কি ছিলে আমার পর্ব -৩৭ (প্রথমাংশ)

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৭(১ম অংশ)

সফেদ কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যরশ্মি ছুঁয়ে গেছে হলদেটে মুখটাকে আদুরে স্পর্শে। সেই স্পর্শে নিভু নিভু চোখের পাতা কিছুটা সময় নিয়েই পুরোপুরি খুলতে পারল মৈত্রী। গাড়ির জানালায় মাথাটা এলিয়ে দিতে গিয়েও দিতে বাধা পেল শক্ত হাতের। পথ এখনো শেষ হয়নি! ভাবতেই চোখ ঝলসে গেল কাচরঙা রোদ্দুরে সবুজের সতেজতায়। ঘাড় ফিরিয়ে ইরশাদের হাতের ফাঁকে বাইরেটা দেখতে লাগল মুগ্ধ হয়ে। ট্যাক্সিটা চলছে উঁচু পথ ধরে আরও উঁচুতে। মৈত্রীর চোখে ধাঁধা লাগছে সে সত্যিই কি পাহাড়ি পথে আছে! আবার ফিরে তাকালো ইরশাদের দিকে৷ চওড়া আদলে সরু নাক, পুরু ঠোঁট, ঘুমন্ত চোখের পাতায় রোদ এসে মিলিয়ে যাচ্ছে আলতো করে। মানুষটা শেষ রাতেও সজাগ ছিল মৈত্রীকে বাহুতে ধরে। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে টের পেয়েছে সবটাই তবুও দূরের জার্নি তার স-হ্য হয়না বলেই মটকা মে-রে পড়েছিল মানুষটার বুকে, কাঁধে। ভয় ছিল এই বুঝি বমি হবে, এই বুঝি মাথা ঘুরিয়ে জ্ঞান হারাবে কিন্তু না তেমন কিছুই হয়নি৷ উল্টো এখন জেগে প্রকৃতির খোলসহীন রূপ দেখতেই সকল ক্লান্তি ফুরফুর করে পালিয়ে গেল কোথাও।

“স্যার চলে এসেছি এটাই রিশাদ স্যারের বাড়ি।”

ড্রাইভারের ডাকে মৈত্রী নড়েচড়ে উঠলো। ইরশাদের বুকে হাত রেখে আলতো ঝাকিয়ে ডেকে তুলল ইরশাদকে। দুজনে গাড়ি থেকে বের হতেই লোহার গেইটের বাইরেই একজন মোটামুটি বয়স্ক লোককে দেখতে পেল তারা। ড্রাইভার ততক্ষণে গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে রাখলো। ইরশাদ এগিয়ে এসে গেইটে ধাক্কা দিতেই লোকটি জানতে চাইলো সে গেইট ধাক্কাচ্ছে কেন?

“আমি ইরশাদ রাজশাহী থেকে এসেছি।রিশাদ রায়হানের বাড়িই তো এটা?”

ইরশাদের প্রশ্ন শেষ হতেই ড্রাইভার এগিয়ে এসে নিজেই বলল, “স্যারের আত্মীয় এনারা। এখানে থাকবেন কিছুদিন মালপত্র ভিতরে নিন।”

দারোয়ান এবং ড্রাইভার দুজনই একে অপরের পরিচিত এবং ইরশাদদের বাস স্টপেজে তাদের জন্য রিশাদই নিজের ড্রাইভারকে পাঠিয়েছিল। রিশাদ নিজে অ-সু-স্থ সেই সাথে বোনের বাচ্চা হয়েছে, তার স্ত্রী মেবিশেরও মায়ের কাছে থাকার ইচ্ছে সব মিলিয়ে তাকে আরও দু তিন দিন ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। তার যাতায়াত প্লেনে হওয়ায় গাড়িটি নিতে হয়নি৷

দারোয়ান আর ড্রাইভারের কথোপকথনের পর দুজনকে ভেতরে নেওয়া হলো। মিনিট কয়েকের মাঝেই ঘর খুলে দেওয়া হলো সবগুলোই। দারোয়ান নিজেই একজন পাহাড়ি ছেলেকে ডেকে তার বোনকে নিয়ে আসতে বলল। আনতুং পাহাড়ি নারী সে-ই বাড়ির নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার কাজ করত আজ মেহমান এসেছে শুনে চলে এলো তাদের প্রয়োজনেই।

পাহাড়ের গায়ে শুভ্ররঙা একতলা বাড়ি। চারপাশে ফুলের গাছ, পেছনের দিকটায় বিশাল খা-দ। আনতুং মেহমানদের জন্য দ্রুতই বাজারের লিস্ট তৈরি করল। রিশাদ স্যাররা এখানে থাকেন না বছর পেরিয়ে গেছে তবে স্যার প্রায়ই আসত। কিন্তু এখানে থাকতেন না বলে বাজার সদাই কিছুই রাখা হয় না। আনতুং অবশ্য মেবিশ মেডামের ফোনকল পেয়েছে কোন এক আত্মীয় নাকি বউ নিয়ে আসবে। সে শুনেছে যারা আসবে তারা নতুন বিবাহিত দম্পতি তাই বুঝতে বাকি নেই তারা নিরিবিলি জায়গায় কেন এসেছে। ইরশাদরা ঘরগুলো একে একে ভেতরে গিয়ে দেখছিল তখন আনতুং তাদের পাশে। করিডোরের মাঝামাঝি যে ঘরটা সেটাতে ঢুকতেই চোখে পড়ল খাটের পেছনে ওয়াল জুড়ে খুব বড় আকৃতির একটা ফটো। ফটোতে রিশাদ বসে আছে বালুর ওপর কোলের ওপর নির্জন আর তার পেছন থেকে কাঁধের উপর উঁকি দেওয়া মেহউইশের মুখটা। পেছনে বিশাল সমুদ্র আর অসীম আকাশ সব মিলিয়ে প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দরে ভরা একটি ফ্যামিলি ফটো। মৈত্রী অবাক হয়ে বলল, “এটা আপনার কাজিন আর তার বউ?”

“হু তাইতো মনে হচ্ছে।”

“কি!”

“রিশাদ ভাইয়ের বউ-ই মনে হচ্ছে।”

“মনে হবে কেন আপনি চেনেন না আপনার কাজিনের বউকে!” মৈত্রী ভীষণ অবাক হলো। ভাবল পাশে থাকা আনতুংকে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু না মহিলা বেরিয়ে গেছে আগেই। ইরশাদ বুঝতে পারলো তার স্ত্রীর বিষ্মিত অভিব্যক্তি তাই একটু পরিষ্কার করতেই বলল, “ভাইয়ের প্রথম স্ত্রীকে চিনতাম ওই যে বলেছিলাম সেদিন প্রেমিকের সাথে ভেগেছে!” মনে করিয়ে দেবার মত করে বলল ইরশাদ। তারপরই বলল, “ইনি সম্ভবত মেবিশবাসী ভাই পরে যাকে বিয়ে করল।”

“ভাইয়া আর ভাবী কিন্তু অন্নেক সুন্দর ৷ দুজনকেই একদম পার্ফেক্ট কাপল মনে হচ্ছে। কি চমৎকার করে হাসছে ভাবি আর ভাইয়ার ফিটনেস দেখে তো মনেই হচ্ছে না ইনি আপনার বড়।”

মৈত্রী তার স্বভাবসুলভ আচরণের বাইরে এসে যেন প্রশংসা করল ফটোর কাপল দুটোর। ইরশাদ ভ্রু জোড়া বক্র করে তাকালো মৈত্রীর দিকে।

“বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে বুড়ো বললে?”

মৈত্রীর থতমত খেয়ে গেল, “ককখন!”

“মাত্রই বললে। রিশাদ ভাই থার্টি প্লাস আর আমি আটাশ প্লাস। তোমার কথা শুনে মনে হলো ভাইকে কচি লাগছে আর আমাকে দেখতে একদম পঞ্চাশের আধবুড়া লাগছে।” আপত্তি তুলতেই যেন কথাটা বলল ইরশাদ। তারপরই মনে হলো বউকে একটু ক্ষে-পা-তে পারলে ভালো হয় তাই ফট করে বলে ফেলল, “তবে যাই বলো তারা কাপল কিন্তু দারুণ। নির্জনের আম্মু পালিয়ে না গেলে এত কিউট ভাবী পাওয়া হতো না। ইশ কি যে গলুমলু লাগছে ভাবীকে! ভাবীর চোখ আর গালদুটো…. ” কথা সম্পূর্ণ করার আগেই মৈত্রী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

“এ্যাই মৈত্রী কোথায় যাচ্ছো?”

“এ ঘরে থাকব না৷ ওপাশে রান্নাঘরের পাশেরটাতে থাকব আমি।”

বউ ক্ষেপেছে ; এখন আর চাইলেও ফাজলামো চলবে না তাই ইরশাদও ব্যাগ নিয়ে চলে গেল পাশের ঘরটায়। ভোরের আলোয় চারপাশ ধুয়েমুছে চকচকে হয়ে উঠেছে তবুও গাছের ডালের ফাঁকফোকরে এখনও কুয়াশার অস্তিত্ব৷ মৈত্রী রুমে ঢুকে পরিপাটি বিছানা দেখতেই গায়ের জ্যাকেট খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাতের জার্নিতে ঘুম হলেও শরীরে একটা ম্যাজম্যাজে ভাব। ইরশাদও তাই গায়ের শার্ট,ব্লেজার খুলে টি শার্ট পরল। বাইরে এসে দারোয়ানকে ডেকে জানিয়ে দিলো তারা একটু রেস্ট করবে। আনতুং এলে বাজারসদাই রেখে যায়। রান্নাটা তারা নিজেই করবে। ইরশাদও এবার রুমে ঢুকতে যাচ্ছিল অন্য ঘরগুলো খুলে রাখা তাই নিজ দ্বায়িত্বে সেগুলো লক করে রুমে এসে মৈত্রীর পাশে শুয়ে পড়ল।

ভালোবাসা না থাকলেও সম্পর্কের দোহাই দিয়েই মনুষ্যজাতি এক্সপেক্টেশন রাখতে পছন্দ করে। প্রিয় মানুষ না কাছের আর আপন মানুষের কাছ থেকেও প্রায়োরিটি পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্খা কেবল মানুষই রাখতে জানে। আর তার দায়ভার সম্পূর্ণ মানুষের ভেতরকার মনটার। ময়ূখের যেখানে শেষরাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে পৌঁছুলো ঠিক আট ঘন্টা লেট। ট্রানজিটে লাগা বাড়তি সময়ের জন্যই এত বিলম্ব হওয়া। তবুও সে সোশ্যাল নেটওয়ার্কির বদৌলত নোরাকে জানানো হয়েছিল সেটা কিন্তু মেয়েটা আসেনি এয়ারপোর্টে। ময়ূখের কাছে নোরার এড্রেস আছে, আছে নোরার মা শাইনের ঠিকানাও। চাইলেই সে ট্যাক্সি করে চলে যেতে পারে তবুও অবচেতন মন খুঁজছে নোরাকে। কিছু সময় চুপচাপ সে ব্যাগপ্যাক এ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায় স্থির হয়ে তারপরই মনে হলো এই দাঁড়িয়ে থাকা, নোরার অপেক্ষা করা অযথা। সে যখন জানিয়েছিল ট্রানজিট টাইম তখন নোরা বলল, ” হোয়াট! ইট’স টু লেট ময়ূখ এন্ড দ্যাট টাইম আই হ্যাভ আ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস৷”

ময়ূখ জবাব ‘ওহ’ বলতেই নোরা বলে দিল এড্রেস তো আছেই তুমি ট্যাক্সি করে চলে আসো। তোমার কাছে পাউন্ডস আছে নিশ্চয়ই!

কারেন্সি চেঞ্জ করাই আছে তার কাছে, এড্রেসও আছে তবুও মন চাইছিল যার জন্য আসা সেই না হয় নিয়ে যেত! কিছুটা সময় মিথ্যে অপেক্ষায় সময় কা-টে এরপরই ময়ূখ এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ডাকে। ফোন বের করে হোয়াটসঅ্যাপ থাকা লোকেশন বলল৷ হঠাৎই পেছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ, “ময়ূখ!”

কণ্ঠটা ঠিক ঠিক শুনে কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো ময়ূখ। পেছনে ফিরে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে না তাই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নোরা নিজেই এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলো৷ এবার আর কাল বিলম্ব না করে ফিরে তাকায় ময়ূখ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নোরা জাপটে ধরে ময়ূখকে। নির্বিঘ্নে ঠোঁটে চুমু খেল। এক, দুই করে কে-টে গেছে কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট খানেক সময়। দুজনের সেই লম্বা চুমুতে বিরতি পড়লো ট্যাক্সি ড্রাইভারের ডাকে। ময়ূখ কিছু বলার আগে নোরাই ট্যাক্সিওয়ালাকে না করে দিল। নোরার নিজের গাড়ি আছে তাতে করেই দুজন রওনা হলো নোরার ফ্ল্যাটে।

চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here