কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -২৫

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

২৫.
নিস্তব্ধ রাত। অস্থির পায়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছে ঐচ্ছি। জানলার ফাঁক গলিয়ে বাইরের মৃদু ঠান্ডা বাতাসগুলো ঘরে প্রবেশ করছে। বারান্দার দরজাটা খোলা, বারান্দায় গিয়ে ধুপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল সে। পেছনের দেয়ালটার সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ মেঘে লুকোচুরি খেলছে। ঐচ্ছি তাকিয়েই থাকে। কালো কালো দলা পাকানো মেঘগুলো কতটা যত্ন করে চাঁদটাকে তার নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে কিন্তু এই চাঁদটা মেঘের এই যত্ন ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে সেই মায়ার চাদর থেকে বেরিয়ে আসছে। মেঘও আবার জড়িয়ে ধরছে তাকে। চাঁদকে বুঝি মেঘ এত ভালোবাসে? এতবার করে চলে যেতে চাইছে তাও সে যেতে দিচ্ছে না। কতটা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখছে তাকে। রাফসানও তো তাকে ঠিক এইভাবেই ভালোবাসে। সেও তো কম চেষ্টা করেনি রাফসানের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার কিন্তু পারেনি, রাফসান তার ভালোবাসা দিয়ে বারবার তাকে আটকে দিচ্ছে। অথচ সে ঠিক ঐ চাঁদটার মতোই অবুঝ, চাঁদ যেমন মেঘের ভালোবাসা বুঝে না সেও তেমনি রাফসানের ভালোবাসা বুঝে না। কতটা স্বার্থপর তারা। ঐচ্ছি তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। গুণগুণ করে গেয়ে উঠে,

‘ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়,
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি, ভালোবাসি

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি

সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে অকারনে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
ভোলা দিনের কাঁদন
কাঁদন হাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি!!

এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি …… ‘

চোখ বুজে ফেলে ঐচ্ছি। কেউ একজন দূর থেকে তখন কম্পিত কন্ঠে বলে উঠে,

‘আমিও, ভালোবাসি ঐচ্ছি।

কিন্তু এই ভালোবাসার সুর ঐচ্ছির কর্ণকুহুরে বাজল না।
বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে ছিল সেখানে। ঘুম আসছে না। বাসায় অনেক ঝামেলা লেগে গিয়েছে। মা বাবা দুজনেই তার এংগেইজমেন্টের কথা ভুলে গিয়েছে। কথার প্রসংগে ঐচ্ছির খালামনি ঐচ্ছির বিয়ের কথা তুলেছিল। তাতেই যেন তাহেরা বেগম আর আদনান সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন। তাদের মেয়ের বিয়ে, এংগেইজমেন্ট অথচ তারা জানে না। দুজনেই যেন হতবাক। তারা যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে বাড়ির বাকি মানুষগুলো। ঐচ্ছির খালামনি আর সাইভিদ। দুজনে তো রীতিমতো আহাম্মক বনে গিয়েছে ঐচ্ছির বাবা মায়ের কথা শোনে। কাল এত আয়োজন করে উনারা ঐচ্ছির এংগেইজমেন্ট করলো আর আজ সেটা তাদের মনে নেই। এটা আদৌ সম্ভব। সাইভিদ তো শেষে রেগেই গিয়েছে যখন তাহেরা বেগম কোনো কিছু মনে করতে না পেরে ঐচ্ছিকে যা নয় তা বলে বকাবকি শুরু করে। ঐচ্ছির এখানে দোষ কোথায়? সে তো কিছু করেনি। সমস্যাটা উনাদের, উনাদের শারিরীক কোনো প্রবলেম হয়েছে তাই হয়তো কিছু মনে করতে পারছেন না। কিন্তু এইসব বলেও সাইভিদ তার খালা খালুকে বোঝ দিতে পারেনা। অবশ্য পারবেই বা কি করে? পুরো ব্যাপারটা নিজের কাছেই কেমন মিসট্যারিয়াস লাগছে তার। দুজনেই হুট করেই সব ভুলে গেল কি করে? এই ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ঐচ্ছির খালামনি তার বাবা মাকে রুমে পাঠিয়েছে ঘুমানোর জন্য। সকালে তারা এই নিয়ে আলোচনায় বসবে। কিন্তু, ঐচ্ছি জানে তার মা বাবা ঘুমাবে না, সারারাত ছটফট করবে। যেমনটা ঐচ্ছি করছে। তার জীবনের গতি যেন হারিয়ে গিয়েছে। ছন্দহীন এক বিরল পথে ছুটে চলছে এই জীবন। ঐচ্ছির ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ফুপিয়ে উঠে সে। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা চোখ মুখ লাল বানিয়ে ফেলে। মাথাটাও ধরে তার। তাও শান্তি পাচ্ছে। কেঁদে কেটে মনটা কিছুটা হলেও হালকা হয়েছে। দূর থেকে কেউ একজন ঐচ্ছির কান্না দেখে। বুকের ভেতরে এক তীক্ষ্ণ ব্যাথা সেও অনুভব করে। নিজের ভালোবাসাকে হাসিল করার জন্য ঐচ্ছিকে বড্ড বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে। বুক চিরে বেরিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস। ফোনটা ভাইব্রেট হতেই, রাফসান পাজামার পকেট থেকে সেটা বের করে। ঐচ্ছি কল দিচ্ছে। কলটা কেটে দেয় সে। আবারো ফোনটা বাজে। এবার কলটা কেটে দিয়ে সে নিজে কল ব্যাক করে। ফোনটা কানে নিতেই রাফসান শুনতে পায় ঐচ্ছির ফুঁপানোর শব্দ। এতক্ষণ দৃর থেকে দেখে যতটা না কষ্ট হচ্ছিল এখন তার কান্নার শব্দে কষ্টাও আরো তীব্র ভাবে বাড়তে লাগল। রাফসান কোনো কথা বলে না। ঐচ্ছিও না। রাফসান খুব মনোযোগ দিয়ে ঐচ্ছির কান্নার শব্দগুলো শুনছে। কাঁদতে কাঁদতে নাক টানল ঐচ্ছি। রাফসান তপ্ত কন্ঠে বললো,

‘খুব বেশী কষ্ট হচ্ছে, ঐচ্ছি?’

ঐচ্ছি এবার অনেকটা জোরেই কেঁদে দেয়। এতটা মায়া নিয়ে কেন কথা বলে সে? রাফসান কি বোঝে না ঐচ্ছির কষ্ট হচ্ছে? খুব কষ্ট। তারপরও কেন এইভাবে জিগ্যেস করে? কাঁদতে কাঁদতে গলা ধরে আসে তার। নাক টেনে ভেজা গলায় বলে উঠে,

‘আমার কষ্টের জন্য আপনি দায়ী রাফসান। কেন আমার জীবনে এলেন বলুন তো? আমার এই ছোট্ট গোছালো জীবনটাতে যবে থেকে আপনি এসেছেন তবে থেকেই সেটা অগোছালো হয়ে গিয়েছে। সবকিছু যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কিচ্ছু ঠিক নেই। হাজার চেষ্টা করেও আমি এখন ভালো থাকতে পারছি না। একটার পর একটা ঝামেলা লাগছেই। এত এত অশান্তি আমি আর নিতে পারছি না রাফসান। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। মা বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে। মানুষ দুটো কিছু মনে না করতে পেরে খুব কষ্ট পাচ্ছে। মেনেই নিতে পারছে না এইসব কিছু। রাফসান, জানেন এইসব কিছুর জন্য আপনি দায়ী। আপনি যদি আমার জীবনে না আসতেন তাহলে এত কিছু হতো না। আমার জীবনটাও সুন্দর হতো। বসন্তের রঙের মতো রঙিন হতো। কিন্তু আপনি এসে সবকিছু শেষ করে দিয়েছেন। এখন আর কিছু আগের মতো নেই। আমার জীবনটা এখন কেমন যেনো ব্ল্যাক এন্ড হুয়াইট হয়ে গিয়েছে। উফফ, আমি না বড্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছি এসব কিছুতে। কিন্তু একটা মজার ব্যাপার কি জানেন, আমি না এখন এই বিয়েটা ভাঙতে চাই না। আমার কাছে এখন এত সুযোগ, বিয়েটা ভেঙে ফেলার তাও আমার ইচ্ছে করছে না। জানেন আমার কি ইচ্ছে করছে? ইচ্ছে করছে বিয়েটা করতে। আপনার ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করছে। আপনাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। আর…’

থেমে যায় ঐচ্ছি। নোনতা জল চোখের কোণে ভিড় জমায়। চোখে ঝাপসা দেখে সে। চোখ পিট পিট করে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বলে উঠে,

‘আমি কে তবে আপনাকে ভালোবাসে ফেলেছি রাফসান?’

রাফসান চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস নেই। এটা কি সত্যিই ভালোবাসা? ঐচ্ছি তাকে ভালোবাসে? রাফসান মেকি হাসে। অতিরিক্ত কষ্টে মানুষ বোধ হয় এমন ভুলভালই বকে। রাফসান মৃদু স্বরে বলে,

‘ঘুমান ঐচ্ছি। অনেক রাত হয়েছে। শুভ রাত্রি।’

ঐচ্ছি নরম গলায় বলে,

‘আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না রাফসান?’

রাফসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,

‘আপনার এই প্রশ্নের উত্তর তো আমারও জানা নেই ঐচ্ছি। এই প্রশ্নটা বরং আপনি আপনার মনকে করুন সেই একমাত্র এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে।’

ঐচ্ছি এক মনে বসে থাকে। আকাশের চাঁদটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। মেঘের ভালোবাসার কাছে তাকেও হার মানতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। ঐচ্ছি অধর জোড়া প্রশ্বস্থ করে হাসে। ঝমঝমিয়ে বলে উঠে,

‘হ্যাঁ, আমিও ভালোবাসি আপনাকে। শুনতে পাচ্ছেন রাফসান? আমার মন বলেছে সে আপনাকে ভালোবাসে…ভালোবাসে আপনাকে।’

এই বলে ঐচ্ছি আবারও সুর ধরে,

‘ভালোবাসি, ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়,
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি, ভালোবাসি’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here