কুয়াশা মন পর্ব ১৫ (শেষ)

#কুয়াশা মন

পর্ব ১৫(শেষ পর্ব)…

সামিরার যখন তিনবছর, তখন আমরা দেশে ফিরে গেলাম। ওখানে মুক্তার বেশ কয়েক মাস থাকার প্রয়োজন পড়ছিল। আর আমি এই জায়গায় পুনরায় ফিরে আসতে উৎসুক ছিলাম। সেখানে দিন খানেকও অনেক কষ্টে থেকেছি। এই বিল্ডিং, এই বাসা সকলই যেন আমাকে ডাকছিল। সাবিহার স্মৃতি ছাড়া সম্পূর্ণই অচল হয়ে পড়েছিলাম। এখানে চলে আসতে পারলেই যেন বাঁচি। এই বাসাটির কারণেই আমি নতুন বাঁধা বাসাটিও ফেলে রেখেছি। আমি মুক্তাকে খুব করে বললাম, আমি চলে আসতে চাই। জায়গাটায় সাবিহাকে খুব মনে পড়ছিল। তার তেমন কোনো স্মৃতিই নেই সেখানে। কিন্তু সামিরাকে ছাড়া আসা সম্ভব ছিল না। তিনটে বছর মুক্তাই তার লালনপালন করে এসেছে। সামিরাকে তার কাছে রাখা ছাড়া আমি বাচ্চা পালনে অনভ্যস্ত এক মানুষ কী করে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আর আমি নিজের খেয়াল ঠিকমত রাখি না, সামিরার কী রাখব। আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম এখানে ফিরে আসার জন্য, সাথে সামিরাকে নিয়ে। মুক্তা যে আসতে পারছিল না, এতেই সমস্যা সকল বেঁধেছে। পরে আমি বললাম, বরং আমাদের বুয়াকেই এখানে নিয়ে আসি। আমি আমার সাধ্যের সামিরার খেয়ালটুকু রাখার চেষ্টা করব। বাকিটা বুয়াই না হয় দেখবেন। মুক্তার কাছে তার শ্বশুর বাড়িতে খুব সমস্যায় পড়তে হয় বলে সে এসবে রাজি হয়ে গেল। আমি সামিরা আর বুয়াকে নিয়ে এদেশে আবার ফিরে এলাম। সামিরা মুক্তার কাছে এযাবৎ থাকায় সে আমাদের সাথে মিশছিল না। আমি নিজেকে ভুলে গিয়ে রীতিমত তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তবুও সে আমাদের সাথে খাপ খাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সামলেছে। তার সাথে বেশ কয়েকদিন থাকতেই বুঝলাম, সেও সাবিহার মত হতে চলেছে। মুক্তার কাছে শুনতাম, অন্য বাচ্চারা যে পরিমাণ কাঁদত, সামিরা তার অর্ধেকও কাঁদত না। তা আমি সামিরার সাথে থাকার কয়েকদিন যেতেই টের পেলাম। সে একদম খুব নম্র স্বভাবের। বুলি জানারগুলো জানে সে। কিন্তু উচ্চারণ করে কম। এক জায়গায় খেলতে দিলে ওখানেই খেলে। বাচ্চা হিসেবে সে কোনোদিকেই বিশৃঙ্খলা করত না। খাওয়াদাওয়া নিয়ে তার খুব একটা ঝামেলা হত না। বুয়া সবকিছু অনায়াসে করে ফেলতেন। তবে সে ছেলেমানুষ পছন্দ করে না। প্রথমত আমাকেই, আমাকে দেখলে সে খুব কাঁদত। সে খুব সুন্দর হওয়ায় যে কেউ তাকে কোলে নিতে চাইত। বিল্ডিংয়ের কোনো ভাই তাকে কোলে নিতে ইচ্ছে পোষণ করলে সে কেঁদে দিত, ঠিক আমাকে দেখলে যেমনটা করত। তবে মেয়েদের সাথে তার খুব ভাল পড়ত। পাশের ফ্ল্যাটের নরিন তাকে নিয়ে যেত। বুয়া রান্নাবান্না করত, আর সে ওখানেই দিনের অর্ধেক সময় কাটাত। আমি এই বৃত্তান্ত মাস খানেক পর মুক্তাকে শুনালাম। সে শুনে খুব খুশি হল যে, সে এই পরিবেশকে মানিয়ে নিয়েছে, তার নিজের দরকার পড়ছে না। এসব বলার কারণ, তার এখানে বছর খানেক না ফেরার প্ল্যান ছিল। শাশুড়ি খুব জোর দিয়েছেন, নাতিপুতি ওখানের সন্তান, ওখানেই থাকবে। মুক্তা আমাকে এই কথা আগে বলেনি। সামিরার এখানে ওকে প্রয়োজন হচ্ছে না শুনেই উগলে দিয়েছে। যাক, নতুন একটা জীবনে, নতুন একজনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাকে সামিরা খুঁজে না। সে বয়সে সে বুঝেই না, মা কাকে বলে। দিন না গড়াতেই আমি নিজেকে কাজের মাঝে হারিয়ে ফেললাম। ব্যস্ত করে তুললাম নিজেকে অফিসের কাজে। সকাল নয়টার দিকে চলে যাই, রাত নয়টা কী এগারোটা নাগাদ ফিরি। এটিই দৈনন্দিন নিয়ম হয়ে উঠেছে। সামিরা বুয়ার কাছেই থাকত সবসময়। আমি কোলে নিতে চাইলে আসত না আমার কোলে। এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাকে কোলে নিতে আর যেতাম না। সে বাসা থেকে বেরই হত না যে, পাঁচ বছরেও সে বুঝতে পারেনি, মা নামের অনেকেরই অতি আপন একজন থাকে। সে আমার কাছ থেকে বড়জোর বাংলা ভাষাটি শিখেছে, তাও ছাড়া ছাড়া।
.
এখন তার সাত বছর। এখনো তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে একবার এসে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, সবারই মা আছে, তার কেন নেই। আমি নিজে সবসময় ভাবি সাবিহা আমার সাথে আছে। কিন্তু অন্যকে বিশ্বাস করা দায়। ঠিক সেভাবে সামিরাকে বোঝাতে পারতাম না।
বাচ্চারা বড় হতেই মুক্তা এখানে ফিরে আসে। আমাদের সাথে দেখে করতে আসার পর, সামিরাকে খুব করে বলেছিল, তাকে ফুফি বলে ডাকতে। কিন্তু সামিরা তাকে চেনে না। সামিরা বুয়াকে ছাড়া কাউকেই চেনে না, এমনকি আমাকেও আব্বু বলে ডাকে না। বুয়া বলেন, সে হয়ত কাউকেই আপন মনে করে না বা চেনে না, চিনতেও চায় না। মুক্তা রীতিমত বলা শুরু করে দিয়েছিল, সামিরার মাঝে মন নেই, কোনো অনুভূতিই নেই। মুক্তা বেশ অবাক হল এই দেখে যে, সামিরা এত বড় হয়েছে তবুও কখনো মাকে খুঁজে না, খুঁজলেও তাতে বিশেষ জোর নেই। সে সবসময় নির্জীব থাকে। বড়জোর বাংলা বই পড়তে জোর করে। তাও আমাকে সরাসরি এসে কিছুই বলত না। বুয়ার মাধ্যমেই আবদার সব শুনাতো। সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ একদিন মুক্তার মেয়ে রাফা হুট করেই সামিরাকে বলে বসল, তার মা মারা গেছে। রাফাকে এই নিয়ে সতর্ক করা হয়নি। মুক্তা তো বরাবরই পরিকল্পনা করে রেখেছিল, সামিরা কারো কাছে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে আমরা যেন মিথ্যা বলি। বছরখানেক পর সেদিন সামিরাকে কাঁদতে দেখলাম। গিয়ে সে রুমের দরজা ভেতর থেকে বেঁধে কাঁদতে লাগল। আমি আর মুক্তা রাফার কাছ কথা সব জেনে খুবই আহত হলাম। সামিরাকে কী বুঝাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমরা এত করে দরজায় বাড়ি দিচ্ছিলাম, কোনোভাবেই দরজা খুলছিল না। অবশেষে আমার পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তা মিথ্যা রটালো, তার মা আছে। কিন্তু দেশে, নিজ বাসায়। আমরা একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছি। জন্মের পর সামিরাকে সাবিহা রাখতে চায়নি বলে মুক্তাই তার লালনপালন করেছে। তার বয়স তিন বছরের মাথায় মুক্তার কাছে সংসারের অতিরিক্ত চাপ পড়ায় আমিই তাকে এখানে নিয়ে এলাম। সব মিথ্যা শুনে সামিরা দরজা খুলল। তবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার আর মুক্তার দিকে একটুও তাকালো না সে। পা বাড়িয়ে বুয়ার কাছেই গিয়ে বলল, খাবার বেড়ে দিতে। সেই থেকে আমি কী মুক্তা, সামিরা কারো সাথেই কথা বলে না। মুক্তা বলেছিল, আমরা নাহয় ওর নজরে খারাপ হলে হব, তবে মা নেই এই কথা সে আর ভাববে না, তার কাছে কষ্টও ভোগ করতে হবে না। আমিও সায় দিলাম, সে আমাকে পছন্দ করে না বৈকি।
.
নিজের জন্য এখন সময় বের করি না বলে ডায়েরির পাতায় আর কলম বসানো হয় না। তাছাড়া আমি ভাবশূন্য একটি ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছি দিন দিন। আমার মনে কিছুই থাকে না, কোনো কথাই থাকে না। কাজেই লেখার জন্য কোনো বিষয়ই থাকে না। সামিরা দশ বছরে পড়েছে। এখনও তার আচরণে পরিবর্তন আসেনি। বরং নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে। বাহিরে সে খেলতে যায় না। বাড়িওয়ালার মেয়ের দুটো বাচ্চা ছেলে বাহিরে ফুলের বাগানের পাশে প্রতিদিন খেলা করে। সামিরার কখনো মনের হাওয়া পাল্টালে ওদের খেলা দেখতে বাহিরে বের হয়। এর চেয়ে অধিক কোনো আমোদ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। সে একমাত্র বুয়ার সাথেই কথা বলে। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। তাছাড়া স্কুলে ব্যতীত বাকি যে সময় বাসায় থাকে তখন রুমেই থাকে। আমি নিজেকে কাজে জড়িয়ে ফেলাই তাকে সময় ক্ষণিকও দেয়া হয় না। আমার মাঝে মাঝে বোধ হয়, সামিরা এখন কাউকে পছন্দ করে না। তার আম্মুকেও পছন্দ করে না হয়ত, কারণ সামিরাকে সে ফেলে চলে গেছে শুনেছে। আমাকে পছন্দ করে না, হয়ত আমি তার মাকে আলাদা হতে দিয়েছি ভেবে। মুক্তাকেও হয়ত এই ধরনের কোনো কারণে পছন্দ করে না। কাজেই ওর ক্ষেত্রে হয়ত সকলে দোষী। এতে আমার বিশেষ কোনো দ্বিমত নেই। সে মায়ের অভাবে নিজেকে ব্যথিত করবে না, এই সর্বেসর্বা।
.
ডায়েরিতে খুঁটিনাটি এসব বিষয় ছাড়া আর তেমন কোনো কথা উল্লেখ নেই। বাকিগুলো তার মাকে নিয়েই লেখা। বাবার ডায়েরি পড়তে সামিরার তেমন সময় লাগল না। নিতান্তই স্বাদহীন ব্যক্তি। তা নাহলে তার মায়ের মত জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাও উল্লেখ করত। লেখাগুলো দেখে বোধ হচ্ছে, ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার মাস কী বছর খানেক পর করে লিখেছে তার বাবা। এই লেখাগুলোতে কোন প্রাণ নেই। লেখারটা লিখেছে সে, যেমন কর্তব্যে পড়ে। প্রাণ যাও আছে সাবিহাকে নিয়ে লেখা প্রচ্ছদটুকুতে, যা সাবিহার স্মৃতিতে লিখেছে সে।
.
সামিরা ডায়েরি রেখে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কেঁদে গেল। সে এতদিন যাদের পর ভেবেছে, ভাবেওনি তারা এতই আপন। মায়ের কথা মনে করত না সে, ফুফি আসলে তাঁকে ফুফি বলে ডাকত না। সবার ওপরে, মিহিরের সাথে সে কখনো চোখাচোখিও হত না। কেমন স্বার্থপরের ন্যায় এতদিন আচরণ করে এসেছে তাদের সাথে। সব থেকে বড় বেশি দুঃখ হচ্ছে, তার মা নেই জেনে।
সামিরা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। খাবার দিতে এসে বুয়া বেশ অবাক হলেন না খেয়েই সামিরার ঘুমিয়ে পড়া দেখে। তিনি সামিরাকে আর জাগালেন না। পাশের টেবিলের ডায়েরিগুলোকে বই ভেবে মনে করেছেন, আজরাত হয়ত সে খুব পড়ালেখা করেছে, অবসাদে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। বুয়ার অসুস্থতা সেরেছে ক্ষণকাল আগে। রান্না সারতে বেশ রাত হয়ে গেল। এও হয়ত একটা কারণ সামিরার ঘুমিয়ে পড়ার। বুয়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সামিরার ঘুমের বেশি প্রয়োজন হয়। বুয়া ভাবছেন, মেয়েটির ওপর লেখাপড়ার এতই চাপ পড়ছে, ঘুমোতেই পায় না। কাল স্কুল বন্ধ। কাজেই সে অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারবে ভেবে বুয়া কিছুটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
.
মিহির বাসায় ফিরেছে। বাজছে সকাল নয়টা। এসময় সামিরা ঘুম থেকে উঠে এসে টেবিলে বসে মুখ ফিরিয়ে নাশতা করে নেয়। আজ তাকে মিহির দেখছে না। বুয়াকে দেখতেই জিজ্ঞেস করল, “কী? সে এখনও ঘুম থেকে উঠেনি নাকি?”
“উঠেছে, কিন্তু খুঁজি পাই না। খুব সকালে তার রুমের দরজা খোলা দেখছি। চোখগুলো তার ফুলে গেছে। রাইতে দেরিতে ঘুমাইছে বলে হয়ত। মেয়েটার আজকাল পড়ার কারণে ঘুমই হইতেছে না। এখন হয়ত বাহিরে গেছে।”
“এত কিসের পড়া? সে তো খাবার না খেতেই নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দেয়। পড়া সে বাদ দিতে পারবে, ঘুমকে কখনো পড়ার কারণে বাদ দিতে দেখেছেন?”
“এও একটা কথা। না জানি তার মনে কী চলতেছে বাবা।”
বুয়া নিজের মত করে নানা প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। মিহির এসে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। বাহিরে বেরুনোর আগেই বুয়া তার নাশতা টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন। মিহির একবার কী ভেবে বলল, “আচ্ছা, ওর বাথরুম কী দেখেছেন? হয়ত সে গোসল করছে। তার তো মাঝে মাঝে সকালে গোসল করার অভ্যাস আপনার কাছে শুনেছি।”
“তাই তো। আমি বাথরুম দেখি নাই।”
“আচ্ছা, আপনি বসেন। আমি দেখছি।”

মিহির বড় দ্বিধার সাথে সামিরার রুমের দিকে পা বাড়াল। মৃদু স্বরে ডাকল, “সামিরা?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মিহির একটু ভেতরে গিয়ে বাথরুমের সামনে দাঁড়াল। দরজা খোলা প্রায়। আরেকটু ঠেলে মিহির মৃদুভাবে ডাকল, “সামিরা?”
বাথরুমেও সামিরা নেই। সামিরা তো বাহিরে যায় না, আজ কিছু মাস যাবৎ। নাকি বুয়ারই এই বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই? হ্যাঁ, হয়তো বা। কাজে ব্যস্ত থাকায় হয়ত সামিরাকে দেখেন না। মিহির রুম থেকে বেরুনোর জন্য পা বাড়াল, ঠিক তখনই টেবিলের ওপর একটি পরিচিত ডায়েরি দেখতে পেল। মিহির বিড়বিড় করে বলল, “আমার ডায়েরিটি এখানে কীভাবে এল? ওটা তো ফেলে রেখেছি আজ দুই বছর যাবৎ। কে এনেছে এখানে? সামিরা? সে কি আমার রুমে গেছিল? সে কি এই ডায়েরি পড়ে ফেলেছে?”
সর্বনাশ! সে সারারাত ডায়েরি পড়ে কেঁদেছে। পড়ালেখার জন্যে নয়, ডায়েরি পড়ার কারণেই সে ঘুমায়নি। মিহির কাঁপা হাতে ডায়েরিটি তোলে নিল। সামিরা তার মায়ের মৃত্যুর সম্বন্ধে জেনে ফেলেছে নিঃসন্দেহে। মিহির কাঁপতে শুরু করেছে। সামিরা আবার কষ্ট দেবে নিজেকে, দুঃখে ব্যতীত হবে। এতবছর তার মায়ের উপস্থিতির যে মিথ্যা নাটক করেছিল সবই ভেস্তে গেল। মিহির নিজ ডায়েরি নিতেই চোখ পড়ল আরেকটি ডায়েরির ওপর। অপরিচিত একটি ডায়েরি! সামিরাও কি ডায়েরি লেখে?
কৌতূহলপরবশ মিহির ডায়েরিটি নিয়ে পড়তে শুরু করল। না, এটি সামিরার ডায়েরি নয়। এ যে সাবিহার ডায়েরি! মিহির কেন বুঝল না এতদিন, সাবিহার ডায়েরি যে তার আলমারিতেই ছিল! মিহির সাবিহার সম্বন্ধে কতকিছুই না জানতে পেত। তাকে নিয়ে সাবিহা কী লিখেছে সবই জানতে পেত।
বুয়া মিহিরকে ডেকেই যাচ্ছেন। মিহির ডায়েরি পড়াতে মশগুল। এসে একবার দেখে গেলেন। মিহিরকে মনোযোগী পাঠকের মত দেখে ফেরত গেলেন।
.
ঘণ্টাখানেক পর মিহির ডায়েরির কিছু অংশ পড়ে নিজ রুমে ডায়েরি দুটোই নিয়ে গেল। দুপুর হয়েছে। সামিরার এতক্ষণে চলে আসার কথা। বুয়া মিহিরকে একবার ডাকলেন। রান্নাঘরের জানালা থেকে নিচের বাগান সরাসরি দেখা যায়। মিহির আসতেই বুয়া বাহিরে বসে থাকা সামিরাকে দেখালেন। কয়েকটা মাস আগে সামিরা ঠিক এভাবে বাগানের পাশে সেট করা বেতের চেয়ারে বসে বাড়িওয়ালার মেয়ের বাচ্চাগুলোর খেলা দেখত। আজও দেখছে। এতদিন কিসের কারণে সে বাহিরে যেত না, তা মিহির ক্রমেই বুঝে ফেলেছে।
সামিরা নিঃশব্দে ফিরে এল। বুয়াকে খাবার দিতে বলল। বুয়া খাবার দিলে সে অন্যমনস্কভাবে খেতে শুরু করলো। বুয়া তাকে এভাবে দেখছে যেন এই সামিরা চির অচেনা। সে খাবার খায় নিজ রুমের ভেতর। আজ খাচ্ছে টেবিলে বসে। নিরিবিলিতে তাকে দেখে গেলেন তিনি। সামিরা খাওয়া শেষে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
বুয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মিহির বের হলে তার দিকে একবার চাইলেন। মিহির চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, সামিরাকে কিছুই জিজ্ঞেস না করে একাই থাকতে দিতে। তারপর মিহির খাওয়ার পর্ব শেষ করে ডায়েরির লেখাগুলো পড়তে লাগল।
.
আজানের আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙল সামিরার। সেই দুপুরে খাওয়ার পর ঘুম দিয়েছে। সেই ঘুমে এখন মাগরিবের ওয়াক্তের সময় উঠেছে। আছরের নামাজ কাজা হল। তড়িঘড়ি করে উঠে নামাজ দুটোই সেরে নিল। মন খারাপ থাকলে তার ঘুম বেশিই হয়। দুপুর বেলায় বিছানায় বসেছিল উদাসীন হয়ে। খানিক পরে ঘুমিয়ে কুপোকাত!
নামাজ শেষে সে কিছুক্ষণ টেবিলে মাথা গুঁজে বসে রইল। কিছুই তার ভালো লাগছে না। আব্বুর কাছে গিয়ে একটিবার ক্ষমা চাইবে? আব্বু কখন আসবে? আসলে কি সে তার আব্বুর কাছে যাবে? গেলে কী বলবে? এতদিন আপনাকে ভুল বুঝে আব্বু ডাকিনি এইজন্য স্যরি? আচ্ছা, বলাটা কি এতই সহজ? তার বাবা হয়ত মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু একটা চাপা অভিমান যে রয়ে যাবে!
সামিরা চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিল। ডায়েরি পড়া এক কথা। পড়তে খুব ইচ্ছে হত। পাঠ্যবইয়ের পড়া এত পীড়া দেয় কেন? সামিরা ভেবে পাচ্ছে না।
রাত দশটার দিকে চুপচাপ খেয়ে এসে সামিরা বিছানায় বসে রইল। সে এতই অন্যমনস্ক আর দুঃখিত যে, বুয়াকে একটিবার জিজ্ঞেস করেনি তার আব্বু এসেছে কি-না বা তার আব্বু এসেছে কিনা দেখতেও যায়নি।
সামিরা হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল। ভেসে আসছে কী সুরেলা একটি সুর! কী অতিপ্রাকৃত এক সুর! ইসস, পৃথিবীটা কতই না সুন্দর। একটু আগে কেন আসেনি এই পৃথিবীতে! সামিরা আগে কেন ভাবেনি? এই সুর যেন এ জগতের নয়। সামিরাকে কেউ যেন ডাকছে। তা কি এই সুর?
.
মাউথ অর্গান হাতে খুব মনোযোগ সহকারে মাতাল হয়ে মিহির সুর তুলছে। সেই জায়গা, পাশেই সেই ফুলের সুভাসে ভরা বাগান, সেই বেতের চেয়ার, সেই সুদর্শন ব্যক্তি এবং সেই মাউথ অর্গান। কতই না পরিচিত এই দৃশ্য! বারো বছর আগের সেই দৃশ্য। পার্থক্য শুধু সময়ের আর ব্যক্তির। ব্যক্তির মুখের উজ্জ্বলতা একটু কমেছে, চোখগুলো বুজেছে, চোখের নিচে সামান্য কালো, চোখ নিমীলিত। বসে আছে আগের ভঙ্গিতে। এক পা চেয়ারের ভেতর, এক পা নিচে। পায়ের নিচে জুতো নেই, ঠিক বারো বছর আগের স্বভাব যেন!
মিহির সুরটির একটি টান দিয়ে নিশ্বাস ফেলার জন্য চোখ খুলল। পাশে বসে আছে সাবিহা, গালে হাত ঠেকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। মিহিরের ভেতর শীতল এক হাওয়া বয়ে গেল। কেমন মনোমুগ্ধকর এক চাহনি, যেন সে সারাজীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় এই সুর শুনে। আর মিহির মাউথ অর্গান হাতেই এই চেয়ারে আজীবন বসে থাকতে রাজি। মিহিরেরও ঠোঁটের কোণে মুচকি এক হাসি ফোটে উঠল। সাবিহা ঠিকই বলেছিল, এই ব্যক্তি হাসলে প্রতিটি মেয়ে যেন পুরো পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে শুধু তাকেই চেয়ে থাকবে। মিহিরের এই প্রত্যাশিত হাসি একনাগাড়ে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে সাবিহা, বেশে সামিরা। মিহির সুরটি বাজিয়ে গেল। পুরনো ভাড়াটেরা অবাক হয়ে জানালর ফাঁকে চেয়ে আছে তাদের। আজ কত বছর পরেই না এই দৃশ্য পুনরায় দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে!
.
সমাপ্ত…
লেখা: ফারিয়া কাউছার
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here