কিচিরমিচির পর্ব -১৫ ও শেষ

#গল্প_কিচিরমিচির
#লেখিকা_আদিয়া_মির্জা_সানা(জ্যোতি)
#ক্যাটাগেরি_রোম্যান্টিক

পর্বভাই আমার দিকে লাল লাল চোখে তাকিয়ে আছে।আমি তার দিকে তাকাতে সে বাজখাঁই গলায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

” কিছু না বলিনা বলে যা নয় তাই বলবি তুই?আমি তোকে আগেই বলেছি যা-ই হয়ে যাক না কেন আমি তোকেই বিয়ে করবো বুঝেছিস?”

আমি গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে৷ আছি।আম্মু আর চাচিমণি উঠে চলে গেল।যাওয়ার আগে চাচিমণি পর্বভাইকে বলে গেল,

” পর্ব খাবি আয়।ডাইনিং এ খাবার দিচ্ছি। ”

পর্বভাই আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে থেকেই জবাবা দিলো,

” আসছি যাও!আর একে বলো রেডি হতে। কোটে যেতে হবে আবিরের রায় দিবে আজ…”

আমি পর্বভাইয়ের অস্থির কন্ঠে বললাম,

” আমি যাবো না আমি ঐ আবিরের সামনে যাবোনা!”

পর্বভাই আমার কাছে এসে আমার বাম হাতের বাহু চেপে ধরলো আর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” তুই যাবি… আবিরের সামনে তুই যাবি! আবিরেরও দেখা উচিত সে একটা মেয়ের সাথে কতটা বিশ্রি আর জঘন্য কাজ করেছে…”

বলেই পর্বভাই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।আমি দৌড়ে আম্মুর রুমে গেলাম সেখান থেকে আম্মু বোরকা এনে পরলাম। হিজাব দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম।পর্বভাই খাচ্ছে।
গায়ে চকলেট কালারের একটা শার্ট আর জিন্স পরা।আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে খেতে খেতেই আমাকে একবার দেখলো।তারপর খাবার মুখে তুলতে তুলতে বললো,

“কিরে গরম লাগে না?”

আমি মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে অসম্মতি জানালাম।সে বললো,

” না লাগলেই ভালো!”

বলে চুপচাপ খেতে লাগলো।সুন্দর একটা চকলেটের ঘ্রাণ পাচ্ছি তার গা থেকে। আমি দৌঁড়ে পর্বভাইয়ের রুমে চলে গেলাম।রুমে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গেলাম।সেখানে নতুন পারফিউমের বোতল দেখতে পেলাম।চকলেট মাস্ক পারফিউম।বোতলটা হাতে নিয়ে গায়ে কয়েকবার স্প্রে করলাম।তারপর বেরিয়ে ড্রয়িং এ পর্বভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করলাম।কিছুক্ষণ পর সে এলো আমার কাছে আসতেই নাক টেনে কয়েবার গন্ধ নিলো ভ্রু কুঁচকে বললো,

” এ তুই আবার আমার পারফিউম ইউস করছিস?”

আমি কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলাম।কিছু দূর গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম পর্বভাই এখনো ভ্রু কুঁচকে আছে।সেভাবেই আমার পিছন পিছন আসছে।আমি পর্বভাই বাইকের কাছে এসে দাড়ায়।পর্বভাই আমাকে একটা হেলমেট পরিয়ে দিলো।আর নিজে একটা পরে বাইকে বসলো আমিও তার পিছনে বসলাম।সে আমাকে ভালোভাবে ধরে বসতে বলে বাই স্টার্ট দিলো।

কোর্টে শুনানি হবে যে কক্ষে তার বাইরে একটি বেঞ্চে বসে আছি আমি আর পর্বভাই।সে দিব্যি ফোন দেখছে।আর আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকটা দেখছি। এর মাঝে আবিরকে দুইজন কনস্টাবল নিয়ে এলো।আবির আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি আবিরকে দেখে ভয়ে পর্বভাইয়ে বুকের মধ্যে সিঁটিয়ে গেলাম। আমার মুখ হিজাব দিয়ে ঢাকার কারণে আবির আমার ক্ষতগুলো সেভাবে আন্দাজ করতে পারলোনা।পর্বভাই আমাকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে। আবিরের দিকে শকুনি চাহনি দেয়।তার চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। পারলে নিজ হাতে এক্ষুনি খুন করে ফেলে আবিরকে।আমি পর্বভাইয়ের শার্টের কলার চেপে ধরলাম।পর্বভাই আমার মাথায় হাত দিয়ে আশ্বস্ত করলো।আবিরকে শুনানির কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো।কিছুক্ষণ পর আমাদেরও ডাকা হলো।

————
এসিড ছোড়ার সর্বোচ্চ শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড!
আবিরের রায় দেওয়া হলো যাবত জীবন কারাদণ্ড! জেলের ভিতর হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে আবির।আমি গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পর্বভাই আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখের থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলাম। অনুভূতিহীনভাবে বললাম,

” আবির…”

আবির মুখ তুললো।আমার দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল। উঠে এসে গেটের ফাঁক দিয়ে আমার মুখের দিকে হাত বাড়াতেই পর্বভাই আমাকে নিজের বুকের সাথে জরিয়ে নেয়।আবির নিচে মাথা নিচু করে বসে পড়ে।কাঁদতে কাঁদতে বললো,

” আমাকে তো তোমরা একটু ভালোবাসতে পারতে। সেই ছোটবেলা থেকে শুধু দয়ায় করে এসেছো।আমাকে দত্তক নিয়ে দয়া করেছো!একটু ভালোবাসলে কি হতো?”

আমি পর্বভাই থেকে নিজে ছাড়িয়ে আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“এটা তোমার ভুল ধারণা এটা কখনোই সত্যি না যে আমরা শুধু তোমাকে দয়াই করেছি।আমরা তোমাকে ভালোবাসিনি!আমরা তোমাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছি ছোটবেলা থেকে কিন্তু তুমি নিতে চাওনি!জানো খালামণির এখন কি অবস্থা তুমি তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ছিলে।একজন নারীর কাছে কতটা কষ্ট দায়ক যে সে কোনোদিন মা হতে পারবে না।আর এই সত্যটা যখন কোনো নারী জানতে পারে তখন সে নিজের বেঁচে থাকার কারণ খোঁজে কেন সে এই পৃথিবীতে এসেছে তার কারণ খোঁজে। খালামণিও যখন জানতে পারে যে সে কখনো মা হতে পারবে না তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।আর তখন তোমাকে খালু নিয়ে আসে।আর সে তার বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই।কিন্তু আজ সে তার সর্বশ্য হারিয়ে নিঃস্ব! ”

আবির চুপ করে মাথা নিচু করে আছে। পর্বভাই আমার হাত ধরে বললো,

“ইশুপাখি চল যেতে হবে এখন ”

আমি আবিরকে উদ্দেশ্য করে আবার দৃঢ় কন্ঠে বললাম,

” আর তোমাকে আমি ধন্যবাদ দিবো।কারণ তোমার জন্য আমি নিজেকে এক নতুন রূপে আবিষ্কার করতে পেরেছি…!আসছি…!”

পর্বভাই আমার হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে এলো।আসার আগে পিছনে ফিরে আবিরের অশ্রু সিক্ত চোখ দুটি দেখলাম।সে তার ভেজা চোখ নিয়ে আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল!

————
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব থেকে চোখ সরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ইশিতা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইজাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

” একটু পানি দিবে ফাইজা আপু গলাটা শুঁকিয়ে গিয়েছে..!”

ফাইজা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইশিতার দিকে।ইশিতা ফাইজার দিকে তাকাতে ফাইজা উঠে গিয়ে পানি নিয়ে আসলো।ইশিতা পানিটা খেয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা গয়নাগুলো একে একে পড়তে শুরু করলো।

” ইশুপাখি এখনো হলো না তোর আমি বিয়ের স্টেজ থেকে কাজীকে বসিয়ে রেখে উঠে চলে আসলাম নিজেই তোকে নিয়ে যেতে…”

পর্ব অস্থির হয়ে বলতে বলতে রুমে ঢুকলো।আচমকা এমন দুম করে ঘরে ঢুকে পড়াই ইশিতার হাত থেকে কানের দুলটা নিচে পড়ে গেল।ফাইজা মুখে হাত দিয়ে মিট মিট করে হাসছে।ফাইজা হাসতে হাসতেই বললো,

” জীবনের এই প্রথম দেখলাম যে বউয়ের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বর নিজেই বউকে নিতে স্টেজ থেকে উঠে চলে এসেছে..”

পর্বভাই চোখ ছোট ছোট করে তাকালো ফাইজার দিকে।ইশিতা মুখ পিটে হাসছে।পর্ব ফাইজাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

” তুই এখানে কি করছিস স্বামী স্ত্রীর কথার ভিতর কথা বলিস লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই যা ভাগ এখান থেকে… ”

ফাইজা টুল থেকে উঠে মুখ ভেঙচি দিলো বললো,

” এহ্ স্বামী স্ত্রী বিয়ে এখনো হয়নি বুঝেছিস?”

ইশিতা মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে। ফাইজা কথাটা বলেই দৌড় দিলো।পর্ব তার দিকে তাড়া করে দরজা পর্যন্ত গিয়ে বললো,

” এ দাড়া তুই আমাকে বুঝাস আমরা স্বামী স্ত্রী কিনা?বিয়ে হোক আর না হোক আমরা স্বামী স্ত্রী বুঝছিস!”

ইশিতা মুখ থেকে হাত সরিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

” বিয়ে ছাড়া কিভাবে মানুষ স্বামী স্ত্রী হয়?”

বলেই ইশিতা আবার হাসতে লাগলো।পর্ব মাথা চুলকে বললো,

” হ্যা তাই তো…!লজিক আছে কথায়…ধূর ঐসব বাদ এখন তাড়াতাড়ি চল..”

বলে পর্ব ইশিতার দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।চকলেট কালার ফুল হাতা গাউনে সোনালি স্টোন বসানো। অর্নামেন্সগুলোও গোল্ডেন। স্মোকী আই!মোটা পুরু ঠোঁটটায় চকলেট কালারের লিপস্টিক।চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। পর্বও ইশিতার সাথে ম্যাচিং করে চকলেট কালারের সেরোয়ানী পরেছে।বরাবরের মতো বড় বড় চুলগুলোর কিছু চুল কপালে ও ডান চোখের পাতার উপর স্থান পেয়েছে।উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ে চকলেট কালারটা যেন তার সৌন্দর্য দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। হাতে টাইটান ব্রান্ডের ঘড়ি।পর্ব নেশাক্ত চাহনি দিয়ে ইশিতার দিকে এগিয়ে গেল।ইশিতা হালকা হেসে মাথা নিচু করে নিলো।পর্ব ইশিতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

” পুরো একটা চকলেট বারের মতো লাগছে তোকে!”

ইশিতা বেশ লজ্জা পেল।তাও চাপা স্বরে বললো,

” আপনাকেও চকলেট বয় লাগছে!”

পর্ব বাঁকা হেসে নিচে পড়া দুলটা উঠালো নিচু হয়ে ইশিতার ঘাড়ে হাত রেখে পিছন থেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ইশিতার প্রতিবিম্বের দিকে তাকে ইশিতার কানে কানে বললো,

” ও আচ্ছা তাই?”

ইশিতা লজ্জায় মাথা উপর নিচ করলো।পর্ব দুলটা কানে পরিয়ে দিলো।একে একে সব গয়না পরিয়ে দিলো।কানে ফিসফিস করে বললো,

” দেখ তো কেমন লাগছে?”

ইশিতা আয়নায় তাকালো প্রথমে মুচকি হাসলো মুখের দাগগুলো চোখে পরতেই মুহূর্তেই তার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল।মুখে হাত দিয়ে বললো,

” এই দাগ!”

পর্ব ইশিতার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো।ইশিতার ছোট্ট মুখটা নিজে দুই হাতের মধ্যে নিলো।সারামুখে চুমু খেয়ে বললো,

” জানিস ইশুপাখি আমার কাছে আমার মায়ের পরে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নারী তুই…!”

ইশিতার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।পর্বর হাতে পড়লো সেই পানি।পর্ব ইশিতার চোখ মুছে দিয়ে বললো,

” হ্যা সত্যি!তা তুই যেমনই হোস না কেন দেখতে।কারণ তুই আমার প্রয়োজন!চাহিদা না!চাহিদা আর প্রয়োজনে যে আকাশ পাতাল তফাত।আমরা যা কিছু চাই তা সব কিছুই চাহিদা আর আমাদের যেটা না পেলে আমরা এককদমও চলতে পারি না সেটা হলো প্রয়োজন! আর তুই আমার প্রয়োজন!তোকে ছাড়া কিভাবে বাঁচি বল?”

ইশিতা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।পর্ব ইশিতার দিকে আবেগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পর্ব শান্ত কন্ঠে বললো,

” ভালোবাসি! ”

ইশিতা পর্বকে জরিয়ে ধরলো।পর্ব ইশিতার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।ইশিতাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য ইশিতার কানে কানে বললো,

” ভাবা যায় এই পিচ্চি ইশুপাখিটার সাথে নাকি আজকে আমার বাসর হবে ”

ইশিতা পর্বর পিঠে একটা কিল দিয়ে বললো,

” ছিঃ.. চুপ করেন…”

পর্ব ইশিতাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। ক্যামেরা অন করে ইশিতার দিকে ক্যামেরা ধরে বললো,

” স্মাইল…!”

ইশিতা মিষ্টি একটা হাসি দিলো।আর পর্বর নিখুঁত ক্লিকে ফ্রেমবন্দী হলো তার সেই মিষ্টি হাসি।

ভালোবাসা চেহারা দিয়ে হয় না।ভালোবাসা এক অদৃশ্য অনুভূতি। হ্যাঁ প্রেম হতে পারে চেহারা দিয়ে কারণ প্রেম আর ভালোবাসার সজ্ঞাটা একেবারেই ভিন্ন!প্রেম ভালোবাসা ছাড়াও হয়…টাকার জন্য,দেহের জন্য, গিফটের জন্য এগুলোর চাহিদা শেষ! প্রেমও শেষ!সীমিত অনুভূতি!তবে ভালোবাসা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও সারা জীবন থেকে যায়!

_________________(সমাপ্ত)__________________

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here