিয়ে যায় । মূলত নাফিসরা দুই বোন এক ভাই , নাফিস বড় তার ছোট দুই বোন । এক বোনকে গত এক বছর আগে বিয়ে দিয়েছে এখন বাকি আছে শান্তা । শান্তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এইবার ২য় বর্ষের ছাত্রী । নাফিস আর জুঁইয়ের সবটাই জানতো সে । মনে প্রাণে চেতেছিল জুঁই ভাবী হয়ে আসবে তাদের ঘরে । কিন্তু পরিস্থিতি সব উলটে দিল । যেদিন সব কিছু শেষ হয়ে যায় সেদিন রাতে নাফিস শান্তার ঘরে প্রায় ২ ঘন্টা শান্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে । ভাইয়ের এমন হৃদয় ভাঙা আহাজারিতে সেরাতে শান্তার কলিজাও কেঁপে উঠেছিল । তাই সেও এখন আর এইসব শুনতে পারে না । শান্তা উঠে চলে যাওয়ার পর পরই রেহানা পারভিন চেচামেচি শুরু করে দেয় ।

– মেয়ের কি চোপা হয়েছে দেখছো তোমরা ?
– ও তো ঠিক কথাই বলেছে । আজকে এত বিয়ে বিয়ে করে পাগল হচ্ছো কেন তুমি ? তখন তো,,,,,,,,,,
– থামো তুমি , নাফিস শুন ?
– প্রতিমাসে সংসার খরচ বাবদ সব টাকা পেয়ে যাবে শুধু আমায় আর দেখতে পাবে না , কথাটা মাথায় রেখে তারপর যা করবার করবে আশা করি । তুমি আমার মা , জন্ম দিয়েছো আমায় , তোমায় এর থেকে আর বেশি কিছুই বলতে পারবো না । শত হলেও আমি তোমার ছেলে , তুমি আমার মা ।

এইসব বলে নাফিস খাবার টেবিল থেকে উঠে যায় । আর রেহানা পারভিন সেখানেই বসে থাকে । আনিস সাহেবও উঠে যায় ।

বিকেলের দিকে ইফসিকে রেডি করিয়ে দিয়ে নিজে রেডি হয়ে দুজনে এক সাথে বেরিয়ে যায় । আজ ইফসি খুব খুশি , সে তার মায়ের সাথে বাহিরে বের হলে অনেক খুশি হয় তার থেকে বেশি খুশি হয় তাকে কেউ সাজুগুজু করিয়ে দিলে । দেড় বছরের ইফসিও বুঝে লিপ্পি দিতে হয় । আর জুঁইও ইফসিকে সাজিয়ে রাখে নিজের মনের মত করে । ইফসিকে বেশি সুন্দর লাগে দুই ঝুটিতে । আর জুঁইও তাকে ঝুটি করিয়ে রাখে । আর ইফসিও মাশা-আল্লাহ নিজের সাজ-গোজ এর ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক । এইটুকুন ছোট মেয়েকে তার মা যেভাবে রাখে সেইভাবেই থাকে ।

মা মেয়ে দুজনে রিক্সায় চড়ে ঘুরে । মেয়ে একবার তার মায়ের কোলে আবার একবার হাটে । সব থেকে অবাক করার কথা হচ্ছে ইফসিকে যেই দেখুক না কেন একবার না একবার ইফসির গাল ধরবেই । ইফসি দেখতে এতটাই মিষ্টি যে , যে কেউই একবার না একবার তাকে আদর করবেই করবে । আর এটাই জুঁইয়ের সব থেকে বড় ভয় ।

জুঁই ইফসিকে নিয়ে একটা শপিং মলে ঢুকে । ঘুরে ঘুরে দোকান গুলো দেখছিল । আসলে জুঁই একটু আনকমন ভালোবাসে বেশি । সে বরাবরই তার মেয়ের জন্য আনকমন জিনিস কিনতে ভালোবাসে । সব দোকান ঘুরে প্রায় ৭/৮ টা জামা কিনে ইফসির জন্যে । এই জামা গুলো দিয়ে ইফসির ভালোই চলে যাবে । ইফসি মায়ের পাশে থেকে আশেপাশে তাকায় । পাশেই সিরামিক শপ । গ্লাস করা দোকান গুলোর বাহিরে থেকে সব কিছুই দেখা যায় । শপের ভেতরে এক পাশে বড় বড় টেডি বেয়ার পুতুল গুলো রাখা আছে । ইফসি তা দেখে মায়ের কাছে বায়না ধরে ।

এখানের বিল মিটিয়ে ইফসিকে নিয়ে সেই দোকানে যায় জুঁই । তবে সেই সময়ে পুতুল গুলো কেনার মত সাহস তার ছিল না । পুতুল গুলোর গায়ে ট্যাগ লাগানো আছে । কোনটা ১২০০ তো কোনটা ১৫০০-৩০০০ এর মধ্যে । এমনিতেই ইফসির জামায় প্রায় ৩০০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে । মাস মাত্র শুরু । বাসা ভাড়া , বাজার সব মিলিয়ে পুরো মাসটা চালাতে হবে তাকে । তাই সব দিক ভেবেই মেয়েকে পাশে রাখা ছোট পুতুলের কাছে নিয়ে যায় । কিন্তু ইফসি ওই বড় বড় পুতুলের মাঝে পান্ডা পুতুলটাই কিনবে । ২৫০০ টাকা দিয়ে ওই পুতুল কিনে দেয়ার মত বিলাসিতার আমেজ এই মুহুর্তে জুঁইয়ের মাঝে নেই । তখন বাধ্য হয়ে দোকানেই ইফসিকে ধমক মারে জুঁই । মায়ের ধমক খেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেয় ইফসি । দুই হাত এক করে বুকের মাঝে ধরে রেখে কাঁদতে থাকে ছোট ইফসিটা । গড় গড় করে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে ইফসির চোখ দিয়ে । ইফসির কান্না দেখে দোকানদার জুঁইয়ের কাছে আসে । আর বলে ,

– ম্যাডাম , বাচ্চা যখন চাইছে কিনে দিন না ?
– আপনি কি ফ্রীতে দিবেন ?

জুঁইয়ের কথা শুনে দোকানদার চুপসে যায় । তখন জুঁই আবারও বলে ,

– বলুন , ফ্রীতে দিবেন ?
– তা কিভাবে দিবো ম্যাডাম ?
– তাহলে , এই মুহুর্তে ওই পুতুলটা কেনার সামর্থ্য আমার নেই ।
– আমরা ডিসকাউন্ট দিবো ।
– কতটাকা ডিসকাউন্ট দিবেন ভাই ? সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা তারপরও ১৫০০ টাকা । ওর মায়ের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকুর মাঝে থাকতে হবে ও-কে ।
– বাচ্চা তো বুঝে না ।
– তাই তো ধমক দেয়া , যাতে বুঝে যায় ।

দোকানদারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকায় জুঁই । কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে ইফসি । জুঁইয়েরও কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে । ইফসি কখনও এত বায়না করে না হয়তো পুতুলটা তার খুব ভালো লেগেছে তাই এত কাঁদছে সে । ইফসিকে কোলে তুলে নেয় জুঁই । ইফসি তখন দুই হাত মুঠোবন্দী করে মুখের সামনে নিয়ে কাঁদছে ।

– আম্মুন আবার কিনে দিবো , কেমন ?

ইফসি কেঁদে যাচ্ছে । এমতাবস্থায় ইফসিকে নিয়ে দোকানের বাহিরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় জুঁই । ঠিক তখনই কেউ একজন পিছন থেকে ইফসির নাম ধরে ডেকে দেয় ,

– ইফসি,,,,,,,,,,,?

ইফসির নাম অন্য কারো মুখে শুনে পিছনে তাকায় জুঁই । তখন দেখে সেই পুতুলটা হাতে নিয়ে নাফিস সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় জুঁই ।

– নাফিস এখানে ? এই সময়ে ? এই দোকানে ? কিভাবে এলো ?

এইসব প্রশ্ন গুলো নিজের মাথায় সাজাচ্ছে জুঁই । আর ওই ফাঁকে ইফসি জুঁইয়ের কোল থেকে নেমে গিয়ে নাফিসের কাছে যায় । পুতুলটা দেখে খুব খুশি হয় ইফসি । পুতুলটা তার থেকেও বড় তাই নাফিস ইফসিকে কোলে তুলে পুতুলটা তার হাতে ধরিয়ে দেয় আর ইফসি আনন্দে পুতুলটার গলা জড়িয়ে ধরে ।

জুঁই ইফসিকে ডেকে নিজের কাছে আসতে বলে । জুঁইয়ের কন্ঠস্বর শুনে নাফিস ইফসিকে কোলে নিয়েই জুঁইয়ের সামনে দাঁড়ায় । তারপর জুঁই আবারও বলে ,

– তোমাকে না বলেছি অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নিতে হয় না ।

তখন নাফিস বলে ,

– দেড় বছরের একটা বাচ্চা এত কিছু বুঝবে কিভাবে জুঁই ?
– বুঝতে হবে ও-কে ।
– আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রুটিনটা আমাদের ক্ষেত্রেই মানায় এদের ক্ষেত্রে নয় জুঁই । বাচ্চাটা পুতুল চেয়েছে ।
– আর তুমিও কিনে দিলে , কেন ? কোন অধিকারে ?
– জুঁই,,,,,,,,?
– ইফসি আসো আমরা বাসায় যাবো ।
– দাড়াও জুঁই , পুতুলটাও নিয়ে যাও । কারণ দেখো ইফসি আবার কাঁদছে ।

জুঁইয়ের এইবার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় । পারে না এখানেই ইফসিকে থাপ্পড় মেরে দেয় । নাফিস ব্যাপারটা বুঝে
জুঁইকে আবারও বলে ,

– ইফসির গায়ে একটা ফুলের টোকাও দিবে না তুমি । এটা ও-কে ওর আংকেল কিনে দিয়েছে । চুপচাপ এটা নিয়ে দোকান থেকে বের হবে । আর কোন কথা না ।

তখন জুঁইয়ের কোল থেকে নাফিস ইফসিকে আবার নিজের কোলে নিয়ে নেয় । তারপর পুতুল আর ইফসিকে নিয়ে নাফিস বের হয়ে যায় দোকান থেকে । না চাইতেও আপাতত এইসব মানতে হচ্ছে তাকে । না হয় ইফসিটা কাঁদতেই থাকবে আজ । শপিং মল থেকে বেরিয়ে নাফিস জুঁইকে বলে ওঠে ,

– বাসায় যাবে তো এখন ?
– হ্যাঁ ,
– চলো নামিয়ে দিয়ে আসি ।
– নাহ , আমরা রিক্সায় করে চলে যাবো ।
– বাইকে উঠো । একা একা কিভাবে যাবা , আমি নামিয়ে দিয়ে আসি ।

জুঁই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভাবে , রাতও প্রায় হয়ে গেছে । একা যাওয়ার থেকে নাফিসের সাথে যাওয়াটাই সেইফ হবে । তাই নাফিসের কথার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে নাফিসের বাইকে উঠে যায় জুঁই । ইফসিকে নাফিস তার সামনে বসায় । এই কয়েকদিনে নাফিস ইফসিকে খুব আপন করে নিয়েছে । প্রায় প্রতিদিনই অফিসে ইফসিকে দেখে নাফিস । পিচ্চি ইফসি সবার সামনে ঘুরে বেড়ায় । যেন ছোট খাট একটা জীবন্ত পুতুল সে ।

আর অন্যদিকে জুঁই ভেবে পাচ্ছে না কি হচ্ছে এইসব । আর কিভাবে হচ্ছে এইসব । আজ এত বছর পর পুরাতন ঘা আবার নতুন করে জ্বলছে । এইসব ভাবতে গিয়ে ধ্যানে হারায় জুঁই । তখন নাফিসের ডাকে তার ধ্যান ভেঙে যায় । নাফিস বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে । কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর জুঁই বাসায় ঠিকানা বলে । আর নাফিস সেই ঠিকানা অনুযায়ী বাইক নিয়ে গিয়ে থামায় ।

বাইক গিয়ে থামে জুঁইয়ের ভাড় বসার সামনে । জুঁই সেকেন্ড ফ্লোরে থাকে । জুঁই ইফসিকে কোলে নিয়ে শপিং ব্যাগ আর পুতুল নিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে । নাফিস সাহায্য করতে চাইলে জুঁই বাঁধা দেয় । নাফিস নিজ থেকেই বলে ওঠে ,

– আমায় বাসায় যেতে বলবে না ?
– তুমি কে হও আমার ?
– মানে ?
– মানে হলো , তুমি তো এখন পর পুরুষ । এখন পর পুরুষ বাড়িতে ঢোকাবো । ভালো দেখাবে ?
– জুঁই,,,,,,,,,,, ?
– হ্যাঁ জুঁই , আমি জুঁই চাই না এই সময়ে এসে আমার গায়ে কলঙ্ক উঠুক ।
– আমরা কি আবার এক হতে পারি না ?.

নাফিসের কথা শুনে জুঁই অবাক নয়নে নাফিসের দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে হালকা হাসি দেয় , আর বলে ,

– নাফিস একটা কথা বলি ?
– হ্যাঁ বলো ,
– আমি আমার আমিকে সাজিয়ে বড় যতনে তুলে দিয়েছিলাম তোমায় । ভেবেছিলাম আপন করে নিবে তুমি । আমার ভাবনার মাঝে ফারাক ছিল বিশাল । তাই তোমার বিস্তার আমার মাঝে হয় নি । আমাদের প্রেমের দাঁড়িপাল্লায় আমার প্রেমের ভাগ টা কম ছিল আর তোমার কথার ভাগ টাই বেশি ছিল । প্রেম নামের যুদ্ধের ময়দানে আমি আজ সর্বহারা এক হেরে যাওয়া বিধ্বস্ত নারী ।।

জুঁইয়ের কথায় নাফিসের শরীরের শিরা উপশিরা গুলো দাঁড়িয়ে যায় । কথা গুলো গল অবদি এসে আটকে গেছে তার । পরক্ষণেই জুঁই বলে ওঠে ,

– আসছি , ভালো থেকো । আর আজকেই শেষ , আর কখনো আমার মেয়েকে কিছু দিও না । ওর বুঝতে হবে ওর বাবা নেই , ও এতিম । ওর মা সামান্য মধ্যবিত্ত নারী যে কিনা মাসে ৩০ দিন অফিস করে রোজগার করে । ও-কে সব কিছুই বুঝতে হবে । আল্লাহ হাফেজ

জুঁই উপরে উঠে চলে যায় । নাফিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে । পরিস্থিতি আজ কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে যেখানে তার কাদম্বরী নিজেই নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে ।

.
.

চলবে…………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here