কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৪৩.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
এ মহল্লায় একজোড়া পাখি আছে।এদের নাম লাভবার্ড দেওয়া যেত।কিন্তু বাচ্চা গুলো দিল না।তারা নাম দিল প্রেমিযুগল।মহল্লার অলিতে গলিতে চর্চা হয়।ওই যে রিঝের বাইক।কিছুক্ষণ পরেই ঘুরতে যাবে তারা।এটা সবাই জানে।রাস্তাঘাটে অধিক কেয়ারের ব্যাপার স্যাপার দেখে সবাই।কেউ অদ্ভুত আনন্দ পায়।কেউ জ্বলে।কিন্তু তাদের ভালোবাসায় কোন কমতি হয় না।মানুষের মতের পরিবর্তন হয়।তাদের ভালোবাসার হয় না।ভার্সিটিতে সবাই একদিন দেখা করতে যায়।কিছু পুরোনো বন্ধুর দেখা মিলে।সবাই তাদের তিনটি জুটির প্রেমের গল্প শুনে।কতই না আনন্দের সব।একটি কৃষ্ণচূড়ার ডালে যেমন শুধু একটি ফুল থাকে না।তাদের বেলাও ঘটেছে তাই।বহু সময়ের বন্ধুত্বে তারা একটি ডালে বাঁধা পড়েছে।রঙ্গে রঙ্গীন ভালোবাসার ডালে!সময় গুলো চলে যায়।পেরিয়ে যায় বছর।আজ আলভীর বিয়ে।ভালোবাসা সত্য হওয়া চাই।মন থেকে চাইতে হবে।তাহলেই যেন হৃদয়ে মিলন ঘটে।প্রীতি মন থেকে চেয়েছিল।তাই সে পেয়েছে।প্রীতি খুব করে বুঝাতে চেয়েছিল আলভীকে।শেষ দিন কেঁদে কেঁদে বলেছিল।আলভী তখন সোজা জানিয়ে দিল সে বিয়ে করতে পারবে না।কারণ জানতে মরিয়া প্রীতি।আলভী পার্কের বেঞ্চের উপরে বসে বলেছিল,’ দেখ প্রীতি।তুমি ডাক্তার।একজন ডাক্তারকে ডাক্তারের সাথে বেশি মানায়।আমি সামান্য ব্যাংকার।মানাবে না।’
পাগল প্রীতি তখন উত্তেজিত গলায় বললো,’ আমি ডাক্তারি ছেড়ে দিবো।তোমাকে বিয়ে করবো।আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।’
আলভী বিস্মিত।একটা মেয়ে কতটা পাগল হলে তার স্বপ্ন ছেড়ে দিতে চায়।তাও যখন সে স্বপ্ন সত্য হয়।এত আবেগ কই পায় এই সব মেয়েরা?আলভী গম্ভীর হয়ে বললো,’ ফালতু কথা রাখ।তোমার সাথে আমার কোন মিল নেই।তাই আমি চাই না আমরা এক হই।যাও এখন।’ প্রীতি মাথাটা নিচু করে বুকের উপরে রাখে।কি যেন ভেবে নেয় সে।তারপর বেশ সহজ গলায় বলে,’ তুমি বিয়ে না করলে কিন্তু আমি জীবনেও বিয়ে করবো না।’
‘ ভালো।করো না।বিয়ে করা একদম ফালতু একটা কাজ।’
প্রীতির কষ্ট হয়।কান্নার একটা ঢেউ চোখের কার্ণিশে জমে।হঠাৎ হঠাৎ বারান্দা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নিচে।আলভীর হৃদয় ভেদ করে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।সাবধানে সে প্রীতির হাত ধরে।এই প্রথম এত যত্নে হাত ধরতে দেখে প্রীতি কিছুসময় তাকিয়ে থাকে।আলভী বুঝিয়ে বলার প্রস্তুতি নিয়ে বললো,’ দেখ প্রীতি প্রথমত তোমাকে আগেই বলেছি তোমার সাথে ডাক্তারকে মানায়।দ্বিতীয়ত তুমি বড় লোক বাবার একমাত্র মেয়ে।বাবাও নাম করা ডাক্তার।কিছু জিনিস আমরা চাইলেও মিলাতে পারি না।অন্যদিকে আমি মধ্যবিত্ত।আমার বাবার মাথায় প্রায় দশলক্ষ টাকার লোন।বাড়ি তৈরি করার সময় নিয়েছে।একা শোধ করা বাবার জন্য কষ্টের।আমি বাবাকে সাহায্য করতে চাই।আমার বোনকে বিয়ে দিতে চাই।তুমি তো জানো আমি আমার বোনকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।তাকে সুখি দেখা আমার জন্য জান্নাতের সুভাসের মতই আরামদায়ক।আমি বড় ছেলে।অনেক দায়িত্ব কাঁধে।আমার বাবা মায়ের ছোট ছোট স্বপ্ন আছে।আমি সেগুলো পুরোন করতে চাই।বাবার একটা নীল রঙ্গের গাড়ির সখ ছিল।আমি সে সখ পুরোন করতে চাই।আর তুমি!তুমি বড়লোক বাবার মেয়ে।দুঃখ দেখনি।আমরা মধ্যবিত্ত হয়ে যেখানে আমার বোনকে এত আদরে রেখেছি সেখানে অর্থ দিয়ে তো তোমার বাবা তোমাকে রাজকুমারীর মত রাখে।তোমার চাহিদা অনেক।এতে তোমার দোষ নেই।আমরা ছোট থেকে যেভাবে গড়ে উঠি আমাদের জীবন চক্র ঠিক তেমনই হয়।তুমি চাইলেই রিক্সা চালাতে পারবে না।বা কুড়ে ঘরে থাকতে পারবে না।কারণ তুমি এডজাস্ট করতে পারবে না।জীবন এমনই।আমার সাথে মানাবে নিজের মত কেউ।বা আরো লো ক্লাসের কাউকে।তোমাকে না।আশা করি বুঝতে পেরেছ।’
আলভী হাত ছেড়ে দেয়।প্রীতির দিকে না তাকিয়ে সে উঠে যায়।হাতে টান পড়ে।পিরে তাকিয়ে দেখে,প্রীতি অশ্রুসিক্ত চোখ এক হাতে মুছে ইশারা করে।সে বসতে বলছে।আলভী এবার খুব বিরক্ত।এসব প্যাচাল তার ভাল লাগে না।সে বিশ্বাস করে না কিন্তু জানে।মেয়েদের কাছে অদৃশ্য পাওয়ার আছে।কখন কখন অপছন্দের ব্যক্তির বা নিষিদ্ধ নারীর প্রেমে না চাইতেও পড়তে হয়।তার নিজের চোখের জ্বলজ্যান্ত প্রমান আছে।রিঝ! ছোট থেকে সে দেখে এসেছে তার বোন কিছুক্ষণ পর পর বিচার নিয়ে আসত।ভাইয়া রিঝ ভাই আমার চুল টেনে দিয়েছে,স্কেল দিয়ে হাতে মেরেছে।কান মলে দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।এসবের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হত তাদের মাঝে।একদিন তো মারা মারি করেছে দুজনে।আলভী তখন রিঝের বুকের উপরে লাথি মেরে প্রশ্ন করেছিল,’ তুই সব সময় আমার বোনকে বিরক্ত করছ কেনো?ওরে মারছ কেন?’
রিঝও তখন খুব রেগে আলভীর পা ধরে ধপ করে ফেলে দেয়।জোরে ঘুষি বসিয়ে দেয় গালের পাশে।ঠোঁট ফেঁটে রক্ত বের হয় তার।ব্যথায় মনে হচ্ছিল মরেই যাবে।ছোট থেকেই রিঝের হাতে পায়ে শরীরে দারুন সব শক্তি।আলভীও কম না।দু’জনের দস্তা-দস্তিতে মাঠের সবাই খেলা ছেড়ে ছুঁটে এসেছিল।সবাই মিলে থামাতে চায়।আলভীর একটাই প্রশ্ন তুই আমার বোনের হাতে মারলি কেন?’আমার বোনের চুল টানলি কেন?’কুত্তা তোরে ছাড়মু না।’আমার বোনের কান ধরে টেনেছিস কেন?’ওকে কান ধরাস কেন?’
রিঝ তখন আগুন চোখে বলেছিল,’ তোর বোনকে দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়।বিরক্ত লাগে।তাই করি।আই হেট হিম।আমার আশেপাশে যেন না আসে।তাহলেই তো হয়।আমাদের বাসায় আসে কেন?সামনে দেখলেই মাথায় আগুন জ্বলে বুঝলি।’
তখন তারা মাত্র ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট ছিল।তুতুল ছোট বেলায় খুব রিঝ ভক্ত ছিল।কোন কারণ ছাড়াই সে রিঝের আশেপাশে থাকত।তাকে খুঁচিয়ে বিরক্ত করত।রিঝ শান্ত চুপচাপে ছিল।তাই তুতুলের খুব আগ্রহ হত।সেবার যে ঝগড়া হয়েছিল সেই ঝগড়ায় তারা একে অপরের সাথে কথা বলেনি দীর্ঘ একবছর।তারপর এক ঈদে মিল হয়।তার পরেও মাঝে মাঝে ঝগড়া হত।কিন্তু কে জানত এই’আই হেট হিম একদিন আই লাভ ইউর উপরেও চলে যাবে।’আলভী রাগী রাগী চোখে তাকায়।প্রীতি নাক টেনে টেনে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,’ তুমি কাকে বিয়ে করবে?’
‘ কাকে করবো সেটা আমার বাবা মা ডিসাইড করবে।আমার কোন পছন্দ নেই।’
‘ কেন নেই?বলো কেমন মেয়ে বিয়ে করবে?তা না হলে এখন সব লোক ডেকে বলবো তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ।’
প্রীতির এহেন কান্ডে আলভী হাতভম্ভ হয়ে যায়।তার চোখের পাতা পড়ে না।প্রীতির মত একজন ডাক্তার এমন বাচ্চাদের মত কথা বলছে?তার মাথা ধরে যায়।প্রীতি আবার কথা রিপিট করে।আলভী রাগে ফঁস ফঁস করে বললো,’ গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করবো।একদম ক্ষেত হবে।কথাই বলতে পারবে না এমন। খুঁশি।এবার আমাকে যেতে দেও আর বিরক্ত করবে না।আমার বাসার আশেপাশেও যেন না দেখি তোমাকে।আমার দূর্বলতাকে হাত করতে চেষ্টাও করবে না।আমার বোনের কাছ থেকে দূরে থাকবে।গট ইট।’
হনহনিয়ে জায়গা ত্যাগ করে আলভী।পিছনে একবার তাকায়নি।সে এখন বিশ্বাস করতে বাধ্য।মেয়েদের চোখে সত্যি পাওয়ার আছে।আর সে চোখ যদি জলে ভরা সমুদ্র হয় তাহলে তো সর্বনাশ!ডুবে মৃত্যু হবে নিশ্চিত।
কেঁটে যায় একটি মাস।রিঝ তুতুলের বিয়ে হবে সেদিন যেদিন তাদের সত্যি বিয়ে হয়েছিল।এক বছর টেকে গেছে।কিন্তু একটা কারণে সেই তারিখে বিয়ে করা সম্ভব হয়নি।তাই পরের বছরে নিয়ে আসা হয়েছে।অন্যদিকে আকাশ রূমাশ্রীর ঘরে নতুন অতিথির আগমন বার্তা চলছে।আসমা রামিম তাদের সংসার গুছিয়ে নিয়েছে।সময়ের ব্যবধানে কিছু মানুষ হারিয়ে গেছে।রামিমের মা মারা গেছে।আসমা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সংসার নিয়ে।তিনি যতদিন ছিলেন তার সময় ছিল অনেক।ঘরের রান্না তিনি করতেন।কাজের লোক কাজ করতেন।ছেলের প্রয়োজনীয় জিনিসও তিনি খুব যত্নে গুছিয়ে রাখতেন।কিন্তু এখন নেই।একটা মানুষ যখন হারিয়ে যায় আমরা তার প্রয়োজনীয়তা আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারি।ভরা স্থানের চেয়ে খালি স্থানে চোখ যায় বেশি।আসমা একজন মা পেয়েছিল।কিন্তু ভাগ্যের খেলায় তাকেও হারাতে হয়েছে।রামিম খুব সাহায্য করে।ঘরের কাজে।নিজের প্রায় জিনিস সে নিজেই গুছিয়ে রাখে।শুক্রশনি দু’জনে এক সাথে রান্না করে।বিকেলে ঘুরে।মাঝে মাঝে বাহিরে খায় পরিবার নিয়ে।আসমার বাবা মাঝে মাঝে মেয়েকে দেখতে আসে।তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান ধুমধামেই করিয়েছিলেন তিনি।কিন্তু মেয়ের মনে জায়গা তেমন করতে পারেননি।ছেলে মেয়ের জীবনে ভালোবাসা এবং অর্থ দুটোরই প্রয়োজন থাকে।অর্থ কম থাকলেও ভালোবাসা দিয়ে তা পূরণ করা সম্ভব।কিন্তু অর্থ দিয়ে ভালোবাসার জায়গা পূরণ হয় না।এখন তিনি মেয়ের সাথে থাকেন মাঝে মাঝে।রামিম দূরত্ব মিটাতে চায়।কিছুটা হলেও মিটেছে।তার বিশ্বাস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
সেদিন বাসায় এসে সারা রাত আলভীর ঘুম হয়নি।প্রেমে পড়তে না কি সময়ের প্রয়োজন পড়ে না।এটা হুট করেই আসে।এসব রূপকথা হলেও সত্য।বহু বছর একটা মানুষের সাথে থেকেও মানুষ প্রেমে পড়ে না।কিন্তু হঠাৎ কোন একদিন প্রেমে পড়ে যায়।আলভীর সাথে ঘটেছে সেই ঘটনা।সে প্রেমে পড়ে গেছে।শ্যামবতির প্রেমে।চোখের জলের প্রেমে।শ্যামবর্নের মেয়েগুলোর চোখে হয় অদ্ভুত সুন্দর।সেই চোখের কার্ণিশ যখন জলে পরিপূর্ণ থাকে তখন প্রেমে না পড়ে উপায় থাকে না।বাসার সবাইকে সে জানিয়ে দিয়েছিল প্রীতির সাথে কি কথা হয়েছিল।তুতুল এতে খুব রেগে যায়।প্রীতির সাথে তার খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।দু’জনে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছে।সে জানে তার ভাই হিরেকে পায়ে পিষে দিচ্ছে।সত্যিকারের ভালোবাসা হিরের চেয়েও মূল্যবান হয়।হিরে তো অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যাবে।কিন্তু কেউ যদি কাউকে কোটি কোটি ডলার দিয়ে বলে আমাকে ভালোবাসো।সে পারবে না।কারণ মন থেকে ভালোবাসা জন্মাতে হয়।এটা অনুভুতির চুড়ান্ত স্তর।কাজ না করলে ফল শূন্য।তুতুল জানে প্রীতি কত ভালোবাসে তার ভাইকে।তাদের মিল হলে খুব ভালো হত।কিন্তু আলভী সব ভেস্তে দিয়েছে।আলভীর রাতে ভালো ঘুম হয় না।সে স্বপ্ন দেখে।চোখ ভর্তি পানি নিয়ে একটি শ্যামবতি।কি অপূর্ব সুন্দর সে।শ্যামলা মেয়েরা এত সুন্দর হয়?আলভীর ঘুম ছুটে যায়।ঘামে একাকার শরীর।বুঝতে পারে সে গভীর ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে।আগে কখন প্রীতিকে তার আহামরি সুন্দর লাগেনি।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় সুন্দর নারী এই শ্যামলতা।প্রথম তার মা।দ্বিতীয় তার বোন।তৃতীয় সে!হায় সর্বনাশ।সে তো আগুনে পা দিয়েছে।নিজেকে সামলে নেয় সে।প্রীতি এই একমাসে সত্যি তাকে আর বিরক্ত করেনি।সে কি ভুলে গেছে?জীবনে এগিয়ে গেছি?যাওয়ারই কথা।কোনো এক ডাক্তারের সাথে বা কোটিপতির সাথে তার বিয়ে হবে।আলভীর কি যে হল।সে বুঝতে পারছে না।তার মনের অবস্থা অনেকটা কাছে আসলে দূরে ঠেলে দেয় আর দূরে গেলে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জ্বলে।
আলভী নিজেকে ব্যস্ত রাখে।অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে।খুব কাজ করে।বাসার সবাই তার পরিবর্তন দেখে।তুতুল রিঝকে সব বলে।রিঝ পাত্তাই দিল না।শুধু বললো,’তোমার ভাই আসলে গোয়ার মানুষ।পাবেও আর এক গোয়ার।সেও কম না।বাদ দেও।’
একদিন আলভী সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে আসে।দরজা খুলতেই দেখে প্রীতি।আলভী চমকায়।একটানা তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ তার মনে হল প্রীতি অদ্ভুত সাজে আছে।সে প্রশ্ন করে,’এসব কি পড়েছ।’ প্রীতি কথা বলে না।শুধু তাকিয়ে থাকে।আলভী ভিতরে ডুকে।দেখে প্রীতির বাবা ভাই।তুতুল কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’ভাইয়া তোর কপাল পুরাই চান্দের লাহান।তোর সব বন্ধু মেয়ে পছন্দ করতে মেয়ের বাড়ি যায়।আর তোর বউ নিজেই তোরে পছন্দ করে বাবা ভাইরে নিয়া হাজির হইছে।’আলভী অবাক হয়ে প্রীতিকে জিজ্ঞেস করে এগুলো কি?প্রীতি কথাই বলে না।ইশারা করে কিসব বুঝায়।আলভী বুঝে না।প্রীতিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে।পুরো গ্রামের মেয়ে সেজে এসেছে সে।আলভী বুঝতে পারছে না গ্রামের মেয়ে কেন সাজল।বিয়ের কথা হয়।আলভীর বাবা মা রাজি হয়।আলভীও রাজি।প্রীতি অবাক।মনে মনে ভাবে গ্রামের মেয়ে এত পছন্দ?আগে বললেই হত।সারা দিন গ্রামের মেয়ে হয়ে ঘুরত।হসপিটালে যেত।আলভী রাজি শুনে প্রীতি খুশিতে আত্নহারা হয়ে সবার সামনে আলভীকে জড়িয়ে ধরে।আলভী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।বাবা মায়ের সামনে এসব তার একদম পছন্দ না।কিন্তু তারও খুব ভালো লাগছিল।প্রীতিকে যাই বলা হচ্ছে সে হাত নাচাচ্ছে।আমিনা এবার একটু নিচু কন্ঠে প্রশ্ন করে,’ তোমার গলায় কিছু হয়েছে মা?’
প্রীতি কিছু বলতে নিয়ে মনে পড়ল সে তো বাবো।তাই মাথা দু’বার দু’দিকে ঘুরাল।সবার থমথমে চিন্তিত মুখ দেখে প্রীতির বাবা বললেন,’ও আপাতত বোবা।’
আলভী বলল,’ কেন? ওতো কথা বলতে পারে?’
‘ পাড়তো।তুমি যখন থেকে বলেছ তুমি গ্রামের ক্ষেত মেয়েকে বিয়ে করবে।যে কথাই বলতে পারে না।তখন থেকে আমার মেয়ে এভাবে আছে।’
আলভী তীক্ষ্ন চোখে একবার পরখ করে দেখে বললো,’ আমি কথা বলতে পারে না মানে বুঝাতে চেয়েছি সে শুদ্ধ ভাষা পাড়বে না।গ্রামের ভাষায় কথা বলবে।আর এসবের মানে কি?পাগলামির লিমিট থাকা উঁচিত প্রীতি।’
প্রীতি এবার ভাবে সে কতটা বোকা।ছেলেটা তার মত বুদ্ধীমান মেয়েকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোকার কোটায় দাঁড় করিয়েছে।প্রীতি রাগী চোখে তাকাল।আলভী হাসলো।প্রীতির বাবা রসিক মানুষ।আলভীর কাছ ঘেঁষে তিনি বললেন,’ প্রেমিকদের লিমিট থাকে না শুনেছি।প্রেমিকার প্রথম দেখলাম।আসলে বাপের মত হয়েছে।তোমার শ্বশুর প্রেমিক মানুষ ছিল।’
তিনি বাম চোখ মারে।আলভী ভিড়মী খায়।মেয়ের মত ডেঞ্জারাস বাপ।আল্লাহ্!প্রীতি আলভীদের ছাদে অপেক্ষা করছিল আলভীর জন্য।সে আসতে দেরি করে।তাও আসত না।তুতুল ঠেলে ঠুলে পাঠিয়েছে।দু’জনে প্রথমে চুপ করে থাকে।প্রীতি সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।রিঝ তখন ফোনে ব্যস্ত ছিল।তুতুল বারান্দায় যায়।চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে,’ শুনুন ওই যে ভাইয়া শুনুন।ভাইয়ার বিয়ে প্রীতি আপুর সাথে ঠিক হয়ে গেছে।
রিঝ শুনেও না শুনার ভান করে।ফোন রেখে তুতুলের বারান্দায় চোখ রাখে।ততক্ষণে তুতুল ক্ষেপা।রিঝ কাগজে কিছু লিখে পাথরে মুড়িয়ে তা ছুড়ে মারে।একদম সোজা তুতুলের ব্যালকনিতে পড়ে।তুতুল তুলে না।সে দোলনায় বসে।রিঝ বার বার ইশারা করে তুলতে।অনেক্ষণ এভাবেই চলে।তারপর তুতুল তুলে।তাতে লেখা,রাগলে তোমাকে আগুন লাগে।মন চায় গায়ে লেপ্টে জ্বলে যাই।তাই একটু রাগিয়েছি।স্যরি!’
তুতুল ভেবেছিল অন্যকিছু হবে।রিঝ শিস বাজায়।গানের দুটো লাইন সে শিস বাজিয়ে সুরের মাধ্যমে গায়।’I have loved you for a thousand years I’ll love you for a thousand more. তুতুল চোখরাঙ্গিয়ে বলে,’ নিষেধ করেছিনা এভাবে বাজাবেন না।সাপ চলে আসবে তো।’
রিঝ প্রতিবারের মত হাসে।প্রীতি উপর থেকে এসব দেখে।আলভীও দেখে।আলভী কোন কথা খুঁজে পায় না।কি বলবে ভাবে।তখন রাগের অভিনয় করে সে বললো,’ হারামিটা আমার বোনের সাথে বারান্দা ট্যু বারান্দা প্রেম করছে।’
‘ তুমি তো প্রেমই করতে পারো না।কিছু শিখো।কত কেয়ারি সে।তোমার বোন খুব লাকি।তোমার মত ভাই।রিঝের মত জীবন সঙ্গী।তোমার বাবা মায়ের মত মা বাবা।শ্বশুর বাড়ি।সব তৈরি।শুধু ভালোবাসা তার জীবনে।’
আলভী মুগ্ধ চোখে রিঝের দিকে তাকায়।দু’জন তখন পাথর ছুড়ে চিঠি আদান প্রদান করছিল।এগুলো তুতুলের আইডিয়া।রিঝের মাথা থেকে এসব আসতো না।কিন্তু পদ্ধতিটা তার খুব পছন্দ।এক কথায় প্রিয় এখন।মাঝে মাঝে কিছু পাথর পরে নিচে পথচারীদের গায়ে।দু’জনেই তখন বারান্দার নিচে বসে লুকিয়ে পড়ে।এভাবে তাদের প্রতি রাতের দীর্ঘ সময় হুট করেই শেষ হয়ে যায়।কখন কখন সারা রাত এভাবে চলে।তুতুল তো ঘুমায়।কিন্তু রিঝ না ঘুমিয়ে অফিস যায়।এত পরিশ্রমের মাঝে একটা তৃপ্তি আছে।আলভী কন্ঠ নরম করে বললো,’ রিঝ খুব ভালো রাখবে আমার বোনকে।তোমার কি মনে হয়?’
‘ পাগল না কি আমি,যে মনে হয় টাইপের কথা বলবো।আমি শিউর।এতো ভালো তুমিও তোমার বোনকে বাসো না।আমি নিজের চোখে রিঝের ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি।এই মেয়েকে সে পাগলের মত ভালোবাসে।না পেলে হয় তো পাগলই হয়ে যেত।’
আলভী প্রীতির দিকে তাকায়।প্রীতি শান্ত হয়ে শুধু তাদের দেখছে।তাদের হাসিতে কুটি কুটি হওয়া দৃশ্য তাকে খুব টানছে। সে দিকে তাকিয়ে প্রীতি বলে উঠে,’ আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না।শুধু তোমার বাবা মা রাজি হয়েছে তাই বিয়ে করছ।’
‘ কে বললো তোমায়?’
‘ আমি জানি।’
‘ তুমি তো সব সময় বেশি জান।আজ এতো কম জানলে কিভাবে?’
‘ মানে?’
‘ মানে খুব সহজ তুমি ভুল জান।’
প্রীতি অবাক হয়ে আলভীর দিকে মুখোমুখি ঘুরে।আলভী আগে থেকেই তাকিয়েছিল।কি চোখ!প্রীতি কেঁপে উঠে সেই চোখের চাহনীতে।যা সে বছরের পরে বছর দেখতে চেয়েছিল আজ তা আলভীর চোখে।প্রীতি খুশিতে আত্নহারা।কিন্তু তার চোখে পানি।কিছু সুখ জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে।এর নাম দেওয়া হয় খুশির পানি।আলভী প্রীতির দুটি হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো,’ আমি হয় তো গল্পের নায়ক বা ছবির নায়কের মত হতে পারবো না।কিন্তু আমি ভালোবাসতে পারবো।সাধানত ভাবে।যেমন আমার বাবা আমার মাকে ভালোবাসে।দীর্ঘ সংসার জীবনে এক সাথে আছে।ঠিক তেমন।কিন্তু আমি এখনো বলছি তুমি আমাদের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না।’
প্রীতি কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।আজ আলভী খালি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না।সেও জড়িয়ে ধরে।কিছুক্ষণ তারা এভাবেই থাকে।প্রীতি হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে বললো,’ আমি কি এলিয়েন??’
‘ এলিয়েন হবে কেনো?’
‘ তাহলে বার বার কেন বলছ আমি মানিয়ে চলতে পারবো না?তোমারাও মানুষ আমিও মানুষ।মানুষের সাথেই তো মানুষের সম্পর্ক হয়।অর্থের সাথে তো আর সম্পর্ক হয় না।আর আমি আহামরি কিছুই না।আমার বাবা আমাকে সঠিক শিক্ষা দিয়েছে।’
একটু থেমে প্রীতি দম নেয়।তারপর আবার বলে,’আমিও তোমার সাথে তোমার স্বপ্ন,দায়িত্ব পুরোন করতে সাহায্য করবো।তোমার সঙ্গী হবো।’
‘ আমি তোমার সাহায্য কেন নিবো?এই জন্য বলেছি আমি তোমার সাথে মানিয়ে চলতে পারবো না।তুমি এখন থেকেই দয়া দেখাচ্ছো।’ আলভী রেগে যায়।প্রীতি আবার জড়িয়ে ধরে।কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,’ সব সাহায্য টাকা দিয়ে হয় না।আমি তোমার সঙ্গী হয়ে সঙ্গ দিবো।যেমনই পরিস্থিতি আসুক এক সাথে থাকব।আমি সেটার কথা বলেছি।ভুল বুঝো কেন।’
আলভী হাসলো।আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।ভালোবাসার অনুভুতি গুলো চাঁদের আলোর মত জ্বল জ্বল করছে।তুতুলের একটা পাথরে মোড়ানো চিঠি পড়ে একটা লোকের মাথায় লোকটি কাগজ পড়ে।তাতে লেখা,’ আপনি একটা অসভ্য।’
লোকটা প্রচন্ড রেগে উপরে তাকায়।ছাদে আলভী আর প্রীতি কথা বলে বলে হাসছিল।লোকটি মনে করে তারা এসব করেছে।বাজে একটা গালি দিয়ে চলে যায়।রিঝ আর তুতুল হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।চারপাশ মুখরিত হয়ে সেই হাসি শুনে।এই হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে।🥀
__________________
‘ আমি তোমার সাথে ব্রেকাপ করতে চাইনি।বাধ্য হয়েছি।’ শান্ত গলায় কথাটা বললো ইয়াজ।তুতুল বিশ্বাস করলো না।সে উঠে যেতে নেয়।ইয়াজ অনুরোধ করে বসতে।তুতুল কাট কাট গলায় বললো,’ ফালতু কথা বন্ধ করুন।’
ইয়াজ শুনে না।সে আবার একুই কথা বলে।তুতুল রেগে যায়।উঠে যেতে নেয়।ইয়াজ তখন রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর শুরু করে।তুতুল একটু দমে যায়।ভয় ভয় করছে তার।চারপাশের সব মানুষ তাকেই দেখছে।আজ তার ভাইয়ের বিয়ে।যেতে হবে তাকে দ্রুত।সে জানে তার ভাই তাকে ছাড়া জীবনেও বিয়ে কবে না।এমন কি প্রীতিদের বাড়িতেও যাবে না।তুতুল বাড়ির পাশের বাজারে এসেছে।প্রীতিকে দেওয়ার জন্য যে গহনা তৈরি করা হয়েছে তার কয়েকটা হুকে সমস্যা ছিল।তাই পাশে একটা দোকানে ঠিক করতে দিয়েছে।সবাই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় সে এসেছে।একা আসেনি তাকে রিঝ নামিয়ে দিয়েছিল।কেউ একজন এসে বললো তাকে একটি ছেলে রেস্টুরেন্টে ডেকেছে।রিঝ মনে করে তুতুল আসে।কিন্তু এসে দেখে ইয়াজ।তুতুল চলে যেতে নেয়।ইয়াজ টেনে নিয়ে আসে।কোন কথা না বলে সোজা একটা কথাই বললো।তুতুল এবার যেতে চেয়েও পারছে না।সবাই তার দিকে জহুরি নজরে তাকিয়ে আছে।ইয়াজ নিজের চুল মুঠো করে টেনে ধরে।তুতুল কিছু বুঝতে পারছে না।তার খুব ভয় লাগছে।চারপাশে চোখ বুলিয়ে রিঝকে খুজে।ইয়াজ জোড়ে থাবা মারে টেবিলে।চিৎকার করে বলে,’ আমাকে তো এতো ভালোবাসতে না?এতো কেন একটুও বাসতে না।তাহলে রিঝের মাঝে এমন কি আছে যে ওকে এতো ভালোবাসো?’
তুতুল কিছু বলতে নিয়ে বুঝতে পারলো তার গলা শুকিয়ে গেছে।কথা বের হচ্ছে না।ইয়াজ সামনের ফুলদানি গ্লাস ছুড়ে মেরে ফেলে দেয়।তুতুল ভয়ে কেঁপে উঠে।সবাই এবার আগ্রহ দিয়ে দেখছে।ইয়াজ কর্কশ গলায় বললো,’ আমি তোমাকে ছাড়তে চাইনি।’ ‘ ছেড়ে তো দিয়েছেন।তাহলে এখন এত তামাশা করছেন কেন?প্লিজ যেতে দিন।’
ইয়াজের ক্রোধ তুঙ্গে।আগুন চোখ নিয়ে তুতুলকে দেখছে সে।হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল।বসে পড়ল চেয়ারে।এক গ্লাস পানি চাইলো।পানি খেয়ে সে গলা পরিষ্কার করলো।তারপর ধীরে ধীরে বললো,’ শুনো রিঝ যাকে তোমার এতো বিশ্বাস আসল কালপিট সে।’ ‘ একদম উনাকে নিয়ে আজে বাজে কথা বলবেন না।উনি তো কখন আপনাকে নিয়ে বাজে কথা বলেনি।’ ‘ বলবে কেনো তার কাজ মানুষের দূর্বলতার ব্যবহার করা।’তুতুল এবার ধীরজ হয়ে বসলো।শান্ত গলায় বললো,’যেমন ?’‘ রিঝ প্রথম থেকে আমাদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি।সেই ছোট থেকে ওর আমাতে সমস্যা।তোমাকে আমি বলিনি কখন সেই ছোট থেকে ও মাঝে মাঝেই আমার গায়ে হাত তুলতো।শুধু শুধু এসে ঝগড়া করতো।আমি ওকে চিনতামই না।দলবল নিয়ে মারতো না।কিন্তু ও একাই ভয়ংকর মারতে পারে।তুমি কয়েকদিন পর পর দেখতে আমার মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ সেটা রিঝ করতো।প্রায় কি মনে করে এসে হুট হাট মেরে চলে যেত।’তুতুল হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল।রিঝ রাগী সে জানে।অন্যায় হলে ঝাপিয়ে পড়ে।কিন্তু শুধু শুধু কাউকে সে মারে না।তুতুল নিজেকে সাবধান করে।ভুলেও রিঝের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ভাবতে না।সে একদম নাঁখচ করে বললো,’ উনি এসব শুধু শুধু কখন করবে না।’
‘ সে করেছে।’
‘ তাহলে আপনি আগে বলেননি কেন?’
‘ কারণ মারার পরে এটাই ডিল হতো।’
‘ কিসের ডিল?’
‘ রিঝ বলে যেত যদি আমি তোমাকে বা কাউকে কিছু বলি সে আবার মারবে।’
‘ আপনি কি পাগল??এসব কি বলছেন?’
‘ সে পাগল।সেই হারামাজাদাটা পাগল।’
‘ সেট আপ।’
‘ আমার সাথে অন্যায় হয়েছে।তোমার আমার জন্য খারাপ লাগার কথা।’
‘ লাগছে না।কারণ আমি বিশ্বাস করি উনি এসব করবে না।’
‘ তোমরা তো এটাও জানো না রিঝ মানুসিক রোগী।’
‘ ওসব উনি মজা করে বলে।’
ইয়াজ হাসতে শুরু করল।তুতুলের মাথাটা কেমন ভারভার লাগছে।রিঝ এসব কেন করত?হ্যাঁ সে প্রায় ইয়াজের হাত পা ভাঙ্গা,মাথা ফাটা,মারামারির চিহ্ন দেখত।কিন্তু তাতে কি প্রমান হয়?তুতুল আবার সাবধান হয়ে বসে।ইয়াজ পাশের ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে দেখায়।হসপিটালের কাগজ।রিঝের।সে কখন কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল সব আছে।তুতুলের মনে পড়ে ছমাসের মত রিঝ লাপাত্তা ছিল।রিঝ অসুস্থ!কিন্তু তার তো মনে হয়নি।তুতুল এবারও অবিশ্বাস করে বললো,’ না এসব মিথ্যা।’
‘ সব সত্য।ফোন করে দেখতে পারো ডাক্তারকে।এতো কষ্ট করার দরকার নেই।তুমি বরং রিঝকে প্রশ্নটা করো।এতো দিনের পরিচয়ে বুঝতে পেরেছি সে মিথ্যা বলে না।শুধু সত্যকে পাশ কাঁটিয়ে দিতে পারে।রিঝ তোমাকে হাসিল করতে চায়।সে তোমাকে পেতে চেয়েছে বরাবরই।এটা কেমন ভালোবাসা?যেখানে অন্যের ভালোবাসার সম্মান নেই?সে আমার ভালোবাসাকে একটা খেলনা বানিয়ে রেখেছে।আমার বাবাকে পর্যন্ত ব্যবহার করেছে।’
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৪৪.🎈
@হাফসা আলম
____________________
তুতুল চোখে মুখে অন্ধকার দেখে।শক্ত হয়ে বসে থাকে সে।ইয়াজ থেমে থেমে এবার বললো,’ ও একটা পাগল।পাগলামি করেছে দীর্ঘ কয়েক মাস।’
‘ এনাফ।আর শুনতে চাচ্ছি না।পাগল হলে পাগল।আপনার কি।দূরে থাকুন এসব থেকে।’
তুতুল হাঁপাতে শুরু করে।তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন।ইয়াজ বললো,’ তুমি এতোটা স্বার্থপর কবে হয়েছ?নিজের কথা ভাবছ।তুমি রিঝকে কত টুকু ভালোবাসো?আমার মত তো আর বাসো না।আমি তোমাকে ভালোবাসি দীর্ঘ অনেক বছর।তুমি মাত্র এক দুই বছরে এতোটা কিভাবে বদলে গেলা।’
‘ গেলাম।হ্যাঁ আমি বদলে গেছি।এবার যেতে দিন।’
তুতুল শুনতে চাচ্ছে না।ইয়াজ জোর করে শুনাতে চাচ্ছে।তুতুল ভেজাল চায় না।এসবে সবাই অন্যকিছু ভাবতে পারে।সে চুপ করে বসে রইল।রিঝের ফাইলটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল।ইয়াজ পরের কথাগুলো হিট লাগিয়ে রেগে বললো,’ রিঝ নিজের চিকিৎসা শেষ করে আসে।জানতে পারে ওর বাবার সাথে আমার বাবার প্রায় একশোকোটি টাকার ডিল হয়েছে।বাবা অনেক লোন নিয়েছে।লাস্ট মোমেন্টে এসে সেই প্রজেক্ট রিজেক্ট করে দেয় ‘sA’কোম্পানি।আমি তো প্রথমে জানতামই না রিঝের বাবার কোম্পানি সেটা।রিঝকে দেখে আমার কখন মনে হয়নি ও এতো বড় কোম্পানির মালিকের ছেলে।খুব সাধারণ মনে হত ওকে।প্রজেক্ট রিজেক্টের ফলে আমরা পথে বসতে যাচ্ছিলাম।এমন নয় যে আমার বাবা একশো কোটি টাকার জন্য এতো ভেঙ্গে পড়েছে।তারা সব কটা চুক্তিবাতিল করেছে।কম করে হলেও প্রায় অনেক শত কোটির ঋণ মাথায় এসে পড়ে।আমি বাবার পক্ষ থেকে মিষ্টার শাহের সাথে দেখা করতে যাই।সেখানে রিঝের দেখা মিলে।আমি ওর সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই জানি।এমন কি সব সময় সে আমার রুটিন।তোমার কথা যতবার আমি ভাবতাম ততোবার তার কথা মাথায় আসত।তাই আমার চেয়ে ভালো ওকে কেউ চিনেনা।বাবার কোম্পানিতে বসার মত ছেলে সে না।আমি প্রথমে মনে করেছি ওকে বললে হয় তো কাজ আরো দ্রুত হবে।কি যানতাম যে এসব ও নিজেই করেছে?সত্যি আমি হতাশ হয়ে পড়ি।সে সব ডিল ক্যান্সেল করে দেয়।এমন কি হুমকিদেয় বাকি কোম্পানির সাথেও চুক্তিবাতিল করবে।আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না।হুট হাট মারা,নিজে থেকে মারামারিতে যোগ দেওয়া,সব রকম রেইসে আমার সাথে পাল্লা দেওয়া পর্যন্ত আমি বুঝলাম সে কোন কারণে আমাকে অপছন্দ করে।হয় তো তোমাকে নিয়ে ওর মনে কোন ফিলিংস আছে।কিন্তু ও এত বেশি ডেসপারেট আমি বুঝতে পারিনি।কোন উপায় খাঁজে পাচ্ছিলাম না।রিঝ অনেক বড় খেলোয়ার।সব প্ল্যান সাথে করেছে।একের পর এক চুক্তি বাতিল হওয়ায় হুট করে আমাদের কোম্পানির রেপুটেশন কমতে থাকে।বাজারে নাম খারাপ হতে শুরু করে।যেহেতু রিঝের বাবার কোম্পানী একটা সুনামধন্য এবং সবার সাথে যুক্ত কোম্পানি তাই তারা এক কথায় সব বাতিল করে দিচ্ছে।অবশ্য অনেক যুক্তিও দেখিয়েছে।যা আমাদের পার্সোনাল ছিল।আমি রিঝের কাছে যাই।অনেক মারামারি হয় আমাদের মাঝে।রিঝ শর্ত রাখে যদি তোমাকে ছেড়েদি ও আমাদের ছেড়ে দিবে।আমি প্রথমে অবাক হলাম।সামান্য একটা ব্যাপারে সে আমাদের পথে বসাতে উঠে পড়ে লেগেছে।দেখ কত পাগল!দেশ কাঁপিয়ে দিবে যেন।আমি সত্যি আশ্চর্য হয়েছিলাম।কোম্পানি আমার বাবার স্বপ্ন।আমাদের মাথা উঁচু করে রাখার জায়গা।কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসা।আমি রাজি হলাম না।কারণ আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি আমি জানি।শেষে কোনো উপায় ছিলো না।বাবা-মা সবাই বললো রাজি হয়ে যেতে।তাই তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম।অন্য মেয়ে বললে বিশ্বাস করতে না।তুমি জানতে আমি অন্য মেয়েদের সাথে তেমন মিশি না।মিফতাকে তাই ব্যবহার করেছি।আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি।সারাটা জীবন বাসবো।রিঝকে ছেড়ে দেও।আমি তোমাকে যে কোন রূপে এক্সেপ্ট করতে রাজি।প্লিজ তুতুল।আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছ তুমি।আমি রাত জেগে থাকি।রিঝ মানুসিক রোগী।ওর সাথে তুমি কখন ভালো থাকতে পারবে না।দেখ তোমাকে পাওয়ার জন্য সে শহরের সব কোম্পানিকে নাচিয়ে ছেড়েছে।বিকৃত মস্তিষ্কের লোকের সাথে তুমি কিভাবে সারাটা জীবন কাঁটাবে?হাউ?ইটস নট পসিবল।সে তোমার ক্ষতি করতে পারে।যখন তখন রাগ উঠে যায় তার।গায়ে হাত তুলে।সামনের কোন কিছুর পরোয়া করে না।আজ পর্যন্ত যত ছেলে তোমাকে পছন্দ করেছে কাউকে সে সুস্থ ছাড়েনি।কারো হাত কারো পা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভেঙ্গে দিয়েছে।প্রমান রেখে কোন কাজ করে না তাই সে সব সময় বেঁচে যায়।প্লিজ।ছেড়ে দেও।ভালোবাসা আর চাওয়ার মাঝে পার্থক্য আছে।বুঝার চেষ্টা করো।সে চায় ভালোবাসে না।’
ইয়াজ ইনিয়ে বিনিয়ে আরো অনেক কিছু বলে।অনেক বুঝায়।নিজের সর্বোচ্চ জ্ঞান কাজে লাগায়।তুতুল কিছু বলে না।পাথরের মত জমে বসে থাকে।কিছুক্ষণ পরে সে নিজে থেকে উঠে যায়।ইয়াজ অনেক ডাকে।সে শুনে না।সব কেমন এলোমেলো লাগছে।রিঝ কেনো এমন করল?এভাবে করা তো অন্যায়?ইয়াজ তো ইচ্ছে করে ছাড়েনি।রিঝ সত্যি ভালোবাসে তো?না কি সব অভিনয়?তুতুল মাথা চেপে মাঝ রাস্তায় বসে পড়ে।তার মনে হচ্ছে আশেপাশের সব ঘুরছে।সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।অনুভব করছে তার গলা রোধ হয়ে গেছে।শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।হাত পা কাঁপছে।তুতুল রাস্তায় কাঁত হয়ে পড়ে।আশেপাশে লোক জমা হয়।এভাবে একটা মেয়েকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে একটি মহিলা পানির বোতল নিয়ে আসে।মুখে মারে।খেতে দেয়।
রিঝ জুয়েলারির দোকানের সামনে এসে অপেক্ষা করছিল।তুতুল ভেতর থেকে আসছে না দেখে সে নিজে গেল।দেখে দোকানে সে নেই।উদ্বেগী হয়ে সে খুঁজতে বের হয়।শুনে,একটা মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে।রিঝ দ্রুত বাইক নিয়ে হাজির হয়।তুতুল ততক্ষণে চলে গেছে।
সবাই তুতুলের জন্য অপেক্ষা করছিল।ঘরে ঢুকে এলোমেলো চুলে।চোখ মুখ শুঁকনো।আমিনা পানি এগিয়ে দিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বললো,’ কি হয়েছে তোর??এমন দেখাচ্ছে কেন?রিঝ কই?’
তুতুল কিছু বলে না।চুপচাপ বসে থাকে।চোখ বুজে।আবার খোলে।ঘরের পর্দা একবার বন্ধ করে আবার মেলে দেয়।রিমোর্ট দিয়ে টিভি অন অফ করে।আলভী শেরওয়ানি পড়ে সামনে আসে।তুতুলের পাশে বসে।মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করে,’ কি হয়েছে তুলা তোর?এখন তো বসন্ত না যে উড়ে যাওয়ার দুঃখে মুখ ভার করে রাখবি।কাহিনী কি?’
তুতুল ভাইয়ের দিকে একবার তাকায়।তারপর আবার টিভির দিকে।মেহমান সহ সবাই অবাক।কেউ কেউ ভাবে উল্টাপাল্টা।আলভীর দিকে তাকিয়ে চুপ থাকে।তুতুল ব্যাগ খুঁজে।তার মা এগিয়ে দেয়।গয়নার বক্স দিয়ে সে বললো,’ ভাইয়া আমাকে ছাড়া বিয়ে করবি??’
আলভী আশ্চর্য হল।বললো,’ মরে গেলেও না।তোর পছন্দের মেয়ে।তোর জন্য আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি হয়েছি।তুই খুঁশি বলে আমি ডেট আরো এগিয়ে নিয়ে এসেছি।তোকে ছাড়া আমার জীবনের কোন শুভ কাজ হয় না।এটা তো হবেই না।’তুতুল উঠে দাঁড়ায়।হাঁটতে হাঁটতে যায় দরজার বাহিরে।তুতুলের বাবা অবাক হয়ে বললো,’ কোথায় যাচ্ছো?’‘ বিয়েতে।’তুতলের কার্যকলাপে সবাই অবাক।আমিনা মেয়ের হাত টেনে বললো,’ রেডি হবি না?’‘ না এভাবেই যাবো।যেতে হলে আসো।আর না হলে বলো।আমি রুমে যাবো।’
সবাই বেরিয়ে পড়ে।গাড়িতে,বিয়ে বাড়িতে,তুতুল কারো সাথে প্রয়োজনের বাহিরে একটা কথাও বলেনি।তার মাঝে দুটো সত্ত্বা কাজ করছে।একজন রিঝের পক্ষে অন্যজন বিপক্ষে।রিঝের সাথে তুতুল একটাও কথা বলেনি দেখে রিঝের রাগ হয়।সে বিয়ে বাড়িতেই খাবারের প্লেট ছুঁড়ে মেরে চলে আসে।কি হচ্ছে কেউ বুঝলো না।বিয়ে শেষ হয়।সবাই ফিরে আসে।প্রীতির ভাই প্রীতির কানে কানে বলে,’ তোর ননদিনী অনেক সুন্দর।আমার লাইন ঠিক করে দে।’
যেহেতু অনুষ্ঠান হয়নি তাই সেভাবে কেউ জানে না।প্রীতির ভাইও জানত না।প্রীতি তখন ভাইয়ের বাহুতে কিল মেরে বললো,’ নিজের মাথা ফাঁটাতে চাস?’
‘ কেন?’‘ যে প্লেট ভেঙ্গেছে সে ওর হাজবেন্ড।সামান্য কথা বলেনি দেখে এত রাগ দেখিয়েছে।যদি তুই বিয়ের কথা বলস কল্লা ফেলবে।দূর হ।’
তুতুল বাসায় আসে।রুমের দরজা বন্ধ করে।আর খুলে না।ঘন্টারপর ঘন্টা দরজা ধাক্কানো হয়।আলভী এসব জানে না।তাকে জানানো হয়নি।তুতুল একটা সময় বিরক্ত হয়ে বের হয়।আর বলে তাকে যেন বিরক্ত না করে।তার ভালো লাগছে না।শরীর অসুস্থ।তারপর থেকে সে রুমে।রিঝ ফোন করে।বারান্দায় রাত কাঁটায়।তুতুল আসে না।সকালে দুশ্চিন্তায় ছুঁটে আসে সে।তুতুলের রুমে অনেক শব্দ হয়।ধাক্কা দেওয়ার পরেও সে খুলে না।রিঝ একটা সময় দরজা ভেঙ্গে ফেলে।রুমের অবস্থা করুন।তুতুল সব ভেঙ্গে ফেলেছে।ঘরের কাঁচের জিনিস এলোমেলো ভাঙ্গা।তুতুল শুয়ে আছে নিচে।চোখমুখ ফোলা!হাতর আঙ্গুল গুলোতে শুকনো রক্ত।রিঝ আঁতকে উঠে।কাছে যায়।কোলে তুলে নেয়।প্রীতি এসে চেক করে।তারপর হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো,’ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।অন্য কিছু না।আর ভাঙ্গচুর করার জন্য হাতে ব্যথা পেয়েছে।’
রিঝ পাশে থাকা সব কিছু দেখে।হিসাব মিলায়।তার মনে পড়ে না কিছু।তাদের মাঝে কিছুই হয়নি।আলভী রিঝের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।রিঝের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সেও জানে না।তবুও জিজ্ঞেস করলো,’ তোর সাথে কিছু হয়েছে?’রিঝ কিছু বললো না।শুধু তুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল।তুতুল বেঘোরে ঘুমচ্ছে।চোখের কোণায় জলের দাগ।চুল টেনে হাতের মুঠোয় নিয়েছে।কিছু চুল এখনো তার হাতের মুঠোয় শক্ত হয়ে আছে।
ঘুম ভাঙ্গে প্রায় দুপুরের দিকে।চোখ আলত খুলেই সে দেখে রিঝ আড়স্ট হয়ে বসে আছে।চোখ গুলো একদম তার চোখের দিকে।চোখ খুলতে চোখে চোখ পড়ে।তুতুল একটু ভয় পেয়ে উঠে।মৃদূ আওয়াজ করে বলে,’আপনি এখানে কি করছেন?’ রিঝ আশ্চর্য হয়।যেন তুতুল ভয়ংকর কিছু জিজ্ঞেস করেছে।তুতুল চারপাশে তাকায়।তার মনে হচ্ছে শরীর ব্যথা।হাতে ব্যথা।তুতুল উঠে বসে।চুলের গোড়ায় চরম ব্যথা।নিজের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে সে মনে করার চেষ্টা করে।সন্ধ্যায় সে রুমে ঢুকেছিল।সবাই খুব ডাকা ডাকি করছিল।বিরক্ত হয়ে সে একবার দরজা খুলেছিল।নিষেধ করেছিল।বিরক্ত করতে না।আয়নার সামনে গেল।নিজের দিকে তাকাল।হঠাৎ কি যেন হল।খুব রাগ উঠল।কেন?জানে না।আয়নার নিচে যত জিনিস ছিল সব ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল সে।কাঁচের ফুলদানি ভেঙ্গেছিল।পর্দা টেনে ছিড়ে ফেলেছিল।রুমের খুব করুন অবস্থা করেছিল।ও সে ব্যথাও পেয়েছিল।তারপর খুব ঘুম ঘুম লাগল।অযথা কেঁদেছিল খুব।কেন?সেটাও জানে না।তবে রিঝের এই রূপটা তার ভাল লাগলো না।সে মেনে নিতে পারছিল না।রুমে সবাই আসে।তুতুল সবাইকে দেখে।সবাই খুব উত্তেজিত।তুতুল এবার রেগে বললো,’ আমার কিছু হলে এত ব্যস্ত হয়ে পড় কেন সবাই?এসব ভাল লাগে না।প্লিজ সবাই সবার কাজে যাও।’তুতুলের বাবা এগিয়ে এল।আলভী আটকে দিয়ে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।রিঝ এই প্রথম তুতুলকে ঝাঁঝাল গলায় পরিবারের সাথে কথা বলতে দেখে কিছুটা বিস্মৃত।সেও চলে যেতে নেয়।তুতুল থাকতে বলে।দরজা বন্ধ করতে বলে।রিঝ অবাক।সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।তুতুল আবার বলে।তারপর দরজা বন্ধ হয়।রিঝকে পাশে বসতে বলে।রিঝ বসে।তুতুল শান্ত স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,’ইয়াজ আমাকে নিজে থেকে ছাড়েনি।আপনি ছাড়িয়েছেন।এটা সত্য?’রিঝের কলিজায় কামড় পড়ে।তার মনে হচ্ছে ভয়ংকর কোন প্রাণী কলিজা কামড়ে ধরেছে।তার চোয়ালের দুপাশ শক্ত কাঠের নেয় হয়ে যায়।চোখজোড়া রক্তাক্ত লাল।তুতুল সব বলে।মনে মনে সে বিশ্বাস করতে চাইছে না।রিঝ সব শুনে রেগে যায়।ইয়াজকে আজ সে নিজের হাতে খুন করবে ঠিক করে।কঠিন গলায় বলে,’ তোমাকে এসব বলার সাহস পেয়েছে কোথায় অসভ্যটা।আজকে আর ছাড় দিবো না।’
রিঝ দুপধাপ পায়ে শব্দ করে উঠে যায়।তুতুল হাত টেনে ধরে।একরোখা গলায় আবার জিজ্ঞেস করে,’ আপনি সত্যি এসব করেছেন?আমি বিশ্বাস করি না।বলে দিন ইয়াজ মিথ্যা বলছে।আসলে হয়েছে কি উনি জ্বলে।আমাকে আপনার সাথে বেশি সুখে দেখে।তাই বানিয়ে বলেছে।আমি বিশ্বাস করিনা।আপনি বলে দিলেই হবে।আমি আপনাকে বেশি বিশ্বাস করি।’রিঝ নিভল।গলা শুঁকিয়ে আসল।হঠাৎ করে তার ভয় ভয় লাগছে।এত বিশ্বাস!যদি ভাঙ্গে?রিঝ শুকনো ঢোক গিললো।তারপর আবার জায়গায় বসল।হাবভাব পাল্টে গেছে তার।তুতুলের খুব ভয় করছে।বুক ধুক ধুক করছে।সে বার বার এক কথাই বলে।রিঝ ধৈর্য্য হারা হয়ে বললো,’ হুম করেছি।আমি সব করেছি।ওর সাথে আমি তোমাকে সহ্য করতে পারতাম না।তাই করেছি।তোমার পিছনে ঘুড়া পর্যন্ত তো ঠিক আছে।কিন্তু বিয়ে?সেটা মানতে পারিনি।তাই এসব করেছি।আরো অনেক কিছু করতে পারি আমি।এই মুহূর্তে খুন করে আসতে পারি।এবং আমি করবোও।সাহস কিভাবে হয় এসব বলার।কিভাবে?’ রিঝ চিৎকার করে উঠে।তাকে ভয়ংকর লাগছে।তুতুল এই প্রথম রিঝকে এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখছে।রিঝ রাগে আশেপাশের বাকি আসবাবপত্র ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।তুতুল শুধু একবার বলে,’আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।শুধু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মাত্র।’রিঝের রাগ আরো দ্বিগুন বাড়ে।সে রেগে তুতুলের দুবাহু শক্ত করে ধরে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’এত গুলো দিনের ভালোবাসা তোমার চোখে পড়েনি?’
‘ আমি তো শুধু ভালোবাসা দেখেছি।কিন্তু আপনি কি সত্যি ভালোবাসেন?’
রিঝ রেগে তুতুলেক ছুড়ে মারে।ইয়াজের রাগ সে তুতুলের উপরে না চাইতেই ঝাড়ছে।তুতুল চমকে উঠে।একটুর জন্য সে পড়ে যেত।হাতে ব্যথা পায়।রিঝের হুশ ফিরে আসে।মাথার চুল টেনে ধরে শক্ত করে।তুতুলের কাছে যায়।তুতুল ততক্ষনে রেগে যায়।দুজনের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়।রিঝ এক সময় চুপ করে যায়।তুতুল কেঁদে একাকার।সে বলেই চলেছে।রিঝ যেটা করেছে ঠিক করেনি।এসব ভুল করেছে।কারো দূর্বলতায় আঘাত করা কখন উঁচিত না।নিজের কাজ হাসিলের জন্য অন্যের দূর্বলতাকে ব্যবহার করেছে।এটা রিঝের ভুল।সে এটা শিকার করুক।রিঝ একরোখা হয়ে থাকল।সে কখন এটাকে নিজের ভুল ভাবেনি।আর ভাবতেও পারবেন না।যেটা সে মন থেকে মানে না সেটা কেউ চাইলেও মানাতে পারবে না।একটা সময় সে উঠে চলে যায়।তুতুল বলে দেয় যদি ইয়াজের সাথে এবার কিছু করে তাহলে রিঝের সাথে সব সম্পর্ক ভেঙ্গে দিবে।রিঝ ক্রোধে ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যায়।
হঠাৎ ঝড়ের মত সব এলোমেলো হয়ে যায়।রিঝ ইয়াজের কাছে যায়।ইচ্ছে মত মারে।নাক মুখ ফাটিয়ে দেয়।হাত ভেঙ্গে দেয়।বাড়িতে ভাঙ্গচুর করে আসে।ইয়াজের বাবা কেইস দেয়।শাহ আলম ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।এসবে কিছু দিন পার হয়ে যায়।তুতুল আরো রেগে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।সে বলেছিল সম্পর্ক রাখবে না।রিঝ নিজের ঘর থেকে বের হয় না।আয়েশা এসব দেখে ভেঙ্গে পড়ে।বিকেলে তিনি তুতুলের কাছে আসে।তুতুল জানালায় বসেছিল।এই জানালা দিয়ে রিঝের রুম দেখা যায়।আয়েশা পাশে এসে বসে।তখনই রামিম আকাশ আসমা আসে।তুতুল সবাইকে দেখে অবাক হয়।আয়েশাকে দেখে তুতুল জড়িয়ে ধরে।সব বলে।আয়েশা আগে থেকে জানত না।রিঝ এ ব্যাপারটা বাবাকে বলেছিল।আয়েশাও একটু রাগ করেছে।কিন্তু ছেলের অবস্থা দেখে তিনি আর থাকতে পারলেন না।তাই না চাইতেও চলে আসতে হল।আয়েশা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে তুতুলের মাথায় হাত বুলায়।তুতুল আমিনার কোলে মাথা রাখে।তিনি চুল ঠিক করছিলেন।আয়েশা রহমানকে দেখে বেরিয়ে গেলেন।আলাদা কথা বলতে দিলেন।আয়েশা তুতুলের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বললেন,’ শুনো মেয়ে তোমাকে আমি মেয়ের মত দেখি।আমার কাছে আমার বাকি সব সন্তানের মত তুমিও।ছোট থেকে আমি তোমারে দেখছি।ভালোবাসছি।আমি তোমার খারাপ চাইবো না।তোমার যদি মনে হয় তুমি রিঝের সাথে ভালো থাকবে না তাহলে থেকো না।আমি নিষেধ করবো না।অনুরোধও করবো না।শুধু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।রিঝ ছোট থেকে একটু আলাদা।আমি জানি না কেন।ছোট থেকে যা ওর পছন্দ তা সে নিজে অর্জন করে নেয়।না করতে পারলে কেড়ে নেয়।এটা আমার চোখে দেখা।রিঝের ফুফাত ভাইয়ের একটা বল তার পছন্দ হয়েছিল।সারা বাজার খুজে পাওয়া যায়নি।রাগে সে সেই বলটাই নষ্ট করে দিয়েছিল।ছোট বেলায় এগুলো সাধারণ মনে করতাম।পরে পরে বুঝতে পারি রিঝ মানুসিক ভাবে খুব ডেসপারেট।তার মধ্যে পাওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছে কাজ করে।কিন্তু ও ক্ষতি করে না কারো।শুধু ইয়াজের বেলায় উল্টো হয়েছে।আসলে উল্টো বললে ভুল হবে।রিঝ তাদেরই ক্ষতি করে যারা তার করে।রিঝ প্রথম থেকে পছন্দ করত না এসব।তখন তুমিও ইয়াজকে পছন্দ করতে না।এটা রিঝের খুব ভালো লাগত।ইয়াজকে অনেক সরাতে চায়।সেও নিজের পথ ছাড়ে না।আমাকে সব বলে সব সময়।প্রতিদিন বলত।সবঠিক ছিল।রিঝ রেগে মার দিত।কিন্তু পরে আবার স্যরিও বলত।এমন নয় যে সে শুধু মেরেছে।স্যরিও বলেছে।ইয়াজও কম না।সব সময় রিঝকে রাগিয়ে দিত।তোমাকে নিয়ে কিছু বললেই রিঝ ক্ষেপে যায়।সে সেটাই করত।কিন্তু বিয়ের ডিসিশন রিঝ মেনে নিতে পারেনি।তোমার মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম।বলেছিলাম রিঝের সাথে তোমার বিয়ে দিতে।রিঝ তোমাকে পছন্দ করে।কিন্তু তোমার মা বললো,তোমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই তোমার বিয়ে দিবে।আমি অনেক বুঝাই।বুঝারই চেষ্টা করে না।তোমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়।আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে।সে ঘুমাতে পারে না।খেতে পারে না।তার বুকে শুধু শব্দ করে।রাত হলেই সে আমার কাছে আসে।বিরবির করে বলে আম্মু আমার কেমন যেন লাগছে।আমি বাঁচবো না মনে হয়।আমাকে সূরা পরে ফু দেও।এসব খুব কমই।রিঝ নিজেকে আঘাত করে।তার কেমন অনুভুতি হচ্ছিল আমি কাউকে বুঝাতে পারবো না।সে নিজের হাত পায়ে আঘাত করত।ভাঙ্গচুর করতো।দিন শেষে সে একটা কথাই বলতো তোমাদের বাড়িতে যাতে কোন কথা না আসে।রিঝ মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।উল্টাপাল্টা কাজ করে।রিঝের অবস্থা ভালো না দেখে আমরা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।চিকিৎসা হয়।রিঝ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়।ফিরে আসি।কিন্তু রিঝের মাথায় কি চলছিল আমরা জানতাম না।ও ওর বাবার সাথে মিলে এসব করে।সব কিছুকে বাদ দিয়ে শুধু ভাব একটা ছেলে তোমাকে কত চায়!সব চাওয়ার মাঝে তুমি আলাদা।আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারবো রিঝ তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসে।আমার ছেলে দেখে বলছি না।রিঝকে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দে দেখেছি এই দুটি বছর।আমি চাই সারা জীবন সে এভাবে থাকুক।অসম্ভব ভালোবাসা কাকে বলে জানো?যখন কেউ তার থেকেও যত্ন করে কাউকে।রিঝ তোমাকে করে।এটা ছাড়া কিছু বলার নেই।’আয়েশা রহমানের চোখে পানি।তিনি উঠে যায়।রামিম তুতুলের দিকে ডায়েরি এগিয়ে দেয়।নিভু নিভু গলায় বলে,’চুরি করে নিয়ে এসেছি।তুমি পড়ো।বুঝো।রিঝকে জানতে পারবে।তাকে চিনতে পারবে।খুব প্রয়োজন তোমার জন্য।নিজের ভালোবাসাকে অনুভব করো।’
আকাশ তেড়ে আসে।ভারী শব্দ করে বলে,’ এটা ঠিক হয়নি।বুঝলাম ভুল করেছে।তবুও..’তুতুল শব্দ করে কাঁদছিল।আসমা থামিয়ে দেয় আকাশকে।কাছে এসে হাত ধরে।তুতুল কথা বলতে পারছে না কান্নার দাপটে।অনেক কষ্টে সে শুধু বললো,’ উনি নিজের ভুল শিকার করেনি কেন?আমাকে সব বলেনি কেন?আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।আমার কিছু ভালো লাগছে না আসমাপু।নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে।চাওয়া পাওয়ার জিনিস মনে হচ্ছে।ভালোবাসা কেন মনে হচ্ছে না?কেন?’তুতুল আসমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।হু হু করে কেঁদে উঠে।কান্নারা বাড়ি খেয়ে যেন জানালা দিয়ে ছুটে রিঝের কান অবধী যেতে চাইছে।আসমা কিছু বলে না।শুধু স্বান্ত্বনা দেয়।চুপ করতে বলে।বুঝায়।
মাগরিবের আজান পড়েছে।রিঝ এলোমেলো শরীরে তুতুলের রুমের দরজা ধাক্কায়।স্যরি বলে।ভাঙ্গা কন্ঠ শুনে তুতুল খুলতে যায়।কেন যেন আবার থেমে যায়।রিঝ অনেক সময় থাকে।দরজার নিচে বসে বসে কাঁদে।তুতুলের বাবা মা রিঝকে উঠে বসতে বলে।আলভী টেনে তুলতে চায়।রিঝ শক্ত পাথরের মত বসে থাকে।সে যাবে না।উঠবেও না।তুতুলও ওই পাশে কাঁদে।হাত রাখে দরজায়।ছুঁযে ছুঁয়ে দেখে।তার মনে হচ্ছে সে রিঝকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।বুকে ব্যথা হয় তীব্র।দম আটকে আসে।ফুঁফানোর শব্দ যায় রিঝের কানে।দুজনের মাঝে শুধু এইটুকু দূরত্ব।একটা দেয়াল।কাঠের মাত্র।তুতুল চেঁচিয়ে বললো,’ চলে যান।আপনার উপস্থিতি আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।’
তুতুল অন্ধকার রুমে মুখ গুঁজে বসে থাকে।চুল গুলো পড়ে সামনে।উড়না কোথায় সে জানে না।নিজের হাত কামড়ে ধরে কাঁদছে সে।চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।এত কষ্ট কেন হচ্ছে?চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।তুতুল উঠে দাঁড়ায়।আলো জ্বালিয়ে ডায়েরি খোলে।কাঠের ডায়েরি।খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি।যে ছবিটা অসম্পূর্ন ছিল দেখা।তুতুল এবার উল্টে দেখে।১৫ বছরের কিশোরীর ছবি।সাদা লম্বা ফ্রক পড়ে আছে।কোঁকড়া চুল গুলো এসে পড়ছে ঠোঁটের উপরে।ডান হাতের দুটি আঙ্গুল দিয়ে বিরক্ত মুখে সেই চুল সরাতে ব্যস্ত কিশোরী।সূর্য তার মাথার উপরে।বিন্দু বিন্দু ঘাম।চোখে মুখে।গাল দু’টি লাল।কুঁচকানো মুখ।কালো চকচকে তিল।এত সুন্দর এই মেয়ে!চোখ বিস্ময়ে ফেঁটে পড়ে তুতুলের।যে ছবিটি তুলেছে সে নিজের সব ছবি তোমার কৌশল একত্র করে তৈরি করেছে এই ছবি।ফুটিয়ে তুলেছে সৌন্দর্যের সমুদ্রকে।গালের পাশে ছোট ছোট লোম গুলোও অদেখা রইলো না।সেগুলোও ছবিরতে ফুঁটে আছে।কমলা রঙ্গের ফ্রক।গলায় ঝুলছে বড় উড়না।যার একটা অংশ ঝিরিঝিরি বাতাসে দক্ষিণ দিকে উড়ছে।কানের ঝুমকা বাতাসে হেলে দুলে শব্দ তুলছে।সুন্দর মুখশ্রীর ঠোঁটটা কি সুন্দর!একেই বলে শিল্প।কি মারাত্নক শিল্পী এই লোক!এই ছবির মহত্ত্ব ফুঁটিয়ে তুলেছে সে।ছবির উপরে হাত ছোঁয়ায়।এটি তার ছবি।সে সেই সুন্দরী মেয়ে।তুতুল দ্রুত আয়নার সামনে যায়।মিলায়।নাহ সে তো এত সুন্দর না।তাহলে এই ছবিতে কেন এতো সুন্দর লাগছে।কেন?তুতুল ছবি রেখে দেয়।পৃষ্ঠা পড়ে।তার বাঁধন ছাড়া জলের সমুদ্র।কিভাবে?কিভাবে এতো ভালোবাসা হয়?কিভাবে কারো এতোটা জুড়ে কেউ জায়গা পায়?তুতুল উড়না কামড়ে ধরে।তার কান্নায় খুব শব্দ হচ্ছে।নিজের কাছে বিরক্ত লাগছে তার।এত কাঁদছে কেন সে?ডায়েরির পাতা ভিঁজে যাচ্ছে।শরীর অসাড় হয়ে আসছে।অনেক গুলো পৃষ্ঠা তুতুল পড়ে না।চোখ ভিঁজে আসে বার বার।একটি রাজকুমারের ভালোবাসা।এক তরফা ভালোবাসা।কতটা বেদনা দায়ক সেই প্রেম!একটি পৃষ্ঠায় তুতুল থমকে যায়।চোখগুলো অক্ষরের গায়ে আটকে যাচ্ছে।
‘ আমি এই জীবনে সবচেয়ে বেশি তোমাকে চেয়েছি।এত বেশি চেয়েছি যে আমি সত্যি নিজেকেও এতটা চাইনি।লোকে বলে ভালোবাসা জীবনে অনেক হয়।হুম হয়।কিন্তু আমার জীবনের প্রথম প্রেম তুমি।প্রথম ভালোবাসা।তুমি প্রথম।এর চেয়ে বেশি গভীর কিছু হয় না।দ্বিতীয় দ্বিতীয় হয়।সেও চায় প্রথম হতে।কিন্তু প্রথম তো প্রথমই।তাকে ছোঁয়া যায় না।ধরা যায় না।অনুভুতির সাথে মিশিয়ে হারিয়ে ফেলা যায় না।সারাটা জীবন অনুভবে রয়ে যায়।এটাই প্রথম প্রেম।প্রথম ভালোবাসা।আর আমি সেই প্রথমকে পাওয়ার অপ্রাণ চেষ্টা করেছি।করছি।কিন্তু তুমি তুষারের মত কেন?কেন তুমি কাছে আসো।পাশে থাক।কিন্তু ছুঁয়ে দিতেই পানিতে পরিণত হও।কেন এমন হয়?কেন তুমি বৃষ্টি নও?কেন তুমি আগুন নও?কেন তুমি তুষার?
তোমার চোখ গুলো বড্ড ভয়ংকর।গোল গোল।এত গোল চোখ হয়?আমি সেই চোখের একজন দেওয়ানা।তোমার কাজল বিহিন সেই চোখ আমার খুব প্রিয়।কোঁকড়া চুলে যখন দোল খায় আমার নিঃশ্বাস কিছু সময়ের জন্য নিজেকে ভুলে যায়।তোমার সেই ঠোঁটে আমার মরণ।তোমার গাল ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে আমার।
আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই।কাছ থেকে।যতটা কাছে থাকলে কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
তুতুল আর এক পৃষ্ঠা উল্টে নেয়।তাতে লেখা,
‘মানুষের খুব করে কিছু সখ থাকে না??আমার ও ছিল।অনেক অনেক বেশি ছিল।এতটা সখ আর কিছুর জন্য ছিল না।সেই সখের জন্য আমি মরিয়া ছিলাম।পাগল ছিলাম।মনে মনে অনেক উম্মাদও ছিলাম।উতাবলা ছিলাম বহু বহু গুণ।কি ছিল সেই সখ যান?আজ বলি।হয় তো তোমাকে পাওয়া হল না।তবুও তুমি শুন,আমার না অনেক অনেক অনেক সখ ছিলো তোমার ওই ডান পাশের ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে কালো তিলে একটা গভীর চুম্মুনের সৃষ্টি করবো।আমি হবো সেই ঠোঁটের প্রথম চুম্মুনের স্রষ্টা।তোমার ঠোঁটের প্রথম ছোঁয়ার রূপকার আমি।অনেক সখ ছিল ঢেউ খেলান চুলের সুঘ্রাণে ভেসে থাকার,অনেক অনেক সখ ছিল,তোমার নিঃশ্বাসের সাথে উঠানামা কারা সেই নীলছে রগ গুলোতে ঠোঁটের আলত স্পর্শ বসানোর।কিন্তু নিয়তি আমার সাথে বড্ড কঠিন ব্যবহার করেছে।বড্ড বেশিই কঠিন হয়েছে আমার বেলায়।বড্ড বেশি!!!ইয়াজ নামক মানুষটা কেন এল?কেন তুমি বিয়ে করতে রাজি হলে?কেন তুমি আমার হলে না?
তুতুল নিজের ঠোঁটের পাশে হাত রাখে।সত্যি কি এই তিলটা এত আপন করে ছুঁয়ে দেখতে চায় কেউ?
পৃষ্ঠা পাল্টে যায়।অনেক পৃষ্ঠা খালি।তুতুল শেষ মনে করে।সে খুব আশাহত হয়।উল্টাতে থাকে।অনেক পরে পৌছে যায়।একটা ছোট লেখা,
‘ সারা পৃথিবী আমার হলেও আমি খুশি হবো না।কারন আমার চাই তুমি।তুমিটাই ভালোবাসা।না চাইতেই বা অল্প চেয়ে পেয়ে যাওয়া জিনিসের চেয়ে বহু চেয়ে পাওয়া জিনিসের মূল্য তুমি বুঝবে না।আমি চেয়েছি,অনেক চেয়েছি,বহু বার চেয়েছি,অপেক্ষা করেছি,অর্জন করেছি।তার মূল্য তুমি নও আমিই বুঝবো।তাই বলবো আমি ভালোবাসি না শুধু ভালোবাসবোও।
‘ মাই বিউটিফুল বার্ড তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।এখানে আমার ভালো লাগছে না।চারপাশে সব পাগল।নিজেকেও পাগল মনে হচ্ছে।তোমার পাগল।’
‘ তুমি নিশ্চুয়ই খুব ভালো আছ?আমি নেই।একদম ভালো নেই।দমটা বন্ধ করো।মাত্র এক মিনিটের জন্য।পারবে না।অনেক কষ্ট।আমার তার চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে।ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে হৃদয়।বলতে পারো তুমি কেন আমার নেশা?কেন ড্রাগের মরন নেশার মত তোমার চোখ।না দেখলেই কেমন মরন যন্ত্রণা।আমি নিতে পারছি না।যতটা শক্ত পৃথিবীর মানুষের চোখে আমার হৃদয় ততাই নরম কাঁদা।আমি সহ্য করতে পারিনা বিরহের ব্যথা।তুমি আমার সর্বনাশা।’
‘ একটা নার্স এসেছিল।প্রথম দিকে বলত সে আমাকে পছন্দ করে।আজ বলছে সে আমাকে ভালোবাসে।অনেক মেয়েই আমাকে এ কথা বলে।এতো মেয়ে আমাকে ভালোবাসে।চায়।আর আমি শুধু তোমাকে চাই।তোমাকে ভালোবাসি।স্পেশাল কিছু তো আছে তোমার মাঝে।সত্যি আছে।স্পেশাল দু’টো চোখ।একটি হৃদয়।একজোড়া ঠোঁট।আর,আর কোঁকড়া চুলের বাহার।’
‘ ছবি দেখতে আর ভালো লাগছে না।আমি তোমাকে দেখতে চাই।শুধু তোমাকে।যেই তুমিটায় আমার হৃদস্পন্দন থমকে যায়।’
‘ আমার তোমাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।ইশ যদি পারতাম!সত্যি যদি পারতাম!তাহলে তোমাকে খুন করে নিজেও খুন হয়ে যেতাম।
আমাদের জন্মটা হোক না আলাদা।মৃত্যু না হয় হোক একসাথে।’
‘ আমি তোমাকে প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখি।আজও দেখেছি।স্বপ্নে তুমি একদম জীবন্ত থাক।আমি চোখ বন্ধ করেই তোমাকে ছুঁয়ে দি।আর তুমি অদ্ভুত সুন্দর হাসো।’
‘ বড্ড এলোমেলো স্বভাবের কাঁদুনি মেয়েটাকে আমি চাই।’
‘ তুমি কষ্ট পাবে যেনেও কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে।করণ তোমার কান্নাও আমার প্রিয়।’
‘ একটা মানুষের সব কিভাবে প্রিয় হতে পারে?কিভাবে তার ভালো খারাপ সব গুণ প্রিয় হয়?আমি সত্যি জানি না।তুমি কি জান?’
‘ ইয়াজকে আমার নিজ হাতে হত্যা করার ভিষণ ইচ্ছে।’
পরের কিছু পৃ্ষ্ঠা ছিড়া।অর্ধেক অর্ধেক কিসব হাবিজাবি লেখা।রক্তের ছাপ।দু’হাতে মাথা চেপে ধরে তুতুল।ডায়েরি ছুঁড়ে মারে।জোরে জোরে শ্বাস নেয়।গলা চেপে ধরে।কেউ যেন শ্বাস নালী রোধ করে রেখেছে।এসব কি পড়ল সে?একটা মানুষ তার অনুপস্থিত সত্ত্বার সাথে কথা বলত এত গুলো বছর!তুতুল হাটুতে কামড়ে ধরে চিৎকার করে।কি অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে তার।আজই যেন মরণ!
ইয়াজ নিচ তলায় দাঁড়িয়ে ছিল।তুতুল গায়ে শাল পেঁচিয়ে বের হয়।ইয়াজকে দেখে তার মুখের রং উড়ে যায়।একটু পিছিয়ে যায়।ঘরের দিকে পা বাড়ায়।ইয়াজ ডাক দেয়।তুতুল ফিরে তাকায়।ইয়াজ দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে বললো,’ তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ?’
তুতুল বুঝতে পারলো না।সে বললো,’ কিসের সিদ্ধান্ত?’
‘ তুমি কার কাছে থাকবে?’রাগে ক্রোদ্ধে তুতুল একটা চড় বসিয়ে দেয়।এটা তার উঁচিত ছিল না।সে দিয়েছে।ইয়াজ যেন আকাশ থেকে পড়ল।এমন মুখ করে বললো,’ তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ?’তুতুলের হুশ নেই।অস্বাভাবিক রেগে বললো,’ মেরেছি বেশ করেছি।আপনি আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন।যে কারণেই হউক ছেড়ে দিয়েছেন।সত্যি বলতে চেয়েছেন বলেছেন।আমিও সব শুনেছি।শুনার পরে আমি না হয় রিঝ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করবো।আমাদের মাঝে রাগারাগী হবে।কয়েকদিন কথা হবে না।কিন্তু আমরা আলাদা হবো ভাবলেন কেন?আরে বাবা আপনি ছিলেন আমার ফিয়ন্সে।উনি আমার হাজবেন্ড।অনেক পার্থক্য।হ্যাঁ আমি রাগ করেছি।কথা বলছি না।কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি নিজের স্বামীকে ছেড়ে আপনার কাছে চলে যাবো।যাওয়া তো দূর আমি তো আপনার সাথে কথাই বলতাম না।কেন এমন বাজে চিন্তা হল আপনার?কিভাবে?’
চিৎকারে বেরিয়ে আসে তুতুলের বাবা।আলভী,প্রীতি মা সবাই।ইয়াজকে দেখে আলভী তেড়ে আসে।তুতুলের বাবা থামিয়ে দিয়ে বললেন,’ তুমি এখানে কি করছ?নিজের কাজে যাও।তুতুল উপরে চলো।’
তুতুল চলে যেতে নেয়।ইয়াজ আবার বাঁধা দেয়।সে বলতে চায় তুতুল ধোঁকাবাজ।সব জেনেও তার ব্যাপারটা বুঝলনা।ভালোবেসে ফেলেছে তাই অন্যায় মেনে নিচ্ছে।তুতুল বললো,’ হুম আমি ধোঁকাবাজ।আপনি ভালো।তাই আপনার সাথে আমি কথা বলতে চাই না।আমি তো বাজে মেয়ে।অন্যায় আমিও করি তাই অন্যায়কারী আমার পছন্দ।’‘ তুমি এখনো রেগে আছ?’ইয়াজ অসহায় কন্ঠে বললো।তুতুল হাসলো।বললো,’ আপনার এমন ফালতু চিন্তা আসে কিভাবে?আমি রাগ করতে যাবো কেন?ওসব আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।আপনি বাধ্যহয়ে বা যেভাবে হোক আমাকে ছেরে দিয়েছন। আমি সত্যি সব ভুলে গেছি।আমার রাগই কাজ করছে না।’তুতুল চলে যেতে নেয়।হঠাৎ কি মনে পড়েছে এমন ভাব নিয়ে সে পিছনে ফিরে বললো,’ ও একটা কথা।আপনি কি সমস্যায় পড়লে নিজের বউকেও বিক্রি করে দিবেন?’
ইয়াজ আগুন চোখে তাকায়।গলা ফাঁটিয়ে বলে,’ তুতুল!
তুতুল ফিচল হাসলো।বললো,’ আপনি শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।বাবার বিজনেসের বদলে আমাকে ছেড়েছেন।রিঝ ভাইয়া আমাকে কিনে নিয়েছে।আমি তো এমনেও তার।সো আপনি সব পাওয়ার পরেও কিভাবে আবার আমার কাছে আসতে পারেন?যে শর্তের বিনিময় মূল্য হিসেবে আমাকে রাখে আমি তার কাছে কেন যাবো?আজ অর্থের জন্য আপনি আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন।বিয়ে করলে অর্থের জন্য বউকেও ছেড়ে দিতেন।রিঝ ভাই তো কিনতে জানে।সে বিক্রি করবে না।এটাই আপনার আর তার মাঝে পার্থক্য।সে টাকার বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে আমাকে কিনেছে।জীবনের বিনিময়ে রাজনের কাছ থেকে আমাকে কিনেছে।ধর্মীয় ভাবে সে আমাকে কিনেছে।আমি নিজের সবটা জীবন তার নাম করছি।ভালো থাকবেন।’
জীবন কি অদ্ভুত।আজ রাজা তো কাল ফকির।কথাটা কত সত্য!ইয়াজ দাঁড়িয়ে থাকে।তার খারাপ লাগছে না।শুধু বুকের ব্যথা হচ্ছে।ভালোবাসার সাথে বুকের সম্পর্কটা না হলেই ভাল হত।যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখানেই শেষ।দিন শেষে ভালোবাসার মানুষটি অন্য কারো।ভাগ্য কতই না ভয়াবহ হয়।যে কোন সময় পাল্টে যেতে পারে।ইশ কি ভাগ্য!
__________
তুতুল ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে।কালো রাত।তবুও আলোকিত চারপাশ।ব্রিজ জুড়ে অনেক লাইট।লাল নীল হলুদ কত কত বাতির আলো ব্রিজে পড়ছে।নিচে পানির মৃদু কল কল শব্দ।অন্ধকারে শোঁ শোঁ শব্দ কানে আসছে।জোনাকি পোকা উড়ছে।দুরের লাল কৃষ্ণচূড়া দেখা যাচ্ছে।লাল হয়ে আছে গাছের মাথাটা।সাদা আলো সেদিকে।তুতুলের গায়ে শাল।ঠান্ডায় মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।দুর আকাশে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে।পানির উপরে ভাসছে কুয়াশা।স্নিগ্ধ বাতাস বইছে।তুতুলের কোঁকড়া চুল পিঠের উপড়ে লেপ্টে আছে।ভিজা চুল।কিছুক্ষণ আগেই গোসল করেছে সে।হঠাৎ করতে ইচ্ছে হলো।গাড়িটা তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে।কালো গাড়ি।দূরে দাড়ালেও তুতুল বুঝতে পারে।এটা রিঝের গাড়ি।গাড়ির দরজা খুলতে দেরি।রিঝের লম্বা পা গুলো দৌড়াতে দেড়ি করে নি এক মিনিটও।দৌড়ে ছুটে আসে সে।একদম তুতুলের সামনে এসে থামে।চোখ লাল।পানি টলমল।নাকটা লাল হয়ে আছে।ভিতরের ফুফানোর শব্দ বাহিরে আসতে চাইছে।তুতুল তাকায়।কিছু বুঝে উঠার আগেই রিঝ দু’হাত মেলে ধীরে ধীরে জড়িয়ে নেয়।শব্দ!রিঝ ভয়ংকর শব্দ করে কাঁদে।যেন বহু বছর পরে দেখা।কিন্তু তুতুলের তো মনে আছে কয়েকদিন আগেই তাদের ঝগড়া হয়েছে।দশবারো দিন হবে।দশদিনকি দশ বছর??তুতুলের উতাল পাতাল হওয়া হৃৎপিণ্ড ঠান্ডা হচ্ছে।তুতুল তাতেও চমকায়।এমন হওয়ার তো কথা না।সে বিগত দিন গুলো তাকে ঘুমাতে দেয়নি।খেতে দেয়নি।মন ভালো ছিলো না।বুক ভারী হচ্ছিলো।দম নিতেও যেন কত কষ্ট।এখন!কি আশ্চর্য্য!!সব শীতল হচ্ছে।রিঝের হৃৎপিণ্ডের শব্দের সাথে তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ মিশে যাচ্ছে।অদ্ভুত এক মিলন মেলা।রিঝ অঝরে কাঁদছে।হারানো,বহু প্রতিক্ষিত কিছু পেয়েছে মনে হয়।মরুভূমিতে সুর্যের তাপে মানুষের হৃৎপিণ্ড যেমন শুকিয়ে যায়,একটু পানির জন্য ধুকে ধুকে ঘুরে বেড়ায়।আর বহু ঘুরার পরে যখন এক সাগর সমান মিঠা পানি চোখে পরে যেমন অনুভুতি হয় রিঝেরও তেমন অনুভুতি হচ্ছে।যেন সে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে জীবন ফিরে পেয়েছে।তুতুল জড়িয়ে ধরে নি।তার হাত গুলো রিঝের পিঠের কাছেই আছে।দু’হাত উঠিয়ে রেখেছে সে।রিঝ জাপ্টে জড়িয়ে আছে তুতুলের কোমড় পিঠ।নিজের গাল তুতুলের কানের পাশে ঘষে।তার চোখের পানিতে তুতুলের পিঠ,গাল,কানেও পানি ঢুকছে।কান্নার শব্দে তুতুলের কান ঝাঁ ঝাঁ করছে।তুতুলের নাকটা জ্বলে উঠে।ঠোঁট কামড়ে ধরে সে।চোখও জ্বালা করছে।হালকা হালকা লাল চোখে পানি জমা হচ্ছে।তুতুল কাঁদছে!!নিজের কান্নায় নিজে অবাক সে!কেন কাদঁছে??রিঝের জন্য??রিঝের কান্না থামেনা।তুতুল হাত এগিয়ে নেয়।পিঠের কাছে এসেও থামে।কয়েক সেকেন্ড ভাবে।তারপর হুট করেই গলা ছুঁয়ে পিঠ জড়িয়ে ধরে।অদ্ভুত অনুভুতিতে মাতিয়ে তুলে হওয়া বাতাসে প্রেমের গন্ধ।রিঝ কান্নায় জড়িয়ে আসা গলায় বলে,
“ স্যরি।আমি খুব স্যরি।কিন্তু ভালোবাসি অনেক।অনেক অনেক বেশি।তাই তো সব করেছি।ভালবাসায় সব জায়েজ।খুন করাও জায়েজ।আমি ভালোবাসি।তোমাকে খুব ভালোবাসি তুলা পাখি।এত ভালো আমি কাউকে বাসতে পারিনি।কাউকে না।”
কান্নার শব্দে ভারী হয় স্নিগ্ধ পরিবেশ।পাশ দিয়ে এক,দু’জন লোক চলাফেরা করছে।তুতুল আর রিঝকে দেখে দাড়িঁয়ে পড়ছে।আবার হেসে চলে যাচ্ছে।রিঝের কান্না থামছে না।তুতুলও জড়িয়ে ধরে আছে।খাঁমছে ধরে পিঠ।তুতুল কান্নায় জড়িয়ে থাকা কন্ঠে বললো,’ এভাবে কাঁদছেন কেন?’
রিঝ সমান তালে কাঁদছে।তুতুল ফিসফিস করে বলে,’ ছেলেদের কাঁদলে খুব বাজে দেখায়।’
‘ দেখাক।আমি বাজে।’ রিঝের কন্ঠ শিশুদের মত শুনাল।তুতুল বললো,’ আমিও স্যরি।কিন্তু আমি কি করবো?আমি আপনাকে বুঝতে পারিনা।আপনি কি করেন বুঝিনা।আপনি কেন এমন তাও বুঝিনা।আপনার মাঝের সব রহস্য আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।এত অদ্ভুত কেন আপনি?আমি আপনাকে বুঝতে চাই।কিন্তু পারছিনা।আমি পারছি না।’
রিঝ তুতুলকে ছেড়ে দেয়।হাঁটু ভেঙ্গে তুতুলের সামনে বসে।তুতুল বিস্মৃত কন্ঠে বললো,’ কি করছেন আপনি?উছে পড়ুন।’
রিঝ উঠে না।বসে থাকে।তুতুলও হাঁটু ভেঙ্গে।রিঝের গালে হাত রেগে আদুরে গলায় বলে,’এমন কেন আপনি?প্লিজ আমাকে বুঝান।’
রিঝ এক টানে নিজের কালো শার্টের বোতাম ছেড়ে ফেলে।বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে তার শরীরে সুন্দর সুঘ্রান।তুতুলের নাকে মুখে এসে বাড়ি খায় সেই ঘ্রাণ।কি মোহনীয় সেই সুভাব।সেই খুশবু।রিঝ তুতুলের ডান হাতটা নিজের ডান হাতে তুলে নেয়।তুতুল অবাক।নিজের বাম পাশের খালি বুকটায় হাত রাখে।তুতুলের সম্পূর্ন্য শরীর কেঁপে উঠে।বুকের তুমুল শব্দ সে হাত নিয়ে অনুভব করতে পারছে।রিঝ হাতটা আরো চেপে ধরে আসহনীয় শিরশির গলায় বললো,’ তুমি শুধু এই শব্দ গুলোকে বুঝার চেষ্টা করো।আমারে নয়।শুধু শব্দ।যে শব্দ তোমার জন্য দিবারাত্রী শুধু বেজেই চলে।’
তুতুল দু’হাত রাখে বুকে।তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিনঝিনে কন্ঠে বললো,’ আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই।অনেক ভালো।আপনার থেকেও বেশি।আমি কথা দিচ্ছি।’
রিঝ জড়িয়ে নেয়।গাড়ি যায় পাশ দিয়ে।লোকটি জানালা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে বললো,’পাগলামীর আর জায়গা পায়না এরা।পাগল কত গুলো।’
দু’জনেই হেসে উঠে।ভালোবাসায় পাগল হলে দু’জনেরই হওয়া উঁচিত।মাঝ রাস্তায় পাগলামি করলে মন্ধ হয় ন।
বাসায় আসে রাত দশটায়।রিঝ সোজা তার বাবা মাকে বাসা থেকে নিয়ে আসে।বিয়ের তারিখ ঠিক করার জন্য।ঠিক সেদিন তারিখ দেওয়া হয়।যেদিন তাদের বিয়ে হয়েছিল।সবাই খুশি।একটা ভালো লাগার জোয়ার বয়ে যায় ঘরে।আলভী রিঝকে জড়িয়ে ধরে বললো,’ কখনো ভাবিনি তুই আমার বোন জামাই হবি।’রিঝ হেসে উঠে জড়িয়ে ধরে বললো,’ আমি জানতাম।তাই তো তোরে দিয়া কাম করাইতাম।’কথাবার্তা শেষ হয় প্রায় একটার দিকে।ঘুম কারো চোখেই ছিল না।সবাই টান টান উত্তেজনায় ছিল।খুশি আনন্দ ভালো লাগা মিশিয়ে সবাই ঘুমের কথা ভুলে গেছে।সবাই একে একে চলে যায়।শেষে যায় রিঝ।
রিঝ আবার ছুঁটে আসে ঘরের ভিতরে।তুতুল তখন নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল।আলভী সোফায় বসে পড়েছে।রিঝ উঁচু কন্ঠে চেঁচিয়ে ডাকল,” তুতুল!”তুতুল পিছনে তাকায়।প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।রিঝ দ্রুত পায়ে হেঁটে আসে তুতুলের কাছে।ভারী অবাক হয় তুতুল।রুম থেকে বেরিয়ে আসে তুতুলের মা,বাবা।সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় আলভী প্রীতি।রিঝ আলত করে ধরে তুতুলের হাতটা।ছোট করে বলে,” একটু কথা ছিলো।এদিকে এসে বসো।প্লিজ।”
হাতটা টেনে নিয়ে আসে রিঝ।সামনের রুমে সোফার সামনে নিয়ে এসে দাড় করায়।তারপর দু বাহুতে তার হাত রেখে বসিয়ে দেয় সোফার উপরে।তুতুল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।রিঝ নিচে ফ্লোরে বসে হাঁটু ভেঙ্গে।তুতুলের দুটি হাত হাতের ভাজে নিয়ে মায়াভরা চোখে তাকায়।একশো বোতল নেশা চোখে ডুবিয়ে রিঝ গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত।কাতর কন্ঠে বলল,” দেখ আমি ভালো ছেলে না।তুমিও যান।খুব রাগী সেটাও যানো তাই তো।”তুতুল স্মিত হেসে বললো,” জানি।আমি এডজাস্ট করতে পারবো আপনার রাগকে।”
রিঝ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,” আমি পাগল তুমি তো যান।মাথায় সমস্যা আছে।মানসিক রোগী।ডাক্তারও দেখিয়েছি।”“ আমার জন্যেই তো আপনি পাগল।এটা ভাগ্য।এত ভালোবাসা হয় না।কিন্তু আমার বেলায় হচ্ছে।’
‘ তুমি চাইলে আমার সাথে না থেকে বারান্দা ট্যু বারান্দায় সংসার করতে পারবে।’
‘ কেন?রুম শেয়ার করতে চান না?এত কিপটুস আপনি?আল্লাহ্।’ তুতুল দুঃখি দুঃখি ভাব করে।রিঝ হাসলো।বললো,’ আমার হৃৎপিণ্ড,কলিজা,নিঃশ্বাসের ভাগ দিয়ে দিয়েছি।রুম তো কিছুই না।কিন্তু আমার সাথে থাকলে তুমি যদি ব্যথিত হও?’
‘ হবো না।এত ভালোবাসা রেখে আমি তো মরতেই চাই না।বারান্দা তো দূরের কথা।’‘ শেষ বার বলছি তুমি আমার হবে?একদম নিজের করে।’তুতুল রিঝের এলোমেলো চুল আরো এলোমলো করে দিয়ে বললো,’ আমি তো আপনারই।’‘ তোমার পরিবার সাক্ষী তুমি কি বলেছ।পরে পাল্টাবে না তো?’
‘ উহু।’
‘ আমাকে ছাড়া জীবনের কোন রাত তুমি কাঁটাতে পারবে না।’
তুতুল আশ্চর্য হল।বললো,’ মানে কি আমি বাবার বাসায় থাকবো না?’
‘ দিনে থাকবে।রাতে না।’আলভী মুখ চেপে হাসে।তুতুলের বাবা মা অবাক।প্রীতি বিমুগ্ধ।তুতুল আলত হেসে বললো,’ ঠিক আছে।’‘ আর একটা কথা।কোন ভাবে কোন পরিস্থিতে আমাকে একা রেখে যেতে পাবে না।’
‘যাব না।এই যে পায়েল।এটা দেখলেই আমার মনে হয় আমি আপনার সাথে আছি।এক সেকেন্ডের জন্য আলাদা হইনি।হবোও না।’রিঝ বাবা মা ভাই কিছু মানে না।তুতুলের কপালে চুমুবসিয়ে দেয়।আলভী কেঁশে উঠে।তুতুলের বাবা মা দ্রুত রুম ত্যাগ করে।প্রীতি ঢুলে ঢুলে দেখে।তুতুল আহাম্মক বনে যায়।রিঝ হিশহিশ করে কানের কাছে এসে বললো,’ ভালোবাসা প্রিয় পাখি।আমার সুন্দর পাখি।আমার হৃদয়ের আগুন।আমি আসবো।তোমার রাজকুমার হয়ে।’__________
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
_________________
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।