কাকতাড়ুয়া পর্ব -০৩+৪

#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_৩+৪
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা

আমার প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করে নিসা উঠে গিয়ে ফোনটা বের করে ফেলল।আমার কাছে ব্র্যান্ড নিউ ফোন দেখে অবাক হল নিসা।

“এই ফোন কই পেলি তুই?”

নিশান ভাই এর নাম বলতে গিয়েই থেমে গেলাম আমি।মনে পড়ল উনি কাউকে জানাতে বারণ করেছেন।চুপ হয়ে গেলাম আমি।মিথ্যা বলা পাপ না হলে একটা বলে ফেলতাম এখন।নিসা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।খুব অসস্তি হচ্ছে আমার।এক ঝামেলার রেশ না কাটতেই আগুনে ঘি ঢালাতে আরেক ঝানেলার শুরু।নিসা এইটা মামির কাছে দিবে।তার পরবর্তী পরিস্থিতির চিন্তা করেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে আমার।এর মাঝেই নিসা ধরে ফেলল ফোনটা কোথায় পেয়েছি আমি।সে চট করে বলল,

“ভাইয়ার কাছে আবদার করেছিলি তাই না?”

এবার আমি কেঁদে উঠলাম।আমার কান্না দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল নিসা।খেঁকিয়ে বলল,

“কি করবি এই ফোন দিয়ে।ভাইয়ার কাছে আমাদের নামে নালিশ,জানাবি?নাকি তোর বাবার পাঠানো টাকার অবশিষ্ট কিছু বাঁচে কিনা জানতে নিজের নামে বিক্যাশ একাউন্ট খুলবি এবং তোর বাবাকে তোর একাউন্টে টাকা দিতে বলবি?”

ক্রমাগত কেঁদেই চলেছি আমি।সারাজীবনে কান্নাটাই হয়ত আমার কপালের লিখন ছিলো।জানি কাজ হবে না তাও নিসার পা জড়িয়ে ধরলাম।

“তুই মামিকে কিছু বলিস না দয়াকরে।আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দে।যা করতে বলবি করব আমি।নিশান ভাইয়ের সাথে মামির অশান্তি হোক আমি চাই না।”

“আচ্ছা বলব না।তবে এই শর্তে যে,আমি যখন যা বলব বিনা বাক্যে তাই করে দিতে হবে এবং ভাইয়া কিছু জানবে না।এই ফোন এখন থেকে আমার কাছে থাকবে।”

এক ঝটকায় পা সড়িয়ে বলল নিসা।হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।ওর শর্তটাও মেনে নিলাম।ও আমার সমবয়সী।ওই বড় আমার।কয়েক মাস আগে পিছে জম্মেছি আমরা।যখন আব্বু আম্মু একত্রে ছিলো ওর সাথে খুব ভালো সখ্যতা ছিলো আমার।এখানে এলেই দুইজন সারাদিন খেলতাম।কত আদরের ছিলাম তখন।কত মজা করতাম একসাথে।নানা-নানি জীবিত থাকাকালীনও ভালোই চলছিলো।মামি আমাকে আর নিসাকে এক নজরে দেখতো।তুলে খাওয়াতো তিন বেলা।কিন্তু একটা এক্সিডেন্টে গত হন তারা।যার দ্বায় আমার কাঁধেই চাপানো হয়।আমার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সবাই।বদলে যায় মামা-মামি।তাদের সমান তালে পাল্লা দিয়ে নিসাও পরিবর্তন হয়ে যায়।

_________
শীতের সকাল।পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়েছে।গরম গরম চিতই পিঠা ডুবানো হয়েছে দুধের হাড়িতে।মামি চুলোয় বসে ভাপা পিঠা বানাতে ব্যস্ত।আম্মু রুটি বেলে ছোট ছোট গোল চাক করে এগিয়ে দিচ্ছে আমার দিকে।হাতে হাত লাগিয়ে দুইজন সমান তালে কাজ করছি।দেখে কেউ বুঝবেই না কয়েক বছর আমাদের মাঝে কথা চলে না।আমার পুলি পিঠার ডিজাইন সুন্দর হয় বলে সে দ্বায়িত্ব বর্তেছে আমার উপর।আম্মুর বর্তমান বর তার আদরের ছেলেকে নিয়ে আসবে জন্য এতো আয়োজন।পাশের পাটিতে বসে ছোট্ট আয়াত গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে এসব।আয়াত আমার সৎ বোন।বছর ছয় হবে।বড় রুটির উপর টিনের রাউন্ড শেপের বস্তু দিয়ে চাপ দিলেই হয়ে যায় অনেক গুলো ছোট অংশ।তার ভিতরে পুর ঠেলে ছোট ছোট চাপ দিয়ে গড়ছি আকর্ষনীয় ডিজাইন।যা দেখে বেশ মজা পাচ্ছে সে।আমি একটা পুলির ডিজাইন দিতে দিতে আয়াতকে বললাম,

“আয়াত সোনা।এসব তোমার পছন্দ হয়েছে?”

আয়াতের বয়স ছয় হলেও সে এখনো স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না।কথা কিছুটা নাসিক্য ঝংকার তুলে উচ্চারন করে।প্রতেকটা কথায় সে ন আর ত ঢুকিয়ে দেয়।সামনে পাটির একটা দাঁত পড়েছে ওর।ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বলল,

“হ্যাঁ খুব পছোন্তো হয়েছে।তুমি এমন কনছো কিভাবে?”

“বড় হলে তুমিও এসব শিখে যাবে।তখন দেখবে এটা কতো সহজ।”

“আয়াতের বড় হয়ে ওসব করে খেতে হবে না।যথেষ্ট আদরের সন্তান সে।রাজকীয় কপাল ওর।অন্যের মতো পোড়া কপাল না।রাজকন্যার মতোই থাকবে।”

কথাগুলো পাশ থেকে উচ্চারণ করল মামি।আম্মুর মুখেও আনন্দরেখা ফুটে উঠল।নিজের সন্তান সুখ কেই না কামনা করে।এক সন্তানের সুখের আশ্বাসে যে অন্য সন্তানকে কতোটা ছোট করা করা হয়েছে তা হয়তো আম্মুর মাথায়ই কাজ করে নি।করবেই বা কি করে।এই জ্ঞানটুকু থাকলে তো আমাকে এই ভাবে কথা সহ্য করতে হত না।আমি কোন প্রতিবাদ করলাম না।যারা বুঝেও অবুঝ তাদের বুঝ দেয়ার কিছু নেই।

“কার কপাল কেমন তা কি আর আগেই বোঝা যায় মামি?আম্মুও তো বিয়ের আগে রাজকন্যার মত ছিলো।বাড়ির সবচেয়ে আদরের প্রান ছিলো সে।অথচ তার কপালে কিন্তু দুই বিয়ে জুটেছে।কেউ কি খুনাক্ষরেও ভেবেছিলো এটা?”

আকাশ মোবাইল স্ক্রল করতে করতে বলল কথাটি।ওর এহেন বক্তব্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেল উপস্থিত সকলে।নিজের মাকে কেউ এভাবে বলে।তাও সৎ বোনের সাপোর্ট টেনে।আম্মু নিমিষেই মুখ কালো করে বলল,

“কেমন ছেলে যে পেটে ধরেছি আল্লাহ।নিজের বোনকে এইভাবে বদদোয়া দিচ্ছিস তুই?”

আকাশ অধর যুগল ফাঁক করে বলল,

“আমি কি ভুল বলেছি নাকি।মেয়ে মানুষের কপাল হল গাড়ির চাকার মত।যতদিন ব্রেক আছে তো আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু একবার ব্রেক ফেল হলে কোন দিকে ঘুরবে কেউ জানে না।তাই অগ্রিম অহংকার করতে নেই।”

আকাশের কথায় ফুঁসে ওঠে আম্মু।

“কি বলতে চাচ্ছিস তুই?আমার অতীতকে বারবার স্মরণ করাতে চাস?আমাকে অপমানিত করতে যে নিজের বোনকে ছোট করছিস তা একবারো ভাবলি না?”

“হুবহু একই ভাবে এরিন আপু অপমানিত হয়েছে তুমি খেয়াল করনি আম্মু।”

আম্মু চড়ম প্রতিবাদ করতে অধর কিঞ্চিৎ পরিমান ফাঁক করল।কিন্তু তার আগেই ওনার বর্তমান স্বামী আফাজ মাহমুদ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,

“মেয়েরা কন্যা থেকে বধু হলেই কাজে হাত দিতে হয়।যত ভালো ক্যারিয়ারেরই হোক বা যত ভালো ঘরেরই হোক না কেন নিজের কাজটুকু নিজেকেই সামলাতে হয়।তাই চলার ক্ষেত্রে সব কাজ শিখে রাখা উচিত।কার কখন কোন পরিস্থিতি হয় বলা যায় না।আমার মেয়ে সব কাজ শিখবে।আমাদের অবর্তমানে যেন ওর কষ্ট না হয় একারণে সব শিখাবো ওকে।”

ওনার কথায় দমে গেলেন আম্মু।আকাশ হালকা হেসে প্রস্থান করল।মামি লজ্জিত হলেন।লজ্জা ঢাকতে হালকা হেসে বললেন,

“তা তোমাদের মেয়ে তোমরা যা ভালো বোঝ তাই করবে।তারপরও তুমি তো অমানুষ না।মেয়েকে তো আর পরের বাড়ি অবহেলায় ফেলে রাখবে না।তাই ও ভালোই থাকবে সবসময়।”

প্রতিউত্তরে মুচকি হাসলেন আফাজ মাহমুদ।অতঃপর আয়াতকে কোলে তুলে নিয়ে আদর একে দিলেন তার ছোট কপালে।আদুরে ভঙ্গিতে বললেন,

“আমার মেয়ের সুখের জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।আমার একমাত্র মেয়ে বলে কথা।আমার ভালোবাসার জিনিস।”

আয়াত তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো করে বলল,

“আমিও তোমাকে অনেক ভানোবাতি(ভালোবাসি) আব্বু।কিন্তু তুমি আমান জন্য কিছু আনোনি কেন?”

“আমার সোনামনির জন্য আমি কি কিছু না এনে থাকতে পারি?এই দেখো তোমার প্রিয় জিনিস এনেছি।”

হাস্যোজ্জল মুখে একটা কিটক্যাট চকোলেট পকেট থেকে বের করলেন তিনি।আয়াত চকোলেট পেয়ে খুশিতে খিলখিল করে হেসে দিলো।এক হাতে ধরে নাড়িয়ে আম্মুকে বলল,

“এ এ আম্মু দেখো কত বনো(বড়) চকোনেত।”

আম্মু চিরচেনা একটা হাসি দিলেন।আয়তকে চকোলেট খেতে বলে আবারও কাজে লেগে পড়লেন।আফাজ মাহমুদ আয়াতের উৎফুল্ল মুখ দেখছে এবং মুচকি হাসছে।এই মানুষটার চিরন্তন অভ্যেস এটা।সবসময় হাসিমুখে থাকেন।দেখে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা দুনিয়ার সব সুখ ওনাকে দান করেছেন।আমারও মাঝে মাঝে এমন সুখী হতে ইচ্ছে করে।উনি যখনই এখানে আসেন আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি ওনাকে।এই হাসি মুখ দেখতেও ভালোলাগে।সুখ,দুঃখ এগুলো অনেকটা ভাইরাসের মতো।আশেপাশের সবাইকে সংক্রমিত করে।যেমন এখনও করছে।একটু আগের ছোট ঝামেলার রেশও কারো মাঝে বিদ্যমান নেই।সবাই আয়াত এবং আফাজ মাহমুদের খুনসুটি দেখে আনন্দ পাচ্ছে।আয়াতের কাছে তিনি বার বার চকোলেট খেতে চাচ্ছেন আর আয়াত বারবার দিবো না দিবে না করে লুকিয়ে ফেলছে।এই ক্ষুদ্র বিষয়ই প্রশান্তির ঢেউ ছড়িয়ে দেয়।
আয়াতের মুখের দিকে পূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে আফাজ মাহমুদ।মেয়েটার গায়ের রঙ কিছুটা চাপা গড়নের হলেও চেহারায় মায়ার কোন কমতি নেই।ওর ডাগর ডাগর চোখ দুটি দিয়েই সবার মাঝে মায়া সৃষ্টি করে। আচ্ছা আমি কি এই মায়া সৃষ্টি করতে অক্ষম ছিলাম?হয়তো আব্বু আম্মুর মায়াটা শুধুমাত্র সৃষ্টি করতে পারি নাই।পাষাণের মনে কি আর সবার জন্য মায়া জন্মে?মায়াটা ঠিকই আছে।তা না হলে কীসের টানে নিশান ভাই আমার সব খেয়াল রাখে।
_______
প্রয়োজনীয় কিছু শিট নিতে কলেজে যাচ্ছি।বাইরে বেড়িয়ে দেখি নিশান ভাই মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।আমাকে এগোতে দেখে বললেন,

“তোদের মেয়ে মানুষের কোথাও যাওয়ার আগে কি পায়ের তলায় বেলের আঠা লাগে নাকি?কি এমন করিস যে এতো দেরী হয়?”

“বোরকার উপর দিয়ে হিজাব লাগিয়েছি জাস্ট।বড়জোড় পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে।তাতেই এতো অধৈর্য হলে চলে?বিয়ের পর বউ যখন সেজেগুজে বের হবে তখন দেখবেন পায়ের তলায় কিসের আঠা লাগে।”

মোটরসাইকেল এর পিছে বসতে বসতে বললাম আমি।নিশান ভাই হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“পাক্কা আধা ঘন্টা হল বসে আছি।আর তুই বলছিস পাঁচ মিমিট ও লাগেনি।আর আমার বউ তোদের মতো এমন মেয়ে হবে না।সে হবে ইউনিক।সবার থেকে অনন্যা।”

নিশান ভাইয়ের কথায় মুখ টিপে হাসলাম আমি।দুষ্টুমি করে বললাম,

“আমাদের মতো মেয়ে বিয়ে না করে আপনার বউ হিসেবে ছেলে মানুষ বিয়ে করেন।দুই মিনিটে রেডি হবে।পুরাই ইউনিক।সবার থেকে অনন্যা।”

বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলাম আমি।নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকা আমার।তারপরও আমার হাসিমাখা মুখ দেখতে নিশান ভাই লুকিং গ্লাস আমার দিকে ঘুড়িয়ে রেখেছেন।নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নিশান ভাই।মটর সাইকেল চলছে তার আপন গতিতে।আমি এখনো হেসেই চলেছি।নিশান ভাই কিছু একটা বলতে অধর নাড়ালেন।কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি।পিছন থেকে একটা সি. এন. জি. এর ধাক্কায় সিটকে পড়লাম আমরা।চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলাম নিশান ভাইকে।পাকা রাস্তার উপর পড়ে রয়েছেন নিশান ভাই।লাল তরলে মাখামাখি ওনার শার্ট।ছয় বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো আবার।অন্ধকার হয়ে গেল আমার পুরো পৃথিবী।

__________
হসপিটাল থেকে ফিরতে মাঝরাত হয়ে গেল।নিশান ভাইয়ের ডান হাত ভেঙে গিয়েছে।ডান পাশের পায়েও ইনজুরি হয়েছে।মাথায় হেলমেট থাকায় মারাত্মক ক্ষতি হয় নি।মামা-মামি ও আমার সৎ বাবা খবর শোনার সাথে সাথে চলে গিয়েছিলো।এতো সময় ব্যস্ততা ও চিন্তায় তারা আমাকে ঘাটতে আসে নি।কিন্তু বাড়ি পৌঁছেই মামি শুরু করে দিলেন বক্তৃতা।মামাও সাথে সায় দিলেন।আমাকে ডেকে নিয়ে প্রশ্ন করলেন,

“আমার ছেলেরই শুধু ইনজুরি হল।তোর কিছু হয়নি কেন?কোথায় ছিলি তুই?”

“সাথেই ছিলাম মামা।ভাইয়া তো পিচ ঢালা রাস্তায় পড়েছে।তাই অত ইনজুরি হয়েছে।সিটকে পাশের ধানক্ষেতে পড়েছিলাম আমি।একারণেই শামুকে একটু পা কাটা ছাড়া আর কিছু হয়নি।”

“শামুকে পা কেটেছে তা এত আহ্লাদী কন্ঠে বলার কিছু নেই।এমন কাজ উদ্ধার করনি তুমি।পারোই তো শুধু আমাদের জালিয়ে মারতে।”

নিসা মুখ ভেঙিয়ে বলল আমাকে।মামিও ঝেড়ে দিচ্ছেন তার সব আক্রোশ।

“আমাদের শান্তির সংসারটা কি ছাড়খার করে দিতে চাস তুই?প্রথম তোর নানাকে শেষ করলি,তোর নানিকে শেষ করলি।এখন আমার ছেলেকে টার্গেট হিসেবে নিয়েছিস।আর কয়টা প্রান গেলে শান্তি পাবি তুই?…”

মাথা নিচু করে আছি আমি।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাপানি।সবাই দোষ আমার উপরেই চাপাচ্ছে।আকাশ দাঁড়িয়ে এসব দেখছে।আমার কষ্টে তার খারাপ লাগলেও বহিঃপ্রকাশ করতে পারছে না।এমন পরিস্থিতিতে কিছু বলে নিজের পায়ে কুড়াল মারবেই বা কে।আকাশ একবার নিশান ভাইয়ের দিকে তাকালো।ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে দিলো হয়তো।নিশান ভাই এতো সময় নিশ্চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললেন,

“এইগুলা সব নাটক ওর আম্মু।ও ইচ্ছে করে করেছে এসব।পূর্ব প্ল্যান ছিলো নিশ্চয়ই।ওই সি. এন. জি. ওয়ালার সাতে হাত করেছিলি নাকি?”

নিশান ভাইয়ের এমন কথায় থমকে গেলাম আমি।সব পরিস্থিতিতে যেই মানুষটা আমার পাশে থেকেছে সেই আমার প্রতিকুলে চলে গেল।অটোমেটিক চোখের পানি থেমে গেল আমার।অল্প শোকে কাতর বেশি শোকে পাথর বলতে প্রচলিত একটা বাক্য আছে।আমারও তাই হল।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম শুধু।নিশান ভাই আবারও বললেন,

“আম্মু ও আমাদের জন্য বিপদজনক।তুমি নিসার কাছে ওকে রেখোনা।কখন নিসার কোন ক্ষতি করার প্ল্যান করবে বুঝতেও পারবে না।আমি কি ওকে কম সাপোর্ট করেছি।তাও আমাকে ছেড়ে দিলো না।”

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইলাম আমি।মাথার উপরের ছাদটা যখন সড়ে যায় তখন মাথা শূন্য হওয়াই স্বাভাবিক।নির্বাক হয়ে শুনতে লাগলাম এদের সব অভিযোগ,অপবাদ।
______________
খাওয়ার ঘরে একটা চৌকি পেতে রাখা আছে।তাতে পুরোনো তোষক পাতা।নিসা একটা পুরোনো কাথা ও তুলে রাখা সিঙ্গেল বিছানার চাদর দিয়ে গিয়েছে।
ওগুলো নিশান ভাইয়ের হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা।চাদরের রঙ জলে গেলেই সেগুলো বাতিল করেন তিনি।নিশান ভাইয়ের ভাষ্যমতে আমার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে এই ঘর।তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম আমি।যাকে বেশি বিশ্বাস করি কিছু দিন পর সেই আমাকে আঘাত দেয়।বসে বসে ভাবতে লাগলাম সেই সময়ের কথা।পুরো শরীর কাঁদায় ভিজে ছিলো আমার।নিশান ভাইকে কোন মতো একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে আমি নিজেই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম।পচা শামুকে পা কেটেছে আমার।রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো।সেদিকে মাথাই ঘামাইনি।নিশান ভাইয়ের চিন্তায়ই অস্থির ছিলাম।নিশান ভাইয়ের ফোন ফেটে খান খান হয়ে গিয়েছিল।ওখান থেকে একটা লোকের ফোন কালেক্ট করে মামাকে কল দিয়েছিলাম।আমি জানি না হসপিটালের কোথায় কি করতে হয়।আমার কাছে ছিলো না কোন টাকা।জীবনের প্রথম একটা মেয়ে হয়ে এসব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।একটা লোক এগিয়ে এসে সাহায্য করেছিলো আমাকে।অনেক লোকের সহানুভুতির পাশাপাশি নোংরা দৃষ্টিও পড়েছিলো আমার কর্দমাক্ত শরীরে।সেদিকে কোন খেয়ালই করিনি।আমি শুধু জানতাম যেকোন মুল্যে নিশান ভাইকে বাঁচাতে হবে।যার জন্য এতো ব্যস্ততা সেই কিনা শেষমেশ এমন করল আমার সাথে।
চাদর পেতে টান টান করে মাত্রই গা এলাতে যাব তখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম।দরজা খুলে দেখতে পেলাম আকাশ দাঁড়িয়ে আছে।আমি উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলাম।এর অর্থ কেন এসেছিস বল।আকাশ মুচকি হেসে বলল,

“নিশান ভাই তোমাকে দেখা করতে বলেছে আপু।সে এখনো জেগে আছে শুধু তোমার সাথে কথা বলবে বলে।”

“আমি তো ওনার ভালো চাই না।না জানি আবার কোন ক্ষতি করে বসি।আমার সাথে আবার কি কথা?”

অভিমানি সুরে বললাম আমি।নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল আকাশ।ফিসফিস করে বলল,

“সেটা না হয় যেয়েই শোনো।না গেলে কিন্তু তুলে নিয়ে যাওয়ার হুকুম আছে হুম।”

কন্ঠে ওর স্পষ্ট সয়তানি।পিছন ঘুরে দাড়ালাম আমি।

“যেই মানুষটা আমাকে ভুল ব্যাখা দিয়েছে তার সাথে আমার কোন কথা নেই।”

“যে সারাজীবন তোমাকে আগলে রেখেছে তার একদিনের ব্যবহারেই ইগনোর করবে?সে তো আর সুস্থ নয় যে পায়ে হেঁটে আসবে?”

আকাশের কথা বুকের ভিতর বিঁধে গেল।সত্যিই তো।আমিও স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি।একদিনের ব্যবহারকে হাজারটা দিনের চেয়ে প্রাধান্য দিচ্ছি।মাথায় ঘোমটা আরও একটু টেনে পা বাড়ালাম নিশান ভাইয়ের কক্ষে।নিথর দেহে শুয়ে আছেন বিছানায়।আমাকে দেখে একটু বিচলিত হলেন,

“তখন ওভাবে কথা বলেছি জন্য মন খারাপ করেছিস?”

“মন গহীনে গাঢ় মেঘ জমিয়ে জানতে চাচ্ছেন বৃষ্টি হবে কিনা?”

“যাক আলহামদুলিল্লাহ।আমার তখনের করা আচরণটা সার্থক হয়েছে।তখন ওভাবে কথা না বললে এমন সাহিত্যিকের মতো কথা বলতে পারতি না।”

“আপনি কি এসব বলতেই ডেকেছেন আমাকে?”

“একদমই নাহ।আমি তো তোর সাথে প্রেমালাপ করতে ডেকেছি।”

এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে রয়েছে।তার উপর ওনার এই ফাইজলামিতে চড়ম বিরক্ত হচ্ছি।মানুষটা এমন কেন?সব সময় আমার পিছে পড়ে থাকেন।আমার প্রত্যেকটা কথা নিয়ে মজা করেন।

“দয়া করে দরকারী কিছু হলে বলুন।আমি তো আর দিনে বিশ্রাম নিতে পারব না।বাড়ির সব কাজ আমাকেই করতে হবে।ঘুমাব আমি।”

“বাহ খুব ভালো বিচার করলি।একজনের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে নিজের ঘুমের চিন্তা করছিস।”

প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ আমি।নিশান ভাই বুঝলেন কষ্টটা একটু বেশিই পেয়েছি।বা হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন তিনি।সাইডে রাখা টেবিলে ফার্স্ট এইড বক্সটা চাইলেন আমার কাছে।এগিয়ে দিতেই সেখানে থেকে একটা কা’টা-ছেড়া’র অয়েন্টমেন্ট ও একটা পেইন কিলার আমাকে দিয়ে বললেন,

“এটা তিনবেলা পায়ে লাগাবি।আর এই পেইন কিলারটা খেয়ে নে।ব্যাথা কমবে।”

চোখের কোনা ভিজে গেল আমার।এমন অসুস্থ থেকেও তিনি আমার খেয়াল রাখছেন ভেবেই অবাক হচ্ছি।

“কি হল?কাঁদছিস কেন?”

“মানুষ দুইটা আবেগে কাঁদে।একটা হল কষ্ট আরেকটা সুখানুভূতি।যার দুইটাই আজকে আমাকে দিলেন।”

“একটু মাথায় বুদ্ধি থাকলে আর কষ্ট পেতি না।তোর একটা আলাদা ঘর লাগত।একটা নিজস্ব ঘর থাকলে কাল ফোনটা হারাতে হত না।তাছাড়া তুই ওই ঘরে থাকাকালীন যখন তখন আমার কাছেও আসতে পারতি না।সামনে তোর পরীক্ষা।সারাদিন কাজ করতেই যায়।পড়াশোনা তো কিচ্ছু করিস নি।বাড়িতে যতদিন আছি সবাই ঘুমিয়ে গেলে তাও আমার কাছে পড়তে পারবি।তোর প্রতি সদয় হয়ে কখনোই আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হত না।”

অন্যরকম এক সুখানুভূতি অনুভব করলাম।এভাবে খারাপ ব্যবহার করেও আমার ফায়দা লুটিয়ে দিলো সে কেউ বুঝতেও পারল না।অথচ আমিই কিনা একবুক অভিমান জমিয়েছিলাম।মানুষটা কত ইউনিক।এমন ইউনিক মানুষ পার্টনার হিসেবে ইউনিক কাওকেই ডিজার্ভ করেন।হালকা হেসে বললাম,

“আপনার বউ খুব লাকি নিশান ভাই।এমন জামাই যার প্রত্যেকটা মেয়ে তার ভাগ্যকে হিংসা করবে।”

“এইজন্যই সবাই তোকে হিংসা করে বুঝলাম।”

ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললেন নিশান ভাই।আমি হেসে দিলাম।

“আমার মতো পোড়া কপালের মেয়েকে মানুষ কেন হিংসা করবে?”

“এইযে আমার মতো একটা নিশান তোর জীবনে ছিলো,আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এই জন্য।”

“ছিলো এবং আছে পর্যন্ত ঠিক আছে।থাকবে বলেন না।বিয়ের পর বউ পেলে কেউ নিজের বোনকেই মনে রাখে না।আর তো আমি আপনার ফুপাতো বোন।”

“তুই আমার ফুপাতো বোন এইটা কে বলছে।তোকে আমি কোনদিনও ফুপাতো বোন ভাবিনি।ফুপুর সাথেই যার সম্পর্ক নেই তাকে ফুপাতো বোন ভাবব কেন!”

“তাহলে কি ভাবেন আমাকে?”

“একটা নাদানমার্কা মানুষ ভাবি।এখন জানতে চাইবি নাদান কি?”

“আপনাকে ফালতু প্রশ্ন করার সময় নেই আমার। থাকেন যাই।”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে আসলাম আমি।নিশান ভাই স্মিত হাসলো।আমার যাত্রা পথে তাকিয়ে বলল,

“আমারও ঠেকা পড়েছে তোর ফালতু প্রশ্নের জবাব দেয়ার।”

শুনেও নিরুত্তর থেকে চলে এলাম।ঘুমানো জরুরি।কাল সকালে উঠতে হবে।রান্না চড়াতে হবে।পায়ে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম।এই বিছানায় ঘুমাতে দিব্বি লাগছে।ডিটারজেন্ট দিয়ে ধোয়া হলেও নিশান ভাইয়ের ঘ্রাণ লেগে আছে এতে।ঘ্রাণটা অবশ্য পারফিউমের।নিশান ভাইকে সারাজীবন নির্দিষ্ট এক ব্র্যান্ডের পারফিউম ইউজ করতে দেখলাম।কখনো চেঞ্জ করেন না এটা।ওনার রুচিই একঘেয়েমি।যেমন সবসময় কালো জিন্স পড়েন।শার্ট ও বেশিরভাগ সময় কালো রঙাই পড়েন।একটা মানুষ একই টাইপের প্লেইন কালো শার্ট এতো কেনে কীভাবে আমি ভেবেই পাই না।নিশান ভাইয়ের এমন হাজারো বৈশিষ্ট্য ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

_______
বাড়ির উঠোনে একটা শিউলি গাছ রয়েছে।শক্ত মাটির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে শিশির ভেজা শিউলি গুলো।এক এক করে একশোটা ফুল কুড়ালাম আমি।নিশান ভাই স্ট্রেচারে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে বললেন,

“এই ফুল কুড়ানোর সময় মনে মনে কি বিড় বিড় করছিস?যাদু করবি নাতো আবার!”

“যাদু কাকে করতে যাব!আমি তো ফুল গুনছি।একশোটা ফুল হলেই চলে যাব।ওগুলো দিয়ে মালা গাঁথব।একশো ফুলের মালা।ব্যপারটা ইউনিক না?”

“যাদু করার মানুষের কি অভাব আছে?ফুপির এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আছে এ বাড়িতে।তাকেই তো সবার আগে টার্গেট করবি।তাছাড়া তোর হাব ভাবও তো ভালো না।সেদিন ওটা বলার পর থেকে ইদানিং ইউনিক হতে চাচ্ছিস।ব্যপার কি?”

“হ্যা আমার তো কাজ নেই আপনার মতো অকর্মাকে যাদু করব।তখন আমার সাথে সারাক্ষন ঝগড়া বাধিয়ে রাখবেন।আর বলবেন আমি যাদুকর।প্রতিউত্তর করলেই বলবেন ঝগড়ুটে।সারাদিন ঝগড়া করি।”

কথাগুলো একদমে বলে শ্বাস ফেললাম।নিশান ভাইয়ের কোন রেসপোন্স পেলাম না।কয়েক মিনিট পর তাকিয়ে দেখি তিনি আমার দিকে বিবশ নয়নে চেয়ে আছেন।চোখ দুটোতে মারাত্মক নেশা মিশ্রিত।দৃষ্টি নামিয়ে ফেললাম আমি।ওই চোখে তাকানোর সাহস নেই আমার।সর্বনাশ হয়ে যাবে।জীবনটা অন্যদের মতো হলে ইচ্ছেকৃত ভাবে এই সর্বনাশে হাজারবার জড়াতাম আমি।জীবন অনুকুলে না হলেও এতো সাপোর্ট পেয়েছি ওনার যা বলার অপেক্ষা রাখে না।জানি না কি ভেবে যেন চোখের কার্নিশ ভিজে গেল আমার।ইদানিং খুব মুড সুয়িং হয়।এই ভালো লাগে তো পরক্ষনেই বিষাদে ডুবে যাই।হটাৎ উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ঘোরলাগা কন্ঠে বললেন,

“কাঁদছিস কেন?আমি তো চাইই তুই ঝগড়ুটে হবি।সারাক্ষন পাখির মতো কিচিরমিচির করবি।আমার সাথে নির্দ্বিধায় ক্যাউ ম্যাউ করবি।কপট রাগ দেখাবি।অভিমানে গাল ফুলাবি।কিন্তু এসব না করে তুই বিষাদে ডুবে থাকিস।হরিণ চোখদুটি প্রায় অশ্রুসিক্ত রাখিস।কেন এরিন কেন?ফুপির নিষ্পাপ ভাতিজাকে কি পাপমুক্ত থাকতে দিবি না তুই?তোর চোখের পানি দেখলে যে আমার দুনিয়া উল্টে দিতে ইচ্ছে করে।সব নিষিদ্ধ অমান্য করে তোকে আগলে ধরতে ইচ্ছে করে।কিছুই কি বুঝিস না তুই?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here