“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না ভাইয়া।প্লিজ আপনি কিছু করেন।”
হাতের চায়ের কাপটা নিশান ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম আমি।আমার উচ্চারিত বুলি কর্ণগোচর হতেই মোবাইলের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।ধাতস্থ কন্ঠে ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন,
“তা কখন বিয়ে করতে চাস তুই?আর আমাকে কিই বা করতে বলছিস?”
নিশান ভাইয়ের প্রতিউত্তরে আহত হলাম আমি।উনি আমার মামাতো ভাই হলেও সব বিষয়ে আমাকে সাপোর্ট করে এসেছে এতোদিন।বাস্তবতার ভীড়ে যখন অতিষ্ট হয়ে যেতাম এক চিলতে বিনোদোন দিয়ে সব স্বাভাবিক করতে উনিই যথেষ্ট ছিলো।যদিও আমাকে কড়া শাসনে রাখার স্বভাব ওনার।
তবুও আমার ছোট খাটো সব আবদার পূরণ করেন তিনি।একারণেই ভেবেছিলাম নিশান ভাইয়া অন্তত আমাকে বুঝবে।এ বিয়েটা ক্যানসেল করতে সাহায্য করবে।কিন্তু উনি উল্টা ত্যাড়া কথা শোনাচ্ছেন আমাকে।চোখের কোনে হালকা পানি জমে গেলো।অতি প্রিয়জনের কাছে আশা নিয়ে কোন প্রস্তাব উপস্থাপন করে নিশ্চিত প্রত্যাখানের আগামবার্তা পেলে এমন হওয়াই স্বাভাবিক।অন্য সময় হলে চলে যেতাম আমি।কিন্তু কোন উপায় নেই।আমার শেষ ভরসার জায়গা উনি।আমি ধরা গলায় বললাম,
“তেমন কিছু না।বিয়েটা শুধু ক্যানসেল করে দিতে বলছি।”
গলার আওয়াজ শুনে হয়তো বুঝে গিয়েছেন আমার অবস্থা।এখনই টুপ করে ফেলে দিবো চোখের পানি।বিষ্মিত হলেন উনি।আমি সহজে কান্না করার পাত্রী না।এটা ভালোই বোঝেন তিনি।ধমকের সুরে বললেন,
“স্টুপিড।একদম কান্না করবি না।কান্না করলেই কি তোর বিয়ে ভেঙে দিবো ভেবেছিস?”
“এখন কান্না আটকিয়ে সারাজীবনের কান্নার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।অদ্ভুত না ব্যাপারটা।”
“তার চেয়ে বেশী অদ্ভুত ব্যাপার কি জানিস তোর বিয়ে ভাঙতে সব মুরুব্বী বাদ দিয়ে আমার কাছে এসেছিস।নাকি আমাকেও তোর হবু বরের মতো বুইড়া মুরুব্বী ভাবিস?”
“মুরুব্বী ভাববো কেন।আপনি ছাড়া আমাকে বোঝার মত আর কে আছে বলেন।আপনিই তো আমার সব আবদারের জায়গা।”
আমার উত্তরে মুগ্ধতায় পূর্ণ আশ্বস্ত একটা হাসি দিলেন উনি।যেন আমার বলা শেষ বাক্যটি ওনার জীবনের পরম প্রাপ্তি।অতঃপর চিরচেনা স্বভাবে ফিরে বললেন,
“তোর বিয়ে ভেঙে আমার ফায়দা কি বল।পরে তো বলবি তোর সুখ সহ্য হয় না বলে বিয়েটাও ভেঙে দিয়েছি।”
“আজব তো।আমি এটা কেন বলব।আমি নিজেই তো আপনাকে বিয়ে ভাঙতে বলছি।”
“তাও বলতে পারিস।তোর মতিগতি বোঝা কঠিন।একদম তোর বাবার স্বভাব পেয়েছিস তুই।কখন কি বলিস নিজেও জানিস না।”
“দেখেন এখানে আব্বুকে তুলবেন না।আপনি তো আমার বাবার চেয়েও খারাপ।সামান্য একটা ব্যাপার তাও ফায়দা খুজতেছেন।”
“ফায়দা খুজব না।তোর বিয়ে হইলে আমার চরম লাভ।এই যে বসে বসে আমার বাবার অন্ন ধ্বংস করতেছিস।এইটা বেঁচে যাবে।”
“আপনার বাবার অন্ন হল কিভাবে?আমার বাবা যে মাসে মাসে টাকা দেয় তা কি বন্যার পানিতে ধুয়ে যায় নাকি?”
“শোন ভালো ছেলে,ধনী পরিবার।দুইটা কাজের লোক আছে ও বাড়ি।কোন যৌতুক না শুধু তোকেই চেয়েছে।বিয়েটা করলে ভালো থাকবি।এমন প্রস্তাব কেউ হাতছাড়া করে নাকি?”
“যদিও ছেলের বয়স বেশী।তারপরও আমার মনে হয় ওদের ভিতরে হয়তো আরও কোন রহস্য আছে।বিনা কারণে কি আর এতিম কোন মেয়েকে কেউ যেচে বিয়ে করায় বলেন?”
“সবচেয়ে বেশী রহস্য হল তুই তোর বাবার মত খাটাস হলেও অসম্ভব সুন্দরী।এটাই ওদের বিয়ে করাতে চাওয়ার কারণ।এটা ভেবে বিয়ে না করার দরকার নেই।”
“আপনিই না বলতেন অনেক বড় হব আমি।অনেক পড়াশোনা করব।প্রতিষ্ঠিত হয়ে অন্যের করুণামুক্ত হব।আমার শত কষ্টের অবসান ঘটাবো।তাহলে এখন বিয়ে করতে বলছেন কেন?”
আমার উত্তরে অবাক হলেন তিনি।দুই ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,
“আমি আবার তোকে কখন বিয়ে করতে বললাম?”
আমিও ছাড়বার পাত্রী নয়।সাথে সাথে উত্তর দিলাম,
“কথা ঘুরাচ্ছেন কেন?মাত্রই তো বুঝাচ্ছিলেন।”
“কথা আমি ঘুরাচ্ছি নাকি তুই ঘুরাচ্ছিস।বিয়েতে অমতের আসল কারণ বল।”
এবার একটু সিরিয়াস হলাম।শাণিত কন্ঠে বললাম,
“আমি পড়াশোনা করতে চাই ভাইয়া।আর আমার তো আঠারোই হয়নি এখনো।”
প্রতিউত্তরে এক চিলতে হাসি দিয়ে উনি বললেন,
“শুধু কি এই জন্যই বিয়ে করবি না নাকি অন্য কোন রহস্য আছে বল?”
“আজব।অন্য কি রহস্য থাকবে?”
“না আবার ভাবতেও পারিস যেই বাড়িতে বড় হয়েছিস সেই বাড়িতেই চিরস্থায়ী হতে।বাড়ির একমাত্র ছেলেটা দেখতে শুনতে কোন দিক দিয়েই তো খারাপ নাহ।”
ওনার নেশা জড়ানো কন্ঠ।এই একটা কথায়ই বার বার আটকে যাই আমি।বুকের মাঝে দ্রিম দ্রিম করছে।ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলাম।বাড়ির একমাত্র ছেলে বলতে তো ওনাকেই বোঝাচ্ছেন।মানুষটা এমন কেন!আমি ওনার প্রতি দুর্বল প্রত্যেকটা কথার দ্বারাই এটা প্রমান করার চেষ্টা করেন।তারপর এইটা নিয়ে মজা নেন।এবার আর চুপ রইলাম না আমি।এর একটা বিহীত দরকার।সাথে সাথে প্রতিবাদ করলাম,
“আমি কি একবারও বলেছি আপনাকে পছন্দ করি?”
“যার মনে যা লাফ দিয়ে ওঠে তা।আমিই কি একবারো ওইটা বলেছি?”
“তো কি বুঝালেন ওইটা দিয়ে?আমি কি বুঝি না ভেবেছেন?”
“তুই আসলেই কিছু বুঝিস না।সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেস।কিন্তু এতো সময় যে উল্টা পাল্টা বক বক করে মাথার বারোটা বাজিয়েছিস।এখন মা’থাটা টিপে দে।”
“আমি কি আপনার চাকর নাকি যে মাথা টিপে দেব?”
“চাকর হলে পা টিপে দিতে বলতাম।অবশ্য চাকর থেকে কোন অংশে কম না তুই।এখন পা ও টিপে দে।ঠিকঠাক কাজ করলে বিয়ে ক্যানসেল।আর না করলে বিয়ের দিন-তারিখ পরশুদিন ঠিক করব।”
সুকৌশলে কথা ঘুরিয়ে ফেললেন উনি।আমি আর কথা না বাড়িয়ে হাত বাড়াতে লাগলাম ওনার মাথায়।কোন কারণ ছাড়াই আমার দুই হাত কাঁপছে।ওই মাথায় হাত দেয়ার সাহস যে আমার নেই।অজানা এক অনুভুতি জেকে বসছে আমার মাঝে।হটাৎ কি মনে করে উনি বললেন,
“থাক কাপটা নিয়ে চলে যা।এখন কাজ করালে তো পরে আবার খোঁচাবি এইটা নিয়ে।আর আমাকে বিরক্ত করবি না।এখন পড়ব আমি।”
আমিও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে প্রস্থান করলাম।আমার নাম অদ্বিতা এরিন।বাবা-মা সখ করে নামটা রেখেছিলো।আইরিশ ভাষায় এরিন অর্থ নাকি শান্তি।তাদের সংসারে চরম অশান্তির সময় মায়ের গর্ভে আসি আমি।তারপর অনেকদিন বেশ ভালে কাটে তাদের সংসার জীবন।আমার আগমনের বার্তা এই শান্তি এনেছিলো বলেই উক্ত নামটা আমার প্রাপ্য করে দিয়েছে।কিন্তু তাদের এই সুখ চিরস্থায়ী হয়নি।ভেঙে গেছে তাদের সংসার।আব্বুও তার মত বিয়ে করে আরেক সংসার নিয়ে ব্যস্ত।আম্মুও সেম।তাদের দুজনেরই অন্য ঘরে সন্তান রয়েছে।তাই আমার অভাব বোধ করে না কেউ।কিন্তু আমার বাবা-মা কেউ না থাকায় প্রতিক্ষনে মিস করি তাদের।তাদের সংসারের বিচ্ছেদ আমার শান্তি অর্থপূর্ণ নামযুক্ত জীবনে অশান্তির মূল কারণ।বাবা মাসে মাসে টাকা দিয়েই তার কর্তব্য বরাদ দেয়।আর মা থাকার জায়গাটা ফিক্স করে দিয়েছে।নানির বাড়ি থেকে বড় হয়েছি আমি।মাঝে মাঝে অবশ্য দাদুবাড়িও যাই।এদের দ্বারা অনেক অপমানিত অবহেলিত হলেও শেষ ঠাইটুকু এরাই দিয়েছে।অবশ্য এর জন্য গুনতে হয় আমার অনেক কিছু।একটা এতিম বাচ্চার জীবন যেমন কাটে আমারও তেমন।বাড়ির কিয়দংশ কাজ আমাকেই করতে হয়।বাবার পাঠানো টাকার বেঁচে যাওয়া অংশটুকু মামির কাছে জমা পড়ে।সেই দুই তিন দিন যা ভালো ব্যবহার পাই।তারপর সব আগের মত।যদিও নিশান ভাইয়ের উপস্থিতি আমার প্রেসার কমিয়ে দেয় অনেক।
নিশান ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স করছে।বাংলা নিয়ে যারা পড়ে তারা নাকি অনেক রোমান্টিক হয়।বিভিন্ন উপন্যাস,কবিতা এসব পড়ে।কিন্তু ওনার মাঝে রোমান্টিকতা বলতে কিছু নেই।তবে অনেক দ্বায়িত্ববান একটা মানুষ এটা বলা যায়।
এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আমি।একটা ভালো ঘর থেকে প্রস্তাব আসায় বাবার অনুপস্থিতিতেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন আমার মামা,মামি।অবশ্য আব্বু এতে অমত করবেন না।তিনি শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া আমার কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেয় না।আমি নিশ্চিত মামা জিজ্ঞেস করলে আব্বু বলবে আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করেন।বিয়ের সময়ও উপস্থিত হবেন কিনা জানা নেই।শুধু খরচের কিয়দংশ পাঠিয়ে দিবেন নিশ্চিত।
এসব ভেবেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম আমি।
________
কেটে গেছে দশদিন।নিশান ভাই বিয়ে নিয়ে মামিদের কিছু বলেছে হয়তো।আপাতত বিয়ে নিয়ে কোন কথা হয় না।আমিও বেশ ফুরফুর মনে আছি।ঘড়িতে রাত ৮টা বাজে।টেবিলে খাবার সাজিয়ে মামা মামিকে ডাকতে যাব।এমন সময় দরজার বাহিরে থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলাম মামার কন্ঠ,
“মেয়েটাকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া কি আসলেই ঠিক হবে বল।ওর খরচ তো আর আমরা দেই না।উপরন্তু কাজের মেয়ের কাজটুকু ওকে দিয়ে করানো যায়।তোমারও সুবিধা হয়।শুধু থাকার জায়গা দিয়েছি মাত্র।”
মামি সাথে সাথে প্রতিবাদ করল,
“শুধু থাকার জায়গা দিয়েছি মানে।ওর পড়াশোনা,ভর্তি,আনুষঙ্গিক কাজ এইগুলা কারা দেখে?ওর বাবা তো খালি টাকা দিয়েই লাপাত্তা।এইগুলা কি আমাদের দেখার দ্বায়িত্ব?জন্ম কি আমি দিয়েছি?সারাদিন জ্বালায়া মারে আমাকে।এইটা লাগবে ওইটা লাগবে।ওর যে চাহিদা ওই গোনা টাকায় কি তা পোষানো যায়?”
“তাও ক্যান্সার আক্রান্ত একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া মন টানে না।”
“ক্যান্সার আক্রান্ত তো কি হয়েছে।মানুষ কি সুস্থ হয় না।আর সুস্থ না হলেও এরিনের নামে অনেক সম্পত্তি গড়াবে।আলিশান বাড়ি ওদের।এরিন সুখেই থাকবে দেখো।তাছাড়া এই বিয়েটা হলে ওরা এক দুই টাকা না পুরা ২০লাখ টাকা দিবে বলেছে।যা দিয়ে তু্মি ব্যবসা গোছাতে পারবে।”
“যতই হোক ভাগনি তো ও আমার।একটা অবৈধ বাচ্চা নিয়ে অভিশপ্ত জীবন কাটাবে এটা আমি মানতে পারব না।”
“ভালো কি আমি ওকে বাসি না?এর চেয়ে ভালো বিয়ে ওকে দিতে পারবে বল?যেখানে ওর বাবারও মত আছে তোমার আপত্তি কিসে?আর অবৈধ তো কি হয়েছে!বাচ্চা তো বাচ্চাই।ওদের বংশ পরিচয়েই থাকবে।বাইরের লোকে কি জানবে কিছু।বিয়েটা আজ রাতেই হোক এটাই চায় ছেলের পরিবার।ওরা চলে আসছে প্রায়।নিশানও নেই।এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হবে না।”
এটুকু বলেই থেমে যায় মামি।আমি আর কিছু শুনতেও পারিনি।মাথা ভো ভো করে ঘুরছে।চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে।কি করব এখন আমি।মাথা শূন্য অনুভুত হচ্ছে।হটাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল।ওরা কাজী সহ বিয়ে করতে এসে গেছে।মামি ভীষন খুশি।মামাতো বোন সাজাতে এসেছে আমাকে।সেও মামির মতোই আচরন করে।সে এসে শাড়ী গহনা সব আমার সামনে বিছিয়ে দিলো।এসব পড়েই হবে আমার ভাগ্যের নিকৃষ্ট পরিবর্তন।হটাৎ..
#চলবে
#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_১
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা