#কুয়াশা মন
পর্ব ৭..
তাঁর এই নীরবতাকে কিসের ইঙ্গিত ভেবে নেবো? আদৌ তিনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন? হ্যাঁ, নেহাতই হয়তো আমি অতিরিক্ত ভাবছি। সবই আমার ক্লান্ত মনের ভুল। যেখানে আমার কোনো দোষ নেই, বকা শোনার কোনো কারণ বেঁচে নেই ওখানে। তবু আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যেতে হবে তাঁর মৌনতা ভাঙানোর।
কী ভাবেন তিনি? কাউকে নিয়ে ঘৃণা পোষেন? কেউ কি তাকে ধোঁকা দিয়েছে? এতো মৌন কেন থাকেন তিনি? কিসের এতো দ্বিধা? সবের উত্তর আমায় জানতে হবে।
বেশ কয়েক পৃষ্টা পর।
মাস দুয়েক অতিবাহিত হয়েছে আমার বিয়ের। এখনও সেই জায়গায় আটকে আছি আমি। মুক্তা যতবারই এসেছে, ততবারই জিজ্ঞেস করেছে আমাদের মাঝে সবই ঠিক হয়েছে কিনা। আমি মুচকি হেসে নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার ন্যায় বলতাম, হ্যাঁ, ঠিক আছে সবকিছু। কিন্তু আড়ালের কথা কেউ আদৌ জানে না। জানে না, আজ পর্যন্ত যে আমরা কখনও দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলিনি, জানে না কেউ আমরা পাশে থেকেও কাছে থাকি না। পাশে থেকেও দূরত্ব যেন বহু ক্রোশ। এও জানে না, একই জায়গায় থেকেও আমরা দুজন দুই ধরনের জীবের ন্যায় আচরণ করি। মাঝে-মধ্যে ভাবনার মাঝে উদ্যত হয়, কেন বিয়েটা করলাম একজনের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে? তারচেয়ে বরং যেভাবে চলছিল সেভাবেই সব থাকত। আজ দুটো জীবন অকারণে নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আমাকে যতটা অপছন্দ করেন, অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে হয়তো ততটা করতেন না। হয়তো তখন তাঁর সংসারটা বেশিদূর অগোছালো থাকত না। সাংসারিক জীবনে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়তেন। তাঁকে বিয়ে করে এখনও আগের পথে থমকে আছি। তাঁর কোনো ভাবান্তর ঘটেনি বিয়ের মাধ্যমেও। বরং নির্জীবতা যেন ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। কাজ, কাজ, কাজ শেষে বাড়ি ফেরা, বাসার লোকের সাথে কুশল একটু-আধটু বিনিময় করা, আবারও কাজ, ঘরে কাজ, বাহিরে কাজ। বিয়ে যেন আমাকে করেননি, এই কাজকেই করেছেন। আবার অনেক সময় বোধ হয়, এই বুঝি কাজ করার বাহানা করছেন, নয়তো নিজেকে ব্যস্ত রাখার ফন্দি এঁটেছেন।
দিন-দিন তিক্ততা আমার মাঝে ভরে উঠছে। এই যেন গর্জে উঠে না বলে দিই, কী হয়েছে আপনার? এতো ভাব কেন দেখান? আমি কোনো ভুল করেছি? করলে আমায় মারুন, পিটুন। কিন্তু এভাবে আমি আপনার এই মৌনতাকে মোটেও সহ্য করতে পারছি না। দোহাই লাগি আপনার, এই মৌনতাকে ভাঙুন। কিন্তু সহসা সামান্য বুলিও উনার সামনে বের করতে পারি না।
আমার ভাগ্যের চালবাজি, মুক্তা আমার অনুপস্থিতিতে আমার ডায়েরিটি সকালে আবার দেখে ফেলেছে। গতবার দেখেছে বলে সে নানা ফন্দি করে আমার জীবনকে অজান্তেই নরকের দিকে ধাবিত করেছে, মিহিরের সাথে বিয়ে দিয়েছে। এবারও দেখেছে আর পড়েছে অনেক কিছুই। না জানি আবার কী করে বসবে সে। এতক্ষণে হয়তো জেনে ফেলেছে এতদিন তাকে আমি মিথ্যে বলে এসেছি। একবার যেই ঢুকেছে তার মাথায়, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কিছুই ঠিক নেই, তবে কিছু একটা করেই ছাড়বে। আসলে ওর মনোভাবনাও খারাপ নয়। শতবার বলেছে, আমার কারণে আজ সে এতো ভালো একটা স্বামী আর সংসার পেয়েছে। বলতে গেলে তখন থেকেই সে আমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছে। এবং সেই ভালোবাসার খাতিরে আমার চাওয়া-পাওয়াকেও অত্যধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।
আজ সকাল উনি বাসায় না থাকায় বসে ডায়েরিতে একটু লিখছিলাম। কোন খেয়ালের মোহে পড়ে খামখেয়ালি হয়ে ডায়েরিটি ওখানেই রেখে কাজ করতে চলে যাই। ব্যস, মুক্তা আমার সাথে কথা বলতে এসে ডায়েরির বর্তমান অংশ পড়ে ফেলল। মিথ্যা বলার দায়ে সে এখনও অবধি আমার সাথে কথা বলেনি। বরং আমি কথা বলতে গেলেও আমাকে ইগনোর করেছে।
আরও বেশ কয়েক পৃষ্টা পর।
কত চেষ্টা, কত প্রতীক্ষার প্রহর গুণেও কিছুই হয়নি। চোখের পলকেই যেন বিয়ের একটা বছর কেটে গিয়েছে। ফুফা বিয়ের শুরুতে আমার সঙ্গে আগের ন্যায় কথাবার্তা বলতেন না। কিছু মাস গত হলে তিনি আমাকে বুঝতে পেরে আবার আগের মতো করে তিনি মাথায় তেল মালিশ করতে আমায় ডাকেন। প্রথমবারের মতো তাঁর মুখে বৌমা ডাক শুনলাম তখনই। কেননা মুক্তা সব উগলে দিয়েছে। কীভাবে, কী ফন্দি রটিয়ে সে যে আমার আর মিহিরের বিয়ে করিয়েছে তার সবেরই স্বীকারোক্তি করেছে। নিষেধ করেছিলাম এমনটা করতে। এখন সে এক মেয়ের জননী, ওই বিষয়গুলো তুললে ফুফার প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে ওর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ ফুফার প্রতিক্রিয়া দু’ধরনের হতে পারত। এক. তিনি সবকিছু মেনে নেবেন, হেসে উড়িয়ে দেবেন নয়তো দুই. মুক্তার সাথে এই নিয়ে নারাজ হবেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই হয়েছে। কেননা তিনি মুক্তার এসব কাজে আমাকে আর মিহিরকে খুব ভুল বুঝেছিলেন। মুক্তাকে অপ্রকাশ্যে অনেক বকা দিয়েছেন। ফুটফুটে কচি রাফাকে নিয়ে সেই যে সে চলে গিয়েছে, আর একটিবারও আমাদের দেখতে মুক্তা আসেনি। সব অভিমানেরই যে খেলা। ফুফাকে বাবা বলে ডাকার অধিকার পাওয়ার পর তাঁকে বুঝাই, ওসবের আড়ালে থাকা আমার প্রতি মুক্তার ভালোবাসার কথা। সব জেনে বাবা নিজেই মুক্তার কাছে গেলেন। তবু তার অভিমান স্বল্প পরিমাণও গলেনি। আমিও যে কম বুঝিয়েছি তা নয়। তবে এই অভিমান বেশিদিন স্থায়ী থাকবে না তার। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি তাকে, পিচ্চি রাফাকেও। তাকে দেখলেই যেন বুকটা খাঁ খাঁ করে। এই যেন কলিজাটি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে-আসবে অবস্থা। যে বাচ্চাদের এতোটা পছন্দ করে আজ তারই কিনা কোল শূন্য। যখনই তার বাসা থেকে ফিরতাম এই নিয়ে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যেত। এসে তাঁকেই ঝাড়তাম। যেগুলো বলার ভয় করি সেগুলোই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। কী হয়েছে আপনার? এতো কেন ভাব দেখান? কাজ তো আমিও করি। কী করেছি আমি? কী ভুল হয়েছে আমার দ্বারা? কেন আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন?
কাপড় গুছানোর সময় কিংবা অন্য কোনো কাজ করার সময় অনর্গল বকে যেতাম তিনি বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসলে, “আমার না.. ভালো লাগে না এসব। হয়তো আপনার মৌনতাকে ভাঙুন নয়তো আমাকেই পর করে দিন।” তিনি কিছু না বলে ল্যাপটপটা বন্ধ করে ধীরে ধীরে কোনো আওয়াজ ছাড়াই বেরিয়ে যেতেন, যেন আমি এযাবৎ এতো কথা কোনো পুতুলকে শুনিয়েছি। রাগ বেড়ে গেলে যখন তাঁকে একটু বেশিই শুনাই, তখন আমার গলা যেন কাটা পড়ে। কারণ তিনি চেঁচিয়ে উঠে নানা বকাবকি করতে থাকেন। একসময় কথা উঠে যেত তালাকের। কাজেই সেসময় আমার মুখ দিয়ে ভয়ে আর কোনো কথা বেরুত না এবং নিজ ভুল বুঝতে পেরে চুপসে যেতাম। কারণ ফুফা এখন আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে অনেকটা কৌতূহলজনক ধারণা রাখেন। আমাদের জুটি যেন সেরা জুটি। আগে কেন ভাবেনি আমাদের দুজনকে একসাথে কত ভালো মানাবে? ওই বাবাই যদি জানতে পারেন, আমাদের সম্পর্কটা যে এমন, একে অপরকে তালাক দিলেই রক্ষা, তবে রঙ করা জানালায় যেন অকালেই জঙ ধরবে।
আমার সংসারে যেন মরিচা ধরেছে। চাকচিক্য বলতে কিছু নেই-ই। দুজন যেন দুই জগতের লোক। একে অপরের সাথে নিঃসঙ্কোচে কথা বলতে যেন সহস্র দ্বিধা। কবে এক হব? কবে মিটবে সকল ব্যবধান? নাকি অচিরেই দূরত্ব হুট করেই বেড়ে যাবে?
মুক্তার মেয়ে রাফার জন্মের দেড় মাস গড়ালে আজ আমরা দুজন তাকে দেখতে গেলাম। মুক্তা অনেক মাস পর মিহিরকে নিজ বাসায় দেখে আহ্লাদে গদগদ করছিল। অন্তর্নিহিত কথা বলতে, তিনি যেতেই চাননি। অনেক জোর করাতেই রাজি হয়েছেন মুক্তার শ্বশুরবাড়ি যেতে। তাঁকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো, যেন মুক্তাকে নিয়ে তাঁর মনে চাপা একটা অভিমান কাজ করছে। কেবল আমিই না, মুক্তাও স্বয়ং খেয়াল করেছে। সারাদিন দুজনই লক্ষ করলাম, যে ভাই বয়সে ছয়-সাত বছর বড় হয়েও বোনকে সবসময় সমবয়সী বন্ধুর ন্যায় দেখেছে, আচরণ করেছে, আজ সে-ই মুক্তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত জানি বাবা আমাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবার পাত্র নন। আমরা যে কাণ্ডখানা করেছি তা বাবা না বললে মিহিরের জানার কথা নয়।
একসময় এ বিষয়ের খোলাসার জন্য মুক্তা মিহিরকে নির্জনে নিজ রুমে নিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তাঁর মনের অবস্থার কথা। তিনি তেমন কিছুই বলেননি। আমিও পাশে রাফাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মুক্তা জানতে চাইল, “ভাইয়া, কী চলছে তোমার মনে? আমি কি তোমার সাথে ভুল কিছু করেছি? তুমি আমার খোঁজখবর নাও না কেন? আসার পর থেকে একটুও ভালোভাবে কথা বলোনি। কী হয়েছে তোমার?”
“কই? কী আবার হবে? কখন তোর সাথে কথা বলিনি?”
“আমি বলেছি ভালোভাবে কথা বলোনি। একদম কথা বলোনি তা তো বলছি না। কিছু হয়েছে কি? বিয়ের পর থেকে আজ অবধি এই একবার এলে। নাকি কাজের চাপই বেড়ে গিয়েছে?”
“এমনিই আসা হয়নি।”
“ভাইয়া, তুমি আর সাবিহা, আমার অত্যন্ত খুব আপন দুজন। সহজেই বুঝে ফেলি তোমাদের মনের কথা। কিছু একটা নিয়ে বড্ড অভিমান করেছ। নচেৎ এরূপ অনীহা দেখাতে না।”
“আমার অনীহা করা বা না করা নিয়ে তোদের কী আসে যায়? আমি কি তোদের আপন কেউ হতে পারলাম কখনও?”
“বলছ কী?”
“হজম হয়নি নাকি?”
“তুমি কী বলবে পরিষ্কার করে বলো ভাইয়া।”
“পরিষ্কার সবকিছু উভয়ের সামনেই আছে। অপরিষ্কার কিছুই নেই। তুই যেটা জানিস, সেটা আমিও জানি। আমি যা জানি, তা আবার তুইও জানিস।”
“ভাইয়া, বলো তো কী নিয়ে অভিমান করেছ?”
“আমার মতো পর কেউ অভিমান করতে পারে নাকি? ও তো আপনেরাই করে। অধিকার আছে বলে কথা। এতো বড় ঘটনা ঘটে গেলেও আমাদের মতো পরদের কিছুই করার থাকে না।”
“কিসের ঘটনা?”
“তুই জানিস না? তুই না জানলে কী করে হয়? তুই আপন হয়েও এমনটা করলি, সাবিহার মতো পরকে তো সাইডেই রাখলাম।”
আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে গেল। আমি জানতাম, তিনি আমাকে ঘৃণা করেন, এটা জানার ব্যথা তাও সওয়া যায়। কিন্তু স্বয়ং তাঁর মুখ থেকে শুনলে মনটাই পাংশুটে হয়ে যায়, ব্যথা দ্বিগুণে বেড়ে যায়।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার