কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব -১৬

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-১৬)

————-
ইহান শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে।যেন এখনই গিলে ফেলবে। কঠিন দৃষ্টি অব্যাহত রেখে বেশ কড়া গলায় বলল,

– একদম ন্যাকামো করবে না। বেড়াতে আসতে চেয়েছ এনেছি কিন্তু কোনো প্রকার বাহানা নয়। ভদ্র ভাবে ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরে যাবে।

নিঝুমের মনটা ফের বিষিয়ে ওঠে। চোখের কোণে আবারও জলের আবির্ভাব। সে নিজের সিটে গিয়ে সোজা হয়ে বসে পড়ে। সিট বেল্ট টা লাগিয়ে নেয়। কোনো কথা মুখ দিয়ে বের করে না। ইহান সেসব দেখে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকায়। ফের ড্রাইভিংয়ে মন দেয়।

শুনশান নীরবতা বিরাজমান একটি জায়গায় এসে গাড়ি থেমেছে। বেড়াতে আসার পূর্বেই নিঝুম বলে দিয়েছিল এ জায়গার ঠিকানা। মূলত সেজন্যই এখানে গাড়ি থামিয়েছে ইহান। গাড়ি থেকে বেড়তে বেড়তে ইহানের গম্ভীর কণ্ঠ,

– চলে এসেছি। নামতে পারো।

নিঝুম চুপচাপ নেমে পড়ে। ততক্ষণে ইহানও বেড়িয়ে গেছে। ইহান আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখতে লাগল। নাহ!এখানে তো তেমন কিছুই নজরে আসছে না। এটা কোনো ঘোরার মতো পরিবেশ হলো। গুমোট স্বভাব সম্পন্ন ইহান মনের মধ্যে জমে ওঠা প্রশ্ন গুলোকে ওভাবেই ধামাচাপা দিয়ে নিঝুমের দিকে তাকালো। নিঝুম তখন কিছুটা দুরত্ব চলে গেছে। নিজের মনেই হেঁটে চলেছে। ইহান পিছু ডাকল না সে ও পেছন পেছন এগোতে লাগল। একটা নিরিবিলি লেকের পাড়ে নিঝুম বসে পরল। জায়গা গাড়ি পার্কিং প্লট থেকে বেশ ভালোই দুরে। নিঝুমের দেখাদেখি ইহানও তার পাশে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে বসল। নিঝুমের দৃষ্টি লেকের স্বচ্ছ পানিতে। ইহান সেদিকে একবার তাকিয়ে সে ও বিরক্তি ফেস করে একই কাজ করছে। মোটামুটি ভীষণ বিরক্ত সে। ঘুরতে আসার নাম করে এমন একটি জায়গায় আসল। সত্যিই মেয়েটা একটা আস্ত পাগলী। ইহানের বিরক্ততা যেন নিঝুম না তাকিয়েও ধরে ফেলল। অতঃপর দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলতে শুরু করল,

– এই মুহুর্তে আপনি নিশ্চয়ই আমার ওপর চরম বিরক্ত। ভাবছেন! এমন একটা জায়গা ঘোরার জন্য কী করে উপযুক্ত হতে পারে। এখানে ঘোরা বা দেখার মতো কী ই বা আছে।

নিঝুম একটু থেমে আবার শুরু করল,
– এই জায়গা টা সবকিছুর জন্য উপযোগী নয় বলেই আমি এখানটা সাজেস্ট করেছি। আমার উদ্দেশ্য সফলের জন্য এটাই বেস্ট জায়গা।

ইহান মোটেও অবাক হলো না। সে হয়তো আন্দাজ করতে পারছে নিঝুমের মতিগতি। তার দৃষ্টি সাবলীল। নিঝুম সেদিকে এক পলক তাকিয়ে ফের লেকের পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
কিছুক্ষণ চলল পিনপতন নীরবতা। অতঃপর,

– এভাবে আর কতদিন চলবে মি. খান?

নিঝুমের মুখ থেকে মি.খান সম্মোধন টা এই প্রথম শুনছে ইহান। এর আগে কখনো শোনার সৌভাগ্য হয়নি। ইহান দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করল। কিছুক্ষণ বাদে ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল,

– চলছে চলুক না। দেখি কতদূর চলতে থাকে এভাবে।

– এটা কোনো সুস্থ বুদ্ধিমান সম্পন্ন মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষের উত্তর হতে পারে না।

– তবে ধরে নাও আমি অসুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী।

– হেয়ালি করার মতো মনের অবস্থা এখন আমার নেই। আ’ম সিরিয়াস।

ইহান বুঝতে পারল নিঝুম ভোলানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করা এতটা সহজ হবে না। সে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,

– বলো কী জানতে চাও?

– অনেক কিছু। আমাকে বিয়ে করার পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী? আপনি যতই বলুন না কেন আমার অপরাধের শাস্তি দিতে এবং আপনার পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কিন্তু আমি জানি এটা আসল সত্যি নয়। আপনাকে এই কয়েকমাসে যতটুকু চিনেছি তাতে করে এই সামান্য লজিকে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা স্বাভাবিক নয়। আপনার সঙ্গে আমার বাবা,ভাইয়ের ও কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে,রিসেপশনে আমাকে পাঠানো সেই ভয়ংকর উপহার, আপনাকে বার কয়েক রাস্তায় মারপিঠ করতে দেখা, ইরার সঙ্গে কলেজের নিহান বলে ছেলেটার সম্পর্ক, নিহানের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া,মায়ের পায়ের অবস্থা, বাবার মৃ’ত্যু আর পশ্চিম পাশের ওই রুমটা ঘিরে রয়েছে অজস্র রহস্য যেটা আমি অজানা। আপনারা সকলে সমানে আমার থেকে কিছু একটা লুকিয়ে চলছেন। কিন্তু আমি সেই গোপন রহস্য টা জানতে চাই। জানতে চাই আমি কেন আপনাকে এতটা ভালবাসা সত্ত্বেও, আপনার বিয়ে করা বউ হওয়া সত্ত্বেও আপনার কাছ থেকে শুধু অবহেলাই পেয়ে আসছি? সকল কিছুর উত্তর আমার চাই।

ইহান বেশ ধৈর্য সহকারে নিঝুমের প্রতিটি কথাই শুনে নিল। নিঝুম বর্তমানে হাঁপাচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে কথা বলায় বেশ ধকল গেলো শরীর, মন দুটোর ওপরই। নিঝুমের চোখে জল চিকচিক করছে। ইহানের মুখ থেকে পজেটিভ কিছু শোনার অপেক্ষায় সে। ইহান নিজেকে ভেতর থেকে শক্ত করতে চেষ্টা করছে। আর নয়! আজ নিঝুমকে সব ঘটনা খুলে বলবে সে। সব শুনে নিঝুম কীভাবে নিবে ব্যাপারটা? নাহ!এতকিছু ভাব্বার সময় নেই। আজ যে করেই হোক নিঝুমকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনতে হবে। ভেতরে ভেতরে মেয়ে টা বেশ কষ্টে আছে।

—————
ইরা মায়ের ঘরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অনিলা খান সেদিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলেন মেয়ের উপস্থিতি। চশমার ফ্রেমটা একটু উপরে তুলে আলতো কন্ঠে বললেন,

– ভেতরে এসো।

ইরা চমকে উঠল। মা বুঝে গেল। সবসময় এমনটাই হয়। ইরা চুপিচুপি এলেও তার মা ঠিক ধরে ফেলেন। ইরা অপরাধীর ন্যায় অনিলা খানের পাশে গিয়ে দাড়াল। অনিলা খান বই থেকে মুখ তুলে বললেন,

– বসো

ইরা তার পাশে বসে পরল। অনিলা খান মেয়ের মুখে হাত রেখে বললেন,

– কী হয়েছে এমন লাগছে কেন? মন খারাপ তোমার?

ইরা কথা ঘুরিয়ে প্রতিত্তোরে বলল,

– তোমার কোলে একটু মাথা রেখে শোবো।

অনিলা খান চমকে উঠলেন। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। তার এই মেয়েটার এমন আবদার করা মানে ভয়ংকর কিছু হয়েছে। সেই ছোট থেকে ইরার যখন প্রচন্ড মন খারাপ হয় তখন সে মায়ের কোলে ঠাঁই খোঁজে। অনিলা খানের চোখে এই ব্যাপারটা খুব সুষ্ঠু ভাবেই ধরা দেয়। ইরা ছোট থেকেই শক্ত সামর্থ্য মনের অধিকারীনি রমনী। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে গেলেও বাহিরে প্রকাশ করার পাত্রী নয়। তার মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ভিন্ন। অনিলা খান দ্রুত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই ইরা চট করে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল। অনিলা খান বেশ ধীরে সুস্থে ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ইরার চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে নামছে অশ্রু ধারা। অনিলা খান বুঝতে পারছেন মেয়ের আকুতি। কিন্তু এই মুহুর্তে চুপ থাকাই শ্রেয়। ঠিক তখনই দরজায় বেলের আওয়াজ শোনা যায়। অনিলা খান কিঞ্চিৎ খুশি মনে বলে ওঠে,

– ইহান,নিঝুম ফিরল বুঝি

ইরা কিছু বলল না। চুপচাপ সেভাবেই পড়ে থাকল। বেশ কয়েক মিনিট পর তাদের সামনে উপস্থিত হলো কাজের মেয়ে রাহিমা। রাহিমাকে দেখে অনিলা খান বললেন,

– কী হয়েছে হাঁপাচ্ছিস কেন? ইহান, নিঝুম ফিরেছে?

রাহিমার অস্থির কন্ঠ,
– খালাম্মা খালাম্মা একটা মস্ত বড় উপহার আসছে। কিন্তু কে দিছে জানি না কিছু বলে নাই। কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দেখি দরজার সামনে ওইটা ফালানো আশেপাশে আর কেউ নাই। আপনে চলেন এখনি দেখবেন কী আছে ভেতরে।

ইরা,অনিলা খান দুজনেই বিস্মিত। ইরা দ্রুত বিছানা থেকে নেমে অনিলা খান’কে হুইলচেয়ারে বসাল। অতঃপর তিনজনে অগ্রসর হলো লিভিংরুমে।

ওমা গিফট তো নয় যেন একটা কফিন বক্স। ইরা বিষ্মিত মনে গিফট থেকে র‍্যাপার আলাদা করতে লাগল। বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। অনিলা খান সহ বাড়ির প্রত্যেকটি মেড সার্ভেন্ট সেখানে উপস্থিত। সকলের দৃষ্টি শঙ্কিত, মন চঞ্চল, বক্ষ দুরুদুরু। ইরা র‍্যাপার পুরোপুরি খুলতেই ভেতর থেকে সত্যিই একটা কফিন সাইজ বক্স বেড়িয়ে এলো। মুখটা এখনো বন্ধ। ইরার হাত কাঁপছে। কিছুতেই সাহস করে বক্সটি খুলতে পারছে না। অতঃপর একজন পুরুষ মেড সার্ভেন্টকে ইশারায় বক্সটি খোলার আদেশ করল এবং নিজে কিছু টা দুরত্ব বজায় রেখে দাড়াল। বক্সটি খুলতেই সকলে ঘাবড়ে গেল। ইরা ভয় পেলেও শক্ত মনের মেয়ে হওয়ার দরুণ মুখে টু শব্দটিও করল না। কিন্তু ললাটে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট। বার কয়েক শুকনো ডোক গিলে খেলল অনায়াসে। অনিলা খান স্তব্ধ। বাকিরা সবাই ভয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেছে। কী বিভৎস দৃশ্য। এমন নৃ’শং’স মৃ’ত্যু কার হলো? কার এই লা’শ’টি। মুখের এমন বিশ্রী অবস্থা করেছে যে চেহারা দেখে চেনার জোঁ নেই। রক্তে মাথা একটি চিরকুট ওপরে ভাসমান। তাতে স্পষ্ট তাজা রক্তে লেখনি, “ছাড়ব না।” ইরার বুকটা মুহূর্তেই ধক করে ওঠে। কে এটা? কে? কে?কে?

অনিলা খান কম্পিত কন্ঠে হাসফাস করতে করতে বলেন,
– ওরা এখনো বাহিরে…..

ততক্ষণে ইশান চুলের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে চুল সেট করতে করতে নিচে নেমে আসছে। সবাইকে এমন নির্জীব দেখে ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে এলো তার। সবাইকে সরিয়ে সামনে যেতেই স্তব্ধ সে ও। অনিলা খান প্রচন্ড রুপে কাঁপছেন। হয়তো যেকোনো মুহূর্তে হুইলচেয়ার থেকে পড়ে যেতে পারেন। উনি কাঁপতে কাঁপতেই ফের বলেন,

– ইশান.. নিঝুম, ইহান এখনো বাহিরে।

ইশান দৌড়ে গিয়ে অনিলা খান’কে জড়িয়ে নিল। ইরাকে ইশারায় ফোন করতে বলল ওদের। ইরা ফোন করল। সকলেই উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইশান ইশারায় জিজ্ঞেস করল, “ফোন ধরেছে কী না?” ততক্ষণে ইরার হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ে গেছে মেঝেতে। অস্পষ্ট স্বরে তার উত্তর, “সুইচড অফ।”

—————–

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

(….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here