কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -০৩

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৩.
ভার্সিটির প্রথম ক্লাসটা কোনোরকমে করে এক প্রকার ছুটেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসে ঐচ্ছি। যদিও তার বেস্টি সায়মা তাকে হাজারটা প্রশ্ন করছিলো, কেন আজ সে ক্লাস করবে না,কি হয়েছে,সে কোথায় যাচ্ছে,তাকে কেন সাথে নিচ্ছে না হাজারো প্রশ্নে ঐচ্ছির মাথা খারাপ করে ফেলছিল। ঐচ্ছি কোনোরকমে সায়মাকে বোঝাল। ঐচ্ছির বলা খাপছাড়া কথা যে সায়মার তেমন একটা বিশ্বাস হয়নি তা সায়মার চোখ মুখ দেখেই সে বুঝতে পারছিলো। তবে এখন আর এসব পাত্তা দিলে চলবে না এখন তো তাকে অন্য কাজ করতে হবে। ভার্সিটির বাইরে থেকে একটা রিক্সা নিয়ে দশ মিনিটের পথ ছুটে এসে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে রিক্সা থামিয়ে নামল সে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়েই রেস্টুরেন্টটার ভেতরে গিয়ে এক পাশের একটা টেবিলে বসে পড়ল। অপেক্ষা এখন শুধু নাজমুল হুজুর আসার। একবার ঘড়ি তো একবার রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে তাকাচ্ছে ঐচ্ছি। কিছুক্ষণ বাদেই রেস্টুরেন্টের কাঁচের দরজা ঠেলে সাদা আল্লাখানা পরা এক লোক ভেতরে প্রবেশ করল। লোকটিকে দেখা মাত্রই ঐচ্ছির চোখ মুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। সেই লোকটিও ঐচ্ছিকে দেখে তার কালচে ঠোঁট জোড়া ছড়িয়ে বিনয়ের হাসি দিয়ে ঐচ্ছির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

‘আসসালামু আলাইকুম,ঐচ্ছি।’

ঐচ্ছি কাতর গলায় সালামের জবাব দিল। আজও সে পারলো না। ছোটবেলা থেকেই যখনই নাজমুল হুজুর তাকে পড়াতে আসতো তখন তিনিই সবার আগে সালাম দিতেন। ঐচ্ছি তখন অনেক চেষ্টা করতো হুজুরকে আগে সালাম দেওয়ার জন্য কিন্তু পারতো না প্রতিবারই হুজুরই তাকে আগে সালাম দিত। আজও তাই। ঐচ্ছি মুখ কালো করে বললো,

‘হুজুর, আজও আমি আগে সালাম দিতে পারলাম না।’

ঐচ্ছির কথা শুনে হুজুর হেসে ফেললেন। বললেন,

‘সালামের উত্তর দিয়েছেন না, সেটাই যথেষ্ঠ। তা কেমন আছেন আপনি?’

ঐচ্ছির মুখটা আগের মতোই কালো করে বললো,

‘ভালো নেই হুজুর?’

হুজুরের মুখের হাসিটা বিলিন হয়ে গেল। উনি ঐচ্ছির বরাবর চেয়ারটাতে বসতে বসতে বললো,

‘কি হয়েছে ঐচ্ছি? আপনার মা বাব ঠিক আছেন তো? কিছুদিন আগে তো আপনার বাবার সাথে আমার কথা হলো।’

‘না হুজুর আমার মা বাবার কিছু হয়নি। উনারা আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছেন। তবে ভালো নেই আমি হুজুর। মা বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।’

মাথাটা নিচু করে কথাটা বললো ঐচ্ছি। ঐচ্ছির কথা শুনে হুজুরের মুখে হাসি ফুটে উঠে। উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠে,

‘আলহামদুলিল্লাহ, এত ভালো খবর। আপনার তাতে মন খারাপ কেন,ঐচ্ছি?’

ঐচ্ছি অসহায় গলায় বললো,

‘হুজুর, আমার মা বাবা আমার বিয়ে একটা জ্বীনের সাথে ঠিক করেছে।’

ঐচ্ছির কথা শুনে হুজুর যেন বিশাল ধাক্কা খেলো। মানুষের বিয়ে কেউ জেনে শুনে কোনো জ্বীনের সাথে দেয় নাকি? চোখ দুটো বাকিয়ে ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে আছে নাজমুল হুজুর। ঐচ্ছির বলা কথাটা ঠিক হজম হচ্ছে না তার। বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থেকে তিনি নিরস গলায় বললেন,

‘এইসব কি বলছেন,ঐচ্ছি? আপনার মা বাবা আপনাকে জ্বীনের সাথে কেন বিয়ে দিতে চাইছে?’

ঐচ্ছি কাঁদো কাঁদো মুখ করে হুজুরের দিকে তাকায়। ভেজা গলায় বলে,

‘না হুজুর আমার মা বাবা রাজি হয়নি, ঐ জ্বীনটাই নিশ্চয়ই কিছু একটা করে আমার মা বাবাকে রাজি করিয়েছে। আর এখন আমাকেও হুমকি দিচ্ছে আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই তাহলে নাকি আমাকে জোর করে বিয়ে করবে। হুজুর আমাকে বাঁচান,প্লিজ। আমি ঐ জ্বীনকে মরে গেলেও বিয়ে করবো না।’

মাওলানা নাজমুল শেখের ললাটে গভীর ভাজ পড়ল। ব্রু জোড়া খানিকটা বাকিয়ে চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলেন তিনি। ঐচ্ছি যখন কালকে রাতে উনাকে কল দিয়ে দেখা করার কথা বলে তখন প্রথমে তিনি কোনোভাবেই রাজি হতে চাননি। একজন মাওলানা হয়ে এইভাবে একটা মেয়েকে নিয়ে রেস্ট্রুরেন্টে কথা বলাটা দৃষ্টিকটু দেখায়। কিন্তু ঐচ্ছি এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলে,তার এই কান্নার দরুন হুজুরকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়। কিন্তু তিনি তখন জানতেন না ঐচ্ছি তাকে কেন ডেকেছে, তবে এখন সব শুনে তিনি হতভম্ব না হয়ে পারলেন না। অপর পাশের চেয়ারটাতে হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে,ঐচ্ছি। চোখ মুখ শুকনো। মাথার হিজাবটাকে পেছন দিকে টেনে ঠিক করে ম্লান গলায় বললো,

‘হুজুর কিছু বলছেন না যে?’

নাজমুল হুজুর জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজালেন। অক্ষিপটের দৃষ্টি দৃঢ় রেখে বললেন,

‘সেই জ্বীনকে কি একবার ডাকা যাবে? আমি তার সাথে দেখা করতে চাই।’

ঐচ্ছির মুখটা এবার একেবারেই চুপসে যায়। মনের ভেতর তার বিন্দু পরিমাণ সাহস নেই যে সে রাফসানকে এখানে ডাকবে। ঐচ্ছি চোখ মুখ খিঁচে হাত কচলাতে থাকে। রেস্টুরেন্টে এসি থাকা সত্ত্বেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। ঐচ্ছির অস্থির মুখপানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নাজমুল হুজুর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঝরঝরে কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ভয় পাচ্ছেন,ঐচ্ছি? মানুষ হয়ে জ্বীনকে ভয় পাওয়াটা মানায় না ঐচ্ছি। একটা সময় ছিল যখন জ্বীন জাতি মানুষ জাতিকে ভয় পেত। কারণ আল্লাহ মানুষ জাতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে জ্বীন জাতিকে সেই ক্ষমতা দেননি। অথচ আজ এত ক্ষমতাবান হওয়ার পরও আমরা জ্বীন জাতিকে ভয় করছি। অথচ আল্লাহ আমাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে তাতে খুব সহজেই আমরা তাদের কাবু করে ফেলতে পারবো। তাই পয় পেলে চলবে না। মনে রাখবেন আপনি হলেন আশরাফুল মাখলুকাত,সৃষ্টির সেরা জীবের ভয় পাওয়া মানায় না। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?’

ঐচ্ছি উপর নিচ মাথা নাড়ায়। তার মানে সে বুঝেছে।

নাজমুল হুজুর এবার মৃদু হেসে বললেন,

‘আলহামদুলিল্লাহ, এবার তাহলে আপনি তাকে ডাকুন। বলুন এখানে আসতে।’

ঐচ্ছি কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে তার মোবাইলটা বের করে। ডায়েল লিস্টে গিয়েই রাফসানের নাম্বারটা পেয়ে যায়। বুকের ভেতরেটা খানিকটা কাঁপছে তার। রাফসান যদি সাধারণ কোনো মানুষ হতো তাহলে কখনোই তাকে এত ভয় পেত না সে,কিন্তু এত হলো মি.জ্বীন যার শীতল চোখের চাহনিতেই যে কারোর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। নিজের মনকে যথেষ্ঠ বুঝিয়ে রাফসানের নাম্বারটাতে কল লাগায় ঐচ্ছি। কল বাজার দুবারের মাথায়ই কলটা রিসিভ হয়,

‘আসসালামু আলাইকুম,ঐচ্ছি।’

শীতল এই শব্দ স্রোতে ঐচ্ছির বুকের ভেতর কেমন যেন প্রশান্তি ছেয়ে গেল। কিন্তু ঐচ্ছির মনের বানোয়াট ভয় সেই প্রশান্তিকে বেশিক্ষণ টিকতে দিল না। ক্ষীণ গলায় সালামের জবাব দিয়ে ঐচ্ছি বললো,

‘আপনি কি এখন ফ্রি আছেন,রাফসান?’

রাফসান একটু না বেশ খানিকটাই অবাক হলো। কোলের উপর থেকে লেপটপ সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। অধর জোড়া প্রশস্ত করে অবাক কন্ঠে বললো,

‘কেন বলুন তো?’

‘ফ্রি থাকলে আপনার সাথে একটু দেখা করতাম আরকি।’

ঐচ্ছির সোজা সাপ্টা কথাতেও খানিক চমকে উঠল রাফসান। যে মেয়ে তার সাথে কথা বলতেই বিরক্ত সে কিনা তার সাথে যেচে পড়ে দেখা করতে চাইছে? স্ট্রেন্জ!

রাফসান মৃদু স্বরে বললো,

‘কখন দেখা করতে চান বলুন, আমি ঠিক সময়ে চলে আসবো।’

‘আমি আপনার সাথে এখনি দেখা করতে চাই! কোথায় আসতে হবে সেটা আমি আপনাকে টেক্সট করে জানিয়ে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, প্লিজ।’

কথাটা বলেই ফোন কাটলো ঐচ্ছি। রাফসান কান থেকে মোবাইলটা সরিয়ে তার দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইল। তখনি ঐচ্ছির নাম্বার থেকে একটা টেক্সট আসে। সেটা দেখা মাত্রই রাফসান আর দেরি করলো না। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যের দিকে..

ঘড়ির কাটা ছুটল। এগারোটা থেকে বারোটা বাজল। রেস্টুরেন্টের স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো একজন সুদর্শন পুরুষ। ঐচ্ছির চোখ সেদিকেই আটকে গেল। মারাত্মক লাগছে রাফসানকে। জ্বীন বলেই কি সে এত সুন্দর? রাফসানের পড়া হালকা সবুজ শার্ট আর হুয়াট জিন্সটা যেন তার সৌন্দর্যকে আরো নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। উজ্জ্বল শ্যামলা রাফসানের গায়ের রঙ। অধর যুগল পিচ কালারের। গাঢ় নীলাভ চোখগুলোতে যেন সম্মোহনীর বিশেষ ক্ষমতা আছে। ঐচ্ছির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির চাহনিতে মুচকি হাসে রাফসান। উফফ কি মারাত্মক সেই হাসি। ইশ! আজ যদি এই সুদর্শন পুরুষটা জ্বীন না হয়ে মানুষ হতো তাহলে ঐচ্ছি চোখ বুজে তাকে বিয়ে করে নিত। কিন্তু সেটা আর এখন সম্ভব না। ঐচ্ছি তার দৃষ্টি সংবরণ করে। এতক্ষণ সে হেংলার মতো রাফসানের দিকে তাকিয়ে ছিল ভাবতেই সে লজ্জায় মিঁইয়ে যায়। ঐচ্ছির পাশে সাদা আল্লাখানা পরা লোকটাকে দেখে রাফসান খুব সহজেই বুঝতে পারে ঐচ্ছি তাকে কেন ডেকেছে। রাফসান চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখেই ঐচ্ছির সামনে এসে দাঁড়ায়। থমথমে গলায় বলে,

‘হঠাৎ এত জরুরি তলপে আমাকে ডেকে আনলেন? এনিথিং রং, ঐচ্ছি?’

ঐচ্ছি শুকনো ঢোক গিলে। ভয়ার্ত চোখে একবার নাজমুল হুজুরের দিকে তাকায়। নাজমুল হুজুর তাকে ইশারা দিয়ে আশ্বস্ত করেন। তিনি গম্ভীর গলায় রাফসানকে বললেন,

‘ঐচ্ছিকে আমিই বলেছিলাম আপনাকে ডাকার জন্য।’

‘আচ্ছা। তা প্রয়োজনটা জানতে পারি?’

‘জ্বি অবশ্যই তার আগে আপনি বসুন।’

ঐচ্ছির পাশের চেয়ারটাতে রাফসান বসেছে। দুজনের চেয়ার মাঝে কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান। রাফসান ঐচ্ছির অনেকটাই কাছে। ঐচ্ছি টের পায় রাফসানের গা থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। এটা কি কোনো পারফিউমের ঘ্রাণ। নাকি রাফসানের নিজস্ব শরীরের ঘ্রাণ। ঐচ্ছি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। রাফসান সোজা হয়ে বসলো। স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাজমুল মাওলানার গম্ভীর মুখপানে। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বললো,

‘এবার বলুন হুজুর কি বলতে চান?’

‘আপনি একজন জ্বীন হয়ে মানুষের মেয়েকে কেন বিয়ে করতে চাইছেন,রাফসান হোসাইন?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here