#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-২০
.
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে পরশ। কিছুক্ষণ আগেই ড্রেসিং কমপ্লিট হয়েছে। ইন্টারনাল ব্লিডিং না হওয়ায় এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। মৃদু এখনো পাথরের মতো একস্থানেই দাড়িয়ে আছে কেবিনের বাহিরে। ডক্টর কিংবা নার্স অনেকবার বলেও মৃদুকে স্বাভাবিক করতে পারেনি। মৃদুর চোখে শুধু পরশের রাস্তায় পরে থাকা নিথর দেহটাই ভাসোমান। কি থেকে কি হয়ে গেলে এখনো বুঝতে পারছেনা মৃদু। নিজেকেই বারবার দোষ দিচ্ছে সে, তার কারণেই তো এমনটা হলো। রাতে বের হওয়ার জন্য জিদ না করলে এমন কিছুই হতো না। নিজের পরিবর্তনে নিজেই ক্ষুদ্ধ সে। আজ যদি পরশের কিছু হয়ে যেত সে নিজেকেও শেষ করে দিতো। যে মানুষটা তাকে পাওয়ার জন্য এতোকিছু করলো, আজ সেই মানুষটার ক্ষতির কারণটাও সে নিজে হয়েছে। মনে মনে পণ করে মৃদু, তার কারনে আবারো পরশের কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই সব ছেড়ে চলে যাবে সে। মৃদুর ভাবনার মাঝেই হস্পিটালে উপস্থিত হন রুশানা বেগম আর তার স্বামী। মৃদুকে স্থীর দেখে রুশানা বেগমের বুকে ধক করে উঠে। কোনো অঘটন হয়েছে কিনা বুঝার জন্য মৃদুকে প্রশ্নের ঝুলিতে চুবিয়ে দেন তিনি।
“এভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন? আমার পরশের কি হয়েছে? তুই কি আমার ছেলেটাকেও শান্তি দিবিনা? জন্মের পর থেকেই তো সব শেষ করে দিচ্ছিস, এবার তো একজনকে শান্তি দে। আমার পরশকে শান্তি দে।”
“…..”
“আরেহ্ বাবা উত্তর তো দে। উফ্ মরণ হয়না কেন তোর? মরে গেলেই তো পারিস, আমার ছেলেটা অন্তত বেঁচে যায়।”
“রুশু কি বলছো এসব? পরশও মরে যাবে মৃদুর কিছু হলে।”
“রাখো তোর ফালতু কথা। কিছু হবেনা আমার ছেলেটার বুঝছো? এই মেয়েটা থাকলে নির্ঘাত হয়ে যাবে।”
নিজের প্রতি হওয়া অভিমানের দলা পাকিয়ে কাকিমায়ের দেয়া অভিযোগে নিজেকে কয়েকবার খুন করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই মৃদু। বারবার সুখ হাতছানি দেয় কেন জানতে ইচ্ছে করছে মৃদুর। সুখের পরিবারে বড় মাকে হারানোর পর থেকে সব নষ্ট হয়ে গেছে। বড় মায়ের পরে পরশকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই পেয়ে যায় মৃদু, আবার পেয়েও হারিয়ে ফেলে। তারপর হারাতে হয় মা-বাবাকে। কাকিমায়ের করা আঘাতের কষ্টকর যন্ত্রণা সহ্য করার পর যখন পরশ ভালোবাসায় মৃদুকে মুড়িয়ে নিল তখনি আবারো পরশকে হারানোর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল প্রায়। মৃদু কেউকে কিছু না বলে নিজের মতো করে বের হয়ে যায় হসপিটাল থেকে।
.
মৃদুর থেকে উত্তর না পেয়ে ভয় গেছেন রুশানা বেগম। আশেপাশে কোনো ডক্টর কিংবা নার্স চোখে পরছেনা তার। পরশ কোথায় আছে সেটাও জানেন না তারা। অতিরিক্ত চিন্তায় আর মৃদুর উত্তর না দেয়ায় তারা দুজনে বেশ ভয় পাচ্ছেন। মৃদুকে না দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে রুশানা বেগম আর তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন-
“এখানে যেই মেয়েটা ছিল সে কোথায়?”
“চলে গেছে সে, আমার ছেলেটা কোথায়?”
“রুশানা বেগমের উত্তরে অবাক হয় নার্স। নিজেকে সামলিয়ে কেবিন দেখিয়ে বলে-এই রুমটাতেই আছে।”
রুশানা বেগম জবাব পেতেই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। ছেলেকে প্রাণহীন মানুষের মতো পরে থাকতে দেখে মোটেই ভালোলাগছেনা তার। রুশানা বেগমের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। পরশ মৃদুকে নিয়ে বের হয়ে যেতেই সে তার পরিচিত একজনের মাধ্যমেই ঐ ছেলেগুলোকে হায়ার করে। পরশের মুখে বারবার মৃদপাখি মৃদপাখি শুনতে শুনতে কার ক্ষতি করবে প্রশ্ন করলে রুশানা বেগম মৃদ নাম বলে। মৃদ নামটা কোনো ছেলের হবে মনে করেই পরশের মাথায় আঘাত করা হয়। পরশ চোখ খুলে মাকে দেখেই কাছে ডাকে। রুশানা বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। পরশ বসার জন্য ইশারা করলে তিনিও স্টীলের টুলটা টেনে নিয়ে বসেন। পরশের বাবাও রুমে আসেন।
“মা মাথায় প্রচন্ড ব্যথা গো। আমি যা বলবো তা শুনিও প্লিজ। খুব কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে তবুও আজকে বলতে চাই আমি।”
“হ্যাঁ বাবা বল তুই। যা বলবি তাই শুনবো আমি।–বলেই কেঁদে দেন রুশানা বেগম।”
“মা আমি তোমার বোনের দেয়া চিঠিটা পড়েছি, বাবা দিয়েছিল। তুমিও তো অনেকবার পড়েছো, মৃদুর ভুলটা কোথায় লেখা আছে মা? তুমি চিঠি পড়েই সব কীভাবে বুঝে গেলে মা? চিঠি লেখার আগে কি হয়েছিল তা কি জানো মা? জানলে কখনোই এমন কিছুই করতে না তুমি। বাবা কথা বলেছিল মৃদপাখির বাবা সাথে এ বিষয় নিয়ে। তিনিই সব বলেছিলেন বাবাকে। এক কাজ করো বাবার কাছেই শুনে নাও।”
রুশানা বেগম নিজের স্বামীর দিকে তাকাতেই তিনি পরশের বেডের কিছু অংশজুড়ে বসে বলতে শুরু করেন।
“মৃদু সেদিন রুনার কাছে ভাত খাবে বলে আবদার করতেই রুনা থাপ্পর দেয় মৃদুর গালে। মৃদু ছোট মানুষ ও কি আর রুনার মতো মানুষের থাপ্পর হজম করতে পারে? কান্না শুরু করে দিলে মুনিরা এসে থামানোর চেষ্টা করে। রুনাকে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেই সে মুনিরাকে বলে সব নাকি মৃদুর জন্যই হয়েছে। মৃদুকে দুনিয়ায় আনার জন্যই সে নিজের সংসার নষ্ট করে ফেলেছে। যখন মুনিরা বলে মৃদু তো রুনারও সন্তানের মতো তখন রুনা কি বলে জানো? মেয়ের মতো কিন্তু মেয়ে তো না। আর রুনার মেয়ের মতো নাকি হতেও পারবেনা। রুনার সন্তান হলে নাকি এমন হতোনা। কিন্তু কেমন হতোনা সেটা বলেনি তোমার বোন। মৃদুর বাবা যখন রেগে থাপ্পর দিয়ে বলেন এইজন্যই তোমার সন্তান হয়নি, সেটা তোমার বোনের ভালোলাগেনি। আত্মহত্যা করে কি তোমার বোন ভালো আছে রুশু? অযথা নিজের প্রাণটা হারালো। সাথে তোমার জিদের কারণে মৃদু নিজের বাবা-মায়ের ছাঁয়াটাও হারালো। ওদের এক্সিডেন্ট না করালে হয়তো সত্যিটা তুমি জানতে পারতে। অতিরিক্ত জিদ তোমার রুশু, একটু নিজেকে শুধরাও।”
“মা আমি তোমাকে কি দোষ দিবো বলো? জানি তুমি তোমার বোনটাকে খুব ভালোবাসতে, কিন্তু সেটার জন্য তুমি যা করেছো সেটা কি উচিৎ ছিল মা? তুমি জানতে আমি আমার মৃদপাখিটাকে কতটা ভালোবাসতার শুরু থেকেই কিন্তু তুমি কি করলে? আমাকে আমার জানটার কাছ থেকেই আলাদা করে দিতে চাইলে। মৃদপাখি যে আমার অক্সিজেন মা। ওকে ছাড়া যে তোমার ছেলেটা বাঁচবেনা মা।”
রুশানা বেগম নিজেকে সামলাতে না পেরে শব্দ করেই কেঁদে দেন। নিজের বোনের অযথা রেগে যাওয়ার স্বভাব সম্পর্কে সে জানতো, কিন্তু সেটা নিয়ে কখনো ভাবার সময় পায়নি সে।
“মা আমার মৃদপাখিকে আমার সামনে নিয়ে আসো না। নিশ্চই খুব ভয় পেয়েছে মেয়েটা মা।”
“আমাকে মাফ করে দে বাবা। আমার কারণে তোর মৃদপাখিকে তুই হয়তো আবারো হারিয়ে ফেলবি।”
“কি বলতে চাইছো মা?”
পরশের বাবা বলেন-
“মৃদু চলে গেছে পরশ। খুঁজতে হবে।”
“না বাবা খুঁজতে হবেনা। আমি জানি আমার মৃদপাখি আশেপাশেই আছে। আমি অনুভব করতে পাচ্ছি বাবা। মা তুমি এনে দাও আমার মৃদপাখিকে।”
রুশানা বেগম ছেলের জন্য তার মৃদপাখিকে খুঁজতে বের হয়ে যান রুম থেকে। গেট থেকে বের হতেই মুখে হাসি ফুঁটে উঠে তার। মৃদুলা যে আগের স্থানের দাড়িয়ে আছে। পরশের প্রতি ভালোবাসা দেখে তিনি অবাক। ছেড়ে যেতে না পেরে ফিরে এসেছে মৃদুলা। মৃদুলার কাছে যেয়ে নিজের দুহাতে মৃদুর হাত নিয়ে বলেন-
“তোর এই মা টাকে মাফ করতে পারবি মৃদমনি?”
বহুবছর পর তার কাকিমায়ের মুখে নিজের আদুরী নামটা শুনে বুকে ধক করে উঠে মৃদুর। আবারো ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে যেয়ে যদি হারিয়ে ফেলে? রুশানা বেগম আবারো বলেন-
“মাফ করবি না তোর মা কে? আমাকে কি মায়ের স্থানটা দিতে পারবিনা মৃদু?”
মৃদুলা ঝাপিয়ে পরে রুশানা বেগমের বুকে। দুজনেই শব্দ করে কেঁদে উঠে। কান্নার আওয়াজে পরশ আর পরশের বাবার চোখে-মুখে প্রশান্তির হাসি ফুঁটে উঠে।
.
২মাস পর-
.
“ভালোবাসি মৃদপাখি”
মৃদু কিছুক্ষণ পরশের চোখে চোখ রেখে বলে-
“ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।”
.
“সমাপ্ত”
.
Very nice 👌👌 👌👌…