কাকতাড়ুয়া পর্ব -০২

#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_২
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা

হটাৎ আমার জন্মদাতা মায়ের আগমন ঘটে।দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি।এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামছেন তিনি।ঘামে ভিজে রয়েছে পুরো শরীর।জোরে দৌড় দেওয়ার ফল এটা।এই বয়সেও দৌড় দেওয়ায় হাঁপিয়ে গিয়েছেন আম্মু।আমার আম্মুকে দেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি।বর্তমানে এই একটা মানুষকে এ বাড়িতে আমার বিশ্বাস এবং ভরসাযোগ্য লাগছে।আম্মুর পিছনে নিশান ভাইকেও দেখলাম।বুকে যেন আরও একটু জোড় পেলাম।এসেই নিশান ভাই থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কি হচ্ছে এখানে?এতো মানুষ কেন?”

নিশান ভাইয়ের প্রশ্নে কিছুটা কেঁপে উঠলেন মামা এবং মামি।নিশান ভাই তাদের একমাত্র ছেলে।প্রচুর ভালোবাসেন ওনাকে।তার উপর আবার প্রচুর রাগী প্রকৃতির মানুষ।তিনি না করে যাওয়ার পরও বিয়ে দিচ্ছে এটা জানলে পুরো বাড়ি ছাড়খার করে দিতে এতটুকু ভাববেন না নিশান ভাই।এটা সবারই জানা কথা।সবাইকে চুপ থাকতে দেখে আবারও প্রশ্ন করেন,

“কি হল চুপ করে আছো কেন?কি হচ্ছে এসব?”

“আসলে আমরা বিয়েটা আজকেই…”

বরযাত্রির মাঝে থেকে একজন উত্তর দিতে নিয়েছিলো।নিশান ভাই হাত উচু করতেই থেমে গেলেন তিনি।রাগে থরথর করে কাঁপছে নিশান ভাই। চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।সেই অগ্নিচোখে আবার তাকালেন মামির দিকে।গম্ভীর কন্ঠে আবারও বললেন,

“আমি না করার পরও এরিনকে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করলে কিভাবে তোমরা?কি ভেবেছ এসব করলে আমি কিছুই জানব না?নাকি বিয়ে হয়ে গেছে ভেবে পরে চুপ করে থাকব।এমনটা ভাবলে কি করে তোমরা?”

মামা,মামি তখনও চুপ করে আছে।আম্মুও কেন কথা বলছে না।তবে তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে নিশান ভাইয়ের কথা বার্তায় বেশ মজা পাচ্ছেন তিনি।এ বাড়িতে আমার সাপোর্ট এ কোন কথা বলে পাত্তা পাবেন না তিনি।সে কি আর আমাকে তার সাথে নিয়ে যেতে পারবেন নাকি?রাখে তো মামারাই।তাই আম্মু কোন কথা তোলেনি।শুধু শুধু অপমানিত হয়ে কি লাভ।যেখানে ভাতিজার দ্বারা কাজ হয়েই যাচ্ছে।
নিশান ভাই এবার পাত্রদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“এ বিয়ে হবে না।আমাদের মেয়ে অতো সস্তাও হয়নি এখনো।আপনারা আপনাদের রাস্তা মাপুন।”

পাত্রের বাবা শাণিত কন্ঠে উত্তর দিলেন,

“দেখো বাবা বেশি লোক না জানলেও বিয়েটা না হলে লজ্জায় পড়ে যাব আমরা।আমাদের সম্মান নষ্ট হবে।”

নিশান ভাই এবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন।কন্ঠে ধাতস্থ ভাব বজায় রেখে বললেন,

“যেই মান আপনাদের তাতে সম্মানও খোঁজেন ভাবিনি।আপনাদের যদি প্রচুর মানও থাকে তাও মেয়ে আমরা দিব না।”

এটা বলেই আমার এক হাত ধরে প্রস্থান করলেন নিশান ভাই।চলতি পথেই শুনতে পেলাম পাত্রের বাবার রাশভারী কন্ঠ।

“আমাদের এভাবে ডেকে এনে অপমান করা মানে কি এসমতয়ারা বেগম?আপনি তো বলেছিলেন মেয়ে সহ সবাই রাজী।এখন বিয়ের সময় এভাবে নাটক করবেন ভাবতেও পারিনি।আমাদের মান সম্মান সব ধুলো মিশিয়ে না দিলেও পারতেন।এর ফল ভালো হবে না।বিয়ে না হলে উচিত জবাব দিবো এর।”

ছেলের বাবার এহেন কথায় কিছুটা রে’গে গেলেন মামি।চড়া গলায় বললেন,

“কি করবেন আপনারা?আমাদের মেয়ে যে আপনাদের কাছে দিতে চেয়েছিলাম এটা কপাল ছিলো আপনাদের।আর কোন মানের কথা বলছেন আপনারা?বাড়ির বউ বিক্রি করে বংশপরিচয় রক্ষার সম্মান।এর চেয়ে ভালো সম্মান কি আসলেই আছে আপনাদের?”

মামির শেষোক্ত কথায় প্রচুর অপমানিত হলেন ওনারা।বিয়ে ভেঙে গেল।যাওয়ার আগে তুমুল গন্ডগোল হল।কেউ দমে যাওয়ার পাত্র নয়।বয়স হলেও ছেলের বাবার তেজ এ ভাটা পড়েনি।অবশেষে মামা মামিকে শাঁসিয়ে বিদায় হলেন ওনারা।

_______
গভীর রাত।সারাবাড়ি শুনশান নীরবতা।বাইরের উঠোনে দাড়িয়ে আছি আমি।গ্রামে বাড়ি আমাদের।শীতের হাওয়ায় ভাসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক।পাশেই কোন গর্তে লুকিয়ে আছে হয়তো।আমারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওদের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকতে।বিষেশত যখন আম্মু এ বাড়ি আসে।কিন্তু পারিনা শুধু মানুষ বলে।আচ্ছা আমরা কি সত্যিই মানুষ।নাকি মানুষের মুখোশ পরে আছি মাত্র।কার আড়ালে কি আছে বোঝা সত্যিই বেশ কঠিন।মামা মামি যে আমার সাথে এতো বড় একটা গেম খেলতে চাইবে ভাবতেই পারিনি।অবশ্য নিজের বাবা মাই যেখানে আমার জীবনের সাথে গেম খেলেছে সেখানে ওর তো দুরের কেউ।

যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করেছি আমি।কোন কথা বলিনা।শুরুতে আম্মু আমার আশেপাশে আসার চেষ্টা করলেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন।তিনিও আর আমাকে ঘাটতে আসেন না।এমনকি নানা নানী গত হওয়ার পর দাওয়াত ছাড়া এ বাড়িও আসেন না খুব একটা।আম্মু ঘরের জানালা খুলে রেখেছেন।ঠান্ডা হাওয়া ভিতরে প্রবেশ করলেও আমাকে দেখতে জানালা খুলে রেখেছেন।একা দাঁড়িয়ে আছি বলে চিন্তা হচ্ছে নিশ্চয়ই।খুক খুক করে কাশছেন তিনি।তাও ঠান্ডা সহ্য করছেন।মায়েরা বুঝি এমনই হয়।সন্তানের জন্য তাদের একবুক সমান ভালোবাসা থাকে।আম্মুকে ওভাবে দেখে খারাপ লাগছে ভীষণ।বুক নিষ্পেষিত হচ্ছে আমার।ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে দুঃখ লুকাতে।কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না।কোথাও একটা বাধা পরে গেছে আমাদের মা মেয়ের সম্পর্কে।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরল নোনাপানি।নানান কষ্টরা দলা পাকিয়ে আসছে আমার দিকে।আমিও পরম যত্নে উগড়ে দিচ্ছি চোখ দিয়ে।বাহ্যিক পরিবেশের ঠান্ডা গায়ে কাঁপন ধড়িয়েছে।সেদিকে কোন খেয়াল নেই আমার।ক্রমাগত কেঁদেই চলেছি আমি।হটাৎ গায়ে গরম কিছু অনুভব করলাম।পিছন ঘুরে দেখি নিশান ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।সন্তর্পণে একটা শাল গায়ে জড়িয়ে দিলেন আমার।শাণিত গলায় বললেন,

“যা হবার হয়ে গেছে।এটা নিয়ে এতো চিন্তা করিস না।আমি থাকতে তোর সাথে খারাপ কিছুই হতে দিবো না।”

“আমি জানি সেটা।আচ্ছা আমার সব বিপদের সময় আপনি আবির্ভাব হন কি করে?আপনি জানেন কি করে প্রতিবার যে আমি বিপদে আছি?”

“ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়।”

“আমার সব আপডেটই কেন রাখেন আপনি?আমাকে ভালো রাখার এতো ইচ্ছা কেন নিশান ভাই?”

আমার প্রশ্নে ভ্রু যুগল আন্দোলিত করলেন নিশান ভাই।সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

“তোর আপডেট জানার সখ আমার কখনোই নেই।আমি বাড়ির ছেলে বাড়ির আপডেট রাখি।আর এই বাড়িতেই তো তুই থাকিস।তাই তোর মতো উটকো ঝামেলার খোজ জানা লাগে।”

ওনার কথায় মুখ ভেংচি কাটলাম আমি।ওনার উপস্থিতি নিমিষেই ভুলিয়ে দিয়েছে আমার সব কষ্ট।এখন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি।যদিও ওনার সাথে কখনো পারি না আমি।হয় বাজে ভাবে পচিয়ে দেন।নয়তে সুকৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে যান।আমি খুনাক্ষরেও বুঝতে পারি না।একটা জোড়ে নিঃশ্বাস নিলাম আমি।অতঃপর আমাকে উটকো ঝামেলা বলার প্রতিবাদ স্বরূপ বললাম,

“উটকো ঝামেলা তো বিদায় করতেই চেয়েছিলো।আটকালেন কেন?”

উনি ভাব নিয়ে প্রতিউত্তর করলেন,

“যতই হোক আমার একটা দ্বায়িত্ব আছে না।তোকে দিয়ে পা টেপালাম।পারিশ্রমিক হিসেবে তো শুধু এটাই চেয়েছিলি।না দিলে আবার বলতি আমারা কাজের লোকের দাম দেই না।”

আশ্চর্যান্বিত হলাম আমি।

“আমি কখন পা টিপলাম?মাথা ঠিক আছে আপনার?”

“ওইতো গিয়েছিলি তো পা টিপে দিতে।আমিই না করলাম।বলা তো যায় না আবার আমার পায়ের বারোটা বাজিয়ে দিস কি না।অঘটন ছাড়া তো অন্য কিছু করতে পারিস না তুই।”

“কিহ।আমি অঘটন ঘটাই।আপনার কোন অঘটনটা ঘটিয়েছি আমি?”

“বিরাট অঘটন ঘটিয়েছিস।এইযে এই নিষ্পাপ একটা ছেলেকে মাঝরাতে পর নারীর সাথে দাঁড়িয়ে রেখেছিস এইটা অঘটন নয় কি?”

“আমার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে কি আপনার পাপ হচ্ছে যে এতো কথা শোনাচ্ছেন।হলে চলে যান।”

“হুম এখন যাই।পরে লোকজনের কাছে বানিয়ে বলবি আমরা তোকে সারারাত বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছি।কিছু খেতে দেই নি।”

“আমি আবার কখন মানুষজনের কাছে এসব বলেছি?আর লোকজন তো আপনার মতো অকর্মা।কোন কাজ বাদ দিয়ে আমি কি করছি না করছি,খেয়েছি কি না এইসব জিজ্ঞেস করবে।”

“মানুষজন যেন জিজ্ঞেস করে সে জন্যই এই ব্যবস্থা করছিস নাকি?সত্যি তোদের বাবা মেয়ের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।”

“আমি আবার কি ব্যবস্থা করলাম?”

“এইযে এইভাবে ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে রাত্রি যাপন করছিস যেন জ্বর-ঠান্ডা হয়।তখন কেউ জিজ্ঞস করলে বলবি ওসব।”

“আমি অত আদরের দুলালিও না যে এই অল্পতে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“মিসকিনদের স্বভাব হল পেটে ক্ষুধা থাকলেও বলতে পারে না।তোর বর্তমান অবস্থা তাই হয়েছে।না খেলে মাথার বুদ্ধি আরও কমবে।ঠান্ডা যে আদরের সন্তান কিনা এই বিচারে হয় না তখন বুঝবি।”

“অত বুদ্ধি বাড়িয়ে কি হবে।এমনিতেও আপনাদের ক্রিমিনালি বুদ্ধির সাথে পারব না আমি।”

“কিন্তু খেয়ে তো পেটের ক্ষুধা মিটাতে পারবি।চল আমার সাথে।”

বলেই আমার হাত ধরে নিয়ে আসলেন।অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোড় করে খেতে বসালেন।খাওয়া শেষ হলে একটা স্মার্টফোন সারপ্রাইজ দিলেন আমাকে।জীবনে প্রথম নিজস্ব ফোন পেয়ে ভীষণ খুশি আমি।আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ভুলে গেলাম বেমালুম।আমার খুশি দেখে নিশান ভাই মুচকি হাসলেন।কেউ যেন না জানে সাবধান করে দিলেন।মামাতো বোনের সাথে ঘুমাই আমি।মেয়েটাও মামির মতোই চোখে চোখে রাখে আমাকে।ওর নাম নিসা।ঘরে যেয়ে দেখি নিসা ঘুমাচ্ছে।হাফ ছাড়লাম আমি।সতর্কভাবে ফোনটা লুকিয়ে রেখে বিছানায় গা এলিয়েছি মাত্র।হটাৎ কানে বাজল নিসার কন্ঠ,

“ওখানে কি লুকালি তুই?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here