কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -০১

ঐচ্ছি নীল চোখা ছেলেটির দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে কৌতুহল সহিত বললো,

‘আপনি মানুষ নন তাই না?’

ছেলেটা দারুণ অবাক হয়ে কপাল কুঁচকে জিগ্যেস করলো,

‘আপনি কি করে বুঝলেন?’

ঐচ্ছির ঠোঁটের কোণে চমৎকার এক হাসি ফুটে উঠল। উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,

‘আপনার মাত্রাতিরক্ত নীল চোখ আর গায়ের উষ্ণতাতেই টের পেয়েছি। তা মি. রাফসান জুবায়ের আপনি কি তবে জ্বীন?’

রাফসান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘জ্বি।’

ঐচ্ছির বড় বড় চোখ গুলোর স্বচ্ছ দৃষ্টি সূচের মতো তীক্ষ্ণ হলো। রাফসানের মুখপানে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো,

‘জ্বীন হয়ে মানুষকে বিয়ে করতে চাইছেন, ব্যাপার কি বলুন তো? আপনাদের জ্বীন জাতির মধ্যে কি মেয়ে জ্বীনের অভাব পড়েছে নাকি?’

রাফসান কফির কাপে চুমুক দিল। তারপর গলাটা হালকা ঝেড়ে বললো,

‘ব্যাপারটা তা না। আসল ব্যাপার হলো আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার গ্রামের বাড়ির পুকুর পাড়ে একদিন আপনাকে দেখেছিলাম। সময়টা হয়তো আজ থেকে প্রায় দুবছর আগে। তখন মেবি আপনার বয়স সতেরো ছিল। আপনাকে প্রথম দেখায় সেদিনই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আর সেদিন থেকেই মনে মনে ভেবে ফেলি বিয়ে করতে হলে আপনাকেই করবো।’

ঐচ্ছি অধর জোড়া গোল করে বললো,

‘ওহহ।’

হঠাৎই আবার টেবিলের উপর কিছুটা ঝুঁকে এসে বলে,

‘আর এখন যদি আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি না হই তবে?’

রাফসান কিঞ্চিত হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই বললো,

‘অবশ্যই হবেন। এছাড়া আপনার হাতে আর কোনো উপায় নেই।’

ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে বললো,

‘মানে?’

রাফসান হাত জোড়া টেবিলের উপর লম্বালম্বি করে রেখে ঐচ্ছির মুখের দিকে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

‘মানেটা খুব সিম্পল ঐচ্ছি। আপনার মা বাবাও এই বিয়েতে রাজি। আর একটা কথা কি জানেন তো আমরা জ্বীনেরা একবার কাউকে ভালোবেসে ফেললে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পিছ ছাড়ি না। আর আপনার উপরও একজন আশিক জ্বীনের নজর পড়েছে ঐচ্ছি, আপনি এখন হাজার চাইলেও তার নজরের বাইরে যেতে পারবেন না।’

কথাটুকু বলেই রাফসান সোজা হয়ে বসলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে বললো,

‘অনেকটা সময় হয়ে গিয়েছে। এবার বাড়ি ফেরার দরকার। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

ঐচ্ছি এখনও রাফসানের বলা আগের কথাগুলোই ভাবছে। মানুষ হয়ে জ্বীনকে বিয়ে করবে? এটা কখনো হয় নাকি? আর তার বাবা মা, উনারাই বা কি করে রাজি হলো এই বিয়েতে। ঐচ্ছির এবার খানিকটা ভয় লাগছে। তার সামনে আস্ত একটা জ্বীন বসা। কিন্তু সে ভীষণ অবাকও হচ্ছে। তার ধারণা মতে তো জ্বীনেরা দেখতে খুব ভয়ংকর হয়। কিন্তু, তার সামনে বসা সুঠাম দেহী পুরুষ জ্বীন টি তো নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ। তাকে দেখে তো বুঝারই উপায় নেয় সে একজন জ্বীন। কিন্তু ঐচ্ছি এত সহজে কি করে সেটা বুঝে ফেললো সেটাও সে বুঝতে পারছে না। সে তো শুধুমাত্র মজার ছলেই কথাটা বলতে চেয়েছিল। রাফসানের গাঢ় নীল চোখ দেখে প্রথমেই সে খানিকটা বিস্মিত হয়। এত নীল তো কোনো সাধারণ মানুষের চোখ হয় না। আর রাফসানের হাত থেকে কফির কাপটা নেওয়ার সময় তার গায়ের অতধ্যিক উষ্ণতাটাও সে টের পায়। ঐচ্ছি ঠোঁট কামড়াচ্ছে আর ভাবছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না এখন তার ঠিক কি করা উচিত। রাফসান ঐচ্ছির মুখের সামনে তুরি বাজিয়ে বললো,

‘হ্যালো ম্যাডাম, কি ভাবছেন এত?’

ঐচ্ছি চমকে উঠে বললো,

‘কই না তো কিছু না।’

‘ঠিক আছে, তাহলে চলুন।’

ঐচ্ছি ইতস্তত গলায় বললো,

‘আপনার যেতে হবে না আমি একাই বাড়ি যেতে পারবো।’

‘আমি জানি আপনি পারবেন তাও দায়িত্ববোধ বলেও তো একটা জিনিস আছে, তাই না?’

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ঐচ্ছিকে রাফসানের সাথেই বাড়ি ফিরতে হলো। ঐচ্ছিকে তার বাড়ির গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়েই রাফসান তার নিজ গন্তব্যের দিকে চলে গেল।

কাঁধের ব্যাগটাকে সোফায় ছুড়ে মেরে ঐচ্ছি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,

‘আম্মু! এই আম্মু! কই তুমি?’

রান্নাঘর থেকেই ঐচ্ছির মা গলা ছেড়ে বললো,

‘এসেই তোর চিল্লা চিল্লি শুরু তাই না?’

ঐচ্ছি এবার রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। গিয়ে দেখে তার মা ছোট মাছ রান্না করছে। ছোট মাছ তার ভীষণ প্রিয়। মুখে হাসি ফুটতে গিয়েও ফুটল না। মুখটা অমাবস্যা রাতের মতো কালো করে বললো,

‘আম্মু তুমি জানো রাফসান যে তোমার আমার মতো সাধারণ কোনো মানুষ না ও একটা জ্বীন?’

তাহেরা বেগম স্বাভাবিক গলায় বললেন,

‘হুম জানি তো।’

ঐচ্ছি বড় বড় চোখ করে তার মায়ের দিকে তাকাল। ভীষণ অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো,

‘জানো মানে? তুমি জানো মানে বাবাও জানে। আর তোমরা জেনে শুনে একটা জ্বীনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছো? এসবের মানে কি আম্মু?’

ঐচ্ছির আম্মু চুলার আঁচটা খানিকটা কমিয়ে ঐচ্ছির দিকে পূর্ণ মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘দেখ মা রাফসান তোকে খুব ভালোবাসে, আর রাফসানের পরিবারও খুব ভালো। জ্বীন হওয়া সত্বেও উনারা আমাদের মতোই স্বাভাবিক। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো রাফসানের সাথে তুই সুখে থাকবি। আর আমরা তোর সুখটাই চাই মা।’

‘তাই বলে তোমরা আমাকে একটা জ্বীনের সাথে বিয়ে দিবে? দুনিয়াতে কি মানুষের অভাব পড়েছে,আম্মু? আমি তো বুঝতেই পারছি না কি করে তোমরা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলে? দেখো আম্মু আমি আমার মত জানিয়ে দিচ্ছি, আমি কোনোক্রমেই কোনো জ্বীনকে বিয়ে করতে পারবো না। ভাবলেই তো কেমন লাগে।’

তাহেরা বেগম মেয়ের কথায় বিন্দু মাত্র চমকালেন না। তিনি নিজের কাজে আবারো মনোযোগ দিলেন। তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে পৃথিবী উল্টে গেলেও এই বিয়েটা হবে। তাই তিনি খুব নিশ্চিন্ত। মায়ের এমন দায়সারা ভাব দেখে ঐচ্ছি ভীষণ রেগে যায়। রাগে চেচিয়ে উঠে বলে,

‘শুনো আম্মু, আমি যখন বলেছি বিয়েটা করবো না তার মানে করবো না। বাবা আসলে বাবাকেও এই কথাটা বলে দিও।’

কথাটা বলেই নিজের রুমে চলে যায় ঐচ্ছি। রুমের দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সে। রাগে মাথার ভেতর ধপ ধপ করছে তার। মায়ের এই আচরণে যতটা না রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশি অবাক হচ্ছে সে। তার বাবা মা কিভাবে এই বিয়েতে রাজি হলো কোনোমতেই সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। চোখ বুজে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে হলো,’আচ্ছা ঐ জ্বীন টা আবার তার মা বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না তো? তাদের তো আবার সেই ক্ষমতা আছে।’ চিন্তায় কপালে লম্বা ভাঁজ পড়ল ঐচ্ছির। সত্যিই যদি এমন কিছু হয় তাহলে সে কি করবে? কিভাবে বাঁচবে সে এই জ্বীনের কাছ থেকে?

ঘুমের মাঝেই ঐচ্ছি টের পায় কেউ একজন খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে। কারো গরম নিশ্বাস তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। হঠাৎই সেই কেউ একজন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

‘ভালোবাসি ঐচ্ছি।’

এই সম্মোহনী কন্ঠের তীক্ষ্ণ সুরটা ঐচ্ছির কানে ঝংকারের মতো বাজতে লাগল। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে সে। অজানা এক অনুভূতিতে হাত পা কাঁপছে তার। কে এই ব্যক্তি? কার কথার স্রোতে এতটা উন্মাদ হয়ে উঠেছে ঐচ্ছি? ব্যক্তিটিকে দেখার জন্য ছটফট চোখ মেলে তাকায় সে। কিন্তু চোখের সামনে কাউকেই দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। সবকিছুকে নিছকই একটা কল্পনা ভেবে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নিলেই সে খেয়াল করে তার রুমের দরজাটা খোলা। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে রুমের দরজাটা আটকিয়েই বিছানায় শুয়েছিল সে। আর ঐ জ্বীনের ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে এই দরজাটা খুললো কে?

চলবে..
#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here