#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৬( ২য় অংশ)
চোখের পলকে সময় কাটছে। শীত শেষ হতে চলল শেষ হচ্ছে জানুয়ারি মাসটাও। ইরিনের দোনোমোনো আচরণে ইরশাদ-মৈত্রীর ঘুরতে যাওয়া বানচাল হলো প্রায় বিশ দিনের মত। এদিকে ময়ূখেরও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এমবাসি দৌঁড়াদৌড়ি সব শেষ হয়ে চলে এসেছে কাঙ্খিত দিনটি। কাঙ্খিত! শুধুমাত্র নোরার জন্যই আকাঙ্ক্ষিত ইরিন তো মনে মনে চাইছিলেন ছেলে তার সাথে থাকবে বউ নিয়ে অন্তত এক বাড়িতে না হোক এক দেশেই! কিন্তু না নোরা আসবে না তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছেড়ে তাই স্যাক্রিফাইসটা ময়ূখ আর পরিবারকেই করতে হচ্ছে৷ ইরশাদের আগে থেকেই এক সপ্তাহের ছুটির এপ্লাই করা ছিল হানিমুন ট্রিপে কিন্তু সে ডেট যেহেতু আম্মুর জন্য পেছাতেই হবে তাই সে ঠিক করল জানুয়ারির ঊনত্রিশ তারিখ থেকে ছুটি কাটাবে। ময়ূখের ফ্লাইট ত্রিশ তারিখ তাই আটাশ তারিখ রাতে সে মৈত্রীকে নিয়ে যাবে রাজশাহী। ময়ূখকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে সে রাতেই আবার তারা রওনা হবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। হাতে চারদিন সময় নিয়ে পাহাড়ের বুকের আবেশে হারাবে দুজন তারপরই সেখান থেকে সরাসরি সিলেটে এসে উঠবে এমনটাই ঠিক হলো। মৈত্রী সকালেই দুপুরের রান্না শেষ করে ব্যাগ গোছাতে বসলো। দুটো লাগেজ নিতে চাইলে ইরশাদ বলল, কোন দরকার নেই। বোঝা টেনে চলতে ফিরতে একদমই ভাল্লাগে না তারওপর বউ সাথে থাকবে। তার চেয়ে ভালো হয় একটা বড় দেখে ট্রলিব্যাগ গোছাও কিন্তু বিপত্তি অত বড় ব্যাগ নেই এখানে। আলমারি থেকে ইরশাদের কাপড় বের করে তাকে কল দিলো মৈত্রী।
“আরেহ আজ ভর দুপুরে বউয়ের কল এলো? বিশেষ কিছু রান্না হলো নাকি!”
“একদমই না। আজ শুধু মাছ ভাজা আর ভাত হয়েছে কিন্তু আপনি বলেন আপনার কি কি গোছাব?”
“যা ভাল্লাগে নিয়ে নাও।”
“তা কি করে হয়? ওখানে কেমন শীত, কেমন পোশাক পরবেন তা ঠিকঠাক বলুন না।”
“আচ্ছা বলছি, প্রথমেই একটা লুঙ্গি, ফুলস্লিভ টি শার্ট নাও দুইটা ওই যে সাদা আর কালোটাও নিও রাউন্ড নেক।”
“আচ্ছা আর শার্ট?”
“শার্ট তো সব অফিসের গুলাই আছে এখানে বাড়ি গিয়ে দেখতে হবে কিছু আছে কিনা! আর শোনো আন্ডারওয়্যার, মোজা এবং অবশ্যই বেল্ট এই জিনিসগুলো একদম হাতের কাছে রাখবে।”
“পারফিউম এর কথা তো ভুলেই গেলেন।”
“উফ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মনে করালেন বেগম সাহেবা থ্যাংক ইউ উম্মাহ্।”
“আরেহ আরেহ অফিসে বসে এসব কি!”
“বউয়ের জন্য এসব সব জায়গায়ই চলে এবার ফোন রাখুন প্লিজ আজ বস এসেছে অফিসে বাই।”
“বাই”
মৈত্রী কল কে-টে আবারও কাজে মন দিল। কাজ করতে করতেই মনে পড়লো সেদিনের কথা যেদিন তাদের হানিমুন ট্রিপ নিয়ে ইরিন ক-ঠি-নরকম বাধ সাধলেন। ইরশাদ যখন মৈত্রী আর তার মায়ের ভিডিও কলে বলা কথা শুনে মৈত্রীকে প্রশ্ন করেছিল, কিসের কথা বলছে আম্মু? মৈত্রী আমতা আমতা করে বলেই দিয়েছিল আম্মু আর মামনি গুড নিউজ শুনতে চায়। ইরশাদ খুব করে রিয়াক্ট করেছিল, ” এজন্যই কি তুমি প্রোটেকশনের ব্যপারটা এভোয়েড করতে চাইছিলে এতদিন?”
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সবরকম জড়তা ছাড়িয়ে গেছে তাদের জীবনে তবুও সেদিন ইরশাদের প্রশ্নে মৈত্রীর খুব লজ্জা লাগল। ইরশাদ অ-ধৈ-র্য্য সে উত্তর শুনতে চায় মৈত্রীও শেষতক কথা লুকাতে পারেনি। মাথা নেড়ে জানালো “হ্যা” কারণ, আম্মু আর মামনি দুজনেই বলেছেন, তোমাদের বয়স একদম পার্ফেক্ট প্রথম সন্তানের জন্য আবার বিভিন্ন কারণে পরে সমস্যাও হয় আজকালকার মানুষদের। ইরশাদ নেয়াহেতই বি-র-ক্ত হয় মৈত্রীর কাছে সব শুনে। বাচ্চার শখ তো তার নিজেরও আছে তাই বলে এত তাড়া দেওয়ার কি আছে। সামনেই মৈত্রীর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা এ সময়টা কোন স্ট্রেস না আসুক। পরীক্ষাটা শেষ হলেই না হয় চেষ্টা করবে। মৈত্রীর খুব বেশিই লজ্জা লাগছিল এসব নিয়ে কথাবার্তা বলতে তবুও ইরশাদ যেভাবে ধমকে ওঠেছে তাতে ভ-য়-টাও কম লাগেনি। এখন কাপড় গোছাতে গোছাতে সেসব ভেবেই মুখে হাসি এলো। কাজের জন্য যে ভাবী আসেন তিনি ঘর মোছা শেষ বলে মৈত্রীকে বলতে এসেছিলেন চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাকে একা একা হাসতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“ইয়া আফনে হাসইন তাও আবার এখলা এখলা ! আফনে হাসতেও জানইননি না জ্বিনে ধরিয়া হাসার ?” (“ওমা আপনি হাসছেন তাও আবার একা! আপনি হাসতেও জানেম নাকি জ্বিনে ধরে হাসাচ্ছে?”)
মহিলাটি আঞ্চলিক ভাষায় এটুকু বলেই আবার বলল, “কাম শেষ আমি যাইরাম গি ভাবি”
মৈত্রী প্রথম বাক্যের শুধু হাসি আর জ্বীন শব্দদুটোর অর্থই বুঝতে পারলো কিন্তু পুরো বাক্যটা আন্দাজ করে নিলো। তারপরই মনে হলো সত্যিই তাকে জ্বীনে ধরেছে নইলে সে এভাবে হাসে নাকি! কাপড় গোছানো বলতে শুধু ইরশাদেরই কয়েকটা গোছানো হল। ইরশাদ বলেছে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ দরকার নেই তুমি লং কূর্তিটুর্তি কিছু নিয়ে নাও তারওপর চাদর বা জ্যাকেট কিছু তো থাকবেই। কিন্তু এখানে মৈত্রীর তেমন কাপড় হাতে গুণে দুটো ইরশাদই কিনেছিলো কয়েকদিন আগে। বাড়িতেও যে খুব একটা আছে তা নয় সে তো বরাবরই কামিজে অভ্যস্ত। তবুও খালামনির দেওয়া ভালো টপ, প্যান্ট আর চমৎকার শীতের পোশাকও আছে। বাড়ি গিয়ে আবার বাপের বাড়িও যেতে হবে কাপড়গুলোর জন্যই এসব ভেবেই মৈত্রী অস্থির হচ্ছে৷ হাতে সময় কম অথচ কত কাজ বাকি! সারাটা দিন এই করব, সেই করতে হবে। ঘরের সব ঠিকঠাক করে রাখা আছে কিনা! সে সাতদিন না থাকলে ঘরের কিছু ন-ষ্ট হবে কিনা এসবের খেয়ালেও মৈত্রী অ-স্থির। ইরশাদ সন্ধ্যায় ফিরতেই মৈত্রীকে দেখে অবাক হলো৷ এত অল্প সময়েই একটা মেয়ে তার সংসারে ঠিক কতোটা জুড়ে গেলে এমন চঞ্চল হতে পারে! মৈত্রীর যে টান জমেছে সংসারের প্রতি তা যেন তার ছটফট করা দেখেই বুঝে নিলো ইরশাদ। মুখ হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে ইরশাদ ডাকল,
“মৈত্রী”
“জ্বী!”
“খাবার দাও।”
“আনছি ” বলেই মৈত্রী ভাত, শিমের ভর্তা আর ডিম ভুনা বেড়ে দিল। ইরশাদ প্লেটে ভাত, ভর্তা নিয়ে মেখে মৈত্রীকে আবার ডাকলো, “এখানে একটু বসো তো!”
মৈত্রীও বসলো ইরশাদের দেখানো তার পাশের চেয়ারটিতে৷ ইরশাদ ভাতের লোকমা তুলে ধরলো মৈত্রীর মুখের সামনে৷
“হা করো, এত কেন চিন্তিত হচ্ছো বলো তো!” আমাদের ঘরে তেমন কোন কিছুই নেই পঁচে গলে ন-ষ্ট হওয়ার মত৷ কাঁচা বাজার শেষ তুমিই তো সকালে বললে। ফ্রিজে মাছ- মাংস কিছু থাকলে সেগুলো চাইলে কেয়ারটেকার চাচার বাড়িতে দিয়ে দিব তারা খেয়ে নেবে কেমন! আর আমার পাখিগুলো তো আনিইনি তাই টেনশন নেই। যাওয়ার সময় ঘরদোর সব ঠিকঠাক লাগিয়ে নেবো। বাইরের বাগানের গাছেদের জন্য মালি চাচা তো আসবেনই।” কথাগুলো বলতে বলতেই ইরশাদ একবার মৈত্রীর মুখে তো একবার নিজের মুখে খাবার তুলছে। খাওয়া শেষে মৈত্রী রান্নাঘর সাফ করে থালা-বাটি সব ধুয়ে রাখলো৷ ইরশাদও ততক্ষণে ফ্রিজে থাকা কিছু মাছ আর একটা মুরগি ছিল তাই ব্যাগে ভরে চলে গেল কেয়ারটেকারের বাড়ি৷ ভদ্রলোক ইরশাদের কাছ থেকে সেগুলো নিতে বেশ ইতস্তত করছিলেন তা বুঝতে পেরে সে বাড়ির মহিলাকে খুঁজে হাতে দিল৷ তারপরই মনে হলো ঘরদোর মোছে যে মহিলাটি সেও তো বেশ অভাবি এগুলো কি তাকে দিলেই বেশি ভালো হতো না! কিন্তু ততক্ষণে আর উপায় নেই সেগুলো নেওয়ার। মনে মনে খা-রা-প লাগলো বলেই ভাবলো কিছু টাকা বেশি দিয়ে দেবে এ মাসে৷ বাড়ি ফিরে মৈত্রীকে তৈরি হতে বলে ইরশাদও তৈরি হয়ে নিলো। দশটার মধ্যেই বাস স্টপেজে থাকতে হবে হাতে সময় কম৷ দুজনেই তৈরি হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাসে চড়লো৷
“ময়ূখ! ভাইজানের ফোন ধরছিস না কেন?” ফখরুল সাহেব ফোন হাতে ময়ূখের রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করলো। তার গোছগাছ শেষ হয়েছে আজ বিকেলেই। ইরিন নিজে দু লাগেজ গুছিয়েছে ময়ূখের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে। কা-ন্না করবে না বলে বলেই বারংবার কেঁদে চলছে সে। সন্ধ্যা থেকে তো দরজা এঁটে কাঁ-দ-তে বসেছে আর তাতেই ময়ূখের মন বি-ক্ষি-প্ত হয়ে আছে। আবরার অনেক বার কল দিলেও ময়ূখ কথা বলেনি। আম্মার কা-ন্না তার কিছুতেই স-হ্য হচ্ছে না এই দুনিয়াদারি দিয়ে কি হবে! মন বলছে বাদ দেই এ যাওয়া। নোরার ইচ্ছে হলে নিজে আসুক পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না গেলে কিছুতেই ভাল হবে না। মৈত্রীকে সে ভুলতে পারেনি একফোঁটাও। দেশে থাকা মানে সকল উৎসব, আয়োজনে কাছাকাছি থাকবে আর বেহায়া মনটা সবচেয়ে বড় পা-প-টাই করবে৷ নোরার কাছে গেলে হয়ত তার সঙ্গ পেয়ে এই পাপী মনের পাপিষ্ঠ ভাবনাগুলো মিলিয়ে যাবে কোথাও এমন ভাবনাতেই যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সে। কিন্তু আম্মার কা-ন্না যে বুকটা এফোড় ওফোড় করে দেয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আম্মার ছায়াতলে তার প্রশান্তির হাওয়া মিলেছে তা আর কোথাও মিলবে না। ফখরুল সাহেব নিজেও ময়ূখের অবস্থা বুঝতে পারছেন। হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে দিলেন, “নে ভাইজানের সাথে কথা বল। কথা শেষ করে খেতে আয়।”
ঘরের চারপাশে চোখ বুলায় ময়ূখ৷ বাতি জ্বলছে তবুও অন্ধকার সবটা এমন কেমন লাগছে! অন্যমনস্ক ভাবেই আব্বুর নম্বরে ডায়াল করে। প্রথম কলেই রিসিভ হয় কিন্তু ওপাশ থেকে মেহেরের কান্না আসছে।
“হ্যালো, মেহের! কি হয়েছে মেহের তুই কাঁদছিস কেন? আব্বু কোথায়?”
“তুমি যেও না ভাইয়া৷ আব্বু ক-ষ্ট পাচ্ছে, আমিও পাচ্ছি৷ তুমি আমাদের কাছে চলে এসো ভাইয়া।”
“এ্যাই বোকা কাঁদছিস কেন আমি তো চলে আসব আবার।”
“না ভাইয়া যেও না তুমি গেলে আর আসবে না আমি জানি।”
“ধুর পাগল! আমার বাড়ি এখানে না এসে কোথায় থাকব? তোর ভাবীর কাছেও তো যেতে হবে তাই না! কাঁদে না বোন আমার আমি বেড়াতে যাচ্ছি আবার চলেও আসব দেখিস।”
ময়ূখ বোনকে কত কি বলে বোঝাচ্ছে অথচ তার নিজের মনটাই বলছে যাস না সেখানে৷ কিন্তু , এভাবে কি চলতে পারে! সংসারটা তো করতেই হবে তার৷ নোরাকেই’বা ক-ষ্ট দেবে কেন মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। ময়ূখ আরও অনেক কিছুই বলে নিজের মনকে। রাতে খাবার খেতে ইরিন বের হলো না ঘর থেকে তাই ময়ূখেরও খাওয়া হলো না, হলো না ফখরুলেরও। ঘরের তিনটি মানুষই সে রাত না খেয়ে পার করলো। ইরশাদরা এসে পৌঁছুলো পরের দিন দুপুরে। হাতে সময় কম তবুও মৈত্রী এসেই নিজে রান্নাবান্নায় নেমে গেল। শ্বাশুড়ির চোখ-মুখ দেখতেই বুঝতে পেরেছে তিনি ঠিক কতোটা ভে-ঙে পড়েছে৷ রান্না শেষ হতেই ইরশাদ জোর করে মা আর ময়ূখকে খাবার খাওয়ালো। সন্ধ্যের দিকে আবার মৈত্রীকে নিয়ে গেল তার বাপের বাড়ি৷ এত ছুটোছুটির মাঝে মৈত্রীর ভয় ছিল অসুস্থ হয়ে পড়ার কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। শুধু ক্লান্তিটাই একটু বেশি ছিল সেটাও উবে গেল রাতে ভালো ঘুমাতে পেরে। ময়ূখের সাথে এয়ারপোর্টে ইরশাদ ছাড়া আর কাউকে নেওয়া হলো না৷ ইরিন কান্নাকাটিতে একদমই নিজের মধ্যে নেই বলেই তাকে নেওয়া হয়নি, ফখরুল সাহেবও তাঁর ভিন্ন ছিলেন না। ময়ূখ যে তাঁর জন্য নিজের সন্তানই ছিলো। আবরারের চেয়ে বেশি তিনিই ক-ষ্ট পাচ্ছেন ময়ূখের এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কিন্তু সিদ্ধান্তটাও যে তিনিই নিয়েছেন৷ ভেবেছিলেন ইরশাদের জীবনটা অগোছালো আর ময়ূখটাকেই দেখবেন গোছালো জীবনে। কিন্তু কি এক অজানা, উন্মাদ হাওয়ায় মোড় বদলে গেল ছেলে দুটোর জীবনের। ইরশাদকে দেখে অন্তর এখন প্রশান্তি পায় কিন্তু ময়ূখটার সাথে কেন এমন হলো! ক-ষ্ট পান ভেবে ভেবে কিন্তু কি করবেন সেটাও তো জানেন না।
চলবে