কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -৩৮

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৩৮.
দেখতে দেখতে চলে গেল বেশ কিছুদিন। হাতে আছে কেবল আর তিন দিন। বিয়ে নিয়ে পুরো দমে তোড়জোড় শুরু। দু দুটো বিয়ে একসাথে একদিনে তাই ব্যস্ততা যেন একটু বেশিই।
এক গাদা শপিং করেছে ঐচ্ছি আর সায়মা। প্রায় একই রকম তাদের পছন্দ। শাড়ি থেকে শুরু করে জুয়েলারি সব সেইম। সায়মা শপিং শেষে তার বাড়ি চলে গিয়েছে আর ঐচ্ছি চলে এসেছে নিজের বাসায়। এত এত শপিং করেও মন ভালো নেই তার। বাড়িতে এসেই শপিং ব্যাগ গুলো বিছানায় রেখে রাফসানকে কল দেয়। কলটা রিসিভ হতেই ঐচ্ছি অভিমানের সুরে বলে উঠে,

‘আপনাকে এত করে বললাম আসার জন্য তাও এলেন না। জানেন সাইভিদ ভাইয়া পুরোটা সময় সায়মার সাথে সাথে ছিল। সায়মার কি পছন্দ না পছন্দ সবকিছু ভাইয়া খেয়াল করেছে। আর আপনাকে আমি এত বললাম তাও এলেন না।’

ঐচ্ছি ঠোঁট গুঁজ করলো। চোখে মুখে একরাশ অভিমান তার উপচে পড়ছে। রাফসান তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। মৃদু সুরে বললো,

‘সরি। কি করবো বলুন, এইদিকে সবকিছু আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। আব্বাজান কিছুটা অসুস্থ আর সাদমান এতকিছু বুঝেও না যে ওর উপর সব দায়িত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। সরি ঐচ্ছি। আমারও ইচ্ছে করছিল আপনার সাথে থাকার জন্য, কিন্তু পারেনি। তার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। আচ্ছা তো কি কি শপিং করলেন?’

ঐচ্ছি অভিমানটা কিছুটা হলেও কমলো। মৃদু হেসে বললো,

‘অনেক শপিং করেছি। জানেন, আমি আর সায়মা সবকিছু সেইম সেইম কিনেছি। আমাদের শাড়ি, জুয়েলারি, জুতা আরো যা যা আছে সবকিছু সেইম। আর বিয়ের দিন আমাদের সাজটাও সেইম হবে।’

কথাটা বলে ঐচ্ছি কিছুক্ষণ থামল। রাফসান হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই ঐচ্ছি উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,

‘আচ্ছা, আপনার সাথে বর যাত্রীতে কারা কারা আসছে। যারা আসবে তারা সবাই কি জ্বীন?’

রাফসান মৃদু হেসে বলে,

‘না কেউ আসছে না। আমার বিয়ের কথা তেমন কেউ জানেই না। জানার মধ্যে কেবল আমার ছোট চাচাই জানেন। আর উনারা নাকি বিয়েতে আসবেন না। আব্বাজানও জোর করেননি। হয়তো এত এত মানুষের ভীড়ে কমফোরটেবল ফিল করবেন না। আসার মধ্যে আমরাই আসছি। আমি, আম্মাজান, আব্বাজান আর সাদমান।’

ঐচ্ছি হতাশ গলায় বলে,

‘ওহ!’

রাফসান বুঝে ঐচ্ছির হতাশ হওয়ার কারণ। তারও তো কিছু করার নেই।

তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বললো দুজন। রাফসানের কথায় ঐচ্ছি হাসলো, কিছু কিছু কথায় আবার লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো। মাঝে মাঝে অভিমানও করলো। তবে সবশেষে সে এইটুকু বুঝলো সে রাফসানের অস্তিত্বে মিশে গিয়েছে। রাফসানকে ছাড়া তার অস্তিত্ব অর্থহীন।

.

রাতে কিছুটা সময় পড়ার পর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল সায়মা। বিয়ের দিন যত এগুচ্ছে তার মনের অস্থিরতাটাও তত বেড়ে চলছে। কত শত চিন্তা তার মাথায় এসে ভীড় করছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ভালোবাসা ছাড়া কোন সম্পর্কই পূর্ণতা পায় না। সাইভিদ আদৌ তাকে ভালোবাসে কিনা কে জানে। বিয়ে নিয়ে সাইভিদও হয়তো খুব এক্সাইটেড তবে তাকে নিয়ে কতটা ভাবে সে? সায়মার মন মস্তিষ্ক জুড়ে সাইভিদ যতটা বিচরণ করে সাইভিদের মন মস্তিষ্ক জুড়েও কি সায়মাও কি ঠিক ততটাই বিচরণ করে? সায়মা বুঝে উঠতে পারে না। সেদিন রাতে যখন সায়মা সাইভিদের রুমে যায় তখন সাইভিদ অদ্ভুত এক কাজ করে, সে সায়মাকে একটা ডায়েরি দিয়ে বলেছিল এটা পড়ার জন্য। তবে কোনো এক অজানা কারণে সায়মা ডায়েরিটা পড়ে না। সে খুব যত্ন করে সেটা আলমারির একটা ড্রয়ারে তালা বদ্ধ করে রাখে। তবে সেটা পড়ার আগ্রহ এখনো তার মনে জাগেনি হয়তো কোনোদিন জাগবেও না। কারণ সায়মা জানে এই ডায়েরি পাতায় পাতায় সাইভিদ খুব নিখুঁতভাবে ঐচ্ছিকে ফুটিয়ে তুলেছে। এই ডায়েরিটার পড়ার অধিকার একমাত্র ঐচ্ছির, সেই অধিকার সে কোনোভাবেই হরণ করতে পারে না, কোনোভাবেই না। অস্থির মন নিয়ে সে যখন সাইভিদে ব্যস্ত তখনই তার ফোনটা বেজে উঠে। শোয়া থেকে উঠে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সাইভিদ। মনের অস্থিরতাটা তখন উত্তেজনায় পরিণত হয়। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করতে গিয়ে কলটা কেটেই ফেলে। সায়মার তো এবার নিজের উপরই ভীষণ রাগ হয়। এমনিতেই এই লোকটা তাকে কলই দেয়না আর যখন দিয়েছে সে রিসিভ না করে উল্টো কেটেই দিয়েছে। নিজের গালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করছে তার। কি দরকার ছিল এত ছটফট করার? আস্তে ধীরেও তো কলটা রিসিভ করা যেত। মুখ কালো করে সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সাইভিদের দ্বিতীয় কলের। কিন্তু এই ইগোয়িস্টিক পারসন তাকে আর দ্বিতীয়বার কল করলো না। বাধ্য হয়ে সেই কল দিল সাইভিদের নাম্বারে। সাইভিদ কলটা রিসিভ করলো, অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙিতে বললো,

‘কিছু বলবে?’

সায়মা তার প্রশ্নে বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। সাবলিল কন্ঠে বললো,

‘আপনি কল দিয়েছিলেন।’

সাইভিদ কিছু না জানার ভাব করে বলে,

‘কই নাতো?’

সায়মা ব্রু কুঁচকালো, তেতো মুখে বললো,

‘দিয়েছিলেন, আর আমি রিসিভ করতে গিয়ে ভুলে কেটে ফেলি।’

সাইভিদ হেয়ালির সুরে বললো,

‘হতেও পারে। ভুলে হয়তো চলে গিয়েছে।’

সায়মার রাগ হয়। বেটা তুই কল দিয়েছিস সেটা স্বীকার করলে কি হয়? সায়মা এখন বেশ বুঝতে পারছে সে কলটা কেটে দেওয়াতে সাইভিদের ইগোতে লেগেছে তাই সে ইচ্ছে করে এমন করছে। সায়মাও তবে কেন গায়ে পড়ে কথা বলতে যাবে। সে সোজা সাপ্টা বলে দেয়,

‘আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে রাখছি।’

রাখছি বলেও সে কলটা কাটলো না। সাইভিদও কাটেনি, ফোনটা কানে নিয়েই বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই দুজন বসে রইল। হঠাৎ সাইভিদ হাসলো, বললো,

‘অযথা আমার নিশ্বাসের শব্দ শুনে নিজের ফোনের টাকা কেন খরচ করছো?’

সায়মা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বোকা বোকা হেসে বলে,

‘না ভুলে গিয়েছিলাম রাখতে। আচ্ছা রাখছি, আল্লাহ হাফেজ।’

ফট করে কলটা কেটে দিয়ে ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। সাইভিদের চিন্তা তাকে ক্রমশ ঘিরে ধরে। ছেলেটা অদ্ভুত, তার কাজকর্মগুলোও অদ্ভুত। তবুও এই অদ্ভুত মানুষের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাজগুলো সায়মার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে..

____________________

পরদিন সকালে গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হলো ঐচ্ছিদের বাড়িতে। বিয়েতে বাইরের আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই বললেই চলে। ঐচ্ছির মা বাবা তেমন কাউকেই ঐচ্ছির বিয়ের খবরটা দেয়নি। কিভাবে দিবে, একটা জ্বীনের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে এই কথাটা পাড়া প্রতিবেশিকে কি করে জানাবেন তারা? এই নিয়ে ঐচ্ছির কিছুটা মনোক্ষুন্ন হলেও পরে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে সে।

কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরেছে ঐচ্ছি। সদ্য গোসল সেরে আসায় চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুচ্ছিলো, তখনি তাহেরা বেগম দ্রুত তার মেয়ের রুমে এলেন। ঐচ্ছিকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলে আবারও তিনি তার কাজে চলে গেলেন। ঐচ্ছি তার গায়ের শাড়িটা ঠিক করে আস্তে আস্তে সাজতে আরাম্ভ করলো।

বেশি সময় লাগল না, দশ মিনিটে সাজ কমপ্লিট। ঘরোয়া ভাবেই ঐচ্ছি আর রাফসানের হলুদ হচ্ছে। তাই আর ঐচ্ছি এত আহামরি সাজলো না। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ এই তার সাজ। চোখ জোড়া বরাবরের মতোই খালি। চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় বড় ঘোমটা টানল সে। ঐ সাজেই একটা সেলফি তুলে রাফসানে পাঠালো। রাফসান তাকে ম্যাসেজ দিয়ে বললো, ‘মাশাল্লাহ’। ঐচ্ছির ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ফুটলো। বুক চিরে বেরিয়ে আসলো অদ্ভুত এক প্রশান্তির নিশ্বাস।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here