কুসুমিত কামিনী পর্ব -০৩

#কুসুমিত_কামিনী ( ৩)
#রেহানা_পুতুল
জান্নাত স্তব্দ হয়ে গেল এত নিকৃষ্ট একটি বিশেষণের তকমা তার কপালে জুড়ল বলে। বিমূঢ় নয়নে চেয়ে রইলো মাহতিমের দিকে। বুকের ভিতর একশো দোযখের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রলম্ভিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

” দূর থেকে কারো সম্পর্কে না জেনে আন্দাজে কিছু বলা মূর্খতার পরিচয় বহন করে মাত্র।”

শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায়না। তেমনি এসব লজিক দেখিয়েও সত্য আড়াল করা যায়না। ভ্রুকুটি করে বলল মাহতিম।

আমার সম্পর্কে আপনার ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল।

” সব জানা সবসময় যেমন সত্যি নয়। তেমনি সব দেখাও সব সময় সত্যি নয়। সেই জানা ও দেখার মাঝেও আরো নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে থাকে। ”

দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। এত দর্শন শোনাতে হবেনা আমাকে।

জান্নাত নিজেকে মাহতিমের দৃষ্টির অগোচরে নিয়ে গেল রুমের ভিতরে। বিছানার চাদর খামচে ধরে দলাই মলাই করে এক করে ফেলল। মাহতিমের তখন আবারও মনে পড়ে গেল সেই কথাগুলো। যেমনটি মনে পড়েছে কবুল বলার পরে জান্নাতকে দেখেই। তারপরেই সে উম্মাদ হয়ে যায়। ঘৃণায় তার বমি আসার উপক্রম হয়েছে৷ সারারাত ছাদে কাটিয়েছে ম’ দ গিলে গিলে। শেষরাতে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে বাসায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে।

কয়েকমাস আগে জান্নাতকে যেই দুটো ছেলের হাত থেকে রক্ষা করেছে সে। তার দুইদিন পর সেই দুটো ছেলের একটার সাথে মাহতিমের আবারও দেখা হয়। সেই ছেলেটা নিজ থেকেই এগিয়ে এলো মাহতিমকে দেখে। প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল,
ভাই সেদিনতো আমাদেরকে চড় থাপ্পড় দিয়ে নাকমুখ লাল করে দিলেন। যেই মেয়েটাকে রক্ষা করলেন আমাদের হাত থেকে। সে নিজেই সেধে সেধে বহু পুরুষের বি’ ছা’ না’ য় যায়। তখন আমরা দুই বন্ধু চিন্তা করলাম, ওতো এমনি। আমরাও মজা লুটি একদিন। বুঝলেন ভাই বোরকার আড়ালে এমন সুন্দরী মেয়েরা শরীর বেচাকেনা করে। এরা মুখোশধারী। এরা দেহ পসারিণী।

তোমার কথা বিশ্বাস করিনা আমি। তোমরা নিজেরাই নষ্ট আর পথভ্রষ্ট বলে এমন পর্দানশীল নিষ্পাপ মেয়েকে নিয়ে হীন মন্তব্য করছ। আক্রোশের সাথে বলল মাহতিম।

ভাই প্রমাণ আপনি স্বচক্ষে দেখবেন। পরশু ঠিক সন্ধ্যা ছুইঁ ছুইঁ সময়ে এখানে আসবেন। আমি নিয়ে যাব সেখানে আপনাকে। তখন দেখবেন।

এরপর মাহতিম ঠিক সময়ে সেখানে যায় সেই ছেলের সাথে। এবং দেখে সত্যি সত্যি জান্নাত নামের এই মেয়েটা একটি নিষিদ্ধ পল্লীর চিপা গলির ভিতরে ঢুকে গেল। বের হয়ে এলো একঘন্টা পর। তখন নিজের চোখকে তার অবিশ্বাস করার আর কোন সুযোগই রইলনা। তার দুকান অগ্নী চুল্লীর ন্যায় তপ্ত হয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল।

ভাবনা শেষে মাহতিম আরেকটি মাটির টব আছড়ে ভেঙ্গে ফেলে। সেই আওয়াজ কর্ণকুহরে যেতেই জান্নাত কেঁপে উঠল ছোট্ট শিশুর মতো।

এবার জান্নাত ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বাথটাবের পাড়ে পা উঠিয়ে বসে পড়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে। ডুব দেয় তার অনাহূত জীবনের সূদুর অতীতে।

_______

হেমন্তের আকাশে সেদিন ঝলমলে সোনা রোদ ছিল। সেই কমলা রঙের রোদে ভীষণ মায়া ছিল। গর্ভ যন্ত্রণা নিয়েও মধুলতা কলতলায় এসেছে মাটির জগটা ভরে নেওয়ার জন্য। তা তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। মাথা তুলে কলপাড় ঘেঁষা চিরহরিৎ কামিনী বৃক্ষটার উপরে নজর বুলায়। অজস্র শুভ্র রঙা কুসুমিত কামিনী ফুল ফুটে আছে। তার কোমল স্নিগ্ধ সুরভিতে চারপাশ সুবাসিত হয়ে আছে। মাটির বুকেও ঝরে পড়ে আছে অজস্র কামিনী ফুল।

প্রসব যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে সেই কামিনী গাছ তলায় মধুলতা জন্ম দেয় চাঁদের মতো একটি ফুটফুটে কন্যা শিশুর। ঘরে যাওয়ার সময়টুকু হয়নি মধুলতার। কামিনী ফুলের কচি শাখাগুলো দুলে দুলে সদ্য ধরনীতে আসা শিশুটিকে অভিবাদন জানিয়েছিল তখনই।

মধুলতা ক্ষীনকায় চোখে কন্যার মুখপানে চায়। এবং বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,
আজ থেকে তুই আমার কুসুমিত কামিনী মা। এই জগতসংসারে তুই ছাড়া আমার যে আর কেউই রইলোনা। কিন্তু আমি কেমন করে, কিভাবে তোকে বড় করব মা? কিভাবে?

যাদের সাহায্যে কামিনীর জন্ম হয়। সেই নারীগুলো মধুলতা ও তাকে বেড়ার খুপরি ঘরটায় নিয়ে আসল। তড়িঘড়ি করে মধুলতাকে গরম পানি করে দিল খাওয়ার জন্য। শিশুটিকে গোসল করিয়ে একটি নতুন তাওয়েলে পেঁচিয়ে নিল তারা। সবার মাঝে চাপা আনন্দ বিরাজ করছে।

মধ্যবয়স্কা সর্দারনী বাসন্তীবালা মধুলতার দিকে চাইলেন অসহিষ্ণু চোখে। বিষকন্ঠে মধুলতাকে ঝাড়লেন নিজের খায়েশ মিটিয়ে ।

কত করে ইনিয়ে বিনিয়ে কইলাম, ফালায়া দে। রাখিস না। পরে শরীরের আদল নষ্ট হইয়া গ্যালে আর খদ্দর আইবো তোর বিছানায়? এই ভ্রুণের পিতা কে তুই কইতে পারবি মধু? যদি নিদিষ্ট করে বলা যাইতো। তাও না হয় দিলেরে বুঝ দিতি। হ্যারে খুইঁজা বাইর করতি। কত বিদেশী পুরুষও আসে। বিছানা বদল হয় ঘন্টায় ঘন্টায়। কার জন্ম দেওয়া কে জানে। এখন ক্যামনে পালবি এই মাইয়ারে? তোর কামাইর পথ ও যে বন্ধ হইলো।

মধুলতা মেলানো দুঠোঁট ফাঁক করেও মিলিয়ে ফেলল। কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল কি যেন ভেবেই। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে নির্জীবের ন্যায়।

পাশ থেকে ললিতা নামের মেয়েটি বলল
” খালা আমার মনে হয় এই মাইয়া কোন সুন্দর পুরুষের জন্ম দেওয়া। চাইয়া দেখেন কি সুন্দর। যেন আসমানের পরী ভুল কইরা মাটিতে আইসা পড়ছে।”

ওই অন্য পুরুষ সুন্দর কস? আমাগো মধু আপা কি কম সুন্দর নাকি। এই পল্লীতে খদ্দের আসে বেশী মধু আপার ম’ ধু’ র লোভেই। আমিই পালতাম ওরে। কিন্তুক এইখানে সেই সুযোগ নাই। বেটাদের লগে শোয়া লাগে।

ওদের খোলামেলা কথাবার্তায় সরব হয়ে উঠল শহরের নিষিদ্ধ পল্লীর মধুলতার এক চিলতে খুপরি ঘরখানা।

পাশ থেকে তাদের বলা কথাগুলো সর্দারনী বাসন্তিবালার কানে পৌঁছায়। সে ঝট করেই বলে ফেলে মধুবালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,

ওই মধু শোন। যেহেতু জন্ম দিয়াই ফেললি বাচ্চাটারে। ওরে এখন পালক দিয়া দে কারো কাছে। তাহলে খদ্দের আইবো আগের মতো। মাইয়ার খরচ ও চালাইতে পারবি। মাঝেমাঝে কাছেও পাবি মাইয়ারে।

মধুলতা ফ্যালফ্যালিয়ে নিরবে অশ্রুপাত করে ফেলে। নদীর স্রোতধারার ন্যায় কলকলিয়ে সে অশ্রু বয়ে পড়ে দুগালের পাশ ঘেঁষে। বাসন্তীবালা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে যায়।

দু’মাস গড়িয়ে যায়। খদ্দের আসলে বাচ্চা দেখলেই মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। মধুলতার আয়ের পথ একেবারেই রুদ্ধ। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে মা মেয়েকে চালিয়ে নিচ্ছে কোনরকম করে। বুকের মাঝে লেপ্টে রাখে কামিনীর পুষ্পতুল্য ছোট্ট শরীরটাকে৷ জীবনের উপর আনা সমস্ত খেদ পানি হয়ে যায় নিমিষেই। যখন দেখে তার কামিনী ফুলটা অবিকল উজল চাহনিতে মায়ের মুখপানে চেয়ে আছে।

তার সহকর্মীরা তাকে নানান যুক্তি খন্ডন করে পরামর্শ দিতে লাগল। মেয়েকে অন্যত্র পালক দিয়ে দেওয়ার জন্য। উপায়ন্তর না দেখে মধুলতা নিমরাজি হয়।

দুদিন বাদে ক্ষুদে কাপড় ব্যবসায়ী মিনারা গিয়েছিল সেই পাড়াতে। এখানে তার কিছু নিদিষ্ট কাষ্টমার আছে। এরা সবসময় তার থেকে জামাকাপড় ও শাড়ি কিনে থাকে যারযার বয়স অনুযায়ী। মধুলতার রুমে ঢুকেই কামিনীকে কোলে তুলে নেয় মিনারা। আলুথালু মুখটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মিনারা।

প্রসঙ্গত পাশে বসা একজন নারী মধুলতার বর্তমান অবস্থার বিবরণ দেয় মিনারার কাছে। শুনে হায় হায় করে উঠে মিনারা। বুক ভরা দুঃখ নিয়ে বলে,

আমরা স্বামী স্ত্রী কত চেয়েও একটা সন্তানের মুখ দেখতে পেলামনা আজো। বিয়ে হলো দুই যুগ পার হয়ে গেল। আর এর পিতা থেকেও নেই। মধু আপা আপনি চাইলে আপনার মেয়েরে আমার কাছে দেন। পেলেপুষে বড় করে দিব। কোন চাওয়া নাই আমার। আপনার যে কোনো শর্তই মানতে আমি রাজী।

একদিকে নিঃসন্তান মিনারার আকুল আবেদন। আরেকদিকে নিষিদ্ধ পল্লীর সহকর্মীদের বোঝানো। নিজের আয়ের পথ ও বন্ধ। চিন্তা করতেই মধুলতা দ্বিধায় পড়ে যায়। মানসিক দোটানায় দুলতে থাকে ঝড়ে দুলতে থাকা মাঝ দরিয়ার নৌকার মতো।

আলতো করে মেয়ের দুচোখের পাতায় মায়ের অধর দুটো ছোঁয়ায়। মিনারার কথায় সম্মতি জানায়। মিনারা যত্ন করে কোলে তুলে নেয় মধুলতার প্রাণের ধন কুসুমিত কামিনীকে।

সেদিন রাতেই মধুলতার ঘরে আচম্বিতে প্রবেশ করে একজন সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষ। চেনা মুখখানা দেখামাত্রই মধুলতার অধরজুড়ে প্রষ্ফুটিত হলো প্রত্যাশার নির্মল হাসি।

চলবেঃ ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here