কবি বর পর্ব শেষ

গল্প : কবি বর | পর্ব : আট/শেষ পর্ব

বিয়ের দিন।
যখন সবাই হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত ঠিক সেই সময় দুরুদুরু বুক নিয়ে এক পা এক পা ফেলে এগোলেন আকমল চাচা। তার হাতে হলুদ খামে হিমেলের লেখা চিরকুট। সেটা যে করেই হোক আদ্রিতার হাতে পৌঁছে দিতে হবে। আকমল চাচা যখন ধীর পায়ে এগোচ্ছিলেন আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন, সেই সময় এক ভদ্রমহিলা তাঁর পথ আটকে দাঁড়ালেন। বিনীত হেসে বললেন,

“আপনাকে তো চিনলাম না?”

আকমল চাচার কাজ কাউকে কিছু না জানিয়ে চিঠিটা চুপচাপ আদ্রিতার হাতে পৌঁছে দেওয়া। অথচ, তিনি ভদ্রমহিলার প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলেন। এবং এতটাই ঘাবড়ালেন যে, আমতা আমতা করে শেষমেশ আসল কথাটা বলেই ফেললেন,

“আমাকে আপনে চিনবেন না। আদ্রিতা ম্যাডামের নামে একটা চিঠি আইছে। সেইটা দিতে আইছি।”

মুহূর্তেই ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর কেমন যেন বদলে গেল। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন,

“চিঠিটা আমায় দিন। আমি পৌঁছে দেব।”

আকমল চাচা সরল মনে ভদ্রমহিলাকে বিশ্বাস করে চিঠিটা দিয়ে যে পথ ধরে এসেছিলেন সেই পথ ধরেই হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, যার হাতে চিঠিটা দিয়েছেন তিনিই আদ্রিতার মা।

প্রিয় হলুদ পরী,
শুনেছি আজ আপনার বিয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা আমি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না। আর তাই আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বলছি, আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। জানি, এখন বলাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু না বলেও পারছি না। বিশ্বাস করুন, আপনার বিয়ে হয়ে গেলে আমি অসহায় হয়ে পড়ব। এতটাই অসহায় হব যে, শেষমেশ হয়তো মায়ের কাছেই চলে যেতে হবে।
জানি না কথাগুলো কেমন শুনাচ্ছে। তবে এর বেশি কিছু বলবার বা লিখবার সাধ্য আমার নেই। আপনি নিজের মতো করে বুঝে নেবেন। কেমন?
একটি আবদার, যদি মন সায় দেয়, যদি মনে হয় হিমেল নামের এই মানুষটা আপনাকে সত্যি ভালোবাসে তবে বিলম্ব করবেন না। চিঠির উল্টো দিকে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, চলে আসবেন। আমরা বিয়ে করব।

অপেক্ষায়,
আপনার কবি/কবি বর

লোকচক্ষুর আড়ালে দাঁড়িয়ে পুরোটা চিঠি পড়লেন তিনি। অতি সন্তর্পনে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে চিঠিটা দলা পাকিয়ে হাতের মুঠোয় রেখে সোজা আদ্রিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অন্য সময় আদ্রিতা মা’কে দেখলেই উঠে দাঁড়াত। আজ তা করেনি। যেমন বসে ছিল তেমনি জড় পদার্থের মতো বসে রইল।

অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আদ্রিতার মা নিচু আওয়াজে বললেন,

“তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি আদ্রিতা?”

আদ্রিতা চোখ তুলে তাকাল না। স্থির হয়ে বসে থেকে বলল,

“বলো।”

“তুই সত্যি কাউকে ভালো-টালো বাসিস না?” মায়ের গলায় সন্দেহের ছাপ স্পষ্ট।

“না।” আদ্রিতা সংক্ষেপে জবাব দিলো।

“তাহলে এটা কী?” বলে তিনি হাতের মুঠোয় রাখা চিরকুট এগিয়ে দিলেন। আদ্রিতা সেটা হাতে নিয়ে আনমনে পড়ল। তারপর যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় বলল,

“এ-নামের কাউকে আমি চিনি না। হয়তো চিঠিটা ভুল ঠিকানায় এসেছে। পৃথিবীতে তো আমি একা আদ্রিতা নই। আরো শত শত আদ্রিতা আছে। তাদের কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে।”

আদ্রিতার কথাটুকু মা বিশ্বাস করলেন ঠিকই তবে আদ্রিতার কণ্ঠস্বর দিয়ে অভিমান উথলে পড়ছে, তা মা’র দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি নিজেকে শান্ত রেখে আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই ছোটোমামা হুড়মুড় করে এগিয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,

“আপা, বাইরে গন্ডগোল লেগে গেছে। তাড়াতাড়ি আয়।”

আদ্রিতার আচরণে আর চিঠির লেখাগুলো পড়ে ততক্ষণে মা’র ভেতরটা পাথুরে মূর্তি হয়ে গেছে। তাই তিনি ছোটোমামার কথায় খুব বেশি অবাক হলেন না। উল্টো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন রে? গন্ডগোল কীসের?”

“আমি কী জানি! একটা লোক এসেছে। সঙ্গে য়্যাব্বড়ো বড়ো গাড়ি। গাড়ি ভরতি মানুষ। লোকটার বডি গার্ডও আছে। বলে কিনা তার ছেলের বউ নিয়ে যেতে এসেছে।”

“বলিস কী!”

“তবে কি মিথ্যে বলছি? শোন আপা, লোকটাকে আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না। ব্যাটাকে কোথায় যেন দেখেছি। টেলিভিশনে বোধহয়।” ছোটোমামা আনমনে কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর আবার বললেন, “ও, মনে পড়েছে। ব্যাটাকে টেলিভিশনেই দেখেছি। টেলিভিশনে একটা ইয়ে দেখায় না, ওই যে সবাই বক্তৃতা দেয় আর একজন বলে হা জয়যুক্ত হয়েছে, হা জয়যুক্ত হয়েছে। বলে না?”

“সংসদে?”

“হ্যাঁ, আপা। ওখানেই।”

ছোটোমামা বোকা কিছিমের হলেও মা মোটেও তেমন না। তিনি সংসদের কথা শুনে দ্রুত ঘর থেকে বেরোলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আবেদ হাসানকে দেখেই চিনতে পারলেন তিনি। মনে মনে বিড়বিড় করে বললেন, মন্ত্রী স্বয়ং আমার বাড়িতে!

আবেদ হাসান যখন তার হবু ছেলের বউ অর্থাৎ আদ্রিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আদ্রিতা গাড়ির কাঁচ দিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছিল। চলে আসতে আসতে নিজের মা’কে দেখছিল, অতি পরিচিত বাড়িটা দেখছিল, দেখছিল আশপাশের অতি পরিচিত এবড়োখেবড়ো, ভাঙা-আধাভাঙা রাস্তা। গাড়িটা যত ছুটছিল ততই দূরে চলে যাচ্ছিল সবকিছু। আদ্রিতা গুম হয়ে বসে থেকে ভাবছিল। এমন ঘটনা বিশ্বাস করার মতো নয়। এরকমটা কেবল গল্পের ক্ষেত্রেই হয়। বাস্তবে এমন আদ্রিতা, আদ্রিতার মায়ের মতো উদার মনের মানুষ, হিমেলের মতো প্রেমিক কিংবা হিমেলের বাবার মতো লোক নেই। বাস্তব জীবন বড়োই কঠিন।

চলে আসার আগে মা আদ্রিতার মাথায় আলতো হাত রেখে বলেছেন,

“সত্যি করে বল, চিঠির এই ছেলেটা যার বাবা তোকে নিয়ে যেতে এসেছে তাকে তুই ভালোবাসিস না?”

তখন আদ্রিতা জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মা যখন দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলেন তখন আদ্রিতা আস্তে করে মাথা নাড়াল। আর তখনই ঘটল অবিশ্বাস্য ঘটনা। আজই আদ্রিতার বিয়ে হবার কথা। এমন পরিস্থিতিতে আদ্রিতার ভালোবাসার কথা শুনে মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠার কথা। অথচ তিনি বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হননি। বরঞ্চ শান্ত গলায় বলেছেন,

“বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। আপনকে পর করে পর মানুষকে আপন করে সারা জীবন বাঁচতে হয়। তুই কাকে আপন করে ভালো থাকবি এটা তুই-ই ভালো জানিস। তাই জোর করব না। তুই যদি চিঠির ছেলেটাকে ভালোবাসিস তবে যা। তার বাবা তোকে নিতে এসেছে। বলেছে, আজই তোদের বিয়ে দেবে।”

মায়ের মুখে এমন অবাক করা কথা শুনে আদ্রিতা হা করে তাকিয়ে রইল। মা বললেন,

“ভাবিস না। এদিকটা আমি সামলে নেব।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here