#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৪
লন্ডন বরাবরই এলিট এডুকেশনের জন্য ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল উভয় স্টুডেন্টদের জন্য উচ্চ আকর্ষণীয়। নোরার ন্যাশনালিটির জন্য এ সুযোগ তার জন্মগতভাবেই পাওয়া হয়েছে। শাইন বরাবরই মেয়েকে ডক্টর হিসেবে দেখতে চাইতো এ নিয়ে আফছারেরও মতবিরোধ ছিল না। তবে তারা কখনোই মেয়েকে এ নিয়ে প্রেশারাইজ তো দূর আগে থেকে কোন সিদ্ধান্তও দেননি৷ নোরা নিজ থেকেই পড়াশোনায় পছন্দসই এগিয়েছে। পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে বিএসসি সাইকোলজি তিন বছরের আন্ডাটগ্রাজুয়েশন প্রোগ্রাম নোরার নিজ পছন্দ এবং পরিশ্রম ছিল৷ এখনো তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটেনি সে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে প্রচণ্ড এক্সট্রা অর্ডিনারী তা হঠাৎই চোখে পড়েছিল তার প্রফেসরের। সেই থেকেই লোকটা তাকে বিভিন্নভাবে এগিয়ে যেতে সবরকম সাপোর্ট করেছে। কিন্তু তাকে কিছু বিষয়ে স-ত-র্ক-তাও জানিয়েছে। হি-প-নো-টি-জ-ম শব্দটার সাথে যেদিন প্রথম পরিচয় ঘটেছে নোরার সেদিন প্রফেসর এর প্রথম শর্ত ছিল শুধুই চিকিৎসার প্রয়োজনে হবে এর ব্যবহার। কখনো কোনো অ-ন্যা-য়, অ-প-ক-র্মে-র স্বার্থে কাউকে হিপ-নো-টাইজ করা যাবে না করলে সেটা ক্রা-ই-ম হিসেবেই ধরা হবে এর কথিত কিছু শা-স্তিও আছে। নোরা অবগত তার শিক্ষার প্রয়োগ বিস্তারিত তবুও সে করেছে কাজটা। ময়ূখকে সেদিন বিয়ের স্টেপ নিতে সে ঠিক এ কাজের মাধ্যমেই বাধ্য করেছিল। লন্ডনে সে চাইলেই বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে নিতে পারে, দৈহিক চাহিদায় লিভ ইনও খুব সহজেই করতে পারতো। আফটার এইটটিন তার পেরেন্টস তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। যদিও নোরা এদিক থেকে ইউ কে’তে থেকেও কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত ছিল তার পিতার কারণে। তবে দেশে এসে প্রথমবার যখন ময়ূখের সাথে সামনাসামনি পরিচয় হলো তখন সে বুঝতে পারলো এই ছেলেটাকে তার ভালো লাগে। চোখের সামনে যখন ফ্রেন্ডদের ক্লোজ ডেট দেখে অভ্যস্ত সেখানে পছন্দের ছেলেটির হাত ছুঁয়ে দেখতেও তাকে দশবার ভাবতে হতো। দেশে আসার সময় গুলো তার কা-ট-তো ভীষণ সাধারণ আর বাঙালি সংস্কৃতি নিজের মধ্যে ধারণ করে। ময়ূখের প্রতি তার আকর্ষণ দিন দিন বেড়ে গেল তাকে হাতের কাছে পেয়ে না পাওয়ার হতাশায়। কৈশোরের চাহিদা যুবতী বয়সে আ-ক্ষে-প হয়ে উঠলো এক সময়। প্রায় প্রতি বছরই নোরা দেশে আসতে থাকলো আর পুরো সময়টা সে বিভিন্ন বাহানায় ফুপির বাড়ি না হয় ট্যুর দিত তার সঙ্গী হিসেবে মেহের তো থাকতোই সাথে ময়ূখকেও থাকতে হতো। আগে ইম্যাচিউর আইডিয়াস দিয়ে ময়ূখের সঙ্গ পাওয়ার চেষ্টা করলেও এবার ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। ময়ূখের দু চোখের ভাষা পড়তে তার সময় লাগেনি সেই সাথে নির্লিপ্ত মেয়ে মৈত্রীর চোখ দুটোও সে দীর থেকেই পড়তে পেরেছিল। নোরা আপন মানুষদের মাঝে কূ-ট-চাল করার কথা কখনো ভাবেইনি অথচ এবার সে সর্বাধিক নিম্ন কাজগুলোই করেছে দূর্বল মনের মানুষগুলোর সাথে। আর তার চৌকস দৃষ্টির শিকার হয়েছে পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের ময়ূখ আর চাপা স্বভাবের মৈত্রী। তবে নোরা পুরোটা পরিকল্পনায় কায়মনোবাক্যে এক ইরশাদ -মেহেরের ভালোটাই চেয়েছে। নোরার মন যেমন ময়ূখকে পাওয়ার লোভে মৈত্রীর মনের ভেতরটাকে উসকে দিয়েছে ভালোবাসার মানুষের দিকে ছোটার জন্য তেমনি ময়ূখকে করেছে কাছের মানুষগুলো থেকে দূর। মুখচোরা নয় সে তবুও নোরার প্ররোচনায় চুপ হয়ে গেছে। শাইন মা হয়ে ঠিকই মেয়েকে বুঝতে পেরেছিল তাই প্রথম থেকেই সাবধান করে গেছেন নোরাকে। সে শোনেনি কোন কথাই বারবার তাকে ফিরে আসার কথা বলেন। তাতেও ভ্রুক্ষেপহীন ছিল নোরা তারই মাঝে জানতে পারে ইরশাদের এনগেজমেন্ট এবং নোরাই কোনভাবে উগরে দিয়েছিল ময়ূখ যে মেয়েটিকে পছন্দ করে সেই মেয়ের সাথেই ইরশাদের বিয়ে। সন্তান যতোই চতুর হোক, যতোই বুদ্ধিমতি হোক না কেন মা-বাবার সতর্ক নজরে সেসব আড়াল হয় না। নোরারও হয়নি, শাইন তার প্রতিটি পদক্ষেপ, পদাচারণে দৃষ্টিপাত করে আফছারের সাথেও যোগাযোগ করেন। প্রকৃতির হিসেব মানুষের হিসেবের চেয়েও কঠোর হয় তা হয়ত আফছার বয়সের অর্ধেক পেরিয়েও আন্দাজ করতে পারেননি। তাইতো নিজ কন্যার ভুলগুলো জানার পর চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে বসে রইলো ঢাকায়। তার ধারণা মেয়েটি মায়ের পথে হাঁটবে না। আপন ভাতিজার সাথে যদি সত্যিই কিছু হয়ে যায় তবে সে সারাজীবনের জন্য মেয়েকে আ-ট-কে রাখতে পারবেন। নোরা হয়ত অধ-র্মে-র পথ ছেড়ে আসবে ময়ূখের খাতিরে। ভুল ছিল সে ; মেয়েটি তার শুধুই নিজের ইগো স্যাটিসফাই করতেই ময়ূখের সাথে নিজেকে জুড়েছে৷ নোরাকে থামাতে না পেরেই শাইন প্রফেসরের শরণাপন্ন হয়েছিল। সব শুনে প্রফেসর নোরাকে বিভিন্নভাবে শাষন-বারণে দেশে ফিরে আসতে বলেছে এমনকি তার তিন বছরের কোর্সে এখনও একটি বছর বাকি সেই বছরটি এবং ক্যারিয়ার নিয়ে হু-ম-কিও দিয়েছেন। তার ফিরে যাওয়ার সময় অল্প ছিল বলেই সে তার শেষ চাল হিসেবে হিপনোটাইজ করেই রেজিস্ট্রি করিয়েছে৷ তাতে সে লাভবানও হয়েছে সকলে নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে বিয়েটা, ময়ূখ সেও কি বাদ আছে! হয়তো ভালোবাসতে পারছে না কিন্তু নোরাকে ঠিকই মেনে নিয়েছে। এইতো চেয়েছিল নোরা।
“ইউ শ্যুড পে ফর ইউর অল মিসটেইকস এন্ড কন্সপিরেসি। ডু ইউ নো হোয়াট হ্যাভ ইউ ব…” প্রফেসর আজ থার্ডটাইম নোরাকে একই কথা বলতে যাচ্ছিলেন তাই নোরা তাঁকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিল। সে স্বীকার করে নিলো নিজের ভুলগুলো। বিয়েটা নিয়ে সে সিরিয়াস ছিলো না কিন্তু ময়ূখের সাথে থাকতে চায় এ কথা সত্যি। নোরা নিজেই তার করা প্রতিটা কাজের জন্য কৈফিয়ত দিল সব শুনে প্রফেসর বলে দিলেন সাইকোলজি নিয়ে পড়া নয় বরং তার এ মুহূর্তে ট্রিটমেন্ট জরুরি। প্রফেসর আর নোরার কথার মাঝেই নোরার ফোন বাজল। ময়ূখ কল করছে! প্রফেসর কল দেখে নিজের কথা শেষ করে নোরাকে বেরিয়ে যেতে বলল।
“কেমন আছো?”
” ফাইন, তোমার টেক্সট ছিল কল দেওয়ার কথা লিখেছিলে।”
ময়ূখ কথাটা বলেই আবার প্রশ্ন করলো, “কোন প্রয়োজন ছিল?”
“এভাবে বলো কেন ময়ূখ! আ’ম ইউর লিগ্যাল ওয়াইফ নট আ আউটসাইডার।”
“স্যরি, ব্যস্ত ছিলে!”
“নো”
“আন্টি কেমন আছে?”
“আই ডোন্ট নো… ময়ূখ এখানে চলে আসো।”
নোরার কণ্ঠে আবদার ছিল না, আকুলতা ছিল না। ময়ূখ শুনেও কিছু বলল না জবাবে। নোরার সাথে তার কিছুতেই মিলবে না তা সে জানে তবুও জীবনটা তো কা-টা-তে হবে ভেবেই বুঝি সে এ পথে অগ্রসর হচ্ছে। আম্মা চিন্তিত থাকছেন নোরার ফিরে যাওয়ার পর থেকে ময়ূখ তা টের পায়। কিন্তু এ মুহূর্তে তার করণীয় কি সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
রাতটা মৈত্রীর আধ ঘুম আধ জাগরণে কে-টে গেছে কাল। সকালে ঘুম ভেঙেছে বাইরের থেকে কারো হাঁকডাকে। চোখ মেলতেই বিছানার ওপর গুছিয়ে রাখা তার জন্য শাড়ি-ব্লাউজ। ইরশাদ যে রেখেছে তা অজানা নয়। মৈত্রীও আর দেরি না করে গোসলের জন্য উঠে পড়ল। শীতের সকালে ঠান্ডা পানিতে গোসল অসম্ভব তাই গরম পানি করতেই সে রান্নাঘরে গেল। খুশির কথা হলো ইরশাদ পানিটাও চুলায় বসিয়ে আগুনের আচ কমিয়ে রেখে গেছে৷ মৈত্রী গরম পানি নিয়ে গোসল সেরে আবারও রান্নাঘরে এসেছিল৷ আবারও পুলকিত হলো হটপট আর ফ্লাক্স দেখে৷ পরোটা, চা সবটা তৈরি করে রেখে গেছে মানুষটা! এত উদার আর যত্নশীল হতে কে বলেছিল মানুষটাকে? মৈত্রী খুব লজ্জা লাগছে এবার সে স্ত্রী হয়ে কিছুই করেনি অথচ তার বর কত কি করে৷ তীব্র শীতের সকালে ধোঁয়া ওঠা চা আর পরোটা দিয়ে রাতের মাংসের তরকারি। চমৎকার নাশতা হয়ে গেল মৈত্রীর একা একাই। কাজের জন্য যে মহিলাকে রাখা হয়েছে তিনি এসেছেন একটু আগেই। মহিলাটি ঘরদোর ঝাড়পোঁছ শুরু করতেই মৈত্রী গিয়ে বসলো দোলনায়। পূবাকাশে রোদ তখনও উঁকি দিচ্ছে দিচ্ছে অবস্থায়। শাড়ির আঁচল গুটিয়ে গায়ে থাকা শালটি ভালো করে পেঁচিয়ে সে বসে পড়লো দোলনায় আর তাতেই মনে পড়ে গেল রাতের ঘটনা। ইরশাদ জোর করেই বলেছিল পরের কাহিনিটুকু৷ ইমরান ভাইয়ের বার্থডের রাতের সে ঘটনার পর ইরশাদ ভীষণ বাজে রিয়াক্ট করেছিল। সকলের সামনে সায়রাকে থা-প্প-ড় মে-রেছিল, ধাক্কা মেরে দেয়ালে ফেলে দিয়েছে। সায়রার কপালের ডান দিক ফেটে সেলাই পর্যন্ত লেগেছিল। কিছুদিন যেতেই ইরশাদ মাফ করে দিয়ে সায়রাকে আবার নিজের জীবনে সব স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল। সায়রাও ইরশাদের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়েছিল কিন্তু তারপর মাত্র দু মাসের মাথায় নাকি হুট করে সায়রা বলল সে ইরশাদকে ভালোবাসে না সে তো ইমরানকে ভালোবাসে। জীবন এতোটাও সিনেমেটিক হতে পারে জানা ছিল না কিন্তু সায়রা তার সাথে নাটকীয় ভাবেই সম্পর্ক শেষ করেছিল। একদিন এসে বলল সে প্রে-গন্যান্ট আর ইমরান তার সন্তানের বাবা। এরপর কি হলো! কোন আলাপ আলোচনা ছাড়াই একদিন মেজো চাচী আর চাচা ইমরানকে নিয়ে গেলেন সায়রাদের বাড়ি সেদিনই সায়রা বউ হয়ে এসে পা রাখলো তাদের বাড়িতে৷ ইরশাদ কিছুদিন একদমই মানতে চাইছিলো না এসব কথা সে রোজ রোজ ইমরানদের ঘরে যেত জোর করে সায়রার সাথে কথা বলত, রাগারাগি করত এমনকি একদিন ইমরানের গায়ে হাতও তুলল। এ নিয়ে পুরো বাড়িতে ঝামেলার সৃষ্টি হতেই সকল চাচা মিলে তার বাবাকে ডেকে কথা শোনালেন। তার ঠিক হল তারা বাড়ি ছেড়ে ভাড়া থাকবেন। তাই করা হলো দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় তারা ভাড়াটে জীবন কা-টা-চ্ছে। এর মাঝে আব্বুর সাথে বড় চাচার যোগাযোগ ঠিক থাকলেও মেজো চাচা আর ছোট চাচার সাথে খুব একটা রইলো না। আব্বু ব্যবসা থেকে ইস্তফা নিয়ে চাকরিতে যোগ দিলেন ময়ূখ বছর কয়েক হলে থেকে পড়াশোনা করল আর ইরশাদ তার স্বপ্নের বিসিএস পরীক্ষায় বসতে পারলো না। মৈত্রী সব শুনে গেল কিন্তু তার বারবার মনে হতে লাগল সায়রা এমন কেন করলো? ইরশাদকে এই প্রশ্নটা করতে গিয়েও করেনি মন বলছিল যদি এমন হয় সায়রা কোন বিপদে পড়ে এমন করেছে তখন ইরশাদের মনে কি আবার সায়রার বসতি গাড়বে? যদি গেঁড়ে যায় সায়রা আবারও ইরশাদের মনে! না না তার পক্ষে এটা মানা অসম্ভব হয়ে পড়বে তারচেয়ে ভালো সায়রা ভুল ছিল কি ঠিক সেসব তাদের অজানাই থাক। ইরশাদের জীবন মানেই এখন মৈত্রীর বসবাস আর কারো নয়।
চলবে
(তথ্যাদি কিংবা বানানে ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন)