কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব -১৮

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী

দেখতে দেখতে কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। সেদিনের পর থেকে শহিদ আহমেদ তার ছেলের সামনে যাওয়া বন্ধ করেছেন। ছেলের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই।

কান্তা কয়দিন থেকে নিজের মত রান্না করছে। কারো সাথে তেমন একটা কথা বলছেনা। সবাইকে এড়িয়ে চলছে। ও অনেক চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক হওয়ার, কিন্তু পারছেনা। এমনকি শহিদ আহমেদের সাথেও খুব একটা কথা বলছেনা।
এদিকে রশিদ বেগ বেশ বুঝতে পারছে এই সংসারে ভাঙ্গনের সুর বেজেছে। বহু বছর যাবৎ এই বাড়িতে থাকায়, সে এই সংসারেরই একজন হয়ে গেছে । আরমান, কান্তা কিংবা শহিদ আহমেদের নিরবতা তাকে ভিষণভাবে পো’ড়া’চ্ছে।
আরমানকে সেই ছোটবেলা থেকেই রশিদ বেগ দেখে আসছে। শান্ত, নম্র এই ছেলেটার ওপর আলাদা টান আছে তার। আরমানও তাকে বেশ মানে। অথচ সেই আরমান গত কয়েকদিন থেকে তার সাথে কথা বলছেনা, তাকে এড়িয়ে চলছে। এ নিয়ে সে ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই বিষয়ে আরমানের সাথে কথা বলতে হবে।

আরমান কয়েকদিন থেকে হন্যে হয়ে বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেহেতু তার অনুপস্থিতিতে কান্তা বাসায় একা থাকবে, সেহেতু তার প্রয়োজন নিরাপদ একটা বাসা।
আজও ভার্সিটি শেষে বের হয় বাসা খুঁজতে।
বাসাটা মোটামুটি অভিজাত এলাকায়। সিকিউরিটি সিস্টেমও বেশ ভালো। সবদিক দিয়েই বাসাটা ওর পছন্দ হয়।
বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে এগ্রিমেন্টে সাইন করে। আগামী পরশুই ওরা নতুন বাসায় শিফট করবে।
এরপর চলে যায় কোচিং-এ।

আজ দু’জনে একসাথে বাসায় ফিরে। আরমান আজ আগেই বেরিয়ে এসেছে। আগামী কয়েকদিন ওকে ব্যস্ত থাকতে হবে।

পরদিন সকালে ভার্সিটিতে যেয়ে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাসায় আসে। কান্তাকে সাথে নিয়ে গোছগাছ শুরু করে। শ্রীজা ছাড়া কেউই জানেনা ওদের বাড়ি ছাড়ার কথা। বিকেলের মধ্যেই গোছগাছ শেষ করে আরমান বাইরে যায়। মালামাল বহন করার জন্য ট্রাক ভাড়া করতে হবে।

রাতে আরমান বাসায় আসলে রশিদ বেগ তাকে কথা বলার জন্য ডাক দেয়। তার কাছে গেলে, সে আরমানকে নিয়ে বাগানে যায়।

” বাবা আরমান, তুমি আমার কাছে আগে যেমন ছোট্টটি ছিলে, এখনও ঠিক তেমনটিই আছ। আমার কোন পরিবার না থাকায় তোমাদের এখানেই বছরের পর বছর ধরে থেকে গেলাম। সেই সুবাদে এই বাড়ির সবার সম্পর্কেই আমার একটুআধটু ধারনা আছে। তুমি এখানে কতটা সাফার করেছ বা এখন অব্দি করছ তা আমি ভালো করেই জানি। এ নিয়ে তোমার বাবার সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। কিন্তু সে চিরটাকাল অন্ধই থেকে গেল। তাকে বোঝাতে আর পারলামনা। কিন্তু তাই বলে তোমার ভেঙে পরলে চলবেনা। এ বাড়িতে তোমাকে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি এটাও জানি প্রতি পদক্ষেপেই তোমাকে বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে। তাই বলে তোমাকে পিছিয়ে গেলে চলবেনা। আমার ফুপু আর বোন মিলে তোমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করবে, এটাও আমি জানি। তারা আজও নিজেদের শোধরাতে পারলনা। তবে মনে রেখ, যেকোন পরিস্থিতিতেই আমি তোমার পাশে থাকব। তুমি তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন করে লড়াই শুরু কর। ”

” যেখানে অধিকার জোড় করে ছিনিয়ে নেয়া হয়, সেখানে মাথা খুঁটে ম’র’লেও অধিকার পাওয়া যায়না। আর তাছাড়া অধিকারের লড়াইয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। আপনি আমার জন্য এতটা ভেবেছেন এজন্য ধন্যবাদ। চাচা, এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগছেনা। আমি ভিষণ ক্লান্ত। ” আরমান আর সেখানে দাঁড়ায়না। সোজা রুমে চলে আসে।

বাসায় আসার পথে আরমান তিনজনের জন্য খাবার এনেছে। আজ এই বাসায় ওদের শেষ রাত। হয়তো আর কখনোই এখানে ওর আসা হবেনা। তাই ও শ্রীজাকে সাথে নিয়ে এই বাসায় শেষ খাবার খাবে।
রুমে এসে শ্রীজাকে ফোন করে তার রুমে ডাকে আরমান।
ভাইয়ের ফোন পেয়েই সাথে সাথে তার রুমে আসে শ্রীজা।
রুমটায় এসেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। তাদের প্যাকিং শেষ!

আরমান, কান্তা দু’জন কেউই আজ রাতে ডাইনিং রুমে খেতে আসেনি, এই বিষয়টা আকলিমা খানম এবং রাজিয়া খানম ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে, কিন্তু এতে তাদের কিছুই যায় আসেনা। তারা খাবার সময় শ্রীজাকে ডাক দিলে শ্রীজা জানায় ওর ক্ষুধা নেই।
এরপর বাসার সবাই মিলে খেয়ে নেয়।

আরমান ফ্রেশ হয়ে আসলে ওরা তিনজন মিলে খাবার খায়। এরপর অনেকক্ষণ যাবৎ আড্ডা দেয়। রাত বাড়লে শ্রীজা নিজ রুমে ফিরে যায়।

প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম থেকে ওঠার খানিক পরেই কান্তা রান্নাঘরে যায়না। আরমান ওকে গতরাতেই নিষেধ করেছিল রান্নাঘরে যেতে।
টুকিটাকি যেসব গোছগাছ বাকি ছিল সেগুলো সেড়ে নেয় দুজন মিলে।

শহিদ আহমেদ বেশ কিছুক্ষণ যাবং ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। নাস্তা করে তিনি বেরিয়ে যাবেন।

কান্তা আজ রান্নাঘরে না আসায় খালা নিজ থেকেই নাস্তা তৈরি করে। এরপর শহিদ আহমেদ সামনে সেগুলো পরিবেশন করে।

” খাদিজা, বউমাকে দেখছিনা যে? সে কি আজ রান্নাঘরে আসেনি? ”

” নতুন বউয়ে আইজ ঘর থাইকা বাইর হয়নাই, ভাই। হের মনে কয় আইজ ঘুম ভাঙ্গেনাই। আপনে এহন এইগুলাই খান। রাইতে নতুন বউয়ের হাতের রান্দন খাইয়েন। ”

খাদিজার কথা শুনে শহিদ আহমেদ চুপচাপ খেয়ে নেন। খাওয়া শেষ করেই তিনি অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে কয়েকবার তিনি আরমানের রুমের দরজার দিকে তাকিয়েছেন। আজকে তার মন কেমন কেমন করছে। ছেলেটাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। গত কয়েকদিন তিনি আরমানের মুখোমুখি হননি। ছেলেটাকে একটিবারের জন্যও তিনি দেখতে পাননি। আজকে তার মন বড্ড উচাটন করছে। বারবার তার মনে হচ্ছে, তিনি কিছু একটা হারাতে চলেছেন।
বেশ কয়েকবার আরমানের রুমের দরজার দিকে তাকানোর পরও যখন ছেলের দেখা পেলেননা, তখন তিনি বাধ্য হয়েই অফিসে রওনা দিলেন৷

সকাল দশটায় ট্রাক চলে আসে। আরমান আগেই কয়েকজন লোককে বলে রেখেছিল, মালামাল গাড়িতে উঠানোর জন্য। তারাও এসে গেছে।

হঠাৎই বাসায় এত লোকজন দেখে আকলিমা খানম বিরক্ত হয়।
আরমান তখন তিনজন ছেলেকে নিয়ে রুমে যাচ্ছিল।

” তুমি কি আমার বাসাটাকে ধর্মশালা পেয়েছ? যাকে তাকে এসে বাসায় ঢোকাচ্ছ! তুমি কি আমার কাছ থেকে হুকুম নিয়ে বাসায় মানুষ ঢুকিয়েছ? আমার বাসায় কে আসবে না আসবে সেটা বুঝব আমি। তোমাকে এসব বিষয়ে কোন অধিকার দেয়া হয়নি। নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা কর। সীমা ছাড়ালে পরিনতি ভালো হবেনা। ” আকলিমা খানমের চোখেমুখে ক্রো’ধ উপচে পড়ছে।

” আমি সীমার মধ্যেই আছি, থাকি এবং থাকার চেষ্টা করি। আপনার আমাকে নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। এখনই যদি এতসব চিন্তা করে শরীরে রোগ বাঁধান তবে বাকিটা জীবন কি করে চলবেন! সামনের দিনগুলোতে আপনার চিন্তার শেষ থাকবেনা। ” আরমান এতটুকু বলেই ছেলেদের নিয়ে রুমে আসে।

ছেলেগুলো অবাক হয়ে যায় আকলিমা খানমের কথা শুনে।

রাজিয়া খানম সোফায় বসে চা পান করছিল।
সেসময় আরমানের রুম থেকে কয়েকজনকে আলমিরা বের করতে দেখে অবাক হয়। ঘটনা কি ঘটছে তা জানার জন্য উসখুস করতে থাকে।
এরপর লোকগুলোকে একে একে খাট, ড্রেসিং টেবিল, রিডিং টেবিল, বুকশেলফসহ আরমানের রুমের সকল ফার্নিচার বের করতে দেখে সে মোটামুটি শিওর হয়ে যায়, আরমান বাসা ছাড়ছে। সে ইশারায় আকলিমা খানমকে কাছে ডাকে।

একে একে সবকিছু ট্রাকে উঠানো হলে কান্তা ও আরমান রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কান্তা একটৃ আগেই বেরিয়েছে।
আরমান দরজার কাছে এসে শেষ বারের মত ফিরে তাকায় তার এত বছরের একাকিত্বের সাক্ষী রুমটার দিকে। এক পা দু পা করে রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। এরপর ধীর পায়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে রুমের প্রতিটি দেয়াল।
আজ থেকে এ বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক ঘুচবে। মায়ের ছোঁয়া আর পাওয়া হয়ে উঠবেনা। এতদিন এত অনাদরের পরও এই বাড়িটার প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোন, প্রতিটি ইটের মাঝে ও মা মা গন্ধ পেত। আজ থেকে আর সেই গন্ধ ওর নাকে আসবেনা। বাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে ওর মায়ের সকল স্মৃতি, যা এই বাড়ির বাতাসে মিশে আছে তার সবকিছুই ছেড়ে যাচ্ছে।
একফোঁটা পানি টুপ করে ঝরে পরে চোখের কোন বেয়ে।
নিজেকে সামলে নিয়ে সকল স্মৃতি পেছনে ফেলে নিজ গন্তব্যে পা বাড়ায় আরমান।

তখনও ড্রয়িংরুমে আকলিমা খানম বিরক্ত রাজিয়া খানম ঠাঁয় বসা।
শ্রীজা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
খালা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরমান এসে দাঁড়ায় তার সামনে।

” খালা, আজ থেকে এ বাড়ির সাথে আমার সকল সম্পর্ক ঘুচল। কিন্তু তোমার সাথে আমার সম্পর্ক চিরকালের। তাই আমি যেদিন তোমাকে আমার কাছে ডাকব, সেদিনই সবকিছু ফেলে আমার কাছে তোমাকে যেতে হবে। তুমি তৈরি থেক। আর তোমার ভাইকে বলে দিও, তার সকল মাথা ব্যথার কারন, বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে। কোনদিনও আমি এ বাড়ির ত্রী সীমানা মাড়াবোনা। তিনি যেন তার স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ভালো থাকেন। ভালো থেক আমার আরেক মা। ”
আরমানের কথা শুনে খালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সে আজ কথা বলার ভাষা হারিয়েছে।

” শ্রীজু, আমরা আসছি। ভালো থাকিস। ” শ্রীজা নিশ্চুপ।

” আপনারাও ভালো থাকবেন। জানি কখনও আমার জন্য দোয়া করবেননা। কিন্তু তাই বলে কখনও অ’ভি’শা’প দিয়েননা। ”
আরমান সোজা বেরিয়ে যায়।

এরপর কান্তা একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here