কুয়াশা মন পর্ব ১৪

#কুয়াশা মন

পর্ব ১৪…

আমি যখন প্রথম শুনেছিলাম আমি বাবা হতে চলেছি, আমার মাঝে যেন আমিই রইলাম না। আমি ঠিক কতটুকু খুশি হয়েছিলাম, তা ওপর থেকে সাবিহা বুঝতে পারেনি। না বোঝারই কথা! আমি কখনো বাহির থেকে কোনো কিছু নিয়ে জোরালো কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি না। ওপর থেকে আমি সব পরিস্থিতিতেই স্বাভাবিকভাবে আচরণ করা শিখে গিয়েছি। আর এটি আমার স্বভাবে রূপ নিয়েছে অনেক আগেই। তাই সাবিহা সেদিন প্রশ্ন করেছিল, বাবা হতে যাওয়ার কথা শুনলে অনেকেই অবাক হওয়ার মত করে প্রতিক্রিয়া দেই, আমি কেন দেই না। আমার প্রতিক্রিয়া সকল আমার আর আমার অন্তরের মধ্যবর্তীতে। কাজেই বাহিরের কেউ আমার কোনো প্রতিক্রিয়া না-ই দেখার কথা। তবে আয়নার সামনে আমার মনোভাব একটু-আধটু বেরিয়ে আসে। যাই হোক, আমি দুইজনেরই যত্ন নিতে শুরু করলাম। নিজেকে ব্যস্ত করে তুললাম এই দুইজনের জন্যই। কারণ এই দুইজনই এখন থেকে আমার সর্বকিছু। আমি অল্প কয়েকদিনে সাবিহার কাছ থেকে রান্নাও শেখে ফেললাম, আর দুয়েক মাস গড়ালে সে একা সব কাজ করতে পারবে না ভেবে। সময়টা আসতেই আমি বেশ কয়েকদিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম, সবসময় ওর সাথে থাকা শুরু করে দিলাম।
.
যেদিন ডাক্তার তার ডেলিভারির ডেট দিয়েছিলেন, সে তখন থেকে কী ছটপটই না শুরু করেছিল! সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। দুয়েকবার তাকে কান্না করতে দেখেছি। আমি সামনে গেলে সে পূর্বেই চোখের পানি মুছা সেরে ফেলত। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে। আর এই কারণেই সেদিন দুর্ভাগ্যক্রমে পা মচকে ফেলল সে। আমি আর তাকে হাঁটাচলা করতে দিলাম না। সেদিন পা মচকে যাওয়ার দরুন তার মনের করুণ অবস্থা আরো গুরুতর হল। আমি তাকে সান্ত্বনা অনেক দিয়েছিলাম। কী ভেবে যেন সে আমাকে তার পাশেই বসে থাকতে বলছিল সারাক্ষণ। কেমন এক উৎসুক চাহনি দিয়ে সবটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিল সে। এমতাবস্থায় আমি ভেবে ফেললাম, জড়তা আর নয়। ওকে আমার মনে কথা আজ বলেই সারবো। বললে হয়ত সে কিছুটা স্বস্তি বোধ করবে। তাকে দুপুরে ঘুমোনোর জন্য শুয়ে দিয়ে বাহিরে চলে গেলাম। যেতেই কিছু লাল গোলাপ কিনলাম। একটি টেডিবিয়ার দিলে খারাপ হয় না। তার লাল রং খুব পছন্দ। আমি ভাবলাম, কেননা লাল একটা টেডিবিয়ার কিনি! এইটিই ভাল পরিকল্পনা। আমি এই তাগিদে মার্কেট ঘুরতে লাগলাম, লাল টেডিবিয়ার যদি পেয়ে যাই। ঘণ্টাখানেক মত চারিদিকে খুঁজলাম। ওরকম টেডিবিয়ার কোনোদিকেই মিলছে না। এলাম তো ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, এই ভেবে সাবিহাকে কল দিলাম। কল দিতেই সে রিসিভ করে ফেলল। সে এখনও ঘুমালো না! আমি তাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে, শীঘ্রই চলে আসছি বলে আশ্বাস দিলাম। তারপর আবার খোঁজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঠিক পাঁচ মিনিট পর সাবিহার কল এল। আমি উঠাতেই সে কেমন খসখসে গলায় বলল, “চলে আসুন না, প্লিজ, আমার ভালো লাগছে না। এতক্ষণ ডায়েরিতে লেখালিখি করে কাটিয়েছি। আর লিখছি না। প্লিজ, চলে.. ”
“হ্যাঁ, বলো।”
আমি অল্প কিছুক্ষণ এপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করে গেলাম, কোনো আওয়াজ আসছিল না আর। তারপর হঠাৎই চিৎকার ভেসে এল ওপার থেকে। আমি আরো জোরে চিল্লাতে লাগলাম হ্যালো বলে। বেশ কয়েকবার চিৎকার শেষে কাতর হয়ে সে মুখকে যেন চেপে বলল, “প্লিজ, চলে আসুন। আমার খুব ব্যথা হচ্ছে।”
আমি টেডিবিয়ার কিনতে গিয়ে অনেক দূর চলে এসেছিলাম। আমি তড়িঘড়ি করে বিশ মিনিটের দিকে চলে এলাম বাসায়। এসেই দেখি সে বিছানার পাশে করে ফ্লোরে পড়ে কাতরাচ্ছে আর চিৎকার করছে। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “এ কী হল? তুমি ফ্লোরে কেন?”
“আমার হাত থেকে মোবাইল ফসকে পড়ে গেছিল। বিছানা থেকে না নেমেই নিতে চেষ্টা করাই বেলেন্স হারিয়েছি।”
আমি তাকে ধরিয়ে উঠে বসালাম। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। সে-ই বলল, এই ব্যথা সহনীয় নয়, আমি পারছি না। আপনি আমাকে শীঘ্রই হাসপাতালে নিয়ে যান।
সে রীতিমত ঘামছিল। চিৎকার করে কাঁদছিল। বিল্ডিংয়ের সবাই কী ঘুমে অচেতন? নাকি আওয়াজই পৌঁছোয় না দ্বিতীয় তলা থেকে? আমি আসতে বিশ মিনিট দেরি করে ফেললাম। তার ওপর তাকে হাসপাতালে নিতেও সময় লেগেছে। সে কীভাবে ভুগেছে, কত কষ্ট ভুগেছে তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। নিজেই তার জন্য কাঁদছিলাম। যেতেই শুনলাম, তার অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। কাজেই সিজার করানো লাগবে।
লাঞ্চের সময়, ডাক্তার আসাতে দেরি হচ্ছিল। আমি সাবিহার হাত ধরে বসে রইলাম। ব্যথা বেশি লাগলে সে হয়তো ঠোঁটে কামড় খাচ্ছে, নয় চিল্লিয়ে উঠছে, নয়তো আমার হাতটিই চেপে ধরছে। আমি কাঁদছিলাম। সে মুখ তোলে বলল, “কাঁদছেন কেন?”
“তুমি শুধুই কি তোমার? আমার নও? ব্যথা আমারও যে লাগছে।”
সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ব্যথা ভুলে সে আমার দিকেই হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। আমি তার হাত দুটো চেপে ধরলাম।
“ভালোবাসি বলে কথা!”
তার ঠোঁটগুলো কাঁপছিল। তারপর দাঁত দিয়ে চেপে কান্না করার চেষ্টা করছিল। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
“চিন্তা করো না, আমাদের বাচ্চার কিছুই হবে না। ডাক্তার এসে পড়বে।
কেন যে তোমায় ছেড়ে গেলাম! ভেবেছিলাম তোমায় প্রথমবারের মত কিছু উপহার দেব। তা আর হয়ে উঠল না। ফুল নিয়েছিলাম। তাও হয়তো পথে পড়ে গিয়েছে।”
আমার চোখ দিয়েও অবিরাম পানি পড়ছিল। পকেট হাতরিয়ে দেখলাম, দুটো ছোট গোলাপ অবশিষ্ট আছে। আমি তা নিয়ে সাবিহার হাতে ধরিয়ে দিলাম। তখনই ডাক্তার প্রবেশ করল। নার্স এসে বলল আমায়, আমার কাছে বাহিরে যেতে হবে।
কিন্তু সাবিহা আমার হাত ছাড়ছিল না। ব্যথায় কাতর হয়ে কাঁদছিল। ডাক্তার বলছিল, আমার হাত যেন সে ছেড়ে দেয়। আমিও তাকে বোঝালাম। অবশেষে সে হাত ছেড়ে, দুটো হাতই বাড়িয়ে দিল। এই প্রথম সে আমাকে মায়ার টানে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি সবার সামনে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ডাক্তারও বললেন, “You may go for it and hurry please.”
আমি আর কারো তোয়াক্কা না করে তার পাশে গেলাম। সে আমায় কাঁপা হাতে জড়িয়ে ধরল আর বলল, “আমার জন্য টেনশন করবেন না। আমি সবসময় আপনার সাথে থাকব। আমাদের বাচ্চারও কিছু হবে না। আমি লুকিয়ে দেখেছি, আপনি বাচ্চার কথা শোনে কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলেন। ওর জন্য একটা নাম ভেবেছি। আলট্রাসনোগ্রাফিতে দেখেছিলাম মেয়ে হবে। তার নাম দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে সামিরাই দেব, বুঝলেন।” ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলল সে। আমি তাকে রেখে বাহিরে চলে এলাম। তবুও তার ব্যথাযুক্ত কান্না আমার কান পর্যন্ত আসছিল। আমি আর পারছিলাম না সইতে। বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে। বাহিরে এসে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। ভাবলাম একবার ভেতরে চলে যাব, কিন্তু তার বেহুঁশ হওয়ার পূর্বের কান্নার গুঞ্জন আমি আর শুনতে পারব না। আমার সেই সামর্থ্য ফুরিয়ে গেছে। আমি বাহিরে দশ মিনিট নাগাদ ছিলাম। তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ভেতরে গেলাম, এতক্ষণে হয়ত তাকে বেহুঁশ করিয়ে ফেলা হয়েছে। তেমনটাই হল, তার কান্না আর শুনলাম না। গিয়ে বসে রইলাম। সাহস জুগিয়ে আম্মুকে কল দিলাম। দিয়ে বললাম, কী কী হয়েছে। আম্মুর চাপাকান্না হয়ত কিছু কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম। অথচ সাবিহাকে এক সময় আম্মু পছন্দই করতেন না। আজ সেই সাবিহাই আমাদের সকলকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমাকেও যন্ত্র থেকে মানুষ বানিয়েছে। কত কীই না করেছে! তার ছটফটানোই কেবল চোখে ভাসছিল। (কিছু ফোঁটা ফোঁটা দাগ। কলমের কালি সেখানে বৃত্তের মত ছোপের সৃষ্টি করেছে।)
.
.
পৃষ্টার এটুকুতে লেখা শেষ। পরবর্তী পৃষ্টার তারিখে নজর পড়ল সামিরার। ঠিক দশ মাস পরের লেখা।
সামিরার অবিকল তার মায়ের মত দেখতে হয়েছে। আমার কেমন যেন লাগছে, সাবিহা যাওয়ার সময় তার বহুরূপী হিসেবে সামিরাকেই রেখে গেছে। বড় হয়ে হয়ত সে তার মায়ের মতই হবে, শান্তশিষ্ট, ভদ্র ও কোমল স্বভাবের। বেশিকিছুর প্রত্যাশা করবে না হয়ত। যেমনটা নিয়তি চায়, তেমনটাই সে মেনে নেবে। নিজের কথা হয়ত তার মায়ের মত খুব কমই ভাববে। আমি চাই আমার মেয়ে আমার মত না-ই হোক। আমি খুব খারাপ। আমি সাবিহাকে তার প্রাপ্যটুকু সময়মত দেইনি। আমি খুব বড় একটা অপরাধী। কেন সেদিন হাসপাতাল থেকে বাহিরে গেলাম? সেদিন যদি না যেতাম, আজ হয়ত সাবিহা আমার পাশেই থাকত। আমার সাথে থাকত সবসময়। কেন মেয়েটি এমনটা করলো? আমাকে তো সে খুব ভালোবাসত। কেন পর করে দিয়েছিল আমায়? কেন আমাকে এত কষ্টতে ভুগতে দিয়ে নিজেই স্বার্থপরের ন্যায় অন্য জগতে পাড়ি জমিয়েছে? আমি কি এতটাই নিকৃষ্ট? আমাকে কেন সে ফেলে চলে গেছে? সে কি জানত না, আমার ভালোবাসা সে-ই প্রথম ছিল?
সেদিন যখন সামিরার কান্নার আওয়াজ শুনেছিলাম, বুকের যন্ত্রণা যেন অল্প পরিমাণে লাঘব হয়েছিল। জানতাম না, অচিরেই আমি দুঃখের সাগরে ভাসতে চলেছি। ডাক্তার যখন বলল, আমরা একজনকেই বাঁচাতে পারলাম, তখন আমার চোখের সামনে যেন অন্ধকার ছেয়ে গেল। এইতো একটু আগে একটি কচি বাচ্চার কান্নার মৃদু আওয়াজ পেয়েছিলাম। তবে কে আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে?
“What do you mean dr.?” চিল্লিয়ে বলেছিলাম। ডাক্তার আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। আমার রক্ত যেন সিদ্ধ হচ্ছিল। আমি একবার চেয়েছিলাম, ডাক্তার বলুক, মিথ্যা ছিল এটি। মা-মেয়ে দুজনই সুস্থ আছে। কিন্তু কার্যত তা হল না। ডাক্তার বললেন, আমরা যখন বুঝেছিলাম, অবস্থা যখন বেশি ক্রিটিক্যাল, এই করুণ অবস্থাতে একজনকেই বাঁচানো সম্ভব, তখন আমরা আপনাকে খুঁজেছিলাম। আপনিই ছিলেন না। এমন সময় পেশেন্ট নিষেধ করলেন কথাটি আপনার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করতে। উনি নিজেই বললেন, উনার বাচ্চাকেই যেন বাঁচাই। তারপর আমরা ঐ কাজে তৎপর হলাম। আসলে একাজ আমরা শুধু পেশেন্টের বলায় দ্রুত করে ফেললাম এমনটা নয়, কারণ আমরা বুঝেছিলাম উনার অবস্থা এতই সংকটময় হয়েছিল যে, বাচ্চাকে না বাঁচিয়ে উনাকে বাঁচালেও উনার বাঁচার সম্ভাব্যতা কম ছিল। কাজেই দুজনকে একই সাথে হারাতেন। ডাক্তার হিসেবে আমি জীবন একটি হলেও বাঁচানোর উচ্ছ্বাস রাখি। দুঃখিত, আপনার স্ত্রীর পেইন উঠার সাথে সাথেই উনাকে নিয়ে আসা উচিত ছিল। বেড থেকে ফ্লোরে পড়েছেন নয়মাসের গর্ভবতী। কাজেই এটি নরমাল কেস নয়।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম উনার কথায়। আমার চারিটা দিক যেন গোলাকারভাবে ঘুরছিল। নাকি আমিই ঘুরছিলাম ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি। আমি সেদিন একজনকে নিয়েই ফিরলাম। দুর্ভাগ্যবশত সেজনের মন আর প্রাণকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে এলাম। নতুন জনকে হাসপাতালে রেখে এলাম। তার অস্বাভাবিক জন্মের কারণে দিন কয়েক তার সেখানেই থাকতে হচ্ছিল। মুক্তা, আম্মুরা ফোনের ওপর ফোন করে গেল। মরার মত কোন রুমের কোন ফ্লোরে পড়ে ছিলাম তা আমার হিসাবই ছিল না। এক সময় আমি খুব নির্জীব হয়ে পড়লাম। আমার চোখ দিয়ে জলও গড়াচ্ছিল না। ফোনটা হাতে নিয়ে মুক্তাকে বললাম, “চলে আয়, তোর বান্ধবীর মেয়ে তোকে ডাকছে।”
ও কিছুই বুঝছিল না। বললাম, “সাবিহা নেই বলে ও তোকে খুঁজছে।”
আমি ফোনটা কেটে দিয়ে হাসতে লাগলাম। স্বার্থপর। অবশেষে তুমিও আগের আম্মুর মত একটা কাজ করে গেলে। আব্বুর মত আমায় ভেঙে চুরমার করে গেলে। পার্থক্য হল, সে নিজের সুখের খাতিরেই স্বার্থপরতা করেছে, আর তুমি আমার খাতিরে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছিলাম। মুক্তা দিন কয়েকে ফিরে এল। আমাকেও হাসপাতালে নিয়ে গেল, চেক আপ করালো। দুর্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসছিলাম। সে কোনোভাবে কান্না লুকিয়ে আমাকে সংযত করানোর চেষ্টা করছিল। পাশেই তার রসিক স্বামী কেমন বাচ্চার মত করে ঠোঁট টেনে কাঁদছিল। এরা সবাই পাগল। আমার সাবিহা আমার সাথে আছে, কিন্তু কেউ বোঝে না। আমি হাসপাতালে দিন কয়েক পড়ে রইলাম। শরীরের অবস্থা চরমভাবে খারাপ ছিল, দিন চারেক শরীরে কোনো খাদ্যই ঢুকেনি বলে। মুক্তার স্বামী এসে আমায় নিয়ে গেল। ওহ, হ্যাঁ, ভুলেই গেলাম। তাকে তো রসিক মিয়া বলে ডাকি। যখন নিতে এসেছিল, হেসে হেসে বলেছিলাম, “কী ব্যাপার রসিক মিয়া? তোমাদের মত মানুষের মুখ কি কখনো এভাবে মলিন থাকে? কী হয়েছে তোমার?”
“আমার কিছুই হয়নি। তোমার শরীর খারাপ বলে তুমি নিজের জায়গায় আমাকে অস্বাভাবিকভাবে দেখছ। আমারটা বারোটা, তোমার নিজের অবস্থা তো তেরোটা।”
আমি শব্দ করে হাসলাম। “রসিক মিয়া, আমি হাঁটতে পারছি না। এভাবে ব্যর্থ চেষ্টা না করে কাউকে ডাকাও। রসিকতাই সবকিছুর সমাধান নয়, কাজেও থাকতে হয়। আমার তর সইছে না। আমি সাবিহাকে দেখবো, আজ এক সপ্তাহেরও বেশি ওকে দেখি না।”
রসিক মিয়া হকচকিয়ে গেলেন। চোখ বড় বড় করে দেখলেন আমার দিকে। আমার হাসিটা যেন দেখতে পাচ্ছিল না। শুরুতেই নিয়ে গেল নিজের বাসায়। মুক্তা ছোট্ট সাবিহাকে কোলে নিয়ে বসেছিল। বললাম, “সাবিহার জায়গাটা অন্য কেউ পাবে না। তুই যদি এই ছোট্ট সাবিহার একটু খেয়াল রাখিস তবে আমি তোর কাছে সারাজীবন ঋণী হয়ে থাকব। তুই যাই চাইবি তাই দেব।”
“এ কী বলছ ভাইয়া? তুমি ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। নিজের খেয়াল রাখো শুধু। আমিই ওর লালন পালন করব। তুমি দেখ, তোমার চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে, কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখখানা।”
“শোন্, ওর নাম দিবি সামিরা। সামিরা নাম দিবি।”
আমি নিজ ভাড়াটে বাসায় উঠে এলাম। মুক্তারা খুব করে জোর করেছিল সেখানেই রয়ে যেতে। যদি ওখানে থাকি নিজেকে আরো বেশি দুর্বল মনে হবে। তারচেয়ে বরং এখানে সাবিহার স্মৃতির সাথে থাকাই ভালো।
রসিক মিয়া এসে দিনে দুইবার করে দেখে যেতেন। আমার কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হত না দেখে খুব অবাক হতেন।
আজ আটমাসে পড়ল মেয়েটি। যখন সে আটবছরের হবে, না জানি কখন হুট করে জিজ্ঞেস করে বসে, আমার আম্মু কই?
কী বলব? সে আমার মনের ভেতর?
না, আমার জীবনে স্বার্থপরের কোনো জায়গা নেই। সামিরা যখন বড় হবে তখন মুক্তার দিয়ে বলিয়ে দেব, আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে। আমাদের একে অপরকে ভালো লাগে না বলে আলাদা হয়ে গেছি। তুই তোর ফুফির কাছে রয়ে গেছিস।
না, এমনটা ঠিক হবে না। আমি সাবিহাকে সবসময় আমার আশেপাশে চাই। কাজেই বলব, তোর আম্মু ভরণপোষণ করতে পারবে না ভেবে তোর ফুফি তোকে নিয়েছিল। এখন তোর ফুফি তোকে বাকি বাচ্চাগুলোর সাথে সামলাতে পারছে না বলে আমার কাছেই ফিরিয়ে দিয়েছে।
চলবে…
লেখা: Faria Kawser
[সম্ভবত আগামীতে এই গল্পের শেষ পর্ব দেয়া হবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here