কুঁড়েঘর ২ পর্ব – ০১

#কুঁড়েঘর ২
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ১৭। (০১)

বর্ষামুখর সময় তাই আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাসও হচ্ছে প্রচুর। এমন আবহাওয়াও যেনো মানুষের গায়ে না লাগার মতোই। সবাই যার যার কাজের জন্য ছুটছে। যেনো একদিন কাজ না করলেই অনেক ক্ষতি হবে তাদের।
কফি শপের ভেতর থেকে থাই গ্লাস দিয়ে বাইরের সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। রিধিশা চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আজকে ভার্সিটিতে বন্ধ দিতে হয়েছে বাবার ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য। এই দুপুরে সময় দিয়েছে তাই রিধিশা কিছুটা বিরক্ত। টিউশনি শেষ হয়ে যাওয়ায় রিধিশা সময়ের আগেই এসে পড়েছে কফিশপে। ছেলেকে রিধিশা দেখেনি নাম্বারও নেয়নি মায়ের থেকে। মায়ের মাধ্যমে কফিশপের নাম জানিয়েছে শুধু।

রিধিশা এক ধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভেতরে তো কতো শতো মানুষই রয়েছে তাদের দেখে আর কি করবে?
থাই গ্লাস ঠেলে একটা যুবককে কফিশপের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে রিধিশা চোখ সরিয়ে নিলো নাহলে খারাপও ভাবতে পারে।
যুবকটা কফিশপের টেবিলগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নাহ! তার কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে দেখতে পায়নি। সামনের টেবিলে একা একজনকে বসে থাকতে দেখে সেদিকেই এগিয়ে যায়। সামনে গিয়েই চেহারা দেখে আলতো হেসে সালাম দেয়।

রিধিশা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে খেয়াল আসতেই হরবরিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যুবকটি আলতো হেসে বললো
” আমি মাহিন শেখ। আপনি রিধিশা তাই না!” রিধিশা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললো
” জী, আপনি… বসুন!” মাহিন চেয়ার টেনে হেসে বসতে বসতে বললো
” আপনিও বসুন! আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে নেই!” রিধিশা চুপচাপ বসে পড়লো। মাহিন আলতো হেসে বললো
” কখন এসেছেন? আমি কি বেশি দেড়ি করে ফেলেছি!”
” নাহ। আসলে আমিই একটু জলদি এসে পরেছিলাম আরকি!”

মাহিন রিধিশার কথায় আবারও হাসলো, বললো
” তাহলে তো মনে হচ্ছে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাড়া ছিলো আপনার।” মাহিনের কথা শুনে রিধিশা লজ্জা পেয়ে যায়। রিধিশার তো ভুলেও তাড়া ছিলো না। রিধিশা নিচু স্বরে বললো
” নাহ তেমন কিছু নয়। ভেবেছিলাম ট্রাফিক থাকলে অনেক লেট হয়ে যাবে তাই আগে বের হয়েছিলাম কিন্তু আজ ট্রাফিক ছিলো না।” মাহিন হেসে বললো
” তাহলে তো আপনার আগে আসাটা তেমন কাজে দিলো না। তবে আপনার পাংচুয়ালিটি দেখে পছন্দ হয়েছে আমার। আচ্ছা তো কি অর্ডার করবো আপনার জন্য?”
” কফিশপে এসেছি কফি তো প্রয়োজন।” মাহিন হেসে মাথা নাড়ায়। ওয়েটারকে ডেকে ২কাপ কফি সহ কিছু স্ন্যাক্স অর্ডার করে।

রিধিশা মাহিনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। তাকিয়ে থাকতেও অস্বস্তি হচ্ছে আবার না তাকালেও নয়। তবে মাহিনের ঠোঁটের কোণে হাসিটা পার্মানেন্ট মনে হচ্ছে রিধিশার। হেসেই যাচ্ছে ছেলেটা। কথা না বললেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। মাহিন গলা ঝেড়ে বললো
“সেইদিন আপনাদের বাড়িতে যেই উদ্দেশ্যে যাওয়া হয়েছিলো সেই কাজটাই পূরণ হয়নি। আপনাকেই কেউ দেখতে পায়নি সামনাসামনি।”
রিধিশা আলতো হেসে নিচু স্বরে বললো
” সত্যি কথা বলতে তো আমার অজান্তে এসব হয়েছে। আমি জানতাম না এসব বিষয়ে তাই আমি কিছু করতে পারিনি।”
মাহিন মাথা নেড়ে বললো
” তা তো বুঝতেই পারছি। তাহলে মিস রিধিশা কিছু জানতে চান আমার ব্যাপারে?” রিধিশা একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে বললো
” আপনার ব্যাপারে জানার মতো কিছুই শুনিনি তবে বলতে চাইলে বলতে পারেন।” ওয়েটার রিধিশাদের কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে যায়। মাহিন রিধিশাকে কফি মগ এগিয়ে নিজেও একটা নিলো।

মাহিন আলতো হেসে বলতে থাকে
” আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কয়েকমাস ধরে বাবা, মায়ের বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে তাই আমিও ভাবছি একা থেকে আর কি লাভ বাবা-যখন বলছে তাহলে বিয়েটা করে ফেলি। পরিবারে আমার মা-বাবা বড় আপু আর ছোট বোন রয়েছে। আপুর বিয়ে হয়েছে তাই শশুড় বাড়িতে থাকে। আর আমাদের ঢাকা নিজস্ব বাড়ি হয়েছে সেখানে থাকি। আম্মু তার যতো ধরনের আত্মীয় ছিলো তাদের সবাইকে মেয়ে খুজতে বলেছিলো। তারপর আপনার খোঁজ পেয়ে গ্রামে ছুটে গিয়েছে। মা-বাবার আপনার ছবি দেখে খুব পছন্দ হয়েছে আপনাকে তাই।”
রিধিশা কফি খেতে খেতে মাহিনের কথা শুনছে বোবার মতো। তবে নিজে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাহিন হেসে বললো
” আর একটা কথা ক্লিয়ার করিনি। আমি কিন্তু অতো সাধু ছেলে না। একটা মেয়ের সঙ্গে রিলেশন ছিলো আমার। ভালোবাসাও ছিলো দুজনের মাঝে তবে কিছু
সম্পর্ক হয় না! খুব বেশি ভালোবাসা থাকলেও সম্পর্কে ইতি পড়ে যায় কোনো কারণে! আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে নিয়ে খুব বেশি ওভার পসেসিভ ছিলো যার কারণে শেষ সময়টাতে খুব বেশি ঝগড়া হতো শেষে সম্পর্কটাই শেষ হয়ে গেলো আমাদের। গত ছয় মাসে যোগাযোগ নেই আমাদের।”

রিধিশা মাহিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
” তাকে খুব ভালোবাসেন এখনও?”
মাহিন হাসলো তবে এই হাসিটা বাকি হাসিগুলোর মতো ছিলো না।
” আমার মতে প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলা যায় না।
এখনও খুব ভালোবাসি। তবে আমার বিয়ের পর আমি আমার স্ত্রীকে ছাড়া অন্য কোনো নারীকে ভালোবাসবো না। প্রথম ভালোবাসা মনের এক কোণে লুকিয়ে থাকবে আর আমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য ভালোবাসা আমার পুরো মন জুড়ে থাকবে।” রিধিশা আলতো হাসলো।
মাহিন হেসে বললো
” এবার আপনার বিষয়েও বলুন! তখন থেকে তো আমার পরিচয়ই জেনে যাচ্ছেন!”
রিধিশা হেসে বললো
” আমার তেমন কোনো পরিচয় হয়নি তাই স্পেশাল কিছু তো বলতে পারছি না। আমি সাধারণ একজন স্টুডেন্ট। ঢাকা একাই থাকি পড়াশোনার জন্য। পরিবারে মা-বাবা আর তাদের একমাত্র মেয়ে আমি রিধিশা। আর….আর জানার মতো তেমন কিছু নেই তবে থাকলে এমনি জেনে যাবেন।”
মাহিন কফিতে চুমুক দিয়ে বললো
” আপনার সোজা সাপটা কথা গুলো ভালো লাগছে।
রিধিশা মাথা নিচু করে আলতো হাসলো। দুজন টুকটাক কথা বলতে থাকে।

কফির শেষ চুমুক দিয়ে মাহিন বললো
” তো রিধিশা ম্যাডাম আপনার মতামত কি বিয়ে নিয়ে?” রিধিশা হাত কচলাতে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। রিধিশা আরো ভাবতে চায় তাই কনফিউজড হয়ে গিয়েছে। মাহিন বুঝতে পেরে হেসে বললো
” সমস্যা নেই আপনার ভাবার জন্য সময় লাগলে অনেক সময় নিতে পারেন। আমি উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো। তবে আমার মতামতটা জানিয়ে দেই! আমার আপনাকে বিয়ে করতে কোনো প্রকার বাধা বা আপত্তি নেই। তবে দুজন ব্যাক্তির মাঝে একটা সম্পর্ক তৈরি হবে তাই দুজনের মতামত থাকা প্রয়োজন। আমার থেকে ৫০% মতামত রইলো আর আপনার থেকে ৫০% মতামত আসলেই এই সম্পর্ক তৈরি হবে।” রিধিশা মুচকি হাসি দিলো।

মাহিন হেসে বললো
” তবে হ্যা! আপনার সাথে কথা বলে খুবই ভালো লেগেছে। যদিও এতো সময়ে মনে হয়েছে আপনি কম কথা বলেন। তবে আই লাইক ইট।” রিধিশা হেসে বললো
” তাহলে তো আমার থেকেও আপনাকে একটা কমপ্লিমেন্ট দেওয়া উচিত তবে… আজ নাহয় দিলাম না।”
মাহিন কিছুটা জোড়েই হেসে দেয় রিধিশাও আলতো হাসলো। কফিশপ থেকে বেরিয়ে মাহিন বললো
” আপনাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসছি চলুন!”
রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” নাহ তার দরকার হবে না। আমি চলে যাবো।”
দুজন বিদায় নিয়ে রাস্তার দু দিকে নিজেদের গন্তব্যে রওনা দেয়।

_________

নিশাদ রাগে টগবগ করে আগুনের মতো ফুঁসছে। অকারণেই এই রাগ। পরীক্ষা শেষ করে বটগাছের নিচে বসে ছিলো। সেই কখন থেকে বসে ছিলো সে! প্রায় ৩ঘন্টা হতে চললো সে রিধিশার জন্য অপেক্ষা করেছে। গতকালকে রান্না করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছিলো নিশাদ কিন্তু রিধিশার তো কোনো দেখাই নেই। রেহানকে দিয়ে জোতির কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে ম্যাডাম নাকি লাপাত্তা। নিশাদ এতোক্ষণ চিন্তা করলেও সেটা এখন রাগে পরিণত হয়েছে। সূর্য নিশাদকে বললো
” নিশাদ ভাই শান্ত হয়ে বস তো! এতো রাগার তো কিছু দেখছি না আমি। হয়তো কাজে গিয়েছে কোনো। তুই তো ধন্যবাদ পরেও দিতে পারবি।”
নিশাদ রেগে পাইচারি করতে করতে বললো
” কেনো পরে বলবো? আমার যখন ইচ্ছে তখন বলবো আমি। নিশাদ তোদের জন্য ছাড়া আর কখনো
কারো জন্য এতো সময় ধরে অপেক্ষা করেছি আর এই মেয়ের জন্য কিনা টানা ৩ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছে আমাকে!” সাদি ভ্রু কুঁচকে বললো
” রিধিশা কি জানতো তুই ওর জন্য অপেক্ষা করবি? নাকি আগে থেকে জানিয়েছিস তুই? একটা মানুষের কতো কাজই তো থাকতে পারবে।”
রেহান নিশাদের সাথে হাটতে শুরু করে। পেছনে হাত দিয়ে বয়স্কদের মতো ভাবতে ভাবতে বললো
” নিশাদ আমার তোর চাল চলন একদমই সুবিধার লাগছে না বাছা! তা তুই কি রিধিশার প্রেমে পড়েছিস?”

নিশাদ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় রেহানের দিকে। রেহান ঢোক গিলে দৌঁড়ে গিয়ে সূর্যর পাশে বসে পড়ে। নিশাদ রাগি গলায় বললো
” আমি অনেক ভালো সাতার জানি তাই কোথাও পড়ার প্রশ্ন উঠে না। তোদের কতোবার বলেছি এই কথা বারবার আমার কানে তুলবি না!”
সূর্য মুখ টিপে হেসে বললো
” দেশের বড় বড় রাজা, বাদশা, সাতারকারি রাও অনেক ভালো সাতার জানার পরও প্রেমের নদীতে পড়লে সাতার কেটে উঠতে পারে না। সেখানে তুই নতুন একজন সদস্য যে কিনা প্রেমের নদীতে পা দিয়েছিস।”
নিশাদ এবার হনহন পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে সেখান থেকে খালি মদের বোতল এনে তেড়ে আসে সূর্যকে মাড়তে। সূর্য উঠে কোনো রকমে নিশাদের সামনে থেকে পালালো। সাথে বাকি দুজনও তাদের মারবে সেই ভয়ে দৌঁড়ে পালায়।
নিশাদ ধুমধাম শব্দ করে মাথা ঠান্ডা করতে শাওয়ার নিতে গেলো।

রিধিশা সন্ধ্যার আযানের পর বাসায় ফিরছে। সব টিউশনি শেষ করে মাত্রই বাসায় ফিরছে। শরীর যেনো চলছেই না। ঘুমে রাস্তাতেই এলোমেলো পথে হাটছে।
রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” কফিশপে আগে গিয়েই ভুল করেছি। না গিয়ে একটু ঘুমালেও এখন এতো ঘুম পেতো না। কফিশপে এতো সময় বসেই অর্ধেক দিন কাটিয়ে দিয়েছি। আমার মতো গর্দভ আর নেই।”
” তা তো নেই সেটার প্রমাণ অনেক আগেই পেয়েছি আমি। তবে বুঝতে পারছি না তুমি কি করে বুঝলে যে তুমি গর্দভ!” রিধিশা পেছনে উঁকি দিয়ে নিশাদকে দেখে। পা চালিয়ে নিশাদের সামনে এসে রাগি গলায় বললো
” কি বললেন আপনি? আপনি আমাকে গর্দভ বলার সাহস কোথায় পেয়েছেন?” নিশাদ চোখ ছোট ছোট করে বললো
” আমি কখন বললাম? তুমি তো নিজেই বললে যে তোমার মতো গর্দভ আর নেই।” রিধিশা তেজি গলায় বললো
” আমার নিজেকে যা ইচ্ছের তাই বলবো আমি। কিন্তু আপনি বলবেন কেনো?” নিশাদ রিধিশার দিকে ঝুকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” কেনো বলবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো? কোথায় ছিলে সারাদিন আগে সেটা বলো। তোমার মতো বজ্জাত মেয়ে একটাও দেখিনি।”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here