#গল্প_কিচিরমিচির
#লেখিকা_আদিয়া_মির্জা_সানা(জ্যোতি)
#ক্যাটাগেরি_রোম্যান্টিক
৯.
রাত ০১:৫!প্রায় পনেরো মিনিট যাবত আমার গলায় মুখ গুঁজে বসে আছে পর্বভাই কোনো সাড়াশব্দ নেই তার।আমার এক হাত তার পিঠে আর এক হাত তার বাহুতে।গলায় ভেজা ভেজা অনুভব করছি।হয়তো পর্বভাই কাঁদছে। নিজের বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় কেউই দেখতে পারে না!যতই সে স্ট্রং হোক না কেন!আজ আপুর বউভাত ছিল।আমরা সবায় যখন আপুর শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হবো ঠিক তার আগ মুহূর্তে বড়বাবার ব্যবসার জায়গা থেকে কল আসে বড় বাবা নাকি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে আর কেমন করছে।আমার আব্বু পর্বভাই সবাই গিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলেছে বড়বাবা স্ট্রোক করেছে।এই প্রথমবার স্ট্রোক করলো বড়বাবা।আবির আর খালামণি চলে গিয়েছে। ঐঘটনার পর আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি যে পর্বভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে একদিনে ঠিক হয়নি।সেই ছোট থাকতেই সব ঠিক করা তাই আমি চাইলেও এটা ভাঙতে পারবো না আর এটা এড়াতে পারবো না।
পর্বভাই আচমকা আমার গলায় নাক ঘষা দিতেই আমার সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল।পর্বভাইয়ের পিঠ থেকে আমি আমার ডান হাতটা সরিয়ে নিলাম।পর্বভাই আমার গলায় মুখ গুঁজে থাকা অবস্থায়ই নাক টানলো কয়েকবার। আমি মৃদুস্বরে বললাম,
“পর্বভাই…”
পর্বভাই আরও একবার নাক টেনে ওভাবেই বললো,
“হুম…”
আমি এবার একটু সাহস নিয়ে বললাম,
“একটা বেজে গিয়েছে ঘুমাবেন না?সকালে তো আবার বড়বাবার কাছে যেতে হবে..”
পর্বভাইয়ের এবারো কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না সে আবারও নাক টেনে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“বিরক্ত করিস না ইশুপাখি….আর আমি সকালে না এখনই আব্বুর কাছে চলে যাবো..”
আমি পর্বভাইয়ের পিঠে আবারও হাত রাখলাম পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
“এতো রাতে..! এখনই!মাত্রই তো আসলেন!আব্বু তো আছে মামা আছে চাচিমণি আছে সবাই তো আছে আপনি না হয় সকালে যেতেন..?”
পর্বভাই এবার আমার গলা থেকে নিজের মুখ উঠালো।চোখ দুটো রক্ত লাল হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো। পরনের টি-শার্টটাও ঠিকঠাক নেই।থ্রিকোয়াটার প্যান্ট পড়া একটা।
পর্বভাই আমার গালে হাত দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
“বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আমি ছেলে হয়ে কিভাবে নিশ্চিন্তে বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকি বল?তুই বল তোর বুকে ব্যাথা আর পেটে ব্যাথা কমেছে?তুই ঐসময় ঐ অবস্থায় না থাকলে ঐ আবিরকে আমি জানে মেরে দিতাম…”
শেষ কথা বলতে বলতে মুহূর্তেই রেগে গেলেন পর্বভাই।আমি তড়িঘড়ি বললাম,
“হ্যা হ্যা সেরে গিয়েছে ওষুধ খেয়েছিলাম এখন আর ব্যাথা নেই….”
পর্বভাই আমার কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দাঁড়িয়ে পড়লো।আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে একটা চুমু খেলো বললো,
“আাসি রে ইশুপাখি তুই ঘুমিয়ে পড়…আর রাত করলে রাস্তায় পুলিশ ধরবে এখনই ধরে কিনা সন্দেহ! ”
আমি বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম। পর্বভাই রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন আমিও তার পিছন পিছন যাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম,
“কিসে যাবেন?”
পর্বভাই সামনে হাঁটতে হাঁটতেই বললো,
“বাইকে যাবো… তুই আবার পিছন পিছন আসছিস কেন ইশুপাখি যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়…!”
আমি পর্বভাইয়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বাড়ি সদর দরজায় গিয়ে দাড়ালাম।পর্বভাই দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললো,
“এসেছিস যখন তখন দরজাটা লাগিয়ে দে…তারপর গিয়ে শুয়ে পড় যা…”
আমি মাথা নাড়িয়ে দরজা দিয়ে দিলাম।রান্না ঘরে ফ্রিজে রাখা আমার পানির পটটা নিয়ে রুমে চলে এলাম।কয়েক ঢোক পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে রেডি হয়ে নিলাম। পর্বভাই হাসপাতাল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে খাচ্ছে। আমি পর্বভাইয়ের বাইকে আগে হাসপাতালের যাবো বড়বাবাকে দেখতে তারপর ভার্সিটিতে যাবো লাইব্রেরি থেকে কিছু নোট করার আছে।পর্বভাই-ই দিয়ে আসবে আমাকে।নীল কালারের একটা থ্রি পিস পরে নিলাম।ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফাইনাল টাচ দিচ্ছি নিজের গেট আপে ঠিক তখনই পর্বভাই ফোন চালাতে ঘরের ভিতরে ঢুকলো বললো,
“কিরে এতো সাজিস কেন? এমনিতে তো পেত্নী সেজে গুঁজে একদম রাম পেত্নী…আর এটা কিভাবে ওড়না দিয়েছিস?ওড়না কি গলায় ফাঁস দেওয়ার জন্য? ঠিক করে ওড়না পর…”
পর্বভাই কথাগুলো বলতে বলতে নিজেই এসে আমার ওড়নাটা গলা থেকে নিয়ে সম্পূর্ণ মেলে পিছন থেকে মাথায় দিয়ে পুরোটা গায়ে পেচিয়ে দিলো।কথাগুলো আমার বেশ গায়ে লাগলো।আমি পেত্নী! মানে আমি ইশিতা কাবির পেত্নী! আর এটা কিভাবে ওড়না দিলো একদম গ্রামের বেটিদের মতো।এসবই মনে আওড়াচ্ছিলাম তখনই পর্বভাই বললো,
“বাহ্! এবার একদম পারফেক্ট!আমার কিউট পেত্নী… ”
আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
“পেত্নী না পতনি…!”
পর্বভাই হো হো করে হেসে উঠলো তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
“ঐ একই হলো পেত্নী পতনি সব একই যাহা পেত্নী তাহাই পতনি…এবার চল তাড়াতাড়ি দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবাকে খাওয়াতে হবে…”
আমি বড়বাবার কথা ভেবে আর কোনো কথা বাড়ালাম না।তবে নিজের শকুনি চাহনি দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষন। তা দেখে পর্বভাই আমার দিকে তাকিয়ে বুকে হাত দিয়ে চোখ টিপ দিলো। বললো,
“বাবা বিয়ের আগেই এমনভাবে তাকাচ্ছিস বিয়ের পর তো মনে হয় চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবি আমার মতো এতো কিউট মাসুম ছেলেকে…!চল চল দেরি হচ্ছে…. ”
এবার আমি মুখ ভেঙচি দিয়ে বললাম,
“পেত্নী আমি খেয়ে ফেলবো আপনাকে তাহলে বিয়ে কেন করছেন পেত্নীকে। আপনি তো কম সুন্দর না তাই সন্দরী মেয়ে পেতেও আপনার কষ্ট হবে না।করা লাগবে না পেত্নীকে বিয়ে…!”
পর্বভাই এবার আমার দিকে এগিয়ে আসলো।আমার একেবারে কাছে চলে আসলো।আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
“আমার সুন্দরী মেয়ে চাই না। আমি আমার ইশুপাখিটাকে চাই।ছোট্ট এই পাখিটাকে আমার বুকের ভিতর রাখতে চাই।আর বিয়ে তো আমি তোকেই করবো তাতে যায় হয়ে যাক না কেন। বিয়ে আমি তোকেই করবো!”
কথাগুলো শুনে আমি আমার চোখ বন্ধ করে নিলাম।পর্বভাই শব্দ করে আমার কানে একটা চুমু খায়।সঙ্গে সঙ্গে আমি কেঁপে উঠি।একটা ঢোক গিলে বলি,
“চলেন.. বড়বাবার কি অবস্থা এখন?”
পর্বভাই আমার হাত দুটো নিজের হাতে মুঠোয় নেয়।তার দিকে স্থীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,
“এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।”
আমি মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বললাম,
“চলেন…”
পর্বভাই একহাত দিয়ে আমার থুতনি ধরে মাথা উপরে তুললো ফিসফিসিয়ে বললো,
“ইশুপাখি..! ”
আমি কোনো কথা বলতে পারছি না যেত সব কথা আমার গলার কাছে আঁটকে যাচ্ছে তাই আস্তে বললাম,
“হুম…”
পর্বভাই এবার আমার আর একটু কাছে এসে আরও ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভালোবাসবি আমায়…?”
আমি কিছু বলতে পারছি না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। পর্বভাই আমার গতিবিধি বুঝতে না পেরে বললো,
“দেখ ভালোবাসিস আর না বাসিস বিয়ে তোর আমার সাথেই হবে।এবার বল ভালোবাসবি নাকি জোর করে বিয়ে করে যেমন সিনেমায় তেমন জোর করে বিয়ে করবো?”
আমি এবার চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম পর্বভাইয়ের দিকে বিষ্ময় ভরা কন্ঠে বললাম,
“আপনি কি আমাকে এখন থ্রেট দিয়ে আই লাভ ইউ বলাবেন নাকি?আপনি তো আমাকে একবারও বলেন নি ভালোবাসি তাহলে আমি কেন বলবো?”
পর্বভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“থ্রেট দিতে হলে দিবো তাতে কি আছে আমার বউকে আমি থ্রেট দিবো তাতে তোর কি?আর আমি তোকে ভালোবাসি বলিনি তাই বলে কি তোর একবারও মনে হয়নি আমি তোকে ভালোবাসি?”
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না চুপচাপ দাঁড়িয়ে রিলাম কারণ আমি পর্বভাই প্রতিটা কাজে বুঝতে পেরেছি যে সে আমাকে ভালোবাসে। নিজের প্রতিটি কাজের মাধ্যমে পর্বভাই আমাকে উপলব্ধি করিয়েছে যে আমাকে ভালোবাসে।এটা আসলেই তার দারুন প্রতিভা।বলতে তো সবাই পারে কিন্তু ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করাতে পারে ক’জন?
হাসপাতালে করিডর দিয়ে আমি আর পর্বভাই হেটে যাচ্ছি পর্বভাই আমার থেকে কিছুটা আগে হাঁটছে। আর আমি চারিদিক দেখতে দেখতে পিছন পিছন যাচ্ছি। আশে পাশে তাকাতে তাকাতে সামনে তাকিয়ে দেখলাম পর্বভাই নেই।আমি এবার কি করবো কোন নাম্বার রুমে বড়বাবাকে রাখা হয়েছে তাও জানি না আমি।এবার আমাকে আবার রিসিপশনের গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে।এসব ভাবতে ভাবতে পিছনে ফিরতেই দেখলাম সাদা এপ্রন পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে আমাকে দেখে এক ভ্রু উঁচু করে মাস্কটা খুললো বললো,
“হাই ম্যাডাম.. আমি ডাক্তার সিয়াম। নিউরোলজিস্ট কেউকে খুঁজেছেন?”
#চলবে…
(