#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬৫
—-‘ দাঁড়া! তোর সাথে আমার একটা কথা আছে?’
ভার্সিটি থেকে সবে বাসায় ফিরতেই আমি শক্ত গলায় বোনকে ডাকলাম। বোন যেতে নিয়েও থমকে দাঁড়াল। ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে বলল,
—-‘ কিছু বলবি?’
—-‘ ঐ ছেলেটা কে ছিলো? আর ও এসব কি বলছিলো? তোকে ভালোবাসে,তোকে ছাড়া থাকতে পারবেনা-
—-‘ জানিনা।’
আমার কথা সম্পূর্ন করার আগেই বোন জবাব দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। যেটা আমার মোটেই পছন্দ হলো না। আমি তেড়ে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে খুব বিশ্রী ভাষায় বললাম,
—-‘ এখানে এসে পড়াশোনার নাম করে ছেলেদের সাথে নষ্টামি করে বেড়াস লজ্জা করে না? নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে! বাবা-মা যদি এসব জানতে পারে তাদের আদর্শ মেয়ে এখানে এসে ছেলেদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াচ্ছে ভাবতে পারছিস তাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!’
আমার এমন কটুবাক্যে বোনের ভেতরটা ঠিকই ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। আমার চোখের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
—-‘ এসব তুই কি বলছিস বোন? আ..আআমি! আমি তো ঐ ছেলেকে ঠিক করে চিনিই না! সেখানে তুই আমাকে-
—-‘ চিনিস না? নাটক করছিস আমার সাথে? না চিনলে একটা অপরিচিত ছেলে এসে আমাকে তুই ভেবে এভাবে জড়িয়ে ধরতো? ভালোবাসি,ভালোবাসি বলে পাগলামো করতো?’
বোন আমার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আহত কন্ঠে বলল,
—-‘ আমি সত্যিই ছেলেটাকে চিনি না। চিনিনা!’
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বোন চোখের জল মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেলো। আমি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে হাসলাম। এটুকু তো সিওর হওয়া গেলো ঐ ছেলেটার প্রতি বোনের কোনো টান নেই। কিন্তু ছেলেটার আছে। আর ছেলেটাকে পেতে হলে আমায় বোন সাজতে হবে। একবার হাত করতে পারলে আমি কে সেটা ম্যাটার করবে না।
আমি আমার মতো প্ল্যান সাজাতে লাগলাম। ছোটবেলার মতো ঘরের বাইরে আমি আবারও কনিকা সাজবো।
বোন সেদিন দুপুরে আর বের হলো না ঘর থেকে। হয়তো ওর আবারও জ্বর এসেছিলো। আর আমার বিশ্রী কটুক্তি গুলোও ওর বুকে ধারালো সুচের মতো ফুটেছিলো। আমি আর সেদিকে কর্নপাত করিনি। শুধু শিলার থেকে জেনেছিলাম বোন দুপুরে খায়নি। এমনকি রাতেও রুম থেকে বের হয়নি। অসুস্থ শরীরে পরপর তিনবেলা না খেয়ে থাকায় পরদিন বোনের বিছানা ছেড়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে উঠলো। তাই এমন সুযোগ আমিও আর হাতছাড়া করিনি। ঠিক বোনের গেটআপ নিয়ে চলে গেলাম ভার্সিটি। গিয়ে দেখি যথারীতি ছেলেটা ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। আকস্মিক আমাকে দেখেই যেন তার অপেক্ষা প্রহর গোনা সার্থক হলো। আমি ওকে দেখতেই আমার পায়ের গতি কমিয়ে দিলাম। যেন ও আমার সাথে কথা বলতে পারে। আমার মনের কথাই ঠিক হলো। আমার পায়ের গতি কমে যেতেই ছেলেটা এক দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি তার মুখশ্রীতে আরও একবার আহত হলাম। আমার চোখ বিশ্বাস করতে চাইলো না ছেলেটা সত্যি এতো সুন্দর দেখতে। তার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম আমি। এরই মাঝে সে অনেক কথা বলেও ফেললো কিন্তু আমি শুনতে পায়নি। আমার শ্রবণ শক্তি লোপ পেয়েছে যেন। আচমকা কারোর টান অনুভব করলাম। ঘোর কাটিয়ে তাকাতেই দেখি ছেলেটা আমাকে তার দিকে টেনে নিয়েছে। আমার অনুভূতিরা সব হৈহৈ করে উঠলো। আমি চোখ তুলে তার চোখে চোখ রাখতেই সে আমায় ছেড়ে দিলো। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আঙ্গুল উঁচিয়ে আমার চোখের দিকে নির্দেশ করলো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। এর মাঝেই কেউ তাকে টেনে খানিক দূরে নিয়ে গেলো। আমি ঘাড় কাত করে দেখলাম। ওটা রেজা ছিলো। রিয়াদকে কিছু বলছিলো। আর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। রিয়াদের চোখে কনিকার জন্য যে ভালোবাসা দেখেছিলাম সেটা রেজার চোখেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু এর মাঝে পার্থক্য ছিলো পবিত্রতার। রেজা কেমন বাঁকা করে আমাকে দেখেছিলো। তার মানে রেজাও কনিকাকে পছন্দ করত। ব্যাপারটা উপলব্ধি হলেও সেটা নিয়ে ভাবার সময় হয়নি কখনও। কারন আমার টার্গেট ছিলো রিয়াদ।
সেদিন রেজা রিয়াদকে নিয়ে চলে গেলো। রিয়াদ চলে যাওয়ার পরে আমিও আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না সেখানে। সোজা বাসায় চলে এলাম। বাসায় ফিরে জানতে পারলাম বোনের জ্বর বাড়াবাড়িতে পৌঁছেছে। এখন যদি আমি ওর দেখাশোনা না করি তাহলে বাবা ঠিকই আমাকে দোষারোপ করবে। বাবার ভয়ে বোনের দেখাশোনা করতে লাগলাম। দুপুরের পরে বাসায় ডক্টর আনালাম। ডক্টর বোনকে দেখে বললেন, ‘টাইফয়েড হয়ে গেছে। সম্পুর্ন বেড রেস্ট নিতে হবে সেই সাথে হাজার খানিক নিয়ম।’ আমি সবটা শিলার উপর চাপিয়ে দিলাম। আর বললাম মরলে মরুক সমস্যা নেই কিন্তু অসুস্থ হয়ে যেন না মরে। ওকে সুস্থ করার দায়িত্ব তোর। শিলা আমার ভয়ে বোনের পুরোপুরি যত্ন নিতে লাগল। আর ঐদিকে রোজ বোনের বেশে আমি ভার্সিটি যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। কিন্তু সেই প্রথমদিনের মতো বোনকে ভেবে ভুল করে রিয়াদ আর এমন কোনো কাজই করল না। মনে হতো ও আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজত। আমার চোখ দুটো তীক্ষ্ণ নজরে দেখত। প্রথম দিনে যেমন কাছে এসে দেখেছিলো সেরকম আর কোনোদিনও হয়নি। বরং দিনদিন আমার আর ওর মাঝে দুরত্ব বাড়তে লাগল। ও দূর থেকে দেখে চলে যেতো। এমন প্রায় দিন পনেরো চলল। আমার আর ধৈর্য্যে কুলালো না। তাই আমি নিজ থেকে গিয়েই রিয়াদের সাথে কথা বললাম।
—-‘ তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো!’
রিয়াদ শুঁকনো মুখে জবাব দিলো,
—-‘ বলুন?’
আমি রিয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে মনের কথা বলে ফেললাম,
—-‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি! কথাটা আমি অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু একটা জড়তার কারনে বলতে পারিনি। তোমাকে দিনদিন যত দেখেছি আমার সব জড়তা কেটে গেছে। তাই আজ বলতে পারছি। আমি সত্যি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভীষণ ভালোবাসো।’
কথাগুলো আমি একদমে বলে ফেললাম। আগ্রহী দৃষ্টিতে রিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম উত্তরের আশায়। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রিয়াদ হাসতে শুরু করল। প্রথমে নিঃশব্দে আর তারপর জোরেশোরে হেসে উঠলো। আমি বোকার ন্যায় তাকিয়ে আছি ওর দিকে। অবাক কন্ঠে বললাম,
—-‘ হাসছ কেন? আমি হাসির কি বললাম?’
আমার প্রশ্নে রিয়াদ হাসি থামানোর চেষ্টা করলো। বড়বড় নিঃশ্বাস নিয়ে হাসির বেগ থামিয়ে বলল,
—-‘ আপনার এই প্রশ্নের সঠিক জবাব এখন দিতে পারছি না। অপেক্ষা করুন। একদিন ঠিকই দিবো।’
এই বলে চলে গেল রিয়াদ। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ওর কথায়। ও কি বোঝাতে চাইলো। আমি আকুতি ভরা কন্ঠে ওকে বারকয়েক পিছু ডাকলাম কিন্তু ও আর ফিরে তাকালো না। চলে গেলো।
আমি বাসায় ফিরে এলাম। এসে শুনি কনিকার অবস্থা খুব খারাপ। হসপিটালে ভর্তি না করালেই নয়। মনেমনে রাগ হলো। ওর উপর আমার দুটো কথার খুব বেশি আচর পড়েছে। তাই এমন অসুস্থতা। কথাগুলো ওভাবে না বললেই হতো। তাহলে আর এসব ঝামেলাও পোহাতে হতো না। শিলা বলল, ম্যাডাম আপনি একবার যান তার কাছে। আমার মনেহয় আপনি আপার কাছে কিছুক্ষন থাকলেও আপা একটু ভরসা পাবে।’
শিলার কথাই ঠিক। ওর এমন অসুস্থতায় হয়তো ও নিশ্চয়ই মনেমনে আমাকে ওর পাশে চাইবে। আর কিছু না ভেবে ওর কাছে চলে গেলাম। বিছানার উপর বেহুঁশের মতো পড়ে আছে বোন। ওকে এই অবস্থায় দেখে ভালো লাগছেনা। ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলাম। মনে হলো ছ্যাঁত করে পুড়ল আমার হাতটা। এখনও প্রচুর জ্বর। শিলার থেকে চেয়ে জলপট্টির ব্যবস্থা করে কিছুক্ষন জলপট্টি দিলাম মাথায়। এক পর্যায়ে দেখি ঘোলাটে চোখে দেখছে আমায়। বোন চোখ খুলতেই মনেমনে শান্তি অনুভব করলাম যেন। নাক কুঁচকে বললাম,
—-‘ আর কতদিন অসুস্থ থাকবি বল তো? শিলার হাতের রান্না আমার মুখে রোচে না! জলদি সুস্থ হয়ে ওঠ!’
আমার এটুকুই কথাই বোনকে রাজ্যের সুখ এনে দিলো। শুঁকনো মুখে ফ্যাকাসে হাসল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
—-‘ কালকের মধ্যে যেন দেখি সুস্থ হয়ে গেছিস নয়তো বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবো কিন্তু।’
বোন আবারও হাসল। ওর এই হাসিতে আজ প্রথমবার কেন জানি রাগ করতে পারলাম না। অসহ্যও লাগলো না। শুধু শান্তি অনুভব করছিলাম। বোনের রুমের জানালা গত পনেরো দিন যাবত বন্ধ পড়ে আছে। শিলাকে বলে সব জানালা গুলো খুলে দিলাম। অসুস্থ থাকাবস্থায় প্রাকৃতিক আলোবাতাসের জরুরি আছে। আমি আর বসলাম না। নিজের ঘরে চলে গেলাম। চেঞ্জ করতে করতে ভাবতে লাগলাম রিয়াদের কথাটা। কি বোঝাতে চাইল সে?
রাতে আরেকবার দেখতে গেলাম ওর শরীরের কন্ডিশন কেমন? মনে মনে ভেবে রাখলাম কাল সত্যি ওকে নিয়ে একবার হসপিটালে যাবো। প্রয়োজন হয়তো এডমিট করবো। এভাবে বসে থেকে কিছুই হবেনা। উল্টে ওর শরীর অসুস্থ হবে। মনেমনে ভেবে রেখে বোনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা চাপিয়ে দিলাম। তারপর শিলাকে বলে শুতে চলে গেলাম।
রাত -২টা।
কনিকার জানালার উপর কারোর বিশাল এক প্রতিচ্ছবি এসে পড়ল। পা টিপে টিপে জানালা ধরে রুমের ভেতর চলে এলো অবয়বের অধিকারী ব্যাক্তি। সামনে তাকিয়ে বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলে স্থির হওয়ার চেষ্টা করল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে ভালো করে পরখ করে কম্বলের নীচে শুয়ে থাকা মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করল। যা দূর থেকে সম্ভব হলো না। তাই পূনরায় পা টিপে টিপে এসে বিছানার পাশ ঘেঁষে নিঃশব্দে বসল। কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে কম্বলটা সরাতে গিয়ে মনের সাথে যুদ্ধ লেগে গেলো। এখানে যদি কনিকা না হয়? তবে___
মন মস্তিষ্কের যুদ্ধে কেউ-ই জিতল না। আর হারলোও না। কনিকার অসুস্থ মুখ খানা দেখতেই ভোঁতা হয়ে গেল রিয়াদের অনুভূতি! অসুস্থতায় কনিকার মুখের চকচকে নিখুঁত ভাবটা নিগড়ে নিয়েছে। চোখের নীচে কালো দাগ,শুষ্ক ঠোঁট, শুঁকিয়ে টানটান করছে মুখের ভাব!রিয়াদের বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। মনের মধ্যে হাহাকার করছে। টানা পনেরোটা দিন কনিকার বেশ নিয়ে অন্য কেউ তার সামনে এসেছিলো,তাকে ভড়কানোর চেষ্টা করেছে। এসব সে কেন করেছে একমাত্র সেই জানে! কিন্তু রিয়াদ প্রথম দিনেই মনিকাকে চিনতে পেরে যায়। তার চোখ দেখেই রিয়াদ সিওর হয় এটা কনিকা নয়। তার বোন মনিকা। তাই রোজ কনিকার অপেক্ষা করতে করতে যখন মনিকা তার সামনে এসে দাঁড়াতো তখন সে তার চোখ জোড়া দেখতো। কনিকার চোখ যে কথা বলত মনিকার চোখ সে কথা বলতো না। আর বলবেই বা কি করে? তার চোখ তো জানেই না মায়াবতীদের চোখ কেমন হয়!
রিয়াদ কনিকার দু-গালে হাত রাখল। কনিকার শরীরের তাপমাত্রা বেশ। রিয়াদ বুঝতে পারল এতদিন কনিকার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে মনিকা তার জায়গা নিতে চেয়েছিলো। এই পনেরো দিন রিয়াদ রাত করে একশবার এসেছে কনিকাকে দেখতে! কিন্তু জানালা বন্ধ থাকায় চেয়েও সে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। তবে আজ জানালা খোলা দেখে সে যেন আবারও একবার তার জীবন ফিরে পেয়েছে। তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুলে পড়ল।
—-‘ কনিকা-
রিয়াদ কোমল স্বরে ডাকল কনিকাকে। কিন্তু কনিকার কর্ণগোচর হচ্ছে কিনা সে কথা নিশ্চিত নয় রিয়াদ। তাই একবারের জায়গায় বার কয়েক ডাকল। আর একপর্যায়ে গিয়ে কনিকা নড়েচড়ে উঠে ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে তাকানোর চেষ্টা করল। ঘোলাটে চোখে অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে দেখতেই তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। আচমকা চোখ দুটো বড়বড় করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠতেই রিয়াদ তড়িঘড়ি করে তার মুখ চেপে ধরল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে দেখতে দেখতে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-‘ কনিকা আমি,আমি। চেঁচিয়ো না। আমি। দেখো? এটা আমি। রিয়াদ-
রিয়াদের কথায় কনিকা আচমকা শান্ত হয়ে গেলো। বড়বড় চোখ জোড়া ধীরেসুস্থে ছোট হয়ে এসে তার দৃষ্টি শান্ত আর ক্লান্ত হয়ে গেলো। তপ্ত হাত দুটো মুখের কাছে এনে রিয়াদের হাতটা নামিয়ে দিলো। রিয়াদ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি নিয়ে গুটিয়ে নিলো। আমতাআমতা করে বলল,
—-‘ স-স-সরি!’
কনিকা ঢোক গিলে ক্লান্তস্বরে বলল,
—-‘ আ-আআ-আপনি-
—-‘ পনেরো টা দিন পার হয়ে গেলো তোমায় না দেখে! কি করে এখনও টিকে আছি সেটাই ভাবছি।’
—-‘ এ-এ-এখানে কি চাই?’
—-‘ তোমায় কিডন্যাপ করতে এসেছি।’
—-‘ ম-মম-মানে!’
রিয়াদ হেসে পড়লো। রিয়াদ হাসতেই কনিকা চোখ বুঁজে নিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,
—-‘ প-প্লিজ! এভাবে হাস-বেননন নাহ!’
রিয়াদ আঁড়চোখে তাকালো কনিকার দিকে। কনিকা অস্থিরতায় কাঁপছে। তার চোখ দুটো বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। রিয়াদ কনিকার কথায় জবাব না দিয়ে ফট করে কনিকার কপালে চুমু খেয়ে বসলো। এমন আকস্মিক ঘটনার জন্য কনিকা কোনো কালেই প্রস্তুত ছিলো না। চাপা আর্তনাদ করে বলল,
—-‘ এ-এএ-এটা আপনি ক-কক-কি করলেন!’
—-‘ শোনো মায়াবতী, আমাদের বংশীয় কিছু গোপন জুলুম আছে যে যেটা চায় সে যদি সেটা পায় তাহলে কেঁড়ে নিয়ে আসে। তো আমি ভাবছি তোমার ক্ষেত্রে আমি এমন নিয়ম প্রয়োগ করব। আমি যেটা চাইছি সেটা যদি না পাই তাহলে সেটা জোর করে আদায় করব। এখন বলো তুমি কি চাও আমি তোমায় তুলে নিয়ে যাই? বাইরে কিন্তু আমার পুরো গ্যাং অপেক্ষা করছে। আমার একটা ইশারাতে তোমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে।’
রিয়াদের এহেম কথায় কনিকা ভড়কে গেলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে জানালার দিকে একবার তাকিয়ে বিছানার সাথে আরও সিঁটিয়ে গিয়ে বলল,
—-‘ আ-আআ-আমি চ-চ-চলে যাবো!’
রিয়াদ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
—-‘ কোথায় চলে যাবে?’
—-‘ আপনাকে কেন বলবো! আপনার থেকে প-পপ-পালাতেই তো চলে যাবো!’
রিয়াদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
—-‘ তো কি হয়েছে? তুমি কি ভাবছো আমি তোমায় খুঁজে পাবোনা? তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাওনা কেন? মনে রেখো রিয়াদ আহমেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেখানেই থাকবে। তার চোখে ফাঁকি দিয়ে পালানো -আআ- সম্ভবই না সুইটহার্ট।’
কনিকা ঠোঁট কামড়ে ইনোসেন্ট মার্কা ফেস করে বলল,
—-‘ এ-এই রিয়াদ আহমেদটা কে?’
কনিকার এমন প্রশ্নে রিয়াদের চোখমুখের এক্সপ্রেসন উড়ে গেলো। বোবা চোখে কনিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ ইট’স মি- রিয়াদ আহমেদ। দ্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিয়াদ আহমেদ। যদিও এখনও পুরোটা পদবীটা পায়নি। তবে অতি শীঘ্রই পেয়ে যাবো।’
রিয়াদের মুখে তার পরিচয় শুনে কনিকার চোখ জোড়া চড়কগাছে উঠে গেলো। ছোটখাটো একটা হা মার্কা রিয়াকশন দিয়ে বলল,
—-‘ আ-আ-আপনি ব-ব-ব্রিগেডিয়ার-
—-‘ জি ম্যাম।’
কনিকা ঢোক গিলে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-‘ আ-আ-আপনি সত্যিই কি আমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছেন?’
রিয়াদ কনিকার খুব কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
—-‘ তুমি রাজি থাকলে সত্যি সত্যি কিডন্যাপ করব।’
রিয়াদ আচমকা কাছে এসে পড়াতে কনিকা ভয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। জবাবে কি বলবে তার আর মাথায় এলো না। কনিকাকে পুনরায় চোখ বুঁজে নিতে দেখে রিয়াদ মুচকি হেসে কনিকার চোখের পাতায় চুমু একে দিলো। আবারও একই কাজ করাতে কনিকা চাপা আর্তনাদ করে চোখ খুলল। রিয়াদ তখনও কনিকার কাছে। এক চুলও সরেনি। কনিকা চোখ খুলে তাকাতেই রিয়াদের চোখে চোখ পড়ল। কি অদ্ভুত নূর রিয়াদের মুখে। কনিকা ঢোক গিলে কিছু বলতে নিলেই রিয়াদ বলল,
—-‘ আর ঠিক তিনদিন বাদে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আমি তো আমার মনের কথা জানিয়ে দিয়েছি এবার তোমার পালা। আমি জবাবের অপেক্ষায় থাকব। ঠিক সেখানটায় তোমার জন্য অপেক্ষা করবো যেখানটাতে আমাদের প্রথম দেখা। আমি অপেক্ষা করব।’
—-‘ আ-আ-আমি কখনই যাবোনা।’
—-‘ আমি অপেক্ষা করব। তুমি আসবে। আমি জানি। তাই আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।’
কথাটা বলতে বলতে রিয়াদ জানালা ধরে নীচে নেমে গেলো। কনিকার তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে বলল,
—-‘ আ-আ-আমিহ!! য-যাবো না! স-স-সত্যি যাবো না কিন্তু-
#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬৬
পরদিন বোনের জ্বর সত্যিই কমে গেলো। আমি আর শিলা তো তাজ্জব বনে গেলাম। এতো জ্বর মাত্র এক রাতের ব্যবধানে কমে গেলো! এটা কি কোনো ভাবেও সম্ভব? শিলা আমাকে বলল,’ম্যাডাম আপনার জন্যই আপা সুস্থ হয়ে উঠছে। আপনাকে আপা সত্যি খুব ভালোবাসে।’ আমি শিলার কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। ভালোবাসে না ছাই সেটা কয়দিন পরেই বোঝা যাবে। যেদিন বোন সুস্থ হলো সেদিনই ও ভার্সিটি যেতে চাইল। কতগুলো দিন গ্যাব হয়েছে,কত পড়া মিস হয়ে গেলো এসব ভেবেই ওর মাথায় হাত। আমি ওকে বললাম মাঝে মাঝে আমি গিয়েছি ভার্সিটি,ওর যা দরকার সব নাইরা-রিনাতের থেকে কালেক্ট করে নিয়ে এসেছি। তাই আজ তাড়াহুড়ো করে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। বোন আমার কথা মেনে এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলো। সুস্থ হতেই সে আবার আগের মতো হয়ে গেলো। বাসার সব কাজ,রান্নাবান্না সব নিজেই শুরু করলো।
দেখতে দেখতে ১৪ফেব্রুযারি এসে পড়ল। আমি গত দু-দিন ধরে ভেবেছি আজকের দিনে আমি রিয়াদকে আবারও প্রপোজ করব। আর যদি প্রপোজালে রাজি না হয় তাহলে নিজের সম্মানের উপর দাগ লাগিয়ে রিয়াদকে ফাঁসাবো। আর একবার রিয়াদ ফেঁসে গেলে ওকে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খুব সু্ন্দর করে সেজেগুজে চলে গেলাম ভার্সিটিতে। আমি জানতাম না বোন বোরিয়েছে কি না দেখারও প্রয়োজন মনে করিনি। কারন প্রতি বছর বোন এই দিনে কোথায় যায় না। বরং রুমে বসে নিজের মতো করে পড়াশোনা করে।
আমি চলে এলাম ভার্সিটি। স্টুডেন্টরা আজকের দিনটা পালন করার জন্য বেশ ঝাঁক ঝমক করে সাজিয়েছে। হয়তো কোনো পারফরম্যান্স হবে। আমার মন বলছিলো আজ রিয়াদ কনিকার খোঁজে এখানে আসবে। আর এতক্ষণে এসে পড়ার কথা। আমি ভীর ঠেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতেই কেউ আমায় হেঁচকা টান দিয়ে ভীড় থেকে বাইরে নিয়ে এলো। মুহুর্তেই মনে হলো এটা হয়তো রিয়াদ কনিকা কে ভেবে আমাকে নিয়ে এসেছে। অন্যান্য দিন রিয়াদ আমার চোখগুলোকে কেমন করে যেন দেখতো আর খানিক বাদেই চলে যেতো। আজও সেই ভয় কাজ করল মনে। আজও যদি রিয়াদ চলে যায় তাহলে তো চলবে না। তাই ভুল করেও ওর দিকে তাকানো যাবেনা। ও আমায় কনিকা ভেবে যেদিকে ইচ্ছে নিয়ে যাক। এই ভেবে আমি আর মুখ উঁচিয়ে দেখলাম না ওকে। ও হয়তো ভীড়ের মাঝে আমাকে ভালো করে দেখার সুযোগ পায়নি। হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত লাগলো তার গন্তব্যে।
________
—-‘ উঁহুম উঁহুম।’
রিয়াদ আঁড়চোখে কনিকার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। কনিকা লজ্জায় মুখ তুলতে পারছেনা। কি করে বলবে সে তার মনের কথা। কনিকা তাকাচ্ছে না দেখেই রিয়াদ গলা খাঁকারি দিলো। যাতে কনিকা একটু তাকায় তার দিকে। টোপ কাজে লাগল। রিয়াদ গলা খাঁকারি দিতেই কনিকা চমকে উঠে তাকালো। রিয়াদের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ ক-কি হয়েছে?’
রিয়াদ অবাক হওয়ার চেষ্টা করে চোখ দুটো গোলাকার বানিয়ে বলল,
—-‘ কি হবে?’
রিয়াদের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় মিইয়ে পড়ল কনিকা। হাসফাস করতে করতে চোখ নামিয়ে আবারও মাটিতে বিদ্ধ করল দৃষ্টি। রিয়াদ এবার বেশ অসহায় বোধ করল। অসহায় কন্ঠেই বলল,
—-‘ আমার থেকে কি এই মাটিকে বেশি পছন্দ হয়ে গেলো নাকি? ভুল করেও একবার আমাকে দেখা হচ্ছে না। বলি এতো লজ্জা পেলে ম্যাডাম এখানে আসল কেন? না এলেই হতো! আমি বরং চলে যাচ্ছি তিনি বসে থেকে লজ্জা পাক।’
এই বলে রিয়াদ উঠে যেতে নিলেই কনিকা আচমকা তার হাত টেনে ধরল যা রিয়াদের কাছে দুঃস্বপ্নের থেকেও ভয়াবহ মনে হচ্ছিল। কনিকা তার হাত ধরা তো দূর তার কথায় যে আজ এখানে চলে এলো সেটাই তো অবিশ্বাস্য ছিলো। রিয়াদ এবার বিস্ময় নিয়েই তাকাল কনিকার দিকে। কনিকার মুখ খানা চিকচিক করছে সোনালী রোদে। রিয়াদের চোখ জুড়িয়ে এলো। কনিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ কিছু বলবে?’
কনিকার চোখমুখ শুঁকিয়ে আসল অজানা ভয়ে। সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ে বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। কি বলবে সে রিয়াদকে? মুখে কিছু বলতে না পারলেও মাথা নাড়ল। অর্থাৎ হ্যাঁ, সে কিছু বলবে তাকে। রিয়াদ পূনরায় চেয়ারে বসতে বসতে অধৈর্য্যে কন্ঠে বলল,
—-‘ আজ টানা ১৯টা দিন অপেক্ষা করিয়েছো! আর দয়াকরে অপেক্ষা করিয়ো না! এতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কিন্তু আমি মরে যাবো এই বলে দিলা-
রিয়াদ কথাটা পরিপূর্ণ করার মাঝেই আকস্মিক কনিকা রিয়াদের মুখ চেপে ধরে কন্ঠে খানিক রাগ ঢেলে বলল,
—-‘ পাগল হয়ে গেছেন আপনি? কি সব যাতা বলছেন!’
রিয়াদ আকস্মিক বোকা বনে গেলো। গোল গোল চোখ পাকিয়ে স্রেফ তাকিয়ে রইলো কনিকার অগ্নিমূর্তি ধারন করা মুখমণ্ডলে।
—-‘ ভালোবাসি আপনাকে। আপনি যদি মরে যান তবে আমার কি হবে?’
কনিকার এহেম কথায় এবার যেন রিয়াদের চোখ জোড়া কোটর থেকেই বেরিয়ে আসবে। কনিকা তার মুখে হাত চেপে আছে সেই সুযোগে সে কনিকার হাতে চুমু খেয়ে প্রফুল্ল কন্ঠে বলল,
—-‘ আমিও তোমাকে ভালোবাসি মায়াবতী। বিশেষ করে তোমার ঐ মায়াবী চোখ জোড়াকে। তুমি একবার তাকালেই আমি ঘায়েল হয়ে যাই।’
কনিকা হেসে পড়ে বলল,
—-‘ আপনি না একদম বদ্ধ পাগল একটা।’
রিয়াদ চোখ টিপে বলল,
—-‘ সবটাই তো তোমার জন্য।’
_________
রিয়াদ আমাকে কিছুদূর নিয়ে এসে আকস্মিক আমার চোখ বেঁধে দিলো। আমি অবাক হয়ে বলে উঠলাম,
—-‘ একি কি করছো? তুমি আমার চোখ বাঁধছো কেন?’
রিয়াদ আমার চোখ বেঁধে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
—-‘ সারপ্রাইজ।’
এই বলে আবারও কোথাও একটা নিয়ে এলো। মিনিট পাঁচেক পরে আমার চোখ খুলে দিতেই আমি আবিস্কার করলাম স্বর্গের মতো একটা জায়গা। যেখানে কেবল ফুলফুলে স্বর্গ তৈরি করা হয়েছে। আমি চারপাশ টা দেখার মাঝেই হঠাৎ কিছু একটা নেমে এলো আমার সামনে। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি তাই চমকে উঠেছি। পরে ঠিক করে দেখতেই মনে হলো এটা একটা বোর্ড। ডেকোরেট করে সাজানো হয়েছে। বোর্ডের মাঝে বিভিন্ন লাইটিং দিয়ে সুন্দর করে কনিকার নামটা সাজানো হয়েছে। যেটা দেখা মাত্রই শরীরে আগুন জ্বলে উঠলো আমার। কিন্তু এই মুহুর্তে কোনো রকম বোকামি করলে চলবে না কারন আমি এখন কনিকা। তাই খুশি হওয়ার নাটক করতে হবে। ঠিক কনিকার নামটার নিচেই আলোয় আলোয় জ্বলে উঠে দৃশ্যমান হলো ‘আই লাভ ইউ।’ সেটা দেখতেই আমার রাগ নিভে গেলো। আমি ভীষণ খুশি হয়ে গেলাম। মুখে হাত চেপে পেছন মুড়ে রিয়াদের দিকে তাকাতেই যেন ধাক্কা খেলাম। একি! এটা কে? কনিকা কয়জনকে তার প্রেমের জ্বালে ফাঁসিয়েছে?
আমি পেছন মুড়ে তাকাতেই ছেলেটা বাঁকা হাসল। মাথা চুলকে লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল,
—-‘ আই রিয়েলি লাভ ইউ কনিকা।’
আমার হঠাৎই মনে পড়ে গেলো একে আমি কোথায় দেখেছিলাম। আমি রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
—-‘ হোয়াট দ্য হেল! আপনি এখানে কি করেন? রিয়াদ কোথায়?’
ছেলেটা বাঁকা হেসেই জবাব দিলো,
—-‘ মাইসেল্ফ ফরহাদ রেজা। রিয়াদের বেস্ট ফ্রেন্ড তবে সেটা শুধুই রিয়াদ মানে। আমি নই। তুমি বলতে পারো আমি রিয়াদের বেস্ট এনিমি।’
ছেলেটা ছিল রেজা। সেদিন ওকে রিয়াদের সাথে দেখেছিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো ও নিজেকে রিয়াদের শত্রু বলে কেন দাবী করছে? ঘাটতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা। আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
—-‘ বেস্ট এনিমি মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বেস্ট এনিমি?’
রেজা হেসে পড়ল। আচমকা আমাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলো। কেমন অদ্ভুত আচরন করে বলতে লাগল,
—-‘ বলব পাখি। তার আগে একটু স্বাদ নেই।’
রেজার কথা শুনে আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। আমি নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বললাম,
—-‘ ছাড়ুন আমাকে! ছাড়ুন! আমি কিন্তু চেঁচাবো।’
রেজা আমাকে ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দিয়ে আবার অদ্ভুত সুরে হাসতে লাগল। আমার চারোপাশে ঘুরে ঘুরে হাসতে হাসতে বলল,
—-‘ আমার খুব ছোট বেলায় মা মারা যায়। বাবা ছিলেন প্যারালাইজড রোগী। খুব কষ্ট করে,মেহনতী করে,খেটেখুটে আজ এই অব্দি এসেছি। কিন্তু রিয়াদকে দেখো__ ওকে প্রশ্ন করো কষ্ট কি? ও কখনও এর কোনো সংজ্ঞাই দিতে পারবে না! কারন ও জানেই না কষ্ট কি? আর জানবেই বা কি করে? ইরানীর বংশীয় ছেলে! ওর তো জন্মই হয়েছে কারিকারি টাকার উপর। ওর বাল্যকাল, শৈশব কাল,কৈশোর কাল.. সব! সবটা টাকার উপর শুয়ে শুয়ে কেটেছে। আর আমায় দেখো শালার জন্ম নিতেই মা-টা মরেছে। ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে একটা অসু্স্থ বোঝা। তাই আমি ওকে কোনোদিনও সহ্য করতে পারিনা। উপরে উপরে বুঝাই আমার থেকে ভালো বন্ধু ও কোনোদিনও পাবেনা। আর ভেতর ভেতর আমার লোভ শুধু ওর টাকার উপর। আর তুমি হলে ওর যৌবন কালের সুখ! তাই আমি ওকে কিছুতেই তোমায় পেতে দিবো না কনিকা। কনিকা ও তোমায় আমার মতো করে ভালো রাখতে পারবেনা। ট্রাস্ট মি। আমি তোমায় যতটা মাথায় তুলে রাখতে পারবো ততটা রিয়াদ পারবে না। ওর কাছে শুধু টাকা আছে, কিন্তু ভালোবাসা নেই। কিন্তু আমার কাছে টাকাও থাকবে আর ভালোবাসাও থাকবে। তুমি আমার হয়ে যাও কনিকা। তুমি আমার হয়ে যাও।’
রেজার কথাগুলো শুনে মনে হলো আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছি। এক তো রিয়াদ এমন সু-পুরুষ তার উপর এতো বড়লোক একটা ছেলে পেলে তো জীবন টাকাময় হয়ে যাবে। রেজার শেষ কথা গুলো আমার কান অব্দি পৌঁছাল না। আমি আপন মনে বিরবির করতে করতে এখান যেতে নিলেই রেজা আমাকে টেনে ধরে। বাঁকা হেসে বলে,
—-‘ কোথায় যাচ্ছো পাখি? রিয়াদের কাছে? কিন্তু আমি তো তোমাকে আজ এখান থেকে কোথাও যেতে দিবো না!’
রেজার কথায় অন্যকিছুর আভাস পাচ্ছিলাম। রেজার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,
—-‘ আমায় যেতে দাও।’
রেজা আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
—-‘ যেতে দিবো? হ্যাঁ যেতে দিতেই পারি কিন্তু তার আগে আমার মনের তৃপ্তিটুকু তো মিটিয়ে দিয়ে যাও!’
রেজার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। ওকে স্বজোরে ধাক্কা মেরে বললাম,
—-‘ আরে আমি কনিকা নই। আমি কনিকার জমজ বোন মনিকা।’
এই বলেই বেরিয়ে এলাম। বুঝলাম রেজা তখনও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমার রেজার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না। আমার মুল আগ্রহ ছিলো রিয়াদ। আমি ছুটে গেলাম রিয়াদকে খুঁজতে। কিন্তু পেলাম না-
মনিকা কথাটা শেষ করতেই মীরের হাত থেকে রিভলবার কেড়ে আনলো হীর। সোজা তাক করল মনিকার কপাল বরাবর। অতঃপর রিভলবারটা থেকে পরপর গুলি বেরিয়ে এসে মুহুর্তেই অতিষ্ঠ করে তুললো চারিপাশ। মনিকা গলা কাটা পাখির মতো ছটফট করতে করতে রক্তে ভেসে উঠলো। রোজ আঁতকে উঠে খামচে ধরলো আদ্রিককে। আদ্রিক রোজকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জড়িয়ে ধরল। রোজের শরীর শীতল হয়ে গেলো। হাত-পা অবশ হয়ে এলো। আদ্রিকে জড়িয়ে ধরার শক্তি টুকুও সে হারিয়েছে যেন।
হীর রেজার দিকে তাকালো। হীর তাকাতেই রেজার জান কবচ হয়ে যাওয়ার মতো দশা হলো। আতংকে ছটফট করতে করতে বলল,
—-‘ আ-আ-আমায় ক্ষমা করে দাও হীর! আমায় যেতে দাও। কথা দিচ্ছি আর কোনো দিন তোমাদের সামনে আসব না। কথা দিচ্ছি। আমার প্রান টা ভিক্ষা দাও হীর! দয়াকরে-
হীর আঙ্গুল উঁচিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
—-‘ শশশ… যত আকুতি-মিনতি করবে গুলির সংখ্যা তত বেশি হবে। সুতরাং? চুপ-
—-‘ আ-আ-আজিম ভাই-
রেজার মুখে আকস্মিক আজিম সাহেবের নাম শুনতেই চমকে উঠলো সবাই। সবচেয়ে বেশি চমকালো সাবাব। শূন্য দৃষ্টিতে পেছন মুড়ে তাকাতেই দেখল এক হাতে রিভলবার নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা।
#চলব___
[