#কান্তা_মনি
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
খাবারের থালা হাতে বেগম নূর জাহানের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। তার পাশ ঘেষেই দাঁড়িয়ে আছে নিয়াজ মির্জা।
-আম্মা! ও আম্মা! আর কতক্ষণ আপনার আদরের পুত্রের ওপর অভিমান করে থাকবেন? আপনার পুত্রের কষ্ট হচ্ছে তো। (নিয়াজ মির্জা)
বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও বেগম নূর জাহান দ্বার খোলেন না। কান্তা মনি ব্যথিত মন নিয়ে নিয়াজ মির্জার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে। নিয়াজ চোখ দ্বারা ইশারা দিয়ে ভরসা দেয় কান্তাকে।
পুনরায় নিয়াজ ‘আম্মা’ উচ্চারণ করতেই বেগম নূর জাহান দ্বার খুলে নিয়াজ ও কান্তার সম্মুখপানে দাড়ান।
-আমাকে একটা সুযোগ দিন আম্মা। গতকাল থেকে নাকি কিছু খান নি। অনুগ্রহপূর্বক খাবারগুলো খেয়ে নিন। আমার সাথে রাগ দেখান কিন্তু খাবারের ওপর রাগ দেখবেন না আম্মা। আপনার শরীর খারাপ হবে তাতে। (মিনতির স্বরে বলে ওঠে কান্তা)
-খবরদার আমাকে আর একবার আম্মা ডেকছো তো। দূর হয়ে যাও আমার সামনে সামনে থেকে।
নিয়াজের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে হন হন করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যান বেগম নূর জাহান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝুলাতে ঝুলাতে কান্তা মনিকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে নিয়াজ মির্জা।
-আমিও তো ভাবি আমার ভাইজানের পছন্দ তো কখনোই খারাপ হতে পারেনা। ভাবিজান তুমিতো একদম একখানা চাঁদের টুকরো। (হেতিজা)
লজ্জায় কান্তা মনির দু’গাল লাল হয়ে গেছে।
-আমি বুঝেছি তুমি হলে গ্রামের স্বাধীনচেতা চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। বেশি একটা আদব-কায়দা মেনে চলতে হয়নি তোমাকে। কিন্তু জমিদারবাড়ির বহু আদব-কায়দা, রীতি-নীতি রয়েছে। ভাবিজান তুমি হলে জমিদার পুত্রের বেগম। তোমাকে এখন থেকে পরিস্থিতি বুঝে সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হবে। আম্মার সাথে কখনো তর্কে জড়াবেনা। এ বাড়ির বড় কেউ তোমার কোনো ভুল-ত্রূটির জন্য যদি বকাঝকা করে কখনো অভিমান করবেনা। (হেতিজা)
-জ্বি আচ্ছা। (কান্তা মনি)
-তোমাকে যেভাবে শিখিয়েছি কিভাবে কিভাবে কথা বলবে সেভাবে সকলের সাথে কথা বলবে। (মেহেরুন্নেছা)
মেহেরুন্নেছার কথায় মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা।
নূর জাহানের কক্ষ অতিক্রম করার সময় কক্ষের ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ পেয়ে চলার কদম থামিয়ে দেয় কান্তা।
“আপনিতো আমাকে কথা দিয়েছিলেন তবে কেন আমার সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করলেন ?”
“আমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি মেহরিন।?”
“নিয়াজের সাথে আমার বিয়ে দেবেন বলেছিলেন তবে কেন আজ শুনি নিয়াজের বিয়ে অন্য কারও সাথে হয়ে গেছে?”
“নিয়াজ জেদ ধরেছিল ওই মেয়েকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা। না জানি কি এমন জাদু করে আমার পুত্রকে নিজের বসে নিয়ে নিলো ওই মেয়ে। তুমি কেদো না মেহরিন। ওই মেয়েকে আমি কিছুতে এখানে টিকে থাকতে দেবোনা। তুমিই হবে আমার একমাত্র পুত্রের বেগম।”
কক্ষের ভেতরের কথোপকথন শুনে মুখে হাত চেপে ধরে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল কান্তা মনি। কক্ষের সামনে থেকে সরে যেতে নিলেই দ্বার খুলে বেরিয়ে এলো মেহরিন এবং বেগম নূর জাহান ।
-এই মেয়ে দাড়াও। কে তুমি? (মেহরিন)
পেছন থেকে মেয়েলি রিনঝিনে কন্ঠ কানে বাজতেই কাপতে কাপতে পেছনে ফিরে দাঁড়ায় কান্তা মনি।
-খালা এই কি নিয়াজের সেই স্বপ্নের রমনী! (তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে উঠল মেহেরিন)
-হ্যা। (নূর জাহান)
-রূপের ঝলক দিয়ে তাহলে নিয়াজের মন চুরি করে নিয়েছো তুমি? নিয়াজ ও পারে বটে! এমন অযোগ্য সাধারণ প্রজার মেয়েকে বেছে নিয়েছে নিজের বেগম হিসেবে! (হাসিতে ফেটে পড়ে মেহরিন)
কান্তা কান্নায় ভেঙে পড়ে কক্ষের উদ্দেশ্যে ছুটতে আরম্ভ করে।
-কারা তোমরা? কার হয়ে এভাবে খবরদারি করছো? এত দুঃসাহস! শাহ নিয়াজ মির্জার ওপর খবরদারি করো? বলো কার আদেশে এসব করছো। (ক্রধান্বিত হয়ে গর্জে উঠল নিয়াজ মির্জা)
-মেরে ফেললেও নাম উচ্চারণ করব না।
গলার কাছে তরোয়াল তাক করে নিয়াজ বলে উঠল,
-শেষ বার সুযোগ দিচ্ছি বলো?
-মেরে ফেলুন আমাদের তবুও নামের একটা শব্দও উচ্চারণ করব না।
নিয়াজ মির্জা গর্জে উঠে একে একে দুইজন গুপ্তচরের গলায় তরোয়াল চালায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত নিয়াজ মির্জার মুখে ছিটে পড়ে। দু দু’টো নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।দঃ হাত থেকে তরোয়াল মাটিতে ফেলে দিয়ে গটগট পায়ে স্থান ত্যাগ করে নিয়াজ মির্জা। সে আচ করতে পারছে কার আদেশে এই গুপ্তচরেরা তার এবং জমিদার বাড়ির ওপর খবরদারি করছিল।
-আব্বা ভেতরে আসব? (নিয়াজ)
-হ্যা ভেতরে আসো নিয়াজ। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
যুবক কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে আশপাশ একবার চোখ বুলালো। চাচা শাহ সুলতান মির্জার ওপর নজর পড়তেই স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
-আব্বা আমি আগেই বলেছি সরদার বংশের সাথে বেশি ঘনিসষ্ঠতা বজায় রাখবেন না। একটু দূরত্ব বজায় রাখুন। সে যতই পরম্ বন্ধু হোক বিশ্বাসঘাতকতা করতে কিন্তু আপন ভাইয়েরও একটু হৃদয় কাঁপে না।
শাহ সুলতান মির্জা হঠাত ভিসুম খেয়ে হনদন্ত চোখে নিয়াজ মির্জার দিকে তাকায়।
-কি বলতে চাচ্ছো তুমি নিয়াজ? মারজানকে নিয়ে তুমি আবারও কোনো সন্দেহ বুনেছো? আবারও বলছি সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে কখনো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
– আব্বা আজকে দু’জন গুপ্তচর ধরা পড়েছে পাইকের হাতে। তাদের আমার ওপর এবং জমিদার বাড়ির ওপর খবরদারি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর আমি আচ করতে পারছি এ আদেশ কে দিয়েছে। (নিয়াজ)
-ব্যাস আর কথা বলবেনা তুমি। ভালো করে তদন্ত করে প্রমাণ আনো। এখন তুমি আসতে পারো বিশেষ আলোচনায় আছি আমি। (শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
যুবক রাগে গটগট পায়ে স্থান ত্যাগ করে।
জমিদার বাড়ির পেছনেই রয়েছে ফুল গাছ,ফল গাছে সজ্জিত একখানা বাগান। বাগানের সাথেই রয়েছে মোলায়ম সবুজ ঘাস বিশিষ্ট একটা ছোট মাঠ। বাগান ও মাঠের চারদিকে দীর্ঘ প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। দুই তিনজন ছোট বাচ্চাকে মাঠে খেলতে দেখে সেদিকেই এগিয়ে যায় কান্তা মনি। একটু পাশেই নিয়াজ মির্জার ভাবি রেহানা (চাচাতো ভাই শাহ আহসান মির্জার বেগম) , মুর্শিদা (চাচাতোভাই শাহ মহাশিন মির্জার এর বেগম) এবং চাচাতো বোন যোহরা দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল।
কান্তা মনি তাদের সম্মুখে দিয়ে দাড়াতেই তিনজনের নজর তার দিকে পড়ে।
-অবশেষে অন্যদের কথাও একটু মনে পড়ল ভাবিজান?(যোহরা)
-আমাদের সাথে কি আর তার কথা বলা চলে? জমিদার পুত্রের বেগম বলে কথা! একটু দেমাগ তো থাকবেই। (রেহানা)
-না না তেমন কিচ্ছু না ভাবিজান। নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। (কান্তা মনি)
-বাবাহ কথা বলার ধরন ও দেখি কতটা বদলে ফেলেছো তুমি! সাবাস। (মুর্শিদা)
বিনিময়ে মুচকি হাসি দিয়ে বাচ্চাদের সাথে ভাব জমানোর উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় কান্তা মনি।
বিশাল পেয়ারা গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে তাকা টসটসে পেয়ারার দিকে নজর চলে যায় কান্তার। একে একে কদম বাড়িয়ে অগ্রসর হয় পেয়ারা গাছে নিকটে। আগের কথা যে বেশ মনে পড়ছে তার। ইচ্ছে মতো সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো সে। গাছে উঠে ইচ্ছে মত এই ফল সেই ফল ছিড়ে খেত। হঠাত মাথার ঘোমটার আচল ফেলে কোমরে গুজে নেয় কান্তা। গাছের প্রথম ডালে উঠে বসতেই একজন দাসী হাক দিতে দিতে এগিয়ে আসে ।
-একি করছেন বেগম। পড়ে যাবেন তো। গাছ থেকে নামুন। দরকার পড়লে কাউকে দিয়ে পাড়িয়ে দিচ্ছি পেয়েরা। দোহায় লাগে বেগম নেমে আসুন গাছ থেকে।
এর মাঝেই নিয়াজ মির্জার আগমন ঘটে বাগানে। চোখের ইশারায় দাসীকে চুপ হয়ে যেতে বলে স্থান ত্যাগ করতে বলে।
নিজ মনে গাছে চড়ে পছন্দমতো পেয়ারা ছিড়ছে কান্তা। তলায় দাঁড়িয়ে নিয়াজ মুচকি হেসে হেসে তার প্রিয়তমার বাচ্চামো দেখতে ব্যস্ত। গাছের তলায় চোখ যেতেই কান্তার শিরদাড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে সুরসুর করে গাছ থেকে নেমে আসে । যুবকের দুষ্টু হাসি দেখে যুবতির যেন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইছে।
আকাশ বেয়ে ঘন আধার নেমে এসেছে।
ক্লান্ত স্বামীকে বাতাস করতে ব্যস্ত কান্তা মনি।
-শুনলাম আমার বেগম নাকি একদিনেই সুন্দর করে কথা বলা রপ্ত করে নিয়েছে। (নিয়াজ মির্জা)
কান্তা মুচকি হেসে উপর নিচে মাথা ঝুলিয়ে ‘হ্যা’ সূচক জবাব দেয়।
-যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি? (আমতা আমতা করে বলে উঠল কান্তা মনি)
-হুম অবশ্যই। (নিয়াজ)
-সকালে যে ঘটনা ঘটছে , কে হত্যা করছে পাইকদেন? ঘটনা কি? (কান্তা মনি)
-তুমি এখনো ছোট কান্তা মনি। এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা তোমাকে। আর তাছাড়া ধীরে ধীরে জমিদার বাড়িতে থাকতে থাকতে সব নিজেই বুঝতে পারবে। তখন আর আমাকে শুধাতে হবেনা। (মুচকি হেসে জবাব দেয় নিয়াজ)
-আচ্ছা। মেহরিন মেয়েটা তো অনেক সুন্দর তা আপনি তাকে কেন বিয়ে করলেন না? শিক্ষিত, যোগ্য, সুন্দরী কিসের কমতি আছে তার? (কান্তা মনি)
যুবকের মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেয়ে বসে। পালঙ্ক থেকে নেমে উঠে দাঁড়িয়ে কান্তার মুখের ওপর ঝুঁকে বলে ওঠে,
-তুমি চাইলে তোমার সতীন বানিয়ে আনতে পারি মেহেরিনকে। কি বলো আনবো?
কান্তা মনি ছলছল চোখে একবার নিয়াজের দিকে তাকিয়ে পালঙ্ক থেকে উঠে যেতে নিতেই নিয়াজ ঘপ করে কান্তার হাত এক টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।
-এই মনে শুধু মাত্র আমার কান্তামনির বসবাস বুঝেছো তুমি? (গম্ভীর মুখ করে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
চলবে…