কাছে দূরে পর্ব ৬৩+৬৪

#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬৩

—-‘ আই.. আই এম এক্সট্রিমলি সরি মিস-

বলতে বলতে হাঁটু গেঁড়ে কনিকার সম্মুখে নেমে এলো রিয়াদ। কনিকার কাঁদো কাঁদো মুখ খানা দেখতে যেন তার মুখখানাও ওমন হয়ে গেলো। কনিকা এলোমেলো হয়ে থাকা কাগজ গুলো একসাথে জড়ো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টেনশনে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। এতো কষ্টের ফল যদি এভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে মরে যাবে সে। আর বোনও তো তাকে কথা শোনাতে ছাড়বেনা। ভাববে সে ইচ্ছে করে এসব নষ্ট করে দিয়েছে!

—-‘ আপনি কাঁদছেন?’

কনিকার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়তেই রিয়াদের অসহায় কন্ঠিটি কানে বাজলো তার। কনিকা রিয়াদের কথার জবাব দিলো না। এমনকি তাকালোও না তার মুখের দিকে। পেছন থেকে কাগজ তুলতে কনিকাকে সাহায্য করতে করতে রিনাত ঝাঁঝাল কন্ঠে বলে উঠলো,

—-‘ কাঁদবে না তো কি করবে হাসবে?এত কষ্ট করে ডাবল খাটনি করে সব এসাইনমেন্ট গুলো করেছে! আর আপনি না জানি কোত্থেকে টপকে পড়ে ওর সব কষ্টে এভাবে জল ঢেলে দিলেন! এবার এগুলো যদি ও জমা দিতে না পারে ভাবতে পারছেন কি হবে? কি আছে কপালে গড নোজ!’

রিনাতের কথায় ঝাঁঝ মেশানো থাকলেও তার সব গুলো কথাই ঠিক। রিয়াদের মনে অপরাধ বোধের পাহাড় উঁচু হয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই কারোর কত বড় ক্ষতি করে দিলো সে! ভাবতেই ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠছে। রিয়াদ পেছন মুড়ে তার বেস্ট ফ্রেন্ড রেজাকেও তাদের সাহায্য করতে ইশারা করে। রেজা পলক ঝাপটে দ্রুত কাজে লেগে পড়ে। খানিক বাদে সব গুলো কাগজ একত্রে করতে পারলেও আপাতত কারোর মাথায় ঢুকছেনা কোন লেখাটা আগে আসবে আর কোন লেখাটা পরে।

কনিকার চোখ মুখ লালচে আভায় ঘিরে উঠেছে। এসব কান্নার ফল। রিয়াদ মনে একরাশ অসহায়ত্বতা নিয়েও কেমন মুগ্ধ চোখে দেখছে কনিকার একেক রূপ। সে মাতাল হয়ে যাচ্ছে। কাগজ গুলো একনজর দেখে রেজা চিন্তিত মগ্নে বলে উঠলো,

—-‘ দোস্ত এবার এগুলো মিলাবি কি করে?’

রিনাত ঘরিতে ব্যস্ত নজর বুলিয়ে বলল,

—-‘ এগুলো মিলাতে মিলাতে কমসেকম আধঘন্টা তো লাগবেই! কিন্তু কনিকা আমাদের হাতে তো মাত্র দশমিনিট সময় আছে! এই দশ মিনিট সময়ে যদি এগুলো জমা দিতে না পারি তবে তো আমাদের এক সেমিস্টার গ্যাব!’

কনিকা হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল মুছে চারপাশে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে চিন্তাক্লিষ্ট কন্ঠে বলল,

—-‘ একটা পার্ফেক্ট জায়গা খোঁজ! আমি দশ মিনিটের মধ্যেই এগুলো সব মিলিয়ে ফেলতে পারবো।’

রিনাত কনিকার দৃষ্টি অনুসরন করে সেও জায়গা খুঁজতে লাগল। সামনে দাঁড়িয়ে রিয়াদ হা হয়ে গেলো কনিকার কথায়। বড় বড় চোখ করে কাগজগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলল,

—-‘ আপনি এতো গুলো পেপারস মাত্র টেন মিনিটে ম্যাচ করতে পারবেন?’

রিয়াদের প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিনাত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—-‘ না পারবে না! আপনি মিলিয়ে দিবেন পাঁচ মিনিটে?’

রিনাতের কথায় রিয়াদ জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে কিছু বলতে নিলেই রিনাত কনিকার হাত টেনে নিয়ে যায়। যেতে যেতে পেছন মুড়ে একবার রিয়াদের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামটি দেয়। যাতে করে রিয়াদের হাসার চেষ্টাটাও মিইয়ে পড়ে। রিয়াদ কনিকার যাওয়ার পথে চেয়ে থেকে বুকে হাত চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রেজা রিয়াদের দৃষ্টি অনুসরন করে বলে,

—-‘ কি মামা প্রেমে পড়ে গেলা নাকি?’

রিয়াদ মুচকি হেসে মাথা চুলকায়। রেজার কাঁধে হাত রেখে বলে,

—-‘ মেয়েটা ভয়ঙ্কর মায়াবতী রে! চোখই ফেরাতে পারছিলাম না!’

রেজা এক ভ্রু উঁচিয়ে থুঁতনিতে হাত ঠেকিয়ে চিন্তামগ্ন কন্ঠে বলল,

—-‘ এটা হয়তো তোর জীবনে ঘটা প্রথম কোনো অবিশ্বাস্য ঘটনা! স্বয়ং রিয়াদ আহমেদের নাকি কোনো মেয়ে মনে ধরেছে। উফফ মামা। জাস্ট ওয়াও!’

রেজার নাটকীয় ভাবভঙ্গিতে হেসে ফেললো রিয়াদ। পকেট থেকে ফোটনা বের করতে করতে বলল,

—-‘ দ্বারা আপাকে একটা ফোন দিয়ে বলি।’

রেজা অবাক হয়ে জানতে চাইল,

—-‘ এতো সামান্য একটা কথাও তোর ভাবিকে বলতে হয় নাকি?’

রিয়াদ হাসতে হাসতে জবাব দিলো,

—-‘ মানুষ টা আমার মায়ের মতো রে। বলতে পারিস মায়ের চেয়েও বেশি।’

রেজা রিয়াদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—-‘ আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু এক্ষনি ভাবি কে এসব কিছু জানাস না। ক’টা দিন যাক। দেখ মেয়েটাকে পটিয়ে প্রেম করতে পারিস কি না? তারপর ভাবীকে জানাস।’

—-‘ বলছিস?’

—-‘ হুম বলছি। আগে প্রেম কর পরে বাসায় জানা।’

রিয়াদের কাছে রেজার কথাটা মন্দ লাগেনি। মেয়েটাকে দেখে যা মনে হয়েছে ও সবার মতো নয়। একদম আলাদা! সবার থেকে আলাদা।

রিয়াদ রেজাকে নিয়ে প্রায় ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। রেজা আর রিয়াদ বাদেও তাদের আরও চারজন বন্ধু এসেছিলো একসাথে। মুলত এই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টি দর্শন করতে। বাকিরা গেলো একদিকে আর রেজা,রিয়াদ এলো অন্য দিকে। অন্যদিকে এসেই রিয়াদের সাথে ঘটে গেলো এই ইন্সিডেন্ট। কনিকার সেই ভয়ার্ত চোখ আর কান্না ভেজা চোখ কোনোটারই মায়া কাটাতে পারছেনা রিয়াদ। থেকে থেকে মনে পড়ছে কনিকার মায়াবী চোখ জোড়ার কথা। কনিকাকে তার মনের উত্তালতা দেখাতে না পারলে সে থাকতে পারবেনা। তাকে আজই আর এক্ষনি বলতে হবে সে প্রেমে পড়েছে। বলতেই হবে।

—-‘ দোস্ত! এসেছে-

পাশ থেকে রেজার কন্ঠে কনিকার আগমন জানতে পেরেই মনের ভেতর ঢেউ শুরু হলো রিয়াদের। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কনিকার আসার পথে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হ্যাঁ কনিকা সত্যি আসছে। রিয়াদ দৌড়ে যেতে চাইল তার সামনে। কিন্তু রেজা তাকে যেতে দিলো না। তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

—-‘ আরে করছিস টা কি? এমন করলে মেয়েটা তোকে খারাপ চোখে দেখবে। ভদ্র লোকের মতো যা। ধীরেসু্স্থে আয়।’

রেজার কথায় রিয়াদের হুঁশ ফিরে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের শার্টের কলার্ট টেনে ঠিক করতে করতে বলে,

—-‘ সরি! চল।’

—-‘ হুম চল।’

রিয়াদ আর রেজাকে এদিক পানে হেঁটে আসতে দেখে কনিকার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। রিনাতের হাত চেপে ধরে করুন কন্ঠে আস্তে করে বলল,

—-‘ দোস্ত ছেলে দুটো এখনও যায়নি!’

রিনাত সামনে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দু’জনকে দেখে কনিকার উদ্দেশ্যে বলল,

—-‘ যায়নি দেখছি। দ্বারা দেখাচ্ছি মজা।’

—-‘ এই এই কি করছিস। চুপ করে দাঁড়া। কিছু করতে হবেনা। দেখিস না ওদের দিকে। অন্য দিকে তাকিয়ে হেঁটে চল।’

তাদের দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নিলেই গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠে রিয়াদ,

—-‘ এক্সকিউজ মি! হ্যালো?’

না চাইতেও দাঁড়িয়ে পড়ে কনিকা আর রিনাত। দু’জনে পেছন মুড়ে তাকানোর মাঝেই রিয়াদ ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে বলে,

—-‘ আপনারা বোধহয় আমাদের দেখেননি!’

রিয়াদের স্নিগ্ধ কোমল হাসিতে কনিকার বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে থাকে। সে চোখ বুঁজে নিয়ে জোরে খামচে ধরে রিনাতের হাত। রিনাত আকস্মিক ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠে। আচমকা তার চিৎকারে কনিকা সহ বাকিরাও চমকে উঠে। রিনাত নিজের হাত চেপে ধরে অসহায় চোখে কনিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-‘ কিরে কি হয়েছে তোর? এমন করে খামচে ধরলি কেন?’

রিনাতের প্রশ্নে লজ্জায় পড়ে গেলো কনিকা। এখান থেকে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে বলল,

—-‘ চচ..চল না জলদি! বব..ববাসায় ফিরতে হ..হহবে!’

কনিকার তোতলানো দেখে রিনাত অবাক হয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে রিয়াদের দিকে একবার তাকিয়ে কনিকাকে পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,

—-‘ কি হয়েছে তোর সত্যি করে বলতো?’

কনিকা রিনাতের হাত ধরে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-‘ বাসায় যাবো। চল না প্লিজ!’

রিনাত অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-‘ আচ্ছা যাচ্ছি ওয়েট। ওদেরকে কিছু বলে আসি।’

রিনাত যেতে নিলেই কনিকা পূনরায় রিনাতের হাত চেপে ধরে বলে,

—-‘ না প্লিজ! ওদের কিছু বকার দরকার নেই। জাস্ট চুপ করে চলে আয়।’

—-‘ এভাবে চলে যাবো? কেমন চোর চোর ফিলিংস হচ্ছে।’

কনিকা রিনাতের হাত ধরে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-‘ এখন মজা করার সময় নেই বাপ। চল বলছি।’

রিনাত ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,

—-‘ আচ্ছা চল!’

রিনাত আর কনিকার শলাপরামর্শ শেষ হচ্ছে না দেখে রিয়াদ গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,

—-‘ আপনাদের গোপন মিটিং শেষ হলে আমি কি একটা কথা বলতে পারি?’

রিনাত আর কনিকা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পূনরায় থমকে গেলো। রিয়াদ এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো। রিয়াদকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেই কনিকার বুকের ভেতর আবারও হাতুড়ির বারি পড়তে লাগল। সে রিনাতের হাত আবারও খামচে ধরলো। রিনাত হয়তো বুঝতে পারছে কনিকার মনের অবস্থা। তাই এবার আর কিছু বলল না। কনিকা দৃষ্টি মাটিতে বিদ্ধ করে রেখেছে। সে ভুল ক্রমেও রিয়াদের দিকে দেখছে না। দেখলেই যেন মুহুর্তেই বিস্ফোরণ ঘটে যাবে এখানে।

রিয়াদ কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি মেলে তাকালো কনিকার দিকে। কনিকার ভয় মিশ্রিত মুখশ্রীতে সে আবারও আহত হলো। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো। আঁড়চোখে একবার রেজার দিকে তাকালো। রেজা ইশারায় বোঝালো অল দ্য বেস্ট। রিয়াদ গলা খাঁকারি দিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে চেষ্টা করল,

—-‘ কনিকা! আ..আপনার নামটা খুব সুন্দর।’

কনিকা আঁড়চোখে তাকালো রিয়াদের দিকে। রিয়াদ কথাটা বলেই চোখ বুঁজে নিলো। সে তো একথা বলতে চায়না। অন্যকিছু বলতে চায়। রিয়াদ হাসফাস করছে।কনিকা রিয়াদকে হাসফাস করতে দেখে কিছু বলতে নিলেই রিয়াদ দম আঁটকে বলে ফেলল,

—-‘ আ..আমি! আ.. আ.. আমি বলতে চাই.. আমি! আমি! আ… আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি!’

রিয়াদের এহেম কথা কনিকার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। রিনাত হা হয়ে গেলো। পেছন থেকে রেজা ইয়েস বলে চেঁচিয়ে উঠলো!

কনিকা সাহস করে মুখ তুলে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,

—-‘ আপনি কি পাগল? মাত্র দুই ঘন্টাও পেরোয়নি আপনি আমাকে দেখেছেন.. আর এর মধ্যেই ভালোবেসে ফেলেছেন?’

রিয়াদ স্মিত হাসল। কনিকার চোখে চোখ রেখে বলল,

—-‘ দুই ঘন্টার মধ্যে নয়! আমি তো দু’সেকেণ্ডেই আপনার প্রেমে পড়েছি। জানিনা আপনার মাঝে এমন কি আছে যা আর বাকি দশটা মেয়ের মাঝে নেই। আমি এই জীবনে কম মেয়ে দেখিনি! বরং সবার চেয়ে বেশিই দেখেছি! কিন্তু আপনার মতো কাউকে দেখিনি। আপনার চোখে-

কনিকা তেতে উঠে বলল,

—-‘ দেখুন মিস্টার আপনার এসব উদ্ভট কথা শোনার আমার কোনো আগ্রহ নেই। ফ্লার্ট করতে হয় তো অন্য মেয়েদের সাথে করুন আমার সাথে নয়। বুঝেছেন?’

—-‘ কনিকা আমি সত্যি বলছি বিলিভ মাই ওয়ার্ড-

—-‘ আপনার আমাকে দেখে কি পাগল মনে হয়?’

—-‘ না! কোনো রাজ্যের এক মায়াবী পরী বলে মনে হয়।’

—-‘ শাটআপ। মানুষ মাত্র দু’সেকেণ্ডে কি করে প্রেমে পড়ে?’

—-‘ পড়ে কনিকা। আমি পড়েছি ট্রাস্ট মি-

কনিকা আর কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে গেলো। রিয়াদ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

—-‘ দু’সেকেণ্ড তো অনেক সময় কনিকা! মানুষ তো এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ে প্রেমে পড়ে।’

রিয়াদের কথা কনিকার কান অব্দি ভেসে আসে। তবে কনিকা আর দাঁড়ায় না। ওখান থেকে চলে যায়। রিয়াদ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। পেছন থেকে রেজা হাসতে হাসতে রিয়াদের দিকে এগিয়ে এসে তার কাঁধ চাপড়ে বলে,

—-‘ মানতে হবে ভাই! যে ছেলেকে মেয়েরা একবার দেখলেই তার পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে থাকে সেই ছেলেকে নাকি আজ একটা মেয়ে পাত্তাই দিলো না! মেয়েটা কি সত্যি সবার থেকে আলাদা নাকি তুই আগ বাড়িয়ে কিছু বলেছিস বলে ভাও খাচ্ছে?’

রিয়াদ ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে মুখে মাস্ক পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে একবার রেজার দিকে তাকিয়ে পূনরায় কনিকার যাওয়ার পানে দৃষ্টিপাত করে চোখে সানগ্লাস পড়তে পড়তে বলল,

—-‘ উঁহু! মেয়েটা ভাও খাচ্ছে না। বরং ও সত্যি সবার থেকে আলাদা। আমার মন বলছে এই সেই মেয়ে যাকে এতদিন আমার মনে খুঁজে গেছে। আজ মিলে গেলো তার দেখা। চল, ফেরা যাক।’

—-‘ হ্যাঁ চল।

রিয়াদ আর রেজা সেখান থেকে চলে গেলো। কনিকাও যথা সময় বাসায় ফিরে এলো। বাসায় ফিরে বোন আমাকে জানালো এসাইনমেন্ট ঠিকঠাক ভাবে জমা দেওয়া হয়ে গেছে। আমি ওর কথা শুনেছি এটুকুই। কোনো রেসপন্স করিনি। ও নিজের রুমে চলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্না-বান্নার কাজ শুরু করে দিলো। প্রতিদিনকার রুটিন অনুযায়ী সব ঘরের কাজ করে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার ঘরে চলে আসলাম। বোন নিজের ঘরে বসে পড়াশোনা করতে লাগল। সকালের ঘটনাটা বোন বেমালুম ভুলে গেলো। পরদিন আবারও দু-বোন মিলে ভার্সিটিতে গেলাম। আজ না গেলেই চলছিলো না। তাই যেতেই হলো। ভার্সিটি গিয়ে ক্লাস করে যখন ফিরছিলাম তখন বারবার খেয়াল করছিলাম রিনাত বোনকে কিছু একটা বলে খোঁচাচ্ছে। আমার বোধগম্য হচ্ছিল না কি হতে পারে? আর নিজের থেকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো সেটাও যেন ইগোতে বাঁধছিল। তাই সেখানে থেকে কিছুই বলিনি। বাসায় ফিরতে কনিকাকে জিজ্ঞেস করলাম রিনাত ওকে কি বলে হাসাহাসি করছিলো? বোন আমার এমন প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলো। জীবনে এই প্রথম বার বোন আমার থেকে কিছু লুকিয়ে গেলো। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলল,

—-‘ তেমন কিছু না রে! ওর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে কথা বলছিলো।’

—-‘ ওর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে কথা বলছিলো কিন্তু তোকে কেন খোঁচাচ্ছিলো?’

বোন অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-‘ ও আমাকে খোঁচাচ্ছিল এতকিছুও নোটিস করেছিস? বাপরেহ্! তাহলে তো বলতে হয় আমার ভাগ্য খুলে গেছে।’

বোনের কন্ঠ কেমন করুন শোনালো। আমি জানতাম ও বরাবর আমার থেকে একজন বড়বোনের ভালোবাসা, আদর চাইত যা আমি কখনও ভুল করেও ওকে দেয়নি। ও ভাবল আমি হয়তো ওকে কেয়ার করছি বলে এসব লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আসলে তো তেমন টা ছিলো না। আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে চলে এলাম। ও আমার চলে যাওয়া দেখে মলিন মুখে তরকারি নাড়ায় ব্যস্ত হয়ে গেলো।
#কাছে_দূরে 💜🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬৪

দেখতে দেখতে দু-দিন কেটে গেলো। এই দু-দিনে আমরা আর ভার্সিটি যায়নি। কোনো আন্তর্জাতিক ছুটি ছিলো। বাসায় থেকে থেকে বোরিং হচ্ছিলাম খুব। তাই বোনকে সাথে নিয়েই বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরোলাম। চারপাশে অল্পস্বল্প বৃষ্টিও ছিলো। শিলা একটা ছাড়া আমার মাথায় ধরে আমার পাশে পাশে হাঁটছিল। আর বোন ছাতা ছাড়াই বৃষ্টির পানি গায়ে মেখে হাঁটছিল। বৃষ্টি ওর ভীষণ পছন্দের ছিলো। তাই কখনও এই ব্যাপারে ও কারোর বারন শুনতো না। বৃষ্টিতে ভিজে রাত করে আবার ঠিকই অসুস্থ হতো। এখানে এসেও বেশ কয়েকবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে। শিলা দুই-একবার ওর একটু দেখভাল করেছে কিন্তু আমি কখনও ওর কাছে যায়নি। আজও এর ব্যতিক্রম হবে না আমি জানি। তবুও ওকে বারন করলাম না। কিছুদূর এগোতেই ঘটে গেলো এক অকল্পনীয় ঘটনা। একটা ছেলে না জানি কোত্থেকে এসে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো আমায়! আকস্মিক ঘটনায় আমাদের তিনজনের চোখই চড়কগাছে চড়ে গেলো। আমি থম মেরে গেলাম। শিলা আঁতকে উঠে চাপা শব্দ করল। আর বোন দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালো। যা ঘটল সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও মুহুর্তেই আমার ভীষণ ভালো লাগতে আরম্ভ করল। এই প্রথম কোনো পুরুষ আমায় এমন করে কাছে টেনে নিলো। এর আগে এমন অনুভূতি আমার কখনও হয়নি। মুহুর্তেই সুখের রাজ্যে ভেসে গেলাম আমি।

ছেলেটা আমাকে ছাড়ার কোনো নামই নিলো না। কেবল আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে। ‘এই দুটো দিন কোথায় ছিলে তুমি? না জানি কত জায়গায় খুঁজেছি তোমায়! কেন এমন লুকোচুরি খেলা খেলছো আমার সাথে? আমার কি অন্যায় বলো তো? ভালেবেসে ফেলেছি যে তোমাকে! এটাই কি আমার অন্যায়?

ছেলেটাকে আমি চিনি না। জড়িয়ে ধরার আগ মুহুর্তেও তার মুখ আমি দেখিনি! এমন কি তার একটা কথাও ঠিক করে শুনিনি কেবল একটা কথা বাদে,’ভালোবেসে ফেলেছি যে তোমাকে!’ আমার মনের ভেতর উতালপাতাল ঝড় শুরু হলো! এ-কি শুনলাম আমি। ছেলেটাকে যখনই আমি হাত তুলে ধরতে যাবো মনে হলো যেমন ঝড়ের বেগে এসে সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো ঠিক তেমনই ঝড়ের বেগে আমার থেকে আলাদা হয়ে গেলো। আমি চমকে উঠলাম। মুখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকাতেই যেন থমকে গেলো আমার পৃথিবী। এতো সুদর্শন ছেলে আমি আজ অব্দি কখনও দেখিনি। কি অদ্ভুত নূর তার মুখে। যেন বারে বারে ঝিলিক দিচ্ছে সেই চমক। আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেলো সাথে সাথে। এমন সুন্দর পুরুষ হয় নাকি?

ছেলেটার দৃষ্টি অস্থির হয়ে উঠলো। সে একবার পেছনের দিকে দেখছে তো একবার আমার দিকে দেখছে। আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে মুড়ে তাকাতেই দেখলাম বোন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না তার মুখে কোনো কথা আছে আর না চোখে কোনো পলক পড়ছে। সে নির্লিপ্ত চাহনীতে দেখছে ছেলেটিকে। ছেলেটিও দেখছে বোনকে। আমি বোনের দিকে বিশেষ পাত্তা দিলাম না। আমার মূখ্য উদ্দেশ্য এই ছেলেটা। তার প্রতিই সব ধ্যানজ্ঞান বিসর্জন করতে চাই। আমি ছেলেটার অস্থির দৃষ্টি আমাতে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় কিছু বলতে নিলেই ছেলেটা আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আমার কথা অসম্পূর্ণ রেখে ছেলেটা বোনের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। বোনকে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মাঝে পেছন মুড়ে একবার আমাকেও দেখলো। আমি তখনও আরেকবার প্রচেষ্টা চালালাম কিছু বলার। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। ছেলেটা বলার কোনো সুযোগই আমাকে দিলো না। বোনের দিকে তাকিয়ে শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,

—-‘ কনিকা! হ..হ্যাঁ! তুমিই তো কনিকা। তাহলে উনি কে?’

ছেলেটার প্রশ্নে বোনের বিশেষ ভাবাবেগ হলো না। বোন বিরস মুখে জবাব দিলো,

—-‘ আমার বোন।’

ছেলেটা চমকালো। আমাকে দেখতে দেখতে অবাক কন্ঠে বলল,

—-‘ এতো মিল!’

বোন পূর্বের ন্যায় জবাব দিলো,

—-‘ জমজ হলে তো দেখতে একই হবে তাই না? বোন? চল বাসায় ফিরবো!’

অল্প সময়ের মাঝেই হাল্কা বৃষ্টির পানিতে ওরা দু’জনেই ভিজে গেলো। ভিজলাম না আমি। বোনের শরীরে কাঁপুনি হচ্ছে ঠান্ডায়। ছেলেটা বোনের শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে বিচলিত কন্ঠে বলল,

—-‘ তুমি তো শীতে কাঁপছো! এমন বৃষ্টিতে কেউ ছাতা না নিয়ে বের হয়?’

বোন ছেলেটার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ছেলেটা আরও কিছু বলতে নিয়েও চুপসে গেলো। ঢোক গিলে একবার পেছন মুড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-‘ সরি মিস। ভুল করে আপনাকে__ ইট’স মাই মিস্টেক। সরি!’

আমার মনের ভেতর জ্বলে উঠল। বুঝতে পারলাম ছেলেটার আমাকে জড়িয়ে ধরা বা ভালোবাসা প্রকাশ করা সবটাই বোনের জন্য ছিলো। এতো সুন্দর একটা ছেলে বোনকে ভালোবাসতে পারে আমি যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু তখনই কিছু বললাম না। বোন ছেলেটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। আমিও আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না। চলে গেলাম বাসায়। রাতে হাড়কাঁপানো জ্বর এলো বোনের। তাই ছেলেটার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করতে পারিনি। শিলা দু-বার গিয়ে খাবার দিয়ে এসেছিলো। বোন একা হাতে কিছুই খেতে পারেনি। যেমনটা দেওয়া হয়েছিলো ঠিক তেমনটাই পড়ে রইলো সব। আমি একবারও গেলাম না ওর ঘরে। শিলাও যায়নি আর।

মধ্যরাত। আমি আর শিলা গভীর ঘুমে। এমন সময় সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে আমাদের বাসায় ঢুকলো রিয়াদ। ও জানতো না কোনটা কার রুম। আমার রুমের জানালা লক করা ছিলো কিন্তু বোনেরটা খোলা ছিলো। তাই ও বোনের ঘরের জানলা থেকেই ভেতরে ঢুকলো। বোন তখন জ্বরের ঘোরে কাতরাচ্ছে। ভেতরে ঢুকতেই কারোর গোঙানির আওয়াজ শুনে থমকে গেলো রিয়াদ। মুলত ভয় পেয়ে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো কম্বলের নীচে কেউ শুয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছে। রিয়াদের মনের ভেতর কেমন করে উঠলো। মনে হলো ‘কনিকা নয়তো?’ রিয়াদ মনের প্রশ্নকে ভুল প্রমান করতে এগিয়ে এলো বোনের দিকে। কম্বলটা মুখ থেকে খানিক সরিয়ে চমকে উঠলো। তার মনের কথাই ঠিক। এতো কনিকাই!

রিয়াদ তড়িঘড়ি কনিকার কপালে হাত ঠেকালো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। রিয়াদ চাতক পাখির মতো চারপাশে কিছু খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে নজরে এলো রাতের খাবার,ঔষধ আরএক গ্লাস জল! রিয়াদ টেনে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। কনিকাকে রেখে উঠে এসে বাইরে যাওয়ার দরজায় এসে দাঁড়ালো। সতর্কতার সাথে দেখলো কেউ আছে কি না। কেউ নেই। রিয়াদ চটজলদি রান্না ঘরে গিয়ে একটা বাটিতে জল নিয়ে আবারও ফিরে গেলো কনিকার ঘরে। জলপট্টি দেওয়ার বাটি তো জোগাড় হলো কিন্তু কাপড় কোথায় পাবে? এখন আবার কাপড় খুঁজতে যাওয়া মানে সময় নষ্ট। রিয়াদ ভাবতে লাগল কি করা যায়। হঠাৎ মনে হলো তার কাছে তো রুমাল আছে। রিয়াদ তার পকেট থেকে রুমাল বের করে কনিকার মাথায় ঘন্টা খানিক জলপট্টি দিয়ে গেলো। আর এই ঘন্টা খানিকের মধ্যেই কনিকার জ্বর বেশ খানিকটা নেমে গেলো। জ্বর নামলেও দুর্বল শরীরে চোখ খুলে তাকানোর জো নেই৷ রিয়াদ বুঝতে পারে। তাই ড্রয়ারের উপর রাখা খাবারটা নিজের হাতেই কনিকাকে খাওয়াতে শুরু করে। কনিকা বুঝতেও পারেনা এখানে কে এসেছে? তার মনে হচ্ছে পাশে তার বাবা আর মা আছে। বাবা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে আর মা তাকে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। খাবার খাওয়া শেষ হতেই রিয়াদ তাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে আবারও শুয়ে দেয়। রিয়াদ কনিকাকে একনজর দেখার জন্য এসেছিলো। আর এখন একনজরের বদলে মন ভরে দেখে গেলো। কনিকার গায়ে এখনও হালকা জ্বর আছে। তাই রিয়াদ কনিকার কপালে জলপট্টির কাপড়টা রেখে দেয়। এখন যে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না তার। তবে উপায় কি? যেতে তো হবেই। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কনিকার চোখমুখ শুঁকিয়ে গেছে একদম। রিয়াদ কতক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে কনিকার হাত টা তুলে আলতো করে চুমু খেলো। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটা বারেবারে প্রতিধ্বনি তুলতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল কনিকা। উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে কপাল থেকে জলপট্টির কাপড়টা হাতের উপর এসে পড়ল। তাতে কনিকা আরেকদফা চমকালো। রাতে কেউ এসেছিলো তার ঘরে! কথাটা মনে হতেই বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগল। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। দরজাটা রাতের মতোই আছে। আর জানালা__ জানালার দিকে তাকাতেই কনিকার হাতপা কাঁপতে লাগলো। জানালা দিয়ে কেউ এসেছিলো! কিন্তু কে? কনিকা জানালার দিকে যেতে নিয়েও থমকে গেলো। কি মনে হতে জলপট্টির কাপড়টার দিকে তাকালো। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিতে নিতে মনে হলো এটা কারোর রুমাল। কনিকার শরীর এবার জমে যেতে লাগল ভয়ে। রাতে কেউ এসে তার কপালে জলপট্টি দিয়ে গেছে তাও আবার নিজের রুমাল দিয়ে! কে এসেছিলো?’

—-‘ ছোট ম্যাডাম আসবো?’

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শিলা। কনিকা আকস্মিক চমকে উঠলো। শিলার গলা পেয়ে দ্রুত রুমালটা লুকিয়ে ফেলল। নিজের বিস্ময় কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-‘ এসো।’

শিলা দরজার ঠেলে ভেতরে এসে বলল,

—-‘ জ্বর কমেছে ম্যাডাম?’

কনিকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

—-‘ উফ শিলা তোমায় কতবার বলব আমাকে ম্যাডাম ডাকা বন্ধ করো। আপু ডাকো নয় আপা ডাকো। কি যে করোনা তুমি।’

শিলা মুচকি হেসে বলল,

—-‘ আচ্ছা আপা। রাতে কি খাবার খেতে পেরেছিলেন?’

কনিকা মনেমনে প্রস্তত হলো ‘না’ বলার জন্য। কিন্তু খাবারের প্লেট খালি দেখে আকস্মিক তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো ঔষধের প্যাকেটও খালি। তার মানে ঔষধও খেয়েছে সে। কিন্তু কখন? শিলাও কনিকার ন্যায় সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। সব খেয়েছে দেখে শিলা মৃদু হেসে বলল,

—-‘ আমি এগুলা নিয়া যাই আপা। আজকের সকালের নাস্তাটা আমিই বানিয়েছি। আসেন খাবেন আসেন।’

কনিকা শিলার কথা শুনেও কোনো কথা বলতে পারল না। কেবল জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ল।

শিলা রুম থেকে বের হয়ে যেতেই কনিকা চটজলদি রেডি হয়ে ভার্সিটি চলে গেলো। এদিকে আমি নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে আরাম করছি। আর ভাবছি গতকালকের ছেলেটার কথা। দেখতে একদম রাজপুত্র। আমি বিয়ে করলে তো তাকেই করবো। আমার মনে লালসা সৃষ্টি হলো রিয়াদকে নিজের করে পাওয়ার। আর ছেলেটা যদি কনিকাকে ভালোবেসে থাকে তবে আমার বিশ্বাস আমি বললেই ও আমাকে ওর ভালোবাসাও দিয়ে দিতে রাজি। মনেমনে এমন অটুট বিশ্বাস নিয়ে রইলাম আমি। ঐদিকে কনিকা ভার্সিটি পৌঁছে গেলো।

রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর সাথে যাকে ও মেলাচ্ছে মানুষ সেই ব্যাক্তিই হবে এটা ওর বিশ্বাস। ভার্সিটি ঢুকতেই সামনে পড়ল রিনাত আর নাইরা।৷ কনিকাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে তারা সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

—-‘ কি রে এত তাড়াহুড়ো করে ছুটছিস কোথায়?’

রিনাত আর নাইরা কে আকস্মিক সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে কনিকা নিজেও থমকে গেলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

—-‘ পরে বলব আগে চল আমার সাথে।’

এই বলে দু’জনকে রেখেই হাটা ধরলো কনিকা। রিনাত আর নাইরা একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তারাও কনিকার পেছন পেছন হেঁটে আসতে লাগল। কিছুদূর এগোতেই কনিকা কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। প্রথম দিনের তুলনায় আজ তিনদিন বাদে তাকে দেখে বেশ অগোছালো মনে হচ্ছে কনিকার। মাথার চুল গুলো এলোমেলো,ক্লান্ত দৃষ্টি, দুর্বল হাসি! সবটাই ব্যতিক্রম। মনে হচ্ছে মানুষ টা তিনটা রাতই নির্ঘুম কাটিয়েছে। কনিকার মনেমনে তৈরি করা প্রশ্ন গুলো তাকে দেখতেই গুলিয়ে গেলো। সে ভুলে গেলো এখানে তার কি কাজ!

বসে বসে এই মানুষটিরই অপেক্ষা করছিলো রিয়াদ। আকস্মিক সামনে এসে যাবে ভাবতে পারেনি সে। কনিকা সামনে এসে দাঁড়াতেই দাঁড়িয়ে গেলো সে। তার সমস্ত ক্লান্তি কেটে গিয়ে চোখেমুখে ফুটে উঠলো উজ্জ্বল হাসি। নিঃশব্দে দু’কদম এগিয়ে এলো কনিকার সম্মুখে। ঠিক তখনই হাঁপাতে হাঁপাতে কনিকার পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো রিনাত আর নাইরা। রিনাত কনিকাকে কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ রিয়াদকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকালো। নাইরা হা মার্কা রিয়াকশন দিয়ে বলল,

—-‘ এ..এই এটা কে রে?’

নাইরার প্রশ্ন রিয়াদ-কনিকা দু’জনেরই ভ্রম কাটে। দু’জনে মুহুর্তেই সচেতন হয়ে উঠে। কনিকা রিয়াদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকালো। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন গুলোকে আবারও জাগ্রত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলো। এরই মধ্যে রিয়াদ ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

—-‘ কনিকা! আমি কি তোমার থেকে দশ মিনিট সময় চাইতে পারি? স্রেফ দশ মিনিট! প্লিজ!’

কনিকা আবারও স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিয়াদের দিকে। রিয়াদের কন্ঠটা কেমন করুন। কনিকার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। পেছন থেকে রিনাত বলে উঠলো,

—-‘ এই নাইরা চল তুই আর আমি যাই। কনিকা কথা বলে আসুক।’

নাইরা রিনাতের কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে চলে গেলো। কনিকা রিয়াদের চোখ দুটো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল,

—-‘ মাঝরাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কারোর বাড়িতে প্রবেশ করা কতবড় অপরাধ জানেন আপনি?’

রিয়াদ চোখ নামিয়ে নিলো। একহাতে মাথা চুলকে আমতাআমতা করে বলল,

—-‘ টানা তিনরাত ঘুমোতে পারছি না! দুটো দিন তো হন্নেহয়ে খুঁজেছি। শুধু এক নজর দেখব বলে। গতকাল মাঝরাস্তায় তোমার বোনকে দেখে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম। তুমি ভেবে পাগলের মতো করে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছি। আরও না জানি কিসব পাগলের প্রলাপ বকেছি। তারপর যখন পেছনে তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম এক মিনিটের জন্য তো আমার পুরো দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিলো। অবশেষে তোমার খোঁজ পেলাম। তোমাকে দেখলামও। কিন্তু ওমন একটা লজ্জাজনক কাজের পর তোমায় আর কিছু বলার সাহস হয়নি। তাই তখনই তোমাদের ফলো করে বাসার এড্রেস চিনে নেই। তারপর গত দুদিনের মতো ঠিক একই কষ্ট হচ্ছিলো। শুধু ছটফট করছিলাম তোমায় এক নজর দেখবো বলে। তাই মাঝরাতেই ছুটে আসি তোমায় দেখতে। তোমার রুম কোনটা জানতাম না। তাই যেই জানালাটা খোলা পেলাম সেটা দিয়েই ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকতেই শুনতে পেলাম কেউ কাতরাচ্ছে। ছুটে এলাম তার কাছে। কম্বলটা তুলে দেখি যার জন্য এতদূর ছুটে এলাম সেই মানুষটিই এভাবে জ্বরে কাতরাচ্ছে। হঠাৎ বুঝতে পারছিলাম না কি করব-

—-‘ হু,হঠাৎ বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন তাই রান্না ঘর থেকে বাটিতে করে জল এনে নিজের রুমাল দিয়ে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিলেন। আর তারপর সেটা আমার কাছে রেখেই পালিয়ে এলেন-

—-‘ তোমার জ্বর নেমে গেলেও পুরোটা নামেনি। তাই ওটা ওখানেই রেখে আসতে হয়েছিলো। তোমার ভীষণ জ্বর ছিলো। দেখলাম রাতের খাবারটাও খাওনি আর ঔষধ গুলোও পড়ে ছিলো-

—-‘ তাই নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আবারও ঔষধও খাওয়ালেন তাইতো?’

—-‘ আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি বিলিভ মি। তোমায় ঐ অবস্থায় ছেড়ে আসতে পারিনি কনিকা। এক নজর দেখতে গিয়ে তোমায় যে এই অবস্থায় পাবো-

হাত তুলে রিয়াদের কথা থামিয়ে দিলো কনিকা। কড়া কড়া কন্ঠে জবাব দিলো,

—-‘ শুনুন এসব আপনি যা করছেন না এটা কিন্তু ভালোবাসা নয় মি.। এটা আপনার ইনফ্যাচুয়েশন! যা সময়ের সাথে সাথে কেটে যাবে। তাই এসব পাগলামি বন্ধ করে পড়াশোনায় মন দিন।’

কথা গুলো বলে কনিকা হেঁটে যেতে নিলেই রিয়াদ তার হাত টেনে ধরে। কানিকা অবাক চোখে রিয়াদের দিকে তাকানোর মাঝেই রিয়াদ কঠিন গলায় বলে উঠে,

—-‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি,ভালোবাসি। শুনেছো তুমি? ভালোবাসি আমি তোমাকে। এটা আমার কোনো ইনফ্যাচুয়েশন নয়। কোনো মোহ নয়। আর সেটা আমি প্রমান করেই যাবো। আমিও দেখবো তুমি কি করে আমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারো।’

রিয়ােদর এহেম আচরন ও কথায় ভড়কে যায় কনিকা। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলার চেষ্টা করে,

—-‘ ক..ককি হচ্ছে টা কি? এ..এএটা আআমার ভ..ভভার্সিটি! প্লিজ-

রিয়াদ ছেড়ে দেয় কনিকার হাত। তার কঠোর দৃষ্টি মুহুর্তেই নরম হয়ে উঠে। অপরাধী গলায় বলে,

—-‘ স..সসরি!’

কথাটা কোনো মতে বলেই চলে যায় রিয়াদ। কনিকা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে দম ছেড়ে বাঁচে।

#চলব___

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here