কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -০৯

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৯.
পড়ন্ত বিকেল। সূর্যের রক্তিম আভা তির্যক ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। দিবাকরের তেজও এখন অনেকটা কমে গিয়েছে। ঐচ্ছির জানলার পর্দার ফাঁক গলিয়ে তির্যক ভাবে হলুদ রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ছে তার ফ্লোরে। বিছানার হেডবোর্ডটার সাথে মাথা ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে সেই আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে সে। উদ্ভ্রান্ত সেই দৃষ্টি। মনটা বড্ড অশান্ত তার। ঐচ্ছি মাথাটা সোজা করে বড় করে একটা শ্বাস টানল। সঙ্গে সঙ্গে তার নাসিকারন্ধ্র দিয়ে খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ প্রবেশ করলো। ঐচ্ছি আবারো শ্বাস টানলো। সেই মিষ্টি ঘ্রাণ আরো তীব্র হলো। ঐচ্ছি সোজা হয়ে বসলো। মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘ্রাণটাকে আরো তীব্র ভাবে অনুভব করার চেষ্টা করলো। ঐচ্ছি ডান হাতের তর্জনী দিয়ে নাকের নিচটা একটু ঘষলো। এই ঘ্রাণটা তার খুব চেনা চেনা লাগছে। এটা কোনো পারফিউমের ঘ্রাণ না। কোথায় যেন সে এই ঘ্রাণটা পেয়েছিল। ঐচ্ছির মনে পড়ছে না কিছু। নির্বাক ভঙ্গিতে বসে থেকে ভাবতে লাগল। কিন্তু এত ঘেটেও মস্তিষ্ক তাকে সঠিক তথ্য জানান দিতে পারলো না। ঐচ্ছির মেজাজ বিগড়ে যায়। আর সেই ঘ্রাণটা এখনো সে পাচ্ছে। ইশ! বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আসে তার। তখনই তার রুমের দরজায় টোকা পড়ে। বাইরে থেকে নির্মল গলায় কেউ বলে উঠে,

‘আসতে পারি?’

ঐচ্ছির অধর কোণে হাসি ফুটে। সে জানে মানুষটি কে। ঐচ্ছি খুশ মেজাজে বলে উঠে,

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

দরজা ঠেলে ভেতরে আসে সাইভিদ। হালকা বাদামী টি শার্টের সাথে কালো টাওজার। ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো। চোখ দুটো কিঞ্চিৎ লাল। উষ্ণ অধর জোড়া নাড়িয়ে সে ঐচ্ছিকে বললো,

‘ফ্রি আছিস?’

ঐচ্ছি ম্লান হেসে বললো,

‘আমি তো সবসময়ই ফ্রি। কিন্তু কেন বলতো?’

অধরপল্লব প্রশ্বস্থ করে সাইভিদ মোলায়েম গলায় বললো,

‘বার্গার খাবি?’

ঐচ্ছির চোখ মুখ যেন খুশিতে ঝলমল করে উঠল। আহ্লাদী গলায় বলে,

‘অবশ্যই।’

সাইভিদ মৃদুহাস্য অধরে বললো,

‘ঠিক আছে। তৈরি হয়ে আয়, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’

সাইভিদ রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ঐচ্ছি খুশিতে নেচে উঠে। বার্গার তার ভীষণ পছন্দের খাবার। আর পছন্দের মানুষের সাথে পছন্দের খাবার খাওয়ার মজাটাই আলাদা। ঐচ্ছি উরাধুরা কতক্ষণ নেচে নিজেকে শান্ত করে। হাঁপিয়ে যাওয়ায় জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। তারপর আলমারি খুলে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
.
.
গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে সাইভিদ। ডানহাতের তর্জনীতে ক্রমাগত ঘুড়ে চলছে সেই গাড়ির চাবি। সাইভিদের চোখ মুখ ফ্যাকাশে। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে অধরপল্লব ছড়িয়ে বাঁকা হাসে সে। মনে মনে কিছু একটা ভাবে। তারপর নিরবে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঐচ্ছি আসছে। সাদা আর নীল রঙ মিশ্রিত একটা থ্রি পিছ পরেছে সে। ঘাড় পর্যন্ত লেয়ার কাট চুলগুলো গার্লি করা। মেয়েদের নাকি কাজল পরলে মায়ামী দেখায়, অথচ এই মেয়েটা কাজল পরে না তাও একে এতো মায়ামী লাগে কেন? সাইভিদ বুঝে উঠতে পারে না। ঐচ্ছির ঠোঁটের গোলাপি লিপস্টিক টার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। ঐচ্ছি সাইভিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। দুষ্টু হেসে বলে,

‘ভাইয়া, আজ তোমাকে ফতুর করে ছাড়বো।’

চোখে হাসে সাইভিদ। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

‘দেখা যাবে।’

.

গাড়ি থামতেই ঐচ্ছি খেয়াল করে তাদের বাম পাশে বড় এক রেঁস্তোরা। এই রেঁস্তোরাতে কখনো আসেনি সে। সাইভিদ গাড়ি থেকে নেমেই ঐচ্ছিকেও নামতে বলে। গাড়ি থেকে নামতেই ঐচ্ছির চোখে পড়ে একটা বড় বিলবোর্ডের উপর। সেখানে ইটালিয়ান ফন্টে বড় বড় করে লেখা ‘PIZZA HUT’

ঐচ্ছির ললাট জুরে ফুটে উঠে এক সমান্তরাল ভাজ। খসখসে গলায় সে সাইভিদকে ডেকে বললো,

‘এটা তো পিজ্জা হাট ভাইয়া। তুমি না বললে আমাকে বার্গার খাওয়াবে, তাহলে পিজ্জা হাটে কেন নিয়ে এসেছো? এইখানে তো শুধু পিজ্জাই পাওয়া যাবে।’

সাইভিদ নির্মল হাসে। দৃঢ় কন্ঠে বলে,

‘আগে তো ভেতরে আয়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে কি করে বুঝবি ভেতরে কি পাওয়া যায় না যায়।’

চোখ মুখ কুঁচকে সাইভিদের পেছন পেছন হাঁটা দেয় ঐচ্ছি। রেঁস্তোরার বাইরের দিকটা যতটা না সুন্দর তার ভেতরের দিকটা আরো বেশি সুন্দর। চারদিক ঝলমল করছে রঙিন আলোতে। বিশাল আয়োজনে ভেতরটা ডেকোরেশন করা। মাথার উপর বিশাল বিশাল ঝুলন্ত বাতিদান। পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের গালিচা। চেয়ার টেবিল গুলোতেও একটা সম্রাটি সম্রাটি ভাব। দুতালার রেঁস্তোরার উপরের তলায় সাইভিদ আর ঐচ্ছি বসেছে। আসার পর থেকেই ঐচ্ছির দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। কত কিছু দেখছে সে। তারা যে টেবিলে বসেছে তার সামনের দেয়ালটার পেন্টিংটা ঐচ্ছির বেশ পছন্দ হয়েছে। দূর থেকে কেমন চিকচিক করছে। যেন এই দেয়ালের পেছনে অন্য একটা জগত আছে। তার পাশেই একটা জায়গা আলাদা করে সাজানো হয়েছে ফটোসেশনের জন্য। অনেকে সেখানে বিভিন্ন পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। ঐচ্ছির ছবি তোলার প্রতি এত আগ্রহ নেই। তাই সে গালে হাত দিয়ে অন্যদের ছবি তোলা দেখতে থাকে।

সাইভিদের অক্ষিগোলকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঐচ্ছির দিকে নিবদ্ধ। রেঁস্তোরার সোফট মিউজিকের আলোড়নে ঐচ্ছির বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। সাইভিদের ঘোরালো দৃষ্টিতে যেন সে নিরব, নিস্তব্ধ। আবেগাহত হয়ে সে ক্ষীণ কন্ঠে সাইভিদকে জিগ্যেস করে,

‘ক-ক-কি দেখছো ভাইয়া?’

‘তোর ঠোঁট দুটো ভীষণ সুন্দর ঐচ্ছি।’

কেঁপে উঠে ঐচ্ছি। এসির শীতল বাতাসে হিম ধরে যায় তার শরীরে। চোখ নামিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাত কচলাতে থাকে। লজ্জায় এই বুঝি মারা পড়বে সে। সাইভিদ অধর জোড়া বাকিয়ে মৃদু সুরে বললো,

‘লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? মনে আছে তোর, ছোট বেলায় যখন একবার তোকে বিয়ে করার কথা বলেছিলাম তখনও তুই ঠিক এইভাবেই লজ্জা পেয়েছিলি?’

ঐচ্ছি নিশ্চুপ। চোখ মুখ খিঁচে নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টায় ব্যস্ত। সাইভিদ বাঁকা হেসে এক ওয়েটারকে ডাক দিল।

‘এই ঐচ্ছি, কি খাবি অর্ডার দে।’

ঐচ্ছি প্রসন্ন গলায় বললো,

‘বার্গার।’

‘এনিথিং এলস, ম্যাম?’

ঐচ্ছি মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘নো।’

ওয়েটার সৌজন্যমূলক হেসে সাইভিদের দিকে তাকালো। বললো,

‘স্যার আপনি কি নিবেন।’

সাইভিদ হেসে বললো,

‘যেহেতু আপনাদের পিজ্জা হাটে আসছি সেহেতু আপনাদের স্পেশাল পিজ্জাটাই খাওয়া যাক। আর হ্যাঁ সাথে দুটো কোলড্রিক্স দিয়েন।’

ওয়েটার মাথাটা হালকা নিচু করে বললো,

‘ওকে স্যার। থ্যাংক ইউ।’

ওয়েটার চলে যেতেই ঐচ্ছি গলা ঝেড়ে বললো,

‘আচ্ছা এখানে যদি সবই পাওয়া যায় তাহলে এই রেঁস্তোরার নাম পিজ্জা হাট রাখলো কেন? আমি তো নাম দেখে ভেবেছিলাম এখানে শুধু পিজ্জাই পাওয়া যায়।’

সাইভিদ ফোড়ন কেটে বলে,

‘তোর মতো মাথা মোটা মেয়েরা তো এমনই ভাববে। নাম পিজ্জা হাট বলে যে কেবল পিজ্জাই থাকতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি। এখানে আরো অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আর এখানকার বার্গারটাও বেশ সুস্বাদু।’

ঐচ্ছি চোখ পিট পিট করে সাইভিদের দিকে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো,

‘তুমি কি এখানে এর আগেও এসেছো নাকি? ৫ বছর তো দেশেই ছিলেনা। এক মাস হয়েছে ফিরেছো। এর মাঝেই এখানে কবে এলে?’

সাইভিদ হেসে ফেলে। বিদ্রুপ মাখানো হাসি। ঐচ্ছির কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,

‘হাসছো কেন?’

‘তুই যে মাথামোটা সেটা আবারও প্রমাণ করলি। আরে গরু এখন ইন্টারনেটের যুগে কি কোনো জায়গায় গিয়ে সেই জায়গা সম্পর্কে জানতে হয় নাকি? ঘরে বসেই তো নেটে সার্চ দিয়ে সবকিছু জানা যায়।’

ঐচ্ছি তেতো মুখে বলে,

‘হু, তো এতে হাসার কি হলো? আর একদম আমাকে মাথামোটা বলবে না। তোমার মতো আমি অত ব্রিলিয়েন্ট না ঠিকই তাই বলে এত গাধাও না।’

‘তুই গাধা কেন হতে যাবি? তুই তো হলি গাধী। জেন্ডারটাও ভালোভাবে পড়িসনি, তাই না?’

কথাটা বলেই আরেক দফা হেসে উঠে সাইভিদ। ঐচ্ছির সারা শরীর জ্বলে উঠে। ফোঁস ফোঁস করতে করতে মনে মনে বলে, আর জীবনেও এই বিলাতি ইন্দুরটার সাথে খেতে আসবো না। সুযোগ পেলেই আমাকে পঁচায়। হনুমান একটা।

ঐচ্ছি নাক মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে।

____________

রেঁস্তোরা থেকে বেরিয়েই ঐচ্ছি ঝলমলে গলায় বললো,

‘ভাইয়া আমি শপিং করবো।’

সাইভিদ তার কথায় পাত্তা না দিয়ে ম্লান গলায় বললো,

‘বিয়ের শপিং তো বরেরা করায়। আমাকে কেন বলছিস। তোর হবু বর রাফসান হোসাইন কে বল।’

ঐচ্ছি ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে,

‘উফফ, আমি বিয়ের শপিং এর কথা বলছি নাকি? এমনি শপিং করবো।’

‘টাকা আছে তোর কাছে?’

ঐচ্ছি বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘আমার টাকা দিয়ে কি হবে? শপিং তো করবো তোমার টাকায়।’

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে সাইভিদ হেয়ালি গলায় বলে,

‘পাগল পেয়েছে নাকি আমাকে যে আমি আমার পকেট খালি করে তোকে শপিং করাবো।’

ঐচ্ছির অনুনয়ের সুরে বললো,

‘প্লিজ, ভাইয়া!’

‘নো ওয়ে।’

শক্ত কন্ঠে বললো সাইভিদ। ঐচ্ছি নাকের পাল্লা ফুলিয়ে বললো,

‘হু, কিপটা কোথাকার। লাগবে না তোমার শপিং করানোর।’
,
,
পিচ ঢালা রাস্তায় মিডিয়াম স্পিডে গাড়ি চলছে। ঐচ্ছি জালনার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সাইভিদের দৃঢ় দৃষ্টি বাইরের সেই পিচ ঢালা রাস্তায়। ঐচ্ছির দিকে একবারও তাকাচ্ছে না সে। ঐচ্ছিও আর তাকায়নি। দুজনেই নিরব, নিস্তব্ধ। তাদের এই নিরবতার কারণ তারা নিজেরাও জানে না। হঠাৎই এই নিরবতাকে ডিঙ্গিয়ে সাইভিদ নরম গলায় বলে উঠে,

‘তুই এই বিয়েটাতে রাজি তো, ঐচ্ছি?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here