কি ছিলে আমার পর্ব – ৩৩ (প্রথমাংশ)

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৩ (১ম অংশ)

আপনজনের মান অভিমান তো কখনো কখনো বিনা বাক্যেও ঘুচিয়ে দেয়া যায় কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি! দুটো দিন পেরিয়ে গেছে সিলেটে এসে অথচ মৈত্রী ইরশাদের ভেতরকার অদৃশ্য দূরত্বটা একচুলও সরেনি উল্টো ইরশাদ এসেই অফিস জয়েন করায় দুজনের রাতটুকু ছাড়া পাশাপাশি থাকা হচ্ছে না। রাতটাও মৈত্রীর নির্লিপ্ততা দেখে তাকে কাছে টানতেও ইচ্ছে হয় না ইরশাদের। দেহের চাহিদা জাগলেও সঙ্গীর নিরাসক্ততা তাকে মুহূর্তেই চাহিদাবিমুখ করে দেয়। এদিকে দিনভর দুজনেই বাকি সবার সামনে প্রচণ্ডরকম স্বাভাবিক থাকাটা প্রকাশ করে। বাড়ির মানুষ গুলো দু দিনে চা বাগানের প্রায় প্রতিটি কোণা কোণা ঘুরে বেরিয়েছে অবাধ আনন্দের সাথে কেউ কিছুই বলেনি। উল্টো অফিস কতৃপক্ষ ইরশাদের পরিবারকে ডিনারে ইনভাইট করেছে আজ৷ এই একটা ব্যাপারে অফিস আর চা বাগানে রমরমা খবর বের হলো নতুন একাউন্ট ম্যানেজার কোম্পানির মালিকের আত্মীয়। ব্যাপারটাতে বেশ বিব্রত ইরশাদ কিন্তু মালিকের কান্ডটাও চোখে লাগার মত। ইরশাদ খোঁজ নিয়ে জেনেছে আগের অফিসারটা নাকি এত সুবিধা পায়নি। সত্যি বলতে ইরশাদ দু দিনেই কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে সব শুনে। এমন কি কারণ হতে পারে এত ভোগ সুবিধা দেওয়ার! সে কোয়ালিফায়েড পার্সন হওয়ায় কয়েক জায়গায় ভাল পদে চাকরি পেয়েছে কিন্তু সবটা মনঃপুত হয়নি বলে সেগুলো এক্সেপ্ট করেনি কিন্তু এখানে তুলনামূলক কম স্যালারিতেও আসার পেছনে কারণ ছিল এই পরিবেশ৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন ভুল করলো নাতো! আজ বসের বাড়িতে ডিনার তাও কিনা সপরিবারে৷ পরিবার বলতে শুধু বাবা-মা ভাই-বোন স্ত্রী সন্তান নয় বাড়ি বয়ে এসে বাগানের ম্যানেজার জানালেন ইরশাদের শ্বশুরবাড়ির যে কজন আছে সকলেই যায় যেন। ইরশাদ বাড়ি ফিরতেই সবাই তৈরি হতে গেল। রাত আটটা নাগাদ কেয়ারটেকার হামিদুল এসে বাড়ির উল্টোদিকে বসের বাংলোয় নিয়ে গেল সবাইকে। এ জায়গাটা খুব বেশি উঁচু নয় আবার একদম সমতলেও নয়। বাড়ি বস নিশ্চয়ই খুব শৌখিন মানুষ তা পুরনো বাড়িটা দেখেই আন্দাজ করা যায় তারওপর এই নতুন বাড়িটির আশপাশ দামী সব পাথর আর মোজাইকে চমৎকার হাঁটাপথ সদর দরজা অবধি, গাড়ি বারান্দা সেই সাথে একটা লন তাতে ছোট্ট একটা নীলচে পানির সুইমিংপুল, আশপাশটা গাছের সমারোহপূর্ণ। পাহাড়ি এলাকায় এত চমৎকার এক বাড়ি রাতের কৃত্রিম আলোতেই যেন সকলের চোখ ধাঁধায়। মৈত্রী আজ তাতের শাড়ি পরেছে তার ওপর লং স্লিভ, ফুল নেক মোটা ব্লাউজ ওপরে শাল, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপায় বাঁধা। লন সাইডের হলদে আলোর আভায় ইরশাদ তাকে এক পলক দেখে আফসোস করল ঘরে কেন একটু খেয়াল করে দেখলো না! এত স্ত্রী যে মোহনীয় রূপময়ী তা যে ইরশাদের আজকের আগে অজানা ছিল বুঝতে পারলো। ফুলশূন্য খোঁপায় তাকিয়ে হাঁড় কাঁপানো শীতেও বুঝি একটু একটু উষ্ণ হচ্ছিলো ইরশাদ। খুব করে মন টানছিলো এই ধোঁয়ার মত কুয়াশাতে লনের একপাশে দোলনা বেঁধে মৈত্রীকে তার বুকের ওমে জড়িয়ে নিয়ে রাতবিলাস করতে।

“আরে আসুন মি. ইরশাদ ভেতরে আসুন আপনারা সবাই।”

সদরে দাঁড়ানো প্রায় ত্রিশোর্ধ লোকটি বেশ হাসি হাসি মুখ করে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে৷ ইরশাদ লোকটিকে চেনে বসের একমাত্র ভাগ্নে জয়। এই লোকটাই মোটামুটি সব কিছু দেখাশোনা করে বলে জেনেছে ইরশাদ। দু দিনের মাঝেই তার সাথে বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ দেখিয়েছে লোকটি কিন্তু এত ঘটা করে দাওয়াত করে বস কি নিজে উপস্থিত নেই? ইরশাদের ধারণাই সঠিক বস লোকটা নিজে নেই এখানে। কোন এক অজানা শ-ঙ্কা-য় ভীত রইলো তার মন৷ বসের ভাগ্নে বেশ খাতির যত্নের সাথে ডিনার সম্পন্ন করালো এবং লোকটার স্ত্রী আর একটি সাত বছরের মেয়েও উপস্থিত ছিল সেখানে৷ সবে মিলে বেশ চমৎকার সময় কাটলো তাদের একত্রে৷ ফিরে আসার কথা তুলতেই লোকটার স্ত্রী বিনয়ের সাথে আবদার জুড়লো বাড়িতে একটু ঘুরে নিতে৷ ইরিন আর রোকসানা রাজী হলো সহজেই তারা মূলত পুরুষ আড্ডায় কাজকর্ম আর ব্যবসায়িক আলোচনায় বসতে বি-র-ক্ত বোধ করছিল৷ মৈত্রীও মামনি আর শ্বাশুড়ির সাথে যুক্ত হতে শেলিকে নিয়ে উঠে পড়লো বসার ঘর থেকে৷ তারা দেখলো বাড়ির বাইরেই নয় শুধু ভেতরটা বিভন্ন জাতের প্ল্যান্টে সজ্জিত, সবুজাভ হয়ে আছে বাড়ির প্রায় প্রতিটি দেয়াল৷ এ বাড়ির ভেতরটা ঘুরতে ঘুরতে ইরিনের হঠাৎই মনে পড়লো তার কলেজ জীবনের সময়টা। তার খুব চেনা আরও একটি বাড়ি ঠিক এমন করেই গাছ, লতাপাতায় সজ্জিত ছিল। সারা বছর একটা মানুষ এমন সব নানা জাতের লতাপাতা এনে ভরে ফেলত বাড়ি আর ইরিনের জন্মদিনে তাদের বাড়িতেও সকল উপহারের সাথে একটি করে লতা পাতার টব এসে হাজির হতো বাড়িতে। ভেতরে ভেতরেই একটা দী-র্ঘ-শ্বাস ফেলল ইরিন পুরনো সেই কথাগুলো মনে করে। মনুষ্যজাতি বড়ই আজব। মোহের পেছনে সম্মানের বলি দিতে সদা প্রস্তুত থাকে৷ বাড়ির আনাচকানাচে ঘুরে ফিরে প্রত্যেকরই মনে হলো বাড়ির মালিকটি আসলে শুধু অর্থের মালিকই নয় শৌখিন এক মনেরও অধিকারী। মেয়েমহল ঘোরাঘুরি ইতি টেনে যখন বসার ঘরে উপস্থিত হলো তখন ইরশাদ আর ফখরুল দুজনেই ভিডিও কলে কথা বলছে কারো সাথে। ইরিনের কানে ফোনের ওপাশের ব্যক্তির কণ্ঠ পৌছুতেই কেমন চ-ম-কে গেল সে। ভয়ও বুঝি পেল একটু। ঠিক আটাশ কি তিরিশ বছর আগের ভয়টা এসে হা-না দিল বুকের ভেতর৷ কণ্ঠটি কি ফয়সাল ভাইয়ার? অবচেতন মন যেন তাকে প্রশ্ন করে বসল। তার প্রশ্নের জবাব মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই পেয়ে গেল সে যখন ফয়সাল বলল, “ইরিন কোথায় ও আসেনি?”

“জ্বী আঙ্কেল আম্মুও এসেছে” এটুকু বলেই খেয়াল করলো আম্মু পাশে তাই সে আবার বলল, “আম্মু এখানেই আছে।”

“কথা শুনেও চুপচাপ আছে দেখেছো কেমন স্বার্থপর হয়েছে বড় ভাইয়াদের সাথে কথাও বলতে চায় না দাও তো ওকে ফোনটা।”

হুট করে বলা ফয়সালের কথা শুনে হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে এলো ইরিনের। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডেকে বলল, “ইয়া মাবুদ এ বয়সে এমন কোন বঞ্চনা দিও না যার ভার সইতে পারা অ-স-ম্ভব হয়। ছেলে-বউ, বেয়াই -বেয়াইন সকলের সামনে সম্মান রেখো।”

মনে মনে প্রার্থনা করে ভী-ত হাতে ফোনটা নিলো ইরিন। সালাম দিয়ে কেমন আছে জানতে চাইলে ফয়সাল চমৎকার হেসে খুব স্বাভাবিক আ-চ-র-ণে কত কি প্রশ্ন করে গেল৷ ইরিন ধীরে ধীরে খুব মেপে জবাব দিয়ে গেল। খুব বেশি সময় তাকে আ-ত-ঙ্কিত থাকতে হয়নি ফয়সালই কোন জরুরি কাজের জন্য কল কা-ট-লো। বাড়ি ফিরে সকলে ঠিকঠাক জানতে পারলো ফয়সাল মানে ইরশাদের বস তার বড় মামার বন্ধু৷ আর ইরিনকেও চেনে খুব ছোট থেকে তাই সবদিকেই এত খাতির যত্ন। লোকটা কোন কারণে আজও বিয়ে করেনি তবে একমাত্র ভাগ্নে আর ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা মিলে সকল ব্যবসা বানিজ্য দেখাশোনা করছে৷ সকলে এতে যেন বেশ স্বস্তি পেলেন ইরশাদ মৈত্রীর এখানে থাকার ব্যপারে শুধু এক আকাশ পরিমাণ ভ-য় চে-পে রইলো ইরিনের বুকে। লোকটা কম হয়রানি তো করেনি বয়সকালে এখন কি আবার কিছু করবে!

নোরা ইউ কে’তে যাওয়ার আজ পঞ্চম রাত চলছে। এত দিনে ময়ূখের সাথে তার কথা হয়েছে মোটে পাঁচবার৷ দু’জন চোখের যেমন দূরে আছে মনেরও ঠিক তেমনই তবুও সম্পর্কের দা-য়-বদ্ধতা মনে রেখেছে একমাত্র ময়ূখই৷ আজ রাতে কল আসবে না একটু আগেই জানা গেল ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে৷ নোরা ছোট্ট করে গুড না-ই মেসেজ পাঠিয়েছে সাথে আরও লিখেছে আজ সে ভীষণ ব্যস্ত তাই আর কল দেবে না। সে সত্যিই কল দেয়নি আর ময়ূখেরও ঠিক অভ্যাস গড়েনি তেমন তাই র-ক্ষা৷ আজ রাতে তার বাইরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু এখানকার প্রচণ্ড শীতে তা সম্ভব নয়। তবুও একটুখানি স্পেস তো অবশ্যই চাই তার এই মুহুর্তে তা বুঝতে পেরে ঘর থেকে বের হলো। ফখরুল টের পেয়েছে পাশ থেকে উঠে ময়ূখের বাইরে যাওয়া৷ ছেলেটার কি হলো মাথায় আসছে না তবে তিনি ভীষণ রেগে আছেন নোরা মেয়েটার ওপর। বিয়েটা কি ছেলেখেলা! ছেলেটাকে রেখে কিভাবে চলে গেল মেয়েটা! ইচ্ছে হলো কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিলো আবার কারো অনুমতি না নিয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেল ভীনদেশে।

চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here