কাছে দূরে পর্ব ৬১+৬২

#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬১

—-‘ আ,,ম আমাকে ছেড়ে দাও হীর! ম,,মনিকা ম্যাডামের এসবের পেছনে আমার কখনই কোনো ভূমিকা ছিলো না!’

শিলার আকুতি ভরা থেমে থেমে আসা কন্ঠে হীর লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো। যেন শিলার কষ্টে হীরের শান্তি লাগছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। হীর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি এঁটে এগিয়ে গেল শিলার পানে। হীরের মুখের হাসি আর তার এগোনে দেখে শিলার আত্না চিরচির করে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল কিছু নেমে গেলো। শিলা মনে মনে মেনে নিলো সে আর বাঁচবে না। হয়তো হীর তাকে এক্ষনি মেরে ফেলবে। শিলা আতংকে থরথর করে কাঁপছে। হীর শিলার মুখোমুখি হয়ে তার চেয়ারের উপর দু-হাত দিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। শিলা ঢোক গিলে গলা ভেজালো। ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠলো শিলা। হীরকে কি করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওর হাত থেকে বাঁচা যায় তার একটা পাকাপোক্ত বুদ্ধি বের করতে হবে।

—-‘ ওহ,তাই নাকি! কিন্তু আমার জানামতে তো তুমি মনির ছোট থেকেই তার প্রত্যেকটা খারাপ কাজে সঙ্গ দিয়ে এসেছো। ইভেন, নানাভাই আর নানুমনি যখন মা আর মনিকে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছিলো পড়াশোনা করার জন্য তুমি তখনও মনির সাথে ছিলে। মনির সাথে মালয়েশিয়া অব্দি চলে এলে। মনির সাথে তোমার অ্যাটাচমেন্ট এতোইটাই ডিপ ছিলো যে মনি রিয়াদ আহমেদকে তার ছোটবোনের প্রেমিক হিসেবে সহ্য করতে পারতোনা সে খবরও তোমার জানা ছিলো। প্রত্যেকটা ক্রাইম মনি তোমায় না জানিয়ে করত না। আর একমাত্র তুমিই ছিলে যে কিনা কখনও মনির কোনো ক্রাইম কে ক্রাইম ভাবতে না। তুমি মনিকে আরও উৎসাহ দিতে। আচ্ছা আমায় একটা কথা বলোতো, এসব করে তোমার কি মিলতো? তোমার প্রাপ্তি কি ছিলো? মনি কি তোমাকে এর জন্য টাকা দিতো? উঁহু! টাকা তো দিতো না! তাহলে? কি ছিলো তোমার প্রাপ্তি? বলো?’

হীর শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বলতে বলতে শিলার বাঁধা হাতে বল প্রয়োগ করে। শিলা ব্যাথায় মুচড়ে যাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে চেষ্টা করছে,

—-‘ আ,,মার ক,,ককোনো প্রাপ্তি ছিলো নাহহ! আ,,মার শুধু মনিকার কাজ গুলো করতে ভালো লাগতো। মনিকা কাজের শেষে আমাকে যে বাহবা দিতো আমার স,,সেটাই ভালো লাগতো।’

হীর শিলাকে ছেড়ে দিয়ে হুহা করে হেসে উঠলো। শিলা চোখ বুঁজে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। তার শরীরে আর এই অত্যাচার কুলচ্ছে না। আর তারউপর শান্তশিষ্ট ভদ্র স্বভাবের একটা মেয়ের এমন ভয়ানক রূপ! সেটাই শত্রুকে অর্ধেক কাবু করে ফেলতে পারে।

হীর হাসি থামিয়ে রোজের দিকে তাকালো। রোজ অবাক চোখে হীর আর শিলার কথা শুনছে। আচমকা হীরকে হাসতে দেখে তার বিস্ময় বেড়ে গেলো। প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে হীরের দিকে তাকাতে হীর বলে উঠল,

—-‘ কি ভাবছিস বোন? শিলা সত্যি সত্যি এসব কিছু তোর মমের খুশির জন্য করত?’

রোজ সন্দিহান চোখে শিলার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-‘ না আপু। আমার কেন যেন শিলার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কারন ওরা প্রত্যেকে স্বার্থের জন্য সবটা করছে। আর তার মধ্যে শিলা একা নিঃস্বার্থ হতে পারেনা।’

রোজের কথা শুনে হীর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি এঁটে বলল,

—-‘ ওর এসব করার পেছনে কারন ছিলো ফরহাদ রেজা। তাই না শিলা?’

হীরের মুখে ফরহাদ রেজার নাম টা শুনতেই পিলে চমকে উঠলো শিলার। তার শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় যেন ফুরিয়ে এসেছে। রোজ আর সাবাবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কি বলল এটা হীর। মনিকার ডান হাত শিলার নজর কিনা মনিকার হাজবেন্ডের দিকে। কি করে সম্ভব!

রোজ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো শিলার দিকে। আগুন ঝরা কন্ঠে বলল,

—-‘ কালপ্রিট!’

হীর রোজ কে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—-‘ রিলাক্স বোন। কাহানী মে টুইস্ট হ্যায়!’

সাবাব আর রোজ একসাথেই বলে উঠলো,

—-‘ টুইস্ট!’

হীর শিলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

—-‘ হ্যাঁ টুইস্ট। বড়সড় রকমের টুইস্ট। শিলা রেজাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করত। কিন্তু নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কখনও এই কথা সে কাউকেই বলতে পারেনি। না মনিকে আর না রেজাকে। শিলা জানত সে সৎ পথে থেকে কখনই রেজাকে কাছে পাবেনা। তাই শিলা অসৎ পথটাই বেছে নিলো। মনি আর রেজার বিয়ের পর শিলা তার বিকৃত মস্তিষ্কের দ্বারা রেজাকে কব্জা করে নেয়। রেজাও ছিলো মেয়ে পিপাসু রাক্ষস। তাই শিলার কুপ্রস্তাব তার কখনও মন্দ লাগেনি! রেজাও শিলার কুপ্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। শিলা এবং রেজা মনির আড়ালেই ওদের এসব নোংরামি চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর। মনি কখনও এর আন্দাজও করতে পারেনি। আর মনি যেন সন্দেহও না করতে পারে তারজন্য শিলা তারপর থেকে আরও বেশি করে মনির সঙ্গ দিতে থাকে। শিলা ভাবত মনির এসব কুকর্মের জন্য মনি একাই ফেঁসে যাবে। তার পেছনে কে বা কারা কলকাঠি নাড়ে সেটা হয়তো সামনে আসবেনা।’

শিলার চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে অতিরিক্ত ভয়ে। হীর এতসব কিছু কি করে জানলো! যে কথা আজ অব্দি স্বয়ং মনিকা জানতে পারল সে কথা অব্দি এই পুঁচকে মেয়ে কি করে জানতে পারে?

হীর শিলার গতিবিধি নিরীক্ষন করতে করতে তার কপালে রিভলবার ঠেকালো। শিলা আতংকে কেঁপে উঠে চিৎকার করতে নিলেই হীর শিলার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,

—-‘ চেঁচালো একটার জায়গায় দুটো গুলি বের হবে। আর দুটোর জায়গায়? চারটা!'(ফিসফিসিয়ে)

প্রান সংকটে পড়ে শিলার মুখের রং পাল্টে গেলো। সে চেঁচাতে গিয়ে একশবার ভাবতে লাগলো। সে এখন যাই করবে হীর তাকে সেটার জন্যই শাস্তি দিবে। আর একমাত্র শাস্তি হলো তার মৃত্যু।

—-‘ হ,,হীর! হ,,হীর আমায় ছেড়ে দা—

লোড করা রিভলবার চালিয়ে দিলো হীর! পরপর তিনটে গুলি বেরিয়ে ঝাঁঝড়া করে দিলো শিলার কপাল। রোজ এবং সাবাব দু’জনেই চমকে উঠল হীরের কাজে। কারন তারা এই মুহুর্তে এমন কাজের সাক্ষী হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। শিলার কপালের রক্ত ছিটকে এসে হীরের শরীর মাখামাখি করে দিলো। শিলাকে মৃত অবস্থায় দেখে হীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। এখনও তিনটে খুব বাকি! কিন্তু নিজেকে এখনই বড় ক্লান্ত লাগছে হীরের। হীর দু-কদম ফেলে আকস্মিক ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। হীরকে বসে পড়তে দেখে রোজ আর সাবাব দৌড়ে এসে ধরলো তাকে। হীর ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেখলো সাবাবের অস্থির দৃষ্টি। সাবাব হীরের দুর্বল চাহনি দেখে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-‘ তোমার রেস্ট দরকার হীরপাখি।’

পেছন থেকে রোজও কিছু একটা বলল। কিন্তু হীরের কানে এসে সে কথা পৌঁছালো না। তার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতেই সাবাবের বুকে মাথা ঠেকালো। অতঃপর আর কিছু মনে নেই।

____________

ভোরের আলো ফুটতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল মনিকা। ঘুমের ঘোরেও কেমন অস্বস্তিতে হাসফাস করছিলো তার শরীর-মন। মনে হচ্ছিল যেন সবটা শেষ হতে চলেছে। তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসতে চলেছে। হীর যা ভয়ানক আচরন করেছে তাতে যা কিছু হওয়া সম্ভব। মনিকা নিজের মনকে বুঝিয়ে বিছানা ছাড়লো। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বাংলাদেশে কল করল। আজিম সাহেব কল তুললেন। আজিম সাহেবকে সবটা বলে মনিকা মালয়েশিয়া আসতে বলল। আজিম সাহেব সবটা শুনে ঘাবড়ে গেলেন। এবার কি সে তার ছেলের হাতে ধরা পড়বে? তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন এমন কাজ হওয়ার আগে যেন তার মৃত্যু হয়।

মনিকা কল কেটে নীচে চলে গেলো। রাতে খাওয়াদাওয়া না করেই ঘুমিয়ে গেছে। এখন কিছু না খেলেই নয়। মনিকা ডাইনিং এ এসে ফলপাকড় কিছু কেটে খেতে খেতে রান্না ঘরে চলে গেলো। রান্না ঘরে পা রাখতেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। রান্নাঘরের বেসিনে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে হীর। মনিকা গগনবিদারী চিৎকার করে দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেলো। তাড়াহুড়ো করে এখান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই হীর হাতের গরম কফিটা ছুঁড়ে দেয় মনিকার দিকে। গরম কফিটা মনিকার গালে লাগতেই ঝলসে যায় তার মুখের একপাশ মনিকা প্রচন্ড জ্বালাপোড়ায় হুমড়ি খেয়ে নিজে পড়ে যায়। তার শরীর অবস হয়ে আসতে শুরু করে। নীচে পড়ে কাতরাতে লাগল সে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেললেও তার চেলারা কেউ এসে তাকে সাহায্য করছেনা। বরং এক এক করে তার সামনে এসে দাঁড়ায় মীর,তরী,কিরন,আভিক,মাহদী, ইভান এবং সাবাব। আর তাদের পেছনে এসে দাঁড়ায় রোজ এবং আদ্রিক। সামনের মানুষ গুলোকে দেখেই মনিকার রুহু বেরিয়ে আসার উপক্রম তাই পেছনের দু’জনকে আর দেখতে পেলো না। তরী আর কিরন মনিকাকে হেঁচকা টেনে দাঁড় করায়। মনিকা আকুতি ভরা কন্ঠে তাকে ছেড়ে দিতে বলে কিন্তু কেউ আর তার আকুতি মিনতি শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করেনা। সবাই মিলে মনিকাকে নিয়ে একটা রুমে চলে যায়। সেখানেই মনিকাকে বেঁধে রেখে বেরিয়ে যায় সবাই। বাইরের থেকে দরজায় তালা দিয়ে সবাই আরেক রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

খানিক বাদে রেজাও নেমে আসে নীচে। মনিকার চিৎকার অবশ্য সে শুনেছে। মনিকাকে নিয়ে সে চিন্তিত না হলেও ফর্মালিটির জন্য তাকে খোঁজ করতেই হবে। হাতে চশমাটা মুছতে মুছতে চোখে পড়ে বার কয়েক হাক পাড়ল ‘মনি’ বলে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেলো না। তাই একটু চিন্তা হতে লাগলো। চারপাশে চাতক পাখির মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলো মনিকা কোথাও নেই। আস্তেধীরে হেঁটে এসে ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়ালো। সব কিছু যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছু হচ্ছে না তবুও যেন মনে হচ্ছে চোখের আড়ালে অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে। রেজা জগ থেকে জল ঢালল গ্লাসে। গ্লাস টা হাতে উঠাতে উঠাতে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। জলটা মুখে নিয়ে কয়েক ঢোক গিলতেই ঘাড়ের মধ্যে ফ্যাচ করে শব্দ করে কিছু একটা বিঁধে গেলো যেন। রেজার দম বন্ধ হয়ে গেলো। শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। নীচে গড়িয়ে পড়তেই পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো হীর। রেজার মুখোমুখি বসে ফিসফিসিয়ে বলল,

—-‘ হ্যাপি বার্থডে রেজা।’

রেজা দম ছেড়ে দিলো। চোখ থেকে গড়িয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই চোখ বুঁজে নিলো সে। হীর হাসতে হাসতে হাসতে উঠে গেলো। পেছন থেকে আভিক,মাহদী আর ইভান এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলো।
#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬২

মুখের একপাশ ঝলছে যাওয়ার অসহনীয় যন্ত্রণা আর ঘাড়ে কিছু বিঁধে থাকার অসহনীয় যন্ত্রণা! দু’জনেই ছটফট করছে তীব্র যন্ত্রণায়। গত একঘন্টা যাবত কাতরাচ্ছে। কিন্তু বাঁধন খুলে এখান থেকে বের হওয়ার সাধ্য কারোর নেই। তাই কাতর কন্ঠে বারবার আকুতি মিনতি করে গেছে হীরের কাছে। সম্পর্কের দোহাই দিয়েছে। তারা দু’জন হীরের মা-বাবার মতো সে কথাও বলেছে। আরও কতকি! হীর তাদের করুন কন্ঠে ঠোঁট টেনে তাচ্ছিল্যের সুরে হেসেছে। মনিকা আর রেজা আচমকা থমকে যায় তাদের মেয়েকে দেখে। তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না তাদের একমাত্র মেয়ে হীরকে এসবের জন্য সাহায্য করেছে!মনিকার মাতৃত্বে আঘাত লাগে রোজের এমন বিশ্বাসঘাতকতায়। তার মন প্রশ্ন করে একটা সন্তান তার বাবা-মাকে কি করে মারার প্ল্যান করতে পারে! প্রশ্ন টা কেবল মনেই নয় সে সরাসরি রোজকেই জিজ্ঞেস করে বসল। রোজ তাচ্ছিল্যের সুরে হাসতে হাসতে জবাব দিলো,

—-‘ মম, তুমি আমাকে এই প্রশ্ন না করো তো সেটাই শ্রেয় তোমার জন্য। কারন স্বার্থের খেলায় মেতে উঠে প্রথমে যে পাপের সূচনা তুমি করেছিলে আমিও সে পথেই হেঁটে এসেছি। তবে এখানে একটা ছোট্ট শব্দের ভুল আছে! তুমি সূচনা ঘটিয়েছিলে স্বার্থপরতার! স্বার্থের জন্য সব কিছু ধ্বংস করার আর আমি এর সমাপ্তি টানবো একটা সুন্দর সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। মম আমারও স্বার্থ আছে। তবে কাউকে খুন করে সম্পত্তি পাওয়ার স্বার্থ নয়! বরং আপনজনকে বাঁচিয়ে তার সাথে আত্মার সম্পর্কটা অটুট রাখতে। মম, তুমি তোমার বোনের কাছে থেকেও কখনও তার ভালো করতে পারোনি। কখনও তার ভালো চাইতে পারোনি। কখনও তাকে প্রটেক্ট করতে পারো নি। উল্টে তুমি বরাবর তার ক্ষতি করে এসেছো। ইভেন শেষ অব্দি স্বার্থের জন্য নিজের বোনটাকেই মেরে ফেললে! অথচ দেখো, আমি আমার বোনের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও সর্বদা তাকে সেফ করার কথা ভেবে গেছি। সবসময় পাগলের মতো করেছি কি করে তাকে বাঁচাবো এই শকুনদের হাত থেকে! কি করে প্রটেক্ট করবো! আমি তোমার মতো হতে পারিনি মম। আমি আমার মনির মতো হতে পেরেছি। আর এটাই আমার শান্তি। তুমি কাছে থেকেও নিজের বোনকে কখনও ভালোবাসতে পারোনি। আর আমি দূরে থেকেই নিজের বোনকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতে পেরেছি মম। ছিহ্! শেইম অন ইউ মম। শেইম অন ইউ।’

রোজ কথা গুলো বলতে বলতে ঘৃনায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মেয়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃনা দেখে আজ প্রথমবার মনিকার বুক কাঁপছে। মুখ ঝলসে যাওয়ার থেকেও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে তার মেয়ে তাকে এতটা ঘৃনা করে ভেবে। যে মেয়ের জন্য তার কখনও মন কাঁদেনি আজ তার কয়েকটা কথার জন্য মনিকার বুক কাঁপছে। মন কাঁদছে। সারাটা জীবন কেবল ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা,বাড়ি-গাড়ি,নিজের একটা ভালো পজিশন এসব ছাড়া কখনই কিছু ভাবেনি সে। জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ সে স্বার্থ ছাড়া এগোয়নি। তবে আজ মনে হচ্ছে সেই জীবনটাই তো বৃথা ছিলো তার। আজ প্রথমবার নিজের মেয়ে তাকে এতটা ঘৃনিত চোখে দেখছে ভেবে মনে হচ্ছে এই তো জীবনের আসল মানে। যেখানে মানুষ মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য লড়ে। তবে নিঃস্বার্থ ভাবে। রোজের জন্মের পর থেকে সে রোজকে কাছে টেনে নিয়ে কখনও জানতে চায়নি কেমন আছে তার মেয়েটা?একসাথে তিনজনে খেতে বসে কখনও মনে হয়নি মেয়েটা তৃপ্তিভরে খেতে পারলো কি না? কখনও শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলে কপালে হাত ঠেকিয়ে আদুরে কন্ঠে বলেনি, ‘চিন্তা করিসনা মা,সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কখনও এমন করেনি সে। বরং সে ভেবে এসেছে টাকাই পারে সব কিছু করতে। খাবার টেবিলে দামী দামী বিদেশি খাবার রেখে আর জ্বর এলে শহরের নামকরা ডক্টরকে নিয়ে এলেই হয়তো ভালোবাসা হয়ে গেলো! কিন্তু না। সেসবের মাঝে তার মেয়েটা কখনও ভালোবাসা খুঁজে নিতে পারেনি। মেয়েটা তো অধীর আগ্রহে বসে থাকত, মম কখন জিজ্ঞেস করবে খাবার কেমন হয়েছে? মম কখন কপালে হাত ঠেকিয়ে বলবে, চিন্তা করিস না! মা আছেতো।’

এসব ভাবতে ভাবতে মনিকার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তার জীবনের সব কিছু বৃথা ছিলো। সবটা!

—-‘ আফসোস হচ্ছে মনি? কষ্ট-ও ভীষণ হচ্ছে বলো? নিজের মেয়ের মুখে এসব কথা শুনলে কষ্ট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক তাই না? বরং কষ্ট না হওয়াটা অস্বাভাবিক। তবে তোমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের জন্য কষ্ট না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাহলে তুমি কষ্ট পাচ্ছো কেন বলো তো? তোমার তো রাগ হওয়া উচিৎ। রেগেমেগে জ্বলে উঠে হীরকে শেষ করার প্ল্যান করা উচিৎ কিন্তু না! তুমি সেটা না করে অনুশোচনায় ভুগছো! এটা কিন্তু ঠিক নয় মনি। দিস ইজ নট ডান!’

মনিকা অপরাধী চোখে তাকালো হীরের মুখ পানে। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

—-‘ হীর! আমায় একটা সুযোগ দাও মাম্মা। কেবল একটা সুযোগ! আমি আমার ভুলগুলোর প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। শুধু একবার-

মনিকার আকুতি শুনে হীর রুসে উঠলো। তেড়ে গিয়ে মনিকার ঝলসানো মুখ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—-‘ চুপ! একদম চুপ! কোন ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও মনি? হু? কোন ভুলের? আমার মা-বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নাকি আমার শৈশব টাকে নরক করে দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত! নাকি আমার পুরো জীবনটাকে পদে পদে নরকে ঠেলে দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত? কোন ভুলের মাশুল দিতে চাও তুমি? প্রায়শ্চিত্ত করে আমার বাবা-মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবে? বলো? পারবে? হাহ্.. প্রায়শ্চিত্ত! প্রায়শ্চিত্তের অর্থ কি জানো তো মনি? নাকি নামে শুনেই জপ করছো? তোমাকে দেখলে আমার রগে রগে জানান দেয় আমার বাবা-মায়ের খুনি তুমি! কতটা নৃশংসভাবে মেরেছো দুটো মানুষকে। আ..আর আর ওদেরকে বাঁচাতে যারা চেষ্টা করেছিলো তাদেরকেও কতটা বাজে ভাবে মেরেছো! মনে আছে সেসব কথা? হু? মনে করো। মনে করে নিজের প্রত্যেকটা ভুলের কথা,অপরাধের কথা! মনে করো মনি!'(চেঁচিয়ে)

মনিকা পোড়া জায়গায় আঘাত পেতেই কুকিয়ে উঠলো! কাতর কন্ঠে বারবার ছেড়ে দিতে বলতেই হীর তাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যায়। সাবাব এগিয়ে এসে হীরের পাশে দাঁড়ালো। হীরের কাঁধে হাত রেখে বলল,

—-‘ শান্ত হও হীর। এসো, বসো এখানে। মাহদী?’

—-‘ ইয়েস স্যার?’

—-‘ হীর আর রোজের জন্য জল নিয়ে এসো। রোজ?’

সাবাবের ডাকে রোজ মলিন হেসে বলল,

—-‘ নো ভাইয়া,ইট’স ওকে। মাহদী ভাইয়া, তুমি শুধু আপুর জন্য জল নিয়ে এসো। আমার জন্য প্রয়োজন নেই।’

পাশ থেকে আদ্রিক রোজের দিকে তাকিয়ে মাহদীর উদ্দেশ্যে বলে,

—-‘ মাহদী ভাই তুমি নিয়ে এসো। রোজের জলের দরকার আছে।’

রোজ আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই আদ্রিক হাত উঁচিয়ে রোজকে থামিয়ে দেয়। রোজ চুপ হয়ে যায় আর কিছু বলে না। আদ্রিক এগিয়ে এসে রোজকে আলগা করে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বলে,

—-‘ ভেঙে পড়ছিস কেন বলতো? আমি আছি না তোর সাথে?’

রোজ মলিন হেসে আদ্রিকের বুকে মাথা ঠেকায়। তাদের দু’জনকে দেখে সাবাবও হীরের বাহু আগলে কাছে টেনে নেয় তাকে। হীর কিছুক্ষন থম মেরে থেকে হঠাৎ মনির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

—-‘ নিজের ছোট বোনটাকে এমন করে মেরে ফেলে কি পেয়েছিলে বলোতো মনি? নিজের বোনকে মারতে এতটুকু কষ্ট হয়নি তোমার?’

হীরের প্রশ্নে ফ্যাকাসে মুখে হাসল মনিকা। ঢোক গিলে ক্লান্ত স্বরে বলতে আরম্ভ করল সেই বিষাক্ত অতীতের কথা,

🌸____১৯৭৬ সাল। ১৭-ই ফেব্রুয়ারি মায়ের কোল আলো করে আমাদের দু-বোনের জন্ম হয়। বাবা তার জমজ মেয়ে হওয়ার খুশিতে পুরো গাজীপুর জেলায় মিষ্টি বিতরন করে। সেই সাথে গরীব-দুঃখীদের সামান্য কিছু বস্ত্র বিতরনও করে। জমিদার বাড়ি ভীড় করে মানুষ আমাদের দেখতে এসেছিলো। কত আনন্দ, কত হুল্লোড় ছিলো আমাদের দুই-বোনের আসাতে। বড় হতে হতে মায়ের মুখে কম গল্প শুনিনি এসব নিয়ে। একই গল্প বারবার শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে যেতো কিন্তু বোনকে দেখতাম ও এতো মন দিয়ে এসব শুনত যেন এই প্রথম শুনছে এই গল্প। বোন ছোট থেকে খুব শান্ত ছিলো। আমার মনে পড়েনা ওকে কখনও শয়তানি করতে দেখেছি। সব সময় একটা গিন্নিপনা ছিলো ওর মাঝে। মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতো। গাজীপুর জেলার এমন কোনো মানুষ ছিলো না যে ওকে ভালোবাসত না। কখনও কোনো ভিক্ষুক এলেও বোন তাকে এক বেলা না খাইয়ে ছাড়তোনা। এমন ছিলো বোন। কিন্তু আমার বরাবর মনে হতো ও এসব লোক দেখানোর জন্য করে। লোকের ভালোবাসা পেতে এসব করে! নাটক করে। আমার সহ্য হতো না ওর এই ভালো মানুষী! আমার খুব হিংসে হতো লোকে ওকে কেন এতো ভালোবাসে? কেন সবাই আমায় ভালোবাসে না? সবাই কেন ওর নাম জপে! আমিও তো ওর মতো দেখতে তাহলে কেন সবাই আমায় ঠিক ওর মতোই ভালোবাসে না? বাবা-মাও এমন করতো! সবসময় বোনকে বেশি ভালোবাসতো। সব ক্ষেত্রে বোন, বোন আর বোন। কখনও এমনও হয়েছে কেউ আমায় আদর করে জড়িয়ে ধরে অনেক প্রশংসা করলো কিন্তু খানিক বাদেই সে বলে বসল, ‘ওহ তুমি মনিকা? আমি তো ভাবলাম কনিকা!’
তুমি বুঝবে না হীর এই কথাটা কতটা ভয়াবহ যন্ত্রণা দিতো আমায়! আমার দিনকে দিন ওর প্রতি ঘৃনা বাড়তে থাকে। বাবা আমাকে সবসময় বলত, কনিকার মতো হ! কনিকার মতো কর! কনিকা যা করে তাই কর। এসব শুনতে শুনতে মনের অজান্তেই কনিকাকে চোখের বিষ ভাবতাম। বোন কখনও শয়তানি করতো না। কিন্তু আমার করা সব শয়তানির নাম ও নিতো। ও নিতো না আমিই চাপিয়ে দিতাম। বাবা-মা ছাড়া আমাদের দু-বোনকে কেউ আলাদা করে চিনতে পারতো না। তাই ঘর ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা জায়গাতেই আমি আমার মনের রাগ সবটা বোনের উপর ঝাড়তে পারতাম। হ্যাঁ হয়তো নামটা আমারই হতো কিন্তু আমি চোখের ধোঁকায় কনিকাকে বানাতাম মনিকা। আর সবাই কনিকাকে মনিকা ভেবে শাস্তি দিতো। কিন্তু বাসায় ফিরলে আমার নামের জন্য ঠিকই বাবার হাতে আমি শাস্তি পেতাম। আমার এতো এতো ভুলে কখনও বোন আমাকে কথা শুনাতো না। বা কখনও প্রশ্নও করত না আমি ওর সাথে এসব কেন করি? ছোট থেকেই ও আমার অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করতো। আমি সারাটা জীবনভর ওর থেকে শুধু কেঁড়ে নিতাম। বাবা কখনও আমাদের দু-বোনের জন্য কোনো খেলনা আনলে বোন বলত, ‘বাবা বোনকে দাও,ওর যেটা ভাল্লাগে ও সেটা আগে নিক।’ বাবাও বোনের কথায় খুশি হয়ে খেলনা গুলো আমার হাতে তুলে দিতো। আর আমিও আমার পছন্দের জিনিস গুলো নিয়ে চলে যেতাম। আর ও সেই বাকি খেলনা গুলো নিয়ে নিজের ড্রয়ারে সাজিয়ে রাখত। কিছু দিন পার হতে যখন আমার খেলনা গুলো নষ্ট হয়ে যেতো বা ভেঙে যেতো আমি সেগুলো এনে বোন কে দিয়ে ওর নতুন খেলনা গুলো নিয়ে যেতাম। ও কিছু বলতো না। মুচকি হেসে আমায় বলত, ‘আমার লাগবেনা, তুই নিয়ে যা।’ আর আমিও নিয়ে যেতাম। ওকে দেখতাম ও সেই ভাঙাচোরা খেলনা গুলোই যত্নে সাজিয়ে রাখত। আমি কখনও ওর মতো হতে পারিনি। আমার লোকজনকে ভালোবাসার থেকে অবহেলা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য লাগলো। আর আমার বোনের সমস্ত জিনিস কেঁড়ে নিতে ভালো লাগত। আমাদের শৈশব এভাবেই কেটে যায়। আমরা স্কুল-কলেজ শেষ করে মালয়েশিয়া চলে আসি। বাবার ইচ্ছে ছিলো তার দুটো মেয়ে তার স্বপ্ন পূরন করবে। আমাদের কোনো ভাই না থাকায় বাবা-মায়ের কোনো আক্ষেপ ছিলো না৷ বাবা-মা কখনও ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ করত না৷ বাবা বলতো একটা ছেলে যা পারে একটা মেয়েও তা পারে। আমরা দু-বোন বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরন করতে চলে এলাম এখানে। সঙ্গে এলো শিলা। শিলা আমাদের বাড়ির এক বিশ্বস্ত মেইডের মেয়ে। আমাদের দেখা শোনা করার জন্য বাবা শিলাকেও সঙ্গে পাঠায়। দেখাশোনা আমাদের দু’জনের করার কথা হলেও শিলা বরাবরের মতোই আমার পায়ের কাছে পড়ে থাকত। এখানে এসেও বোন কখনও এক মুহুর্তের জন্য আমার হাত ছাড়েনি। পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, ঘুম সব কিছুতেই ওর নজরদারি ছিলো। বোন আমাকে এমন ভাবে আগলে রাখত যা মা-ও কখনো পারেনি। শিলাকে আমাদের দেখভাল করার জন্য পাঠানো হলেও শিলা আমার পা চাটা ছাড়া আর কিছুই করতো না। আমাদের দু’জনের দেখভাল বোন নিজেই করতো। কখনও পড়াশোনায় আমাকে কেউ টক্কর দিয়ে যেতে পারতো না। তবে তার পেছনের আসল কারন ছিলো এক্সামে বসে বোন আমার পেপার লিখত আর আমি ওর পেপার। আমি ইচ্ছে করেই ওর পেপার খারাপ করে লিখতাম। যেন ও মোটামুটি ভাবে পাশ করতে পারে। জীবন এভাবে খুব ভালোই যাচ্ছিল কিন্তু তার আর বেশিদিন গেলো না। হঠাৎ আমাদের দু-বোনের জীবনে চলে এলো এক সুদর্শন যুবক। ভাগ্যের পরিহাসে সেদিন আমার জায়গায় বোন গিয়েছিলো এসাইনমেন্ট জমা দিতে। আমি ইচ্ছে করেই ওকে দিয়ে সারারাত খাঁটিয়ে আবার সেই পেপার জমা দিতে ওকে একাই পাঠালাম। কেন জানিনা ও আমার জন্য জীবন দিয়ে দিলেও আমার মন ভরতো না। তবুও ওকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগতো।

৭-ই অক্টোবর। সকাল ৯টা বেজে ১৫ মিনিট।

—-‘ এই যে ডিয়ার কনিকা। আজ একা যে? তোর সিরিয়াস মুডওয়ালি বোন কোথায়?’

কারোর কন্ঠ পেয়ে কনিকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। দূরে দাঁড়িয়ে আছে রিনাত। রিনাত কে দেখে কনিকা মৃদু হাসল। ভার্সিটির দিকে ইশারা করে বলল,

—-‘ এগুলো জমা দিতে হবে। এসে কথা বলছি।’

রিনাত দ্রুত কদম ফেলে কনিকার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

—-‘ আমিও জমা দিবো চল।’

—-‘ তুই না কাল একবার জমা দিয়েছিস?’

—-‘ আরে ওটা আমার ছিলো না। নাইরার ছিলো।’

কনিকা ভাবুক কন্ঠে বলল,

—-‘ নাইরার এসাইনমেন্ট তুই দিয়েছিস কেন? নাইরা কোথায়?’

রিনাত উদাসীন কন্ঠে বলল,

—-‘ বেচারির শরীর টা তেমন ঠিক নেই। তাই ওর টা আমিই দিয়ে দিলাম। আর আজ নিজেরটা দিতে এসেছি। তো এখন বল তোর বোন কোথায়? আর তুইও তো গতকাল জমা দিয়েছিস তবে আজ আবার এলি কেন?’

কনিকা স্মিত হেসে হাতের এসাইনমেন্টের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

—-‘ এটা বোনের। ওরটাই জমা দিবো।’

রিনাত বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—-‘ কেন রে? তুই কেন ওরটা জমা দিবি। ও কি নিজে আসতে পারে না?’

কনিকা রিনাতের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হেসে বলল,

—-‘ বোনের সব কাজ আমার করতে খুব লাগেরে। তাই সব নিজের হাতে করেই নিয়ে এসেছি।’

কনিকার কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো রিনাত। কনিকার হাত ধরে তাকেও দাঁড় করিয়ে বলল,

—-‘ কি বলছিস তুই? এর একটা এসাইনমেন্ট করতে আমার জীবন বেরিয়ে আসার দশা আর তুই কিনা তোর বোনেরটাও করে নিয়ে এসেছিস?’

কনিকা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-‘ সো হোয়াট? তুই এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন বলতো? আরে আমার বোনই তো! আর ও এসব করতে একদম পছন্দ করে না। জানিসই তো একটা এসাইনমেন্ট করতে কত খাটনি হয়। বেচারি এতো খাটনি করতে পারত না বলেই তো আমি করে দেই। এতো ওরও হেল্প হয় আর কোনো খাটনিও হয়না।’

রিনাত আচমকা রেগে গিয়ে বলল,

—-‘ শোন কনিকা, বোনকে ভালোবাসিস ঠিকাছে৷ কিন্তু এতোটাও ভালোবাসিস না যে এই ভালোবাসাই একদিন তোর কাল হয়ে দাঁড়ায়।’

রিনাতের কথা শুনে কনিকা ফিক করে হেসে বলল,

—-‘ হয়েছে জ্ঞানদিদি এবার তো ভেতরে চল! লেট হয়ে গেলে প্রবলেম হয়ে যাবে চল চল।’

কনিকা রিনাতকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেই আচমকা কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু পড়ল না। আগন্তুক তাকে তার শক্ত হাতে বন্দি করে নিয়েছে। আকস্মিক ঘটনায় কনিকা নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে ভয়ের দরুন আগন্তুকের কলার্ট খামচে ধরে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। আর তার হাতের এসাইনমেন্টের ফাইলটা পড়ে গিয়ে সমস্ত পেপার এলোমেলো হয়ে গেলো। আগন্তুক নীচে পড়া কাগজগুলো দিকে একবার তাকিয়ে কনিকার দিকে তাকাতেই থমকে গেলো। সে কিছু বলতে চেয়েছিলো কনিকাকে। কিন্তু কনিকার ভয় মিশ্রিত মুখশ্রীতে আঁটকে গেলো সে। কনিকা পড়ে গেছে না দাঁড়িয়ে আছে দেখার জন্য চোখ খুলতেই অসাধারণ গড়নের কোনো মুখ আবিষ্কার করলো! ভয়ে তার কপাল কুঁচকে গেলেও আগন্তুকের অসাধারণ মায়াবী চেহারায় তার কপাল চওড়া হয়ে গেলো। লোকটার চোখে গভীর মায়া। আগন্তুকও একই ভাবে দেখছে কনিকাকে। ভাসা ভাসা চোখ দুটোয় একরাশ ভয়। ভয়ঙ্কর মায়াবতী। দু’জনের মনের মধ্যেই অজানা ঘন্টা বেজে গেলো। তবে আগন্তুক সেটাকে সায় দিলেও কনিকা সেটাকে সায় দিলো না। তার চোখের ভয় কেটে গিয়ে রাগে লাল হয়ে উঠলো চোখ। আগন্তুককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তার কষ্টের এসাইনমেন্টের পেপার গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকতে দেখেই কান্না পেয়ে গেলো। নীচে ধপ করে বসে পড়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল,

—-‘ এবার কি হবে?’

#চলব___

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here