কহিনুর পর্ব -১১

#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১

পশ্চিম আকাশে চাঁদ বাঁকা হয়ে কিরণ দিচ্ছে। বাড়ির ডান সাইডে থাকা আলোর ছিটা গেট পযর্ন্ত ছড়িয়ে আছে। অধরা ক্রমাগত পিছিয়ে আসছে। সামনের মানবটার দৃষ্টি ওর মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করছে। অধরা পেছনে ফিরে দৌঁড় দিবে সেই সময় লোকটা ওকে থামিয়ে দিলো। বলে উঠলো
> থামো মেয়ে, আমি তোমার ক্ষতি করতে আসিনি। কিছু বলতে এসেছি।
অধরা থমকে গিয়ে ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
> শুনতে চাই না আপনার কথা। ধবংস করতে চাইছেন তো আমাকে? আমি এমনিতেই ধবংস হয়ে গেছি।

অধরার কথা শুনে লোকটা হাসলো। ঠোঁট কামড়ে বলল,
> সন্দেহ করে দোষারোপ করা কি উচিৎ হচ্ছে? আমি খারাপ কিছু করেছি দেখেছো আজ অবধি? ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে তুমি খামাখা আমাকে ভয় পাচ্ছো। আমি ছোট থেকেই আলোতে যেতে পারিনা কারণ সূর্যের আলোতে আমার সমস্যা হয়। শরীর লাল হয়ে ফুলে উঠে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এটা এক ধরনের রোগ। তুমি এই বিষয় নিয়ে সন্দেহ করছো? আর কহিনুরের বিষয়টা ওটা ড‍্যাড দাদুর থেকে পেয়েছে। দাদু কি সব আজেবাজে কথাবার্তা বলে উনার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন। তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছো। আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমার ক্ষতি কেনো চাইবো আমি, বলো?
অধরা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। শাশুড়ির শেষ কথাটা বারবার কানের মধ্যে প্রতিধ্বনি করছে। কাউকে বিশ্বাস করা উচিৎ হবে না। তবুও কিছু বলা দরকার তাই বলল,
> আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার স্বামী চেয়েছেন তাই এখানে আছি। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নেই। আপনি কি এগুলো বলতেই এসেছেন?
লোকটা এক’পা দু’পা করে একদম অধরার সামনে এসে থামলো। দৃষ্টি ওর মুখের দিকে। অধরার অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা হেসে বলল,
> বিশ্বাস করছো না জানি। তবুও আমি চাই তোমরা ফিরে আসো। ভূল ধারনা নিয়ে বসে থেকে কি হবে বলো? নিজের চোখে না দেখলে সেটা নিয়ে চিন্তা করে কি হবে?
অধরা লোকটার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। মনে হলো চিৎকার করে সবটা বলতে কিন্তু পারলো না। কিছু বলতে চাইলো তাঁর আগেই অধরার পেছন থেকে জুবায়ের বলে উঠলো,
> ও এখানেই থাকবে আমার সঙ্গে। বাড়িতে নিতে পারলে আমাকে খুন করে আমার স্ত্রী সন্তানকে নিজের কব্জায় নিতে খুব সুবিধা হবে জানি। কিন্তু কি বলতো আমি আপাতত সেটা চাইছি না। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজের কথা ভাবে আমিও তাঁই ভেবেছি। কহিনুরকে না পেলে তোদের সমস্যা, আমার তো না? তাহলে আমি কেনো তোদের জন্য নিজের স্ত্রী ক‍ন‍্যাকে ত‍্যাগ করবো? কোন সুখ পাবো মিস্টার জামসেদ ফারুকী? ভালো করে শুনে নিন আপনার আর আপনার ড‍্যাডের কোনো পরিকল্পনা সফল হচ্ছে না।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। সামনে ওর ভাই জামসেদ ফারুকী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। হয়তো জুবায়েরের থেকে এসব আশা করেনি। জুবায়ের অধার হাতের কব্জি ধরে ফিসফিস করে বলল,

> ভেতরে যাও শীত পড়ছে। আমি কথা বলে আসছি।

অধরা কি করবে বুঝতে পারছে না। থাকা উচিত নাকি চলে যাওয়া উচিৎ? দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা হচ্ছে ওর থাকা শোভা পাচ্ছে না কিন্তু না থাকলে যদি এরা দু’ভাই ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তখন? জুবায়ের ওর সঙ্গে একবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দ্বিতীয়বার করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। করতেই পারে। তাছাড়া ও ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। স্বামী বলে তাঁকে কারণ ছাড়া বিশ্বাস করে ঠকার মনে হয়না। জুবায়েরকে ও আপাতত সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছে। অধরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুবায়ের আবারও বলে উঠলো,
> কি হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বিশ্বাস করতে পারো শেষবারের মতো।
অধরা কিছু বললো না। চুপচাপ ভেতরে চলে গেলো। জুবায়ের একবার পেছনে তাঁকিয়ে সামনে দৃষ্টি ফিরালো। জামসেদ তখনো চুপচাপ ছিল। অধরাকে যেতে দেখে চাপা কন্ঠে বলল,
> ভাই তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস? শোন আমি কিন্তু ইনোসেন্ট। যা হচ্ছে তাঁর বিন্দুমাত্র আমার হাত নেই। জানিস তো ড‍্যাড কেমন? দাদু উনার মাথায় আজেবাজে সব ঢুকিয়েছে। তাছাড়া তোর যদি অধরাকে নিয়ে আমাদের এই বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় তাহলে ওকে নিয়ে তুই দাদুর কাছে চল। ওখানে থাকবি। ওখানে দাদু দাদিমা সবাই আছে।
> এখানে থাকলে কি অসুবিধা? তাছাড়া তুই কেনো মাথা ঘামাচ্ছিস? আমার স্ত্রী কোথায় থাকবে সেটা না হয় আমি ভাববো। ড‍্যাডকে বলিস এসব কু কর্ম ছেড়ে ভালো হয়ে যেতে। আধুনিক যুগে বসবাস করে সেই আদিকালের মতো ফালতু জিনিস নিয়ে উনি পড়ে আছেন। তাছাড়া আমি তো এখন তোদের পথের কাঁটা। উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হলো কিন্তু হলো না। ভাই অযথা সময় নষ্ট করিস না। এবার যা আমি আসছি।
জুবায়ের কথা শেষ করে এক মূহুর্ত আর অপেক্ষা করলো না। হাটতে শুরু করলো। ওকে পেছন থেকে বহুবার ডাকা হলো। জুবায়ের ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অধরার পাশে গিয়ে বসলো। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর আগের চেয়ে হালকা ফোলা ফোলা লাগছে। পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরীরের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। মেয়েটাকে এতোদিন কেনো যে এভাবে দেখা হলো না এখন বেশ আফসোস হচ্ছে। তখন তো জুহি আর আরমান ফারুকীর জন্য চোখে পট্টি বাঁধা ছিল। জুবায়ের একমনে এসব ভেবে চলেছে। হঠাৎ অধরার কথা শুনে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। অধরা চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলো,
> দেখা শেষ হয়ে থাকলে বলুন উনি সত্যি সত্যি কোনো রোগে আক্রান্ত কিনা?
জুবায়ের থতমত খেয়ে বলল,
> আমি জানিনা। মাম্মা বলেন ও ছোট থেকেই এমন। ওর সুবিধার জন্য লুকিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।
> লুকিয়ে কেনো? লোকজন উনার অস্তিত্ব জানলে অসুবিধা কি হতো? নাকি অন‍্যকিছু। ধরুন ওর কাছে এমন কোনো পাওয়ার আছে যেটা আপনার কাছে নেই। আপনাকে খু*ন করে ওকে আপনার জায়গাই প্রতিষ্ঠা করবেন আপনার বাবা। আপনাকে হত্যার পেছনে আরও কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে সেটার খোঁজ করুন। এখানে বসে থেকে কিছু হবে না। চলুন এমন কোথাও যায় সেখানে গিয়ে পুরোপুরি রহস্যের সমাধান জেনে নিতে পারবো। আমাকে নিয়ে টেনশন নেই। বাচ্চা হতে এখনো অনেকটা সময় আছে। ততদিন আমাকে কিছু করবে না। বিপদ আপনাকে নিয়ে। জুবায়ের বসে থাকলে সমস্যা বৃদ্ধি হবে। বুদ্ধি নেই কেনো আপনার?
জুবায়ের অধরার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। এই মেয়েটার বুদ্ধি সত্যিই চমৎকার। ওর ভালো লাগছে অধরা ওকে নিয়ে চিন্তা করছে কিন্তু ওকি আদো মেয়েটার ভরসার যোগ্য? জুবায়ের কিছু একটা ভেবে বলল,
> ওই বাড়িতে পা রাখলেই আমি নিজের মধ্যে থাকি না। জানিনা কি হয় তোমাকে দেখতে পারিনা। রাগ হয় অশান্তি লাগে। আমি না চাইতে তোমার উপরে টর্চার করি। কিছু একটা আছে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। বোঝাতে পারবো না তোমাকে।
অধরা আগ্রহ নিয়ে বলল,
> আপনি তখন নিজের মধ্যে সত্যি থাকেন না। সম্মোহন করা হয়। কারো হাতের পুতুলের মতো আচরণ করেন। যাইহোক এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমি বুদ্ধি বের করছি। আপনি আমাদের যাওয়ার কথা ভাবুন। এখানে ফিরবো একেবারে সব রহস্য জেনে তারপর।
> আমাদের আরেকটি বাড়ি আছে তুমি জানো? সেখানে দাদু আছেন। ভাই বলছিলো ড‍্যাড এসব দাদুর কথায় করছেন। তুমি যাবে সেখানে?
অধরা একটুও চমকালো না। বাড়ি থাকতেই পারে। কারণ আরমান ফারুকী স্ত্রীকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় সেখানে থাকেন। কিন্তু সেই বাড়িতে কে কে আছে এটা ওর জানা নেই। কখনও বলতে শোনেনি। অধরা সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
> যাওয়ার ব‍্যবস্থা করুন। আর আপনার ভাইকে একটু বলবেন ভাতৃবধুকে বোনের নজরে দেখলে ভালো হয়। হারাম জিনিসের প্রতি উনার একটু বেশিই আগ্রহ। আমি যতই নিজেকে আড়ালে রাখি উনি সামনে চলে আসছেন।
জুবায়েরের খারাপ লাগছে,রাগ হচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
> সরি। তোমার সন্ধান কিন্তু ওই দিয়েছিল। আমাকে বলেছিল শুধু বিয়ের পরে একটা বাচ্চা হলে তোমাকে ছেড়ে জুহিকে বিয়ে করে নেওয়ার কথা। তাছাড়া তখন আমি ড‍্যাডের বাধ‍্য ছিলাম। ভাইবোনদের কথা ভেবেছিলাম।
অধরা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> বউরা সব সময় খারাপ হয়না। আপনাদের মতো পুরুষের বিয়ে করা সাজে না। ভাইবোনদের ভালো করতে নিষেধ করছি না তাইবলে নিজের সন্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দিবেন এটা কেমন কথা? আপনি জানেন ঘরের শান্তি হচ্ছে স্ত্রী সন্তান। যাইহোক বুঝতে হবে না। রহস্যের সমাধান করে আমাকে ছেড়ে দিয়েন। জুহি তো নেই আত্না ফাত্তা থাকলে ডেকে নিয়ে বিয়ে করে নিয়েন। আমি মেয়েকে নিয়ে থাকবো। তারপর যদি ভালো কাউকে পাই তখন বিয়ে নিয়ে ভাববো। আমি যথেষ্ট সুন্দরী । ছেলের অভাব হবে না। তাছাড়া আপনার ভাই আছেন তো। উনি বারবার আমাকে কু ইঙ্গিত….
অধরা বাকীটা বলতে পারলো না। জুবায়ের ওকে মুখ চপে ধরে রাগে ফুলছে। ভ্রু কুচকে বলল,
> বিশ্বাস ভেঙেছি শাস্তি হিসেবে সারাজীবন এক কক্ষে দুটো বিছানা তৈরী করে ঘুমাবো তবুও চোখের সামনে থাকা চাই। আমি খারাপ মানুষ সারাজীবন খারাপ থাকবো। মারামারি জোরজবরদস্তি সব আমার কাজ। ভালো হতেও চাইছি না। তুমি যদি এসব ফালতু চিন্তা করে থাকো আমিও খারাপ হবো। ভালোবাসা বাসির দিন শেষ। আমাকে দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করে আমার সামনে ঘুরবে সমস্যা নাই।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। অধরা জানতো এমন কিছুই হবে। জুবায়েরকে চিনতে ওর বাকি নিই। একটু চেতিয়ে দিলেই কাজ হয়েছে। যে ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সেখানে এই মাথা মোটা লোকটাকে নিয়ে গিয়ে বিপদ হবে কি কে জানে।
☆☆☆☆☆☆☆☆
গাড়ি চলছে জুবায়েরের দাদুর বাড়িতে। সকাল সকাল আঙ্কেল আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েছে অধরা। সঙ্গে আয়াত এসেছে। অধরা ওকে নিতে চাইনি কিন্তু ছেলেটা শুনছে না। যদি কোনো ঝামেলা হয় তাই জোর করে এসেছে। কাজের মেয়েটা আর মারিয়াও আছে। জুবায়ের মারিয়াকে রেখে কোথাও যায়না। বোনকে সঙ্গে রাখে। মেয়েটার মধ্যে কিছু ঝামেলা আছে। আরমান ফারুকী জানলে ঠিকই মেয়েকে নিজের কাজে লাগিয়ে দিবে। সকলের ছোট বোনটাকে ওর বাকী বোনদের থেকে আলাদা রাখে। ওরা বোবা বধির হতে পারে কিন্তু কিভাবে জানি মানুষের সব কথা বুঝে যায়। রাতের আধরে সব পার্টিতেও যায়। কোনো রাত মিস করে না। দীর্ঘ চার ঘন্টা পর গাড়ি থামলো বিশাল এক অট্টালিকার সামনে। বাড়িটার ধুসর রঙের। অধরা গাড়ি থেকে পা নামাতেই মনে হলো পুরো শরীর কেঁপে উঠে পড়ে যাবে। জুবায়ের ওকে ধরে ফেলল। দীর্ঘসময় গাড়িতে থাকার ফলে এমন হচ্ছে। মারিয়া এসে ওর হাত ধরে ইশারা করলো ভেতরে যাওয়ার জন্য। গেটের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ওদেরকে বরণ করে নিতে। বাড়ির ভেতরটাতে ছোটখাট একটা বাগান দেখা গেলো। আচার্যের বিষয় এখানে কোনো ফুল নেই। অধরাকে রাণীর মতো বরণ করা হচ্ছে এটাই ওকে ভাবাচ্ছে। কয়েকজন মিলে ওকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিলো। অধরা বসতেই সিঁড়ি দিয়ে একজন সাদা চুলের বৃদ্ধ লোক নেমে আসলো। অধরা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here