কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-২০+২১🎈

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-২০.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
হোটেল হিল ভিউর সামনে এসে দাঁড়ায় সবাই।সকালের ফঁকফঁকে রোদ এসে পড়ছে চারপাশে।চিকচিক করছে আশেপাশের রাস্তাঘাট।সকাশ ৮টা বাজতে চলেছে।শীতের সকালের রোদ কড়া।তার থেকেও কড়া মনে হয় এই শহরের রোদ।তুতুল মাথায় একটা হাত দিয়ে রেখেছে।রোদের হালকা তাপও এই শহরের কড়া।সূর্য যেন তার মুখে এসে থেমেছে।হলুদ কিরণ একদম তার মুখের উপরে পড়ছে।চোখমুখ কুচকে আছে সে।ঘামও হচ্ছে।এই সামান্য রোদে ঘাম!!তুতুল বিস্মিত।যে শহরের সকালটা এতো সুন্দর তার রোদ এতো কঠিন কেনো??ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তুতুল কিছুক্ষণ পর পর ঘাম মুছে নিচ্ছে।নাকের ডগার বিন্দু বিন্দু ঘাম গায়ের উড়না দিয়ে মুছে নিচ্ছে।জ্যাকেট খুলে বাম হাতের বাঁধনে নিয়েছে।পারলে জুতাও খুলে ফেলতো।কিন্তু দেখতে বাজে দেখাবে তাই সে জুতা হাতে নেয়নি।তুতুলের মুখের এই বিরক্তি ভাব এতক্ষণে রিঝের চোখে পরে।এগিয়ে এসে হাতের জ্যাকেট টেনে নেয়।সেই জ্যাকেট মাথার উপরে ঘোমটার মতো দিয়ে দেয়।তারপর নিজেরটা তুতুলের হাতে দিয়ে বলল,
“ এবার ঠিক আছে।”

তুতুল ভারী বিরক্তি নিয়ে তাকালো।ডান হাত দিয়ে মুখটা মুছে বলল,
“ এটা কি হলো??একেই গরমে বাচঁতাছিনা।তার উপরে আপনি আমার হাতে নিজের জ্যাকেট দিয়ে দিলেন??কি পাইছেন??আপনার চাকর লাগে আমাকে??”
“ আরে ঘরের মানুষ কাজ করলে সেটা চাকর হয় না কি।যতো সব।এতো কাজ চোর কেনো তুমি??সামান্য জ্যাকেট নিতে পারছো না।”
“ আপনার জ্যাকেট অনেক ভারী।” তুতুল মুখটা কালো করে বলল।”

রিঝ হাসলো।অদ্ভুত একটা গাড়ি এসে তাদের সামনে দাড়ালো।উপরে,পাশে, সব খালি।শুধু লোহায় আবৃত।রিঝ,রামিম আর তুতুল বাদে সবার এটাই প্রথম বান্দরবানে আসা।তাদের কাছে গাড়িটা আরো বিস্ময়কর।সবাই যখন তাকিয়ে থাকতে ব্যস্ত রিঝ তখন সবার সামনে তুতুলকে কোলে তুলে নেয়।তুতুল হতভম্ভ!রেয়ানার মুখ দেখার মতো।তার যেনো স্বর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে।তুতুল হতভম্ভ গলায় বলল,
“ আপনি কি পাগল??”

রিঝ হেসে উঠে বলল,
“ হলে সমস্যা কি?”

গাড়ির নাম চাঁদের গাড়ি।কেউ কেউ জিপ বা চান্দের গাড়িও বলে।গাড়ির চারপাশ খোলা।ভিতর থেকে উপরে তাকালে আকাশ দেখা যায়।তুতুল নাম শুনেছে আগে কখনো উঠে নি।মেয়েরা এক পাশে বসেছে অপর পাশে বসেছে ছেলেরা।সামনা সামনি সবাই।রামিম রিঝকে প্রশ্ন করলো,
“ তুই এমন এলোমেলো কাজ করছ কেনো??নিজে ড্রাইভ করলি,এখন চাঁদের গাড়ি,আবার সাইরু।ভাই তুই কি পাগল হয়ে গেলি না কি??”

তুতুল সবার আগে বলল,
“ হুম হয়ে গেছে।আপনার এখনো সন্দেহ আছে না কি ভাইয়া??”

আকাশের আনন্দ দেখার মতো।সবাই যেখানে চুপচাপ সে চিৎকার করছে।চাঁদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তার জন্য অপূর্ব গাড়ি।পাহাড়ের সৌন্দর্য থাকে দু’পাশে।উপরে তাকালেই আকাশ।খোলা আকাশ।গাড়ি থানছি স্টেশন থেকে মোড় ঘুরায় ।গাড়ি উপরের দিকে উঠতে যাবে ঠিক তখনই তুতুল ধপ করে পরে যায়।সিটের নিচে।হাতে হাঁটুতে ব্যথা পায়।রেয়ানা হু হা করে হেঁসে উঠে।রিঝ দু হাতে তুতুলকে ধরে।তুতুল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেই দেয়।চলন্ত গাড়ি।গতি অনেক বেশি।এই গাড়ি গুলোর বৈশিষ্ট এটাই।দ্রুত গতিতে চলে।আঁকাবাঁকা পথে বাতাসের বেগে ছুটে যায় বহু দূর।তুতুলকে টেনে তোলে রিঝ রামিম আর আসমা মিলে।পায়ের কাছে আর হাতের কুনইতে ব্যথা পেয়েছে সে।রিঝ তুতুলকে নিজের পাশে বসায়।রামিম ব্যগ থেকে পানির বোতল নিয়ে এগিয়ে দেয়।তুতুল কাঁদতে কাঁদতে পানি খায়।পানির সাথে হিঁচকি উঠে।রিঝ হাতটা ঝেড়ে দেয়।পানি ঠেলে মুছে দেয়।শান্ত করার জন্য বলে,
“ এভাবে কাঁদছো কেনো??ব্যথা ভালো হয়ে যাবে।”

তুতুল নাক টেনে টেনে বলল,
“ সব হইছে আপনার জন্য।আজাইরা গাড়ি নিয়ে আসার কি দরকার ছিলো??এমনেই যেতে পারতাম।আর এই দিকে আসারই বা কি দরকার ছিলো।ওই দিকেই তো নীলাচর,মেঘলা আর কি কি জানি ছিলো।ওহ্ আমার হাত।”
তুতুল শব্দ করে কাঁদে।রিঝ দু’হাতে বাচ্চাদের মতো করে তুতুলকে কাছে টেনে নেয়।কন্ঠ নরম করে বলে,
“ থাক আর ব্যথা হবে না।ভালো হয়ে যাবে।স্যরি বুঝতে পারিনি তোমার এই গাড়িতে এতো সমস্যা হবে।আমি ভেবেছি প্রকৃতি দেখার জন্য এই জিপের চাইতে বিকল্প আর কোনো গাড়িই ভালো হবে না।স্যরি এগেইন।”
তুতুল ঠোঁট উল্টে নেয়।সবাই এতোই মগ্ন হয়ে কথা শুনছে যে গাড়ির মোড় ঘুরাতেই ধপ ধপ করে সবাই একজনের গায়ের উপরে আর একজন পরে।শুধু রিঝ শক্ত হয়ে বসে আছে।দুই হাতে তুতুলকে জড়িয়ে আছে সে।তুতুল চুপ করে কান্না থামায়।সবার পড়া দেখে তুতুল রিঝের বুকে মুখ গুঁজেই হাসলো।বলল,
“ একদম ভালো হইছে।যেমন কর্ম তেমন ফল।অন্যের কষ্টে হাসলে এমনই হয়।”

রেয়ানা পরে সবার নিচে।সে পড়ার সময় আসমাকে টেনে ধরে।এক এক করে সবাই পরে।রেয়ানার অবস্থা খারাপ।তুতুল হাসছে তো হাসছেই।রিঝ নিজেও হেসে উঠে কিন্তু তুতুলকে থামতে বলে।তুতুল থামে না।উঠতে নিলে আবার ধপদাপ করে পরে সবাই।তুতুল উচ্চ শব্দে হাসে।রিঝ বলল,
“ তোরা কি সব তুতুলের মতো বাচ্চা আবাল না কি??শক্ত করে বসতে হয় যানছ না??”

তুতুল চোখ ছোট করে বলল,
“ কে আবাল??”

রিঝ মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো।তাই কথা ঘুড়িয়ে বলল,
“ আমি ছাড়া আর কেউ না।”

সবাই হাসে।একে একে উঠে বসে।তুতুল তো এলোমেলো ভাবে পরেছে তাই বেশি ব্যথা পেয়েছে।বাকিরা সবাই ঠিক ভাবেই পরেছে।তাই সবাই মোটামুটি ঠিক আছে।তুতুলের হুঁশ হয়।বুঝতে পারে।সে রিঝের শক্ত বুকে মাথা দিয়ে রেখেছে।বুঝতে পরেই সে দ্রুত মাথা সরিয়ে নেয়।গাড়ি আবার ব্রেক করতেই পরতে নেয়।রিঝের হাত ধরে বসে পরে।রিঝ বলল,
“ আকাশ,রামিম,হিমেল যা মেয়েগুলোর হাত ধর।কখন যে আবার ধপাস ধপাস করে পড়বে হিসাব নাই।

রিঝের কথায় ফুসে উঠে মেয়ে সমাজ।সবাই কড়া চোখে তাকায়।রিঝ এমন একটা ভাব করছে যেনো,এটার চাইতে বড় সত্যি আর নেই।সত্যিই মেয়েটা যেখানে সেখানে ধপ ধাপ করে পরে।মেয়েদের মুখটা দেখে ছেলেরা সবাই মিটমিট করে হাসলো।
_____________________
তুতুল চারপাশটা দেখছে।সবুজ আর সবুজ।এ যেনো নীলের তলায় সবুজের দুনিয়া।তীব্র বাতাসে চুল করে দিচ্ছে এলোমেলো অগোছালো।চোখে মুগ্ধতা।সূর্যের আলো পড়ছে সবুজের বুকে।রূপ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।এই রাজ্যের রূপ যেনো শুধু বাড়ছে।কমার নাম নেই।যত দূর যাচ্ছে,যতো পথ পাড়ি দিচ্ছে রূপের বাহার বেড়েই চলেছে।মাথার উপরে তেজি সূর্যের ঝলকানিও হার মানবে সবুজের কাছে।একের পর এক দ্রুত বেগে ছুটে আসছে গাছ,লতা,পাহাড়।তুতুল সামনের দিক করে বসেছে।তাই তার পিছনে পরেছে পাহাড়।সামনে পরেছে গাছ,লতাপাতা,আর বিশাল নদীর দৃশ্য।দূরে দূরে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়।গাড়ি একবার নিচে নামছে।তো আবার উপরে উঠছে।আকাঁবাঁকা পথ।বাতাসের তেজ সাই সাই করে আসছে।লতার ভাজে ফুল!সেই ফুল সবুজের সমারহের রূপ আরো অপরূপ সৌন্দর্যে মেখে রেখেছে।ছোট ছোট লাল ফুল।হলুদ ফুল।আর সাদা ফুল।একটা দুইটা সাদা পাতার গাছও দেখা যাচ্ছে।রঙ্গের গাছও আছে বটে।সব রূপ পাগল করে তুলছে তুতুলের চঞ্চল দু’টি আখিকে।এ যেনো নতুন করে রূপের আবিষ্কার।তুতুলের নামতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু হাতের ব্যথায় ভালোও লাগছে না।লাল লাল ছোট ফুল গুলো তাকে টানছে।বরাবরই সে ফুল প্রেমি।এখনই পাহাড়ের বুকে উঠে ফুলগুলো হাতে নিয়ে নিতো সে।যদি তার খারাপ না লাগতো।তুতুলের চুলের গন্ধে রিঝের কান,নাক ঝাঁ ঝাঁ করে উঠছে।প্রকৃত পক্ষে চুলের কোনো নিজস্ব ঘ্রান হয় না।শরীরের ঘ্রান আর সেম্পুর ঘ্রান মিশে একটা অদ্ভুত ঘ্রানের জন্ম দেয় চুল।সবাই সেই ঘ্রান পায়ও না।যে পেতে চায় সেই পায়।রিঝের চোখে মুখে ধনুকের মতো এসে আঁছড়ে পড়ছে সেই চুল।তবুও সে সরিয়ে দিচ্ছে না।সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিঝ গাড়ির উপরের খোপের মাঝে মাথা ঢুকিয়ে দাড়িয়ে পরে।অনেক গাড়িই ঘুরতে আসছে।সকাল সকালই মানুষের ভীর বাড়ে এই নীলগিরির পথে।অনেকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।চিৎকার করছে।রিঝ দু’হাতে ভর করে নিজেকে গাড়ির একদম উপরে নিয়ে আসে।তুতুল এই দৃশ্য দেখে আঁৎকে উঠে।দু’কানে হাত রেখে চোখ বুঝে।আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে উঠে,
“রিঝ ভাই!!পড়ে যাবেন তো??”

সবাই খুব ভয় পায়।আসমাও চিৎকার করে উঠে বলে,
“ পাগল হইলি না কি?রিঝ নাম কইতাছি।”

রিঝ একদম মাথায় উঠে সুন্দর করে পা দ এর মতো ভাজ করে বসে।চাঁদের গাড়ি দুইটি অংশে ভাগ করা থাকে।একটা অংশ লোহার শিক চারপাশে।অপর অংশ নরমাল গাড়ির মতো।রিঝ দুই অংশ মিলিয়ে বসেছে।রামিম নিজেও ভয় পায়।এটা সে ভাবেনি।রিঝ সাহসী।খুব সাহসী।কিন্তু এটা করার মতো সাহস আছে সে জানতো না।তুতুল উঠে দাঁড়াতে নিয়ে আবার পড়ে যেতে নেয়।রামিম হাত ধরে।তুতুল উত্তেজিত হয়ে রিঝকে বলল ,
“ আপনি কি পাগল??এভাবে উঠে বসেছেন কেনো??পড়ে গেলে কি হবে জানেন??নামেন।”

রিঝ নিজের উড়ন্ত সিল্কি চুল সামলাতে ব্যস্ত।তুতুলের উত্তেজনা দেখে তার কেনো যেনো খুব ভালো লাগছে।তার ইচ্ছে করছে মৃত্যুকে একদম কাছ থেকে দেখে আসতে।তখন তুতুলের রিয়েকশন কেমন হবে ভাবছে সে।তুতুলকি অনেক কাঁদবে??না !কাঁদলে তারও খারাপ লাগবে।তুতুল কাঁদুক সে চায় না।কিন্তু তুতুলের বড় বড় ডাগর চোখ পানিতে ভাসলে সত্যিই একটা অদ্ভুত মায়ার ভুবণ তৈরি হয় মুহূর্তে।রিঝ নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়।সেই প্রথম সুপ্ত প্রেমিক যে চায় তার সুপ্ত ভালোবাসা কাঁদুক।রিঝ শক্ত হয়েই বসেছে।কিন্তু ভাবনার জগৎে থাকায় গাড়ি থামার সময় সে পরে যেতে নেয়।তুতুল ভয়ে চিৎকার করে চোখ বুঝে।বুকের ধুকধুক শব্দ নিজের ভিতর থেকে সবাই শুনতে পাচ্ছে।রিঝ উপর থেকে উল্টে ঝুঁকে।হাতগুলো লোহার রডের উপরে ভাঁজ করে রাখে।তুতুল চোখমুখ কুঁচকে আছে।ভয়ের সেই তীব্র শব্দ তার কানেও এসে লাগছে।রিঝ হেসে উঠে।তুতুল তড়িৎ করে চোখ খুলে তাকায়।উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে রিঝ তার দিকে অপলক তাকিয়ে হাসছে।সিল্কি চুল গুলো মুখটা হালকা ডেকে রেখেছে।সবাই হাপ ছেড়ে বাঁচলো।আসমা রাগে আগুন হয়ে বলল,
“ রিঝ ফাইজলামিরও সামা থাকে।তুই কবে থেকে এমন ফাজিল হয়ে গেলি??এসব তো তোকে মানায় না।শান্ত ছেলেটা চোখের সামনে খারাপ হয়ে গেলো।আল্লাহ তোর মার কাছে কি কমু??সময় থাকতে ভালো হয়ে যা দোস্ত।ফাইজলামি ছাড়।”

আসমার কথায় সবাই হেসে উঠে।শুধু তুতুল বাদে।সে এখনো রিঝের দিকে তাকিয়ে আছে।গাড়ি থেমেছে।তুতুল সবার সামনে হুট করে খাজের মাঝে দু’হাত ঢুকিয়ে রিঝের গলা জড়িয়ে ধরে।রিঝের গলা লোহার সাথে লাগে।তীব্র ব্যথা পায় সে।তবুও শব্দ করে না।সে অবাক!বিস্মিত!হতবাক!পারলে তো সে এই মুহূর্তেই পাগল হয়ে যেত।তুতুল কেঁদেই দিলো।ফুঁপিয়ে বলল,
“ ভাইয়া এগুলো কি??এমন করার মানে কি??আর কখন এমন করবেন না।জানেন কত ভয় পাইছিলাম?”
“ সত্যি!!তুমি ভয় পেয়েছো??তাও আমার জন্য??” রিঝের কন্ঠে ভারী অবাক ভাব।সে বিশ্বাসই করতে পারছে না।তুতুলের হুঁশ হয়।সরে যায়।গলা ছেড়ে।রিঝ এখনো উপুত হয়ে শুয়ে আছে।তুতুলের সাদা হয়ে আসা মুখে মুহূর্তেই ছুটে আসে একফালি রক্ত পিন্ড।যা তার মুখ লাল করে তোলে।অদ্ভুত লজ্জায় সে মিইয়ে যায়।নিজের চোখ নিজেই বুজে নেয়।উত্তর না দিয়েই হনহন করে সে নেমে যায়।রিঝ এখনো বিস্মিত!চিৎ হয়ে গাড়ির পিঠেই মাথা রেখে দেয়।

সাইরু হিল রিসোর্ট।শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান।নীলগিরি রোডে ওয়াই জংশন আর্মি ক্যাম্পের পাশেই সাইরু হিল রিসোর্ট অবস্থিত।দিগন্ত জুড়ে ঢেউ খেলা পাহাড়ের ভাজ ও শুভ্র মেঘেদের সমুদ্র নিয়েই এই সাইরু হিল। আশেপাশের পাহাড়গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ পাহাড়টিতে গড়ে উঠা সাইরু হিল রিসোর্ট ।অনেকের মতে বর্ষাকাল হচ্ছে সাইরু হিল রিসোর্ট ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময়। তবে, শীতকালেও সাইরু হিল রিসোর্ট -এর সৌন্দর্য অসাধারণ।রিঝই এই রিসোর্টে আগে থেকেছে।অন্যকেউ আগে থাকে নি।এটি একটি লাক্সারী রিসোর্ট।সাধারন মানুষ থাকতে চায় না।অর্থের দিকে এটা প্রচন্ড পিড়াদায়ক।রামিম আগে এসেছিলো নীলগিরিতে।এটাও দেখেছে।তখন সে ভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্র।রিঝ এবং তার প্রথম বান্দরবানে আসার সময় ছিলো সেটা।ভালো সুবিধা দেয় এমনটা ভেবে রিঝ এখানে থাকতে আসেনি।প্রথম বারের পরে যতবার এসেছে সে এই রিসোর্টেই থেকেছে।টাকা বেশি খরচ হলেও জায়গাটা তার খুবই প্রিয়।এখানে থাকার একটাই কারন তা হলো পাহাড়,মেঘের সৌন্দর্য একদম কাছ থেকে দেখা।রামিম ব্যাগটা কাধে নিয়ে রিঝের পাশে এসে দাড়ায়।তারপর বলে,
“ এখানে থাকার কি দরকার??খরচ অনেক বেশি।১০০০০ টাকার নিচে কোনো রুমই নেই।আর ভালো মানের নিতে গেলে তো আরো বেশি।”

রিঝ হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“ সৌন্দর্যের কাছে অর্থ মূল্যহীন।আর ভাবখানা এমন করতাছস যেন তুই ফকির।এতো টাকা জমাই কি করবি??পরে দেখা যাবে বউ সব নিয়া আর একজনের হাত ধরে পালাই গেছে।”

আকাশ পিছে পিছে আসে।এতো সুন্দর রিসোর্ট দেখে সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ দোস্ত জীবনে মনে হয় এইডাই ভালা কাম করছস।এতো সুন্দর জায়গা আমি আমার জীবনে দেখি নাই।”

রামিম আর রিঝ দুজনেই আকাশের দিকে তাকায়।রিঝ মুচকি হেসে বলে,
“ সুন্দর তাই না?”

আকাশ দ্বিগুণ তালে হেসে বলল,
“ সুন্দর মানে!পাগল হয়ে যাওয়ার মতো।তা ভাড়া কত??তুই কক্সবাজারে আমার ভাড়াটা দিছস।এবার আমি তোরটা দিবো।রামিম তোরটাও।শতহোক তোরা আমার জানের জিগার।”

রিঝ রামিম দু’জনেই ঠোঁট কামড়ে ধরে।হাসি যেন মুখ ফেটে বেড়িয়ে আসবে।রিঝ নিজেকে ঠিক করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ বেশি না দোস্ত।কত দিন থাকবি বল??তার উপরে হিসাব করে কমুনে।ক??”

রিঝ আকাশের দুই বাহুতে হাত রাখে।রামিমও সাথে।যাতে পড়ে যাওয়ার সময় ধরতে পারে।রামিম হেসেই চলেছে।তবে শব্দ করছে না।হিমেলও পাশে এসে দাড়ালো।মেয়েরা যেখানেই যাবে দ্রুত কোনো কাজ করতে পারে না তারা।ব্যাগ নামাতেই তাদের সময় লাগছে।টানতে আবার সময় লাগবে।আরো কত কি।রামিম বুঝেনা।এতো বড় ব্যাগে মেয়েরা কি নিয়ে ঘুরে।শালার ঘুরতে আসছে তাও একজনের তিন চারটা করে ব্যাগ।যেনো জীবনের জন্য শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে যতো সব।আকাশ চারপাশে একবার আলতো করে চোখ বুলিয়ে বলল,
“ আমার তো সারা জীবন থাকতে ইচ্ছা করতাছে।তবে এতো দিন সময় নাই।ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসছে।সাত দিন থাকমু।হুম সাত দিনই ফাইনাল।”

রিঝ আর রামিম মিটমিট করে হেঁসে উঠে।রিঝ মুখে মুখেই হিসাব করে।রামিম করে ফোনে।রিঝ হিসাবে খুবই পাকা।দ্রুত সে গুনের কাজও করতে পারে।তাও বড় বড় অঙ্কের।হিসাব করে বলল,
“ আকাশ তুই প্রস্তুত??”

আকাশ ক্ষেপে যায়।হ্যাঁ সে একটু কিপটা।তাতে কি হয়েছে।৩০০০০/৫০০০০ টাকা কী সে দিতে পারবে না?অব্যশই পারবে।ব্যাংকে তার কোটি টাকা জমা আছে।যদিও রিঝ আর রামিম বাদে কেউ জানে না।তাতে কি?তাকে এভাবে অপমান করতে পারে না ওরা।আকাশ ক্ষেপা গলায় বলল,
“ তোরা কি ইয়ারকি মারতাছস আমার লগে?”

রিঝ সিরিয়েস হয়।খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার কর সে বলল,
“ বেশি না দোস্ত।তিন জনের মোট আসবে ৩৩৬,০০০ টাকা।আর তুই যদি সবারটা দিতে চাস!না মানে তোর মন তো বিশাল।তাই বললাম যদি সবারটা দিতে চাস তাহলে দিতে হবে ৮৯৬,০০০টাকা।”

রিঝ সংখ্যা বলে একটা একটা করে।আকাশ মিলায়।কিছুক্ষণ শুধু শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে।তারপর ঠাস করে রামিমের গায়ে এলিয়ে পরে।সবাই হেঁসে উঠে।আকাশের অবস্থা ভয়ংকর।এতো টাকা??পুরা দশ লক্ষ!!বিগত পাঁচ বছরেও সে এত টাকা খরচ করেনি।এখন কিনা মাত্র সাত দিনেই দিতে হবে??রিঝ শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
“ কিরে কয়জনেরটা দিবি??না কি সবারটা দিবি??”
“ আমি তো নিজেরটা কিভাবে দিবো ভাবতাছি।কে কইছে তোরে এই রিসোর্টে আইতে??কে??” আকাশের কন্ঠে চিন্তা।”

রিঝ হেসে উঠে বলল,
“ চিল দোস্ত।তোরে দিতে হইবো না।নিজেরটাই দিছ।আর আমরা চারটা রুম নিবো।সো এতো টাকা আসবে না।সবাই নিজেরটা দিলে অঙ্ক কমে আসবে।”

আকাশ আরো ক্ষেপে।সবাই ওর মজা নিচ্ছে।রিঝকে ধাওয়া করে।রিঝ দেয় এক দৌড়।রামিম পিছনে পিছনে।আকাশ পুরাই ক্ষেপা হয়ে আছে।আজকে কাউরে ছাড়বে না সে।
______________________
সাইরু তে রয়েছে ৫ ধরনের রুম এবং ভিলা। প্রিমিয়াম, এক্সিকিউটিভ, সাঙ্গু ভিউ (ছাদ সহ এবং ছাদ ছাড়া) এবং ফ্যামিলি কটেজ। প্রত্যেকটিতেই আছে বারান্দা যেখান থেকে উপভোগ করা যায় নয়নাভিরাম প্রকৃতি। প্রত্যেকটি রুমেই রয়েছে এলসিডি টিভি এবং শীতাতপ ব্যবস্থা।তুতুলের রুমটা প্রিমিয়াম।মেয়েদের জন্য দুটি রুম নেওয়া হয়েছিলো প্রথমে।পরে আসমার আর তুতুলের জন্য আলাদা আলাদা রুম নেওয়া হয়েছে।ছেলেদের জন্য দুটি।রামিম আর রিঝ একটা রুমে ,হিমেল,আকাশ এক রুমে।তাদের ভিলার নাম সাঙ্গ ভিউ ছাদ সহ।তুতুলের কপাল বরাবরই ভালো।এবার তার রুমটা পরেছে একদম পাহাড় ঘেঁষে।তাই পাহাড়ের ভাজগুলো অসাধারন ভাবে দেখা যায়।সম্পূর্ন রিসোর্ট ঘুরা একদিনে সম্ভব না।বিশাল এরিয়া নিয়ে তৈরি এই রিসোর্ট।তুতুল আর আসমা অনেক টুকু হেঁটে দেখে।মাঝে মাঝে তো তুতুল ভুলেই যায় তাদের রুমটি কোনদিকে।রিসোর্টে রয়েছে বিশাল রেষ্টুরেন্ট।তুতুল একটু হেঁটে যেখানে বসার জায়গা পাচ্ছে বসে পড়ছে।প্রকৃতিকে যদি কেউ ছুঁয়ে দেখতে চায় তার ভাষ্য মতে তাদের এখানে আসা উঁচিত।যেদিকে যায় সেদিকেই প্রকৃতির ছোঁয়া।গাছ।দূরে পাহাড়।সূর্যের আলো পড়ছে একদম মাথার উপরে।তুতুলের সেই রোদ গায়ে লাগছে না।রোদের সাথে চারপাশ থেকে ছুঁটে আসছে বাতাস।বাতাসের সেই তালে রোদের তাপ আর গায়ে লাগছে না।পাশের একটা জায়গায় চোখ পরে তুতুলের।চড়ুই পাখির বাসার মতো দোলনা।তুতুলের বাসায়ও আছে।আসমাকে নিয়ে সে সেই দোলনায় বসে।কিছুক্ষণ দোল খায়।আসমা তুতুলের কিছু ছবিও তুলে।তুতুল জানে না।অনেক্ষণ হেঁটে তারা রুমে আসে।তুতুলের জন্য একা একটা রুম নেওয়া হয়েছে।তুতুল রুম শেয়ার করতে পারে না।তার বিশাল বিছানা লাগে।সারা বেড জুড়ে গড়াগড়ি করা তার স্বভাব।তাই আলভী আসার সময় বলে দিয়েছিলো তুতুলের আলাদা রুম চাই।রিঝেরও কথাটা মাথায় ছিলো।তাই আলাদা রুম নিয়েছে।প্রিমিয়ামে দু’জন মানুষ আর একটি বাচ্চা থাকতে পারে এমন রুম।মায়শা আর রেয়ানা একটা রুম শেয়ার করে থাকবে।আর আসমা নিজের জন্য আলাদা রুম নিয়েছে।এদের সাথে সে থাকবে না তাই।রেয়ানা একটু খিটখিটে স্বভাবের।আসমার সাথে তর্ক করেছে সে।তাই আসমার ওকে ভালো লাগছে না।রিঝ এখানের বহুল পরিচিত টুরিস্ট।যতবার এসেছে এখানে থেকেছে।তাই তার জন্য আলাদা একটা সুবিধা রয়েছে।এবং সবাই তাকে খুব সাদরে রাখে।আর চিনেও।আসমা আর তুতুলের রিসোর্ট একুই।মায়শা আর রেয়ানা টাকা বাচাঁতে সাঙ্গু ভিউ ছাদ সহ ভীলায় থাকবে ঠিক করে।আকাশ ওয়াসরুমে ঢুকে নিজের মাথায় পানি দেয়।হিমেল বলল,
“ কিরে তুই কি এখনো টাকার চিন্তা করতাছস??”

আকাশ চোখ গরম করে তাকায়।বলে,
“ আর কোনো কথা নাই তোগো কাছে??সবগুন শুধু এইডাই কইতাছস ক্যান??”
“ কারন তুই এইডারেই ভয়পাছ।”

হিমেল হাসলো।নিজের জামা কাপড় গুঁছিয়ে রাখছে সে।আকাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ এতো গুঁছিয়ে লাভ নাই।কালকেই চলে যামু।”
“ তুই দোস্ত শান্ত হ।দরকার হলে তোর ভাড়া আমরা সবাই মিল্লা দিয়া দিমু।”
“ চুপ কর শালা।আমার ভাড়া আমিই দিমু।তবে এটার ভাড়া কত??”
“ ১০০০০ মেবি।”

আকাশ হাফ ছেড়ে বাঁচলো।দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“ যাক বাবা বাঁচা গেছে আমি তো ভাবছি আমার সব গেলো বলে।আল্লাহ গো।নামাজ পড়তে হইবো।”

আকাশ ওযু করে।হিমেল তামাশা করে বলল,
“ নামাজ তো জীবনেও সব ওয়াক্ত পড়ছ না।এখন পড়বি তাও কিপটামি করিছ না।সব পড়িছ।আকাশ এটার জন্যেই তোর গার্লফ্রেন্ড নাই।সব কিছুতেই কিপটামি।”
“ একদম আজাইরা কথা কইবি না।গার্লফ্রেন্ড নাই তো কি হইছে??” আকাশের তেজি গলা।

হিমেল রয়ে সয়ে বলল,
“ গার্লফ্রেন্ড বিহীন তরুনের
পৃথিবীতে বেঁচে থাকা,
ঘাসবিহীন মাঠে গরুর পায়চারির মতো।”
~হুমায়ুন আহমেদ~

আকাশের চেহারা বেচারা হয়ে যায়।হিমেল হাসে।আকাশ মনে মনে ঠিক করে কোটি টাকা গেলেও একটা গার্লফ্রেন্ড তার চাই।চাই চাই।প্রেম সে করবেই।প্রেম না করে বিয়ে করবে না জীবনেও।
_________________________
রিঝ তুতুলের কটেজে আসে।দেখে লক করা।আসমাকে অকেক্ষণ ডেকে তারপর ঘুম থেকে উঠাতে পারে সে।এই মেঘাচ্ছন্ম পাহাড়ের দেশের হিমেল বাতাসে তার দারুন মন কাড়া একটা ঘুম চোখে ধরা দিয়েছিলো।কিন্তু এই রিঝ তারে ঘুমাইতেই দিলো না।আসমা রিঝকে বকা দিতে দিতে দরজা খুলে দেয়।রিঝ তখন সানগ্লাস খুলতে ব্যস্ত।চার কোণা সানগ্লাস তার।পাওয়ার দেওয়া।রিঝের যত সানগ্লাস আছে সব গুলোতে সে পাওয়ার যোগ করে।তা না হলে ভালো করে দেখতে পায় না।আসমা পা থেকে মাথা পর্যন্ত রিঝকে দেখে।সাদা শার্ট কালো থ্রি কোয়াটার প্যান্ট।রিঝ মাথাটা কাত করে ভ্রুতে দু’টি আঙ্গুল রেখে বলল,
“ তুতুল কই??”

আসমা সচেতন হয়।ঘুম উড়ে যায়।সোজা হয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“ রুমে নাই??”
“ থাকলে কি আর তোরে ডাকতাম??”

আসমা বিচলিত হয়ে বলল,
“ কি কছ দোস্ত?কই গেলো ও??”

রিঝ সানগ্লাস পরে নেয়।আসমা উড়না নিয়ে আসেনি।তাই বলল,
“ দাড়া আমিও যাবো।উড়না নিয়া আসি।”

রিঝ থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ লাগবো না।আমি খুঁজে নিতে পারমু।কোনা কোনা জানা আছে আমার।চিন্তা করা লাগবে না।”

আসমা তুতুলকে কল করে।কয়েকবার বাজার পরে সে ধরে।আসমা বলে,
“ কই গেলা তুমি??রিঝ আমি দুজনেই চিন্তায় আছি।ঠিক আছো তো??”

অপর পাশ থেকে তুতুল বলল,
“ হুম ঠিক আছি।চিন্তা করতে হবে না।আর উনাকেও বলে দিয়েন খুঁজতে হবে না।”

ফোনটা কট করে কেঁটে দেয়।আসমা হা হয়ে যায়।আবার নিজে নিজেই বলে,
“ দু’টাই পাগল।মাঝে থেকে আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে।যত সব ঢং।”

আসমা আবার ঘুম দেয়।আজকে তারা কোথাও যাবে না।শুধু রিসোর্ট ঘুরে দেখবে।এই রিসোর্ট আসলেই ঘুরে দেখার মতো।শুধু এটা দেখার জন্যেও অনেকে এসেছে।

তুতুল হাপিয়ে উঠেছে।ছয় তলার মতো বেয়ে উঠে আবার দু’তলার মতো উঠতে হয়েছে তাকে।পুলটা এতো উপরে তৈরি করার ভুত কার মাথায় এসেছে তাকে দেখার ইচ্ছে তুতুলের।মনে মনে কিছুক্ষণ পাগল বলল লোকটাকে।বানাবে ভালো কথা।কিন্তু এতো উপরে কেনো??আশ্চর্য!তুতুল ঘুরে আসে।তার মনে হচ্ছে আজকে ওজন দশ কেজি কমে গেছে।এতো উপরে উঠেছে কমতেই হবে।তুতুল সুইমিংপুলের সামনে এসে দাড়ায়।তখন সূর্য হেলে পড়েছিলো।সুইমিংপুল দেখে তুতুল বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে!!এটা কি!!পৃথিবীতে অনেক সুন্দর জায়গা আছে সে জানে।বাংলাদেশেও আছে।কিন্তু এটা তো সব কিছুর উর্ধ্বে।পাহাড়ের বুকে একটা ছোট সমুদ্র!এটি এমন এক সুইমিংপুল যেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৮০০ ফুট উপরে।পুলের অপর পাশে বিশাল নিচু খাঁদ।যা ১৮০০ ফুট নিচু।পানি বেয়ে পড়ছে সেই পুলের বাহিরে।দেখে ছোট সমুদ্র বলাই চলে।ঘন পাহাড়।আকাঁবাঁকা,ঢেউ খেলামো বাহার।সবুজের চাইতেও সবুজ।তুতুল মুগ্ধ হতে পারছে না।এর চাইতে বেশি কোনো ভাষা থাকলে সে সেটাই হচ্ছে।নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে অদ্ভুত ঘ্রাণ!এটা সত্যিই দুনিয়ার স্বর্গ।পাহাড় গুলো একের পিঠে এক যেন সারিবদ্ধভাবে সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে সাজিয়েছেন।তুতুল কান খাড়া করে।কিচকিচ পাখির শব্দ কানে আসে।আশেপাশে পাখি আছে।বন্য পাখি!তুতুল দু’হাত প্রজাপতির মত মেলে ধরে দীর্ঘশ্বাস নেয়।সমু্দ্র আর পাহাড় যেনো একসাথেই তার চোখে ধরা দিয়েছে।তুতুল যখন এই সুন্দর রূপের মাঝে ডুবে ছিলো তখনই ফোনটা বেজে উঠে খুবই বাজে ভাবে।ঠিক বিরিয়ানির মধ্যের এলাচের মতোই।কয়েকবার কেঁটে দেয় সে।আশেপাশে দুই একজন মেয়ে আছে।তারা পিছনের দিকে তাকিয়ে কি যেন মুগ্ধ হয়ে দেখছে।তুতুল পিছনে তাকায়।দেখে রিঝ আসছে।ঢোলা সাদা শার্ট বাতাসে উড়ছে।সাথে দোল খাচ্ছে সুর্যের আলোতে হালকা সোনালি হয়ে উঠা চুলগুলো।চোখে চার কোণা কালো সানগ্লাস।হাতের ঘড়ি ঝুলে আছে অনেকটুকু।কানে হেড ফোন।হাতে ফোন।আবার কল আসে।তুতুল দ্রুত পাশের চেয়ার গুলোর নিচে লুকিয়ে পরে।কল রিসিভ করে।রিঝ সুন্দর করে জিজ্ঞেস করে,
“ কোথায় তুমি??”

তুতুল আস্তে করে বলল,
“ আমি আমার রুমে ছাড়া অন্য কোথায় থাকবো?”

রিঝ হেঁটে মেয়েগুলোর দিকে এসে তুতুলকে খুঁজে।মেয়েগুলো হা করে তাকিয়ে থাকে।কিছুক্ষণ পরে সুইমিং করা শুরু করে।রিঝ সেদিকে তাকায় একবার।মেয়েটার সিল্কি সোজা চুল।রিঝকে তাকাতে দেখে সে ডুব দিয়ে উঠে।রিঝের দিকে তাকায়।রিঝ সানগ্লাস নামিয়ে উপর দিয়ে দেখে।মেয়েটা খুশিতে গদগদ।রিঝ ফোনে তুতুলকে বলল,
“ আর তোমার জুতা কই??”

তুতুল একটু অবাক হলো।তারপর বলল,
“ পায়ে। কেনো??”
“ না কিছু না।” রিঝ সানগ্লাস পরে নেয়।হেড ফোন ঘাড়ে নামিয়ে নেয়।মেয়েটা কাছে এসে বলল,
“ এসকিউজমি।”

রিঝ তাকায়।বলে,
“ ইয়েস!”
“ আপনি কি কিছু বলবেন??”

রিঝের চোখ যায় পাশে।একটা সাদা চেয়ারের পিছনে তুতুল বসে আছে।রিঝ সেদিকে যেতে যেতে বলল,
“ বলবো একটু পরে।আপনি আপনার কাজ করুন।”

তারপর আবার ফোন কানে নিয়ে বলল,
“ তুতুল তা তুমি এখন কি করছো??”
“ নাচ করতাছি দেখবেন??” তুতুলের রাগি কন্ঠ।
“ দেখালে কেনো দেখবো না।আমি আবার না বলতে পারি না।তুমি তো জানোই।”
“ আপনি এই সময় ফোন দিলেন কেনো??”
“ তুমি ঠিক আছো কি না জিজ্ঞেস করার জন্য।”
“ আমি কি ছোট বাচ্চা??যে দেখে দেখে রাখতে হবে।”

রিঝ হাসলো।তুতুলের পছনে এসে হাঁটু ভেঙ্গে বসলো।তুতুল এখনো টের পায় নায়।সামনের আয়নায় দেখা যাচ্ছে তুতুল রিঝকে ভেঙ্গাচ্ছে।নিচের দিকে তাকিয়ে আছে তাই রিঝকে দেখছে না।তুতুল বিড়বিড় করে কথা বলছে নিজের সাথে,
“ শয়তান একটা।যেখানে যায় মেয়েরা হুমড়ি খাই পরে।যেন মানুষ না ভুত।যত সব।আবার আমার পিছনে পিছনেও এসে গেছে।ওহ্।একটু শান্তিও দিবে না।হারামি একটা।”

রিঝ হাসিতে মাখামাখি হয়ে বলল,
“ তাই না কি?তা তুমি এতো পালাতে চাও কেনো??”

তুতুলের মনে হলো কথাটা দু’বার এসেছে।একবার ফোনে আর একবার পিছন থেকে।পরে নিজেকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ পালাতে যাবো কেনো?আপনি কি ভুত নাকি।”
“ না সেটা না।তবে তুমি আমাকে ভয় পাও।”
“ ভুলেও না।আমি তো লুকে আছি কারণ এখন আপনার সাথে দেখা হলেই নিচে চলে যেতে বলবেন।”
“ তাহলে তুমি শিকার করছ তুমি পুলের পাশে আছ??”
“ হ্যাঁ আছি তো !! তার উপরে চেয়ারের পিছনে লুকে তাও আপনার জন্য…”

তুতুল এক হাতে মুখ চেপে ধরে।বলতে বলতে সবই বলে দিলো।রিঝ ফোনটা কেঁটে দেয়।পিছন থেকে বলে,
“ আর লুকিয়ে থাকতে হবে না।উঠে এসো।”

তুতুল দেখে পিছন থেকে কথা আসছে।রিঝ পিছনে।সামনের আয়নায় রিঝকে দেখেই তুতুল চট করে পিছনে তাকাতে নেয়।ঠিক তখনই ঠাস করে মাথার সাথে বাড়ি খায়।দুজনেই ব্যথা পায়।দু’জনেই আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে উঠলো,
“ আহ্!

রিঝ দূরে সরে এসে মাথায় হাত বুলায়।তুতুল নিজেও নিজের মাথায় হাত ঘঁষে।হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়তেই তুতুল ব্যথা ভুলে রিঝের মাথা দু হাতে ধরে নিজের মাথার সাথে একুই জায়গায় বাড়ি দেয়।দ্বিতীয় বাড়িটা রিঝের জোড়ে লাগে।তাই সে কঠিন গলায় বলে,
“ আর ইউ ক্রেজি??”

তুতুল নিজের মাথা ঘঁষতে ঘষঁতে বলল,
“ আপনি পাগল।কে বলছে এখানে এসে বসতে??আমি বলছি??যতসব।”
“ পরের বাড়িটা দেওয়ার মানে কি?? সেটা তো তুমি ইচ্ছে করেই দিয়েছ।” রিঝের কন্ঠে রাগ।
“ না দিলে তো আমার শিং উঠতো।আপনি তো এটাই চান।তাই না??”
“ স্টুপিড একটা।বের হও।”

হাতটা টেনে বের করে আনে রিঝ।তুতুল মাথায় হাত বুলাতে ব্যস্ত।মেয়েটা পুল থেকে উঠে আসে।রিঝের সাথে তুতুলকে দেখে চমকায়।কিছু বলার আগেই রিঝ বলল,
“ আপনার পায়ের জুতোটা তুতুলের।তাড়াহুড়ো করে নামার সময় ভুলে তুতুলেরটা পড়ে নিয়েছেন।এটাই বলার ছিলো।”

মেয়েটা বেকুব বনে গেলো।জুতা খুলে দিলো।তুতুল বুঝতে পেরেছে রিঝ প্রথম থেকেই সব ধরতে পেরেছে।জুতাটা পড়ে নেয় সে।মেয়েটা আস্তে করে বলল,
“ স্যরি।আসলে ভুলে হয়েছে।”
“ ইটস্ ওকে।” রিঝ সানগ্লাসটা দুই আঙ্গুলের উপরে রেখে অদ্ভুত ভঙ্গীতে ঘুড়িয়ে পরে নেয়।মেয়েটা সেটাও চোখ কুঁচকে দেখে।একটু চুপ থেকে তারপর বলল,
“ আপনার ওয়াইফ??”

“ ওয়াইফ” কথায় দু’জনেই চমকায়।তুতুল রিঝের মুখের দিকে তাকায়।রিঝ ঘাঁড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ আপনার কি মনে হয়??”

মেয়েটা হাসলো।বলল,
“ আমার তো সেটাই মনে হচ্ছে।তা না হলে জুতোর মত তুচ্ছো জিনিসও মনে রাখা সম্ভব না।”

মেয়েটার কথায় রিঝ হেঁসে উঠে বলল,
“ সব উত্তর জানতে হয় না।তুতুল চলো।আর নাইস দু মিট ইউ।বাই।”

তুতুলের হাতটা রিঝের হাতের বাঁধনে।পুলের পাশে পা ভিঁজিয়ে বসে দু’জনেই।তুতুল তাকিয়ে আছে রিঝের মুখের দিকে।হাতের আঙ্গুলের ভাজে লেপ্টে আছে দু’জনের দশটি আঙ্গুল।রিঝের চোখ শূন্যে,পাহাড়ের ভাজে,আনাচে কানাচে,মেঘের খোঁপে।পুলের অপর পাশ থেকে পুরো শহর দেখা যায়।বান্দরবান শহর! পাহাড়ের ভাজে চিকন সাঙ্গু নদী দেখা যাচ্ছে।নিস্তব্ধতা ঠেলে তুতুল ভেজা কন্ঠে বলল,
“ ধন্যবাদ।”

রিঝ চোখ বাকিয়ে তাকালো।সানগ্লাস নাকের ডগায় নামিয়ে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,
“ সিরিয়েসলি??”
“ মজা না।সত্যি।” তুতুলের স্বাভাবিক কন্ঠ।

রিঝ হাসলো।তারপর বলল,
“ কেনো??”
“ এই যে এতো সুন্দর পাহাড়ের,মেঘের ভিরে নিয়ে আসার জন্য।এতো সুন্দর জায়গা আমি আমার জীবনেও দেখিনি।ওয়াও কি চমৎকার সব।”

তুতুল চারদিকে তাকায়।রিঝ কিছু বলে না।পিছনে দু হাত রেখে তুতুলের দিকে তাকায়।তুতুলের চুল গুলো পতাকার মতো উড়ছে।সবুজের বুকে আকাশের নিচে কালো পতাকা।তুতুল আগের মত থেকেই প্রশ্ন করে,
“ সাইরু!নামটা সুন্দর না??”

রিঝ সচ্ছো পানির দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।নীল পানির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ হুম সুন্দর।এই নামের পিছনে একটা দারুন কাহিনী আছে।”
“ কিসের কাহিনী??” তুতুল রিঝের দিকে মুখ করে তাকায়।পানিতে চপ চপ শব্দ হয়।রিঝ কন্ঠ নিচু করে বলল,
“ প্রেম কাহিনী!!”

তুতুল ভারী আশ্চর্য হলো।কৌতুহল নিয়ে বলল,
“ আপনি যানেন??জানলে বলেন প্লিজ।”
“ জানি।আমি শুনেছি এক চাকমা বৃদ্ধার কাছে।সে না কি শুনেছে তার স্বামীর কাছে।অনেক আগে শুনেছি।ভুলে গেছি অনেক কাহিনী।আবছা আবছা মনে আছে।”
“ আমি শুনতে চাই।” তুতুলের কন্ঠে প্রবল আগ্রহ।রিঝ কিঞ্চিত হাসলো।সূচনা করার ভঙ্গীতে বসে বলতে শুরু করলো।তুতুল মনোযোগী খুব।রিঝ বলল,
“ প্রেমের ইতিহাসে গড়া , “ সাইরু হিল রিসোর্ট ” এর নামকরণের কাহিনীটা সত্যিই অবাক করা।দীর্ঘদিন আগে, বান্দরবান জেলার দূরবর্তী অঞ্চলে এক পাহাড়ী বংশের রাজার কন্যা ছিল যার নাম ছিল সাইরু। সে এক যুবক যে কিনা অন্য গোত্রের এক রাজপুত্রের সঙ্গে প্রেমে মগ্ন ছিল। প্রেম তো কোন সীমানা বা সীমাবদ্ধতা জানে না। অবশেষে প্রবীনরা এব্যাপারটা জেনে যায় এবং এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে যায় যে তারা এটাকে শেষ করার জন্য চরম পদক্ষেপ নিয়ে নেয়। তখন যুবকটি দ্রুত তার গোত্রের অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে। এদিকে সাইরু এই ঘটনায় এতটাই কষ্ট পায় যে নিঃসঙ্গ সাইরু দুঃখে নির্জন জঙ্গলের পথে একদিন একা একা বেড়িয়ে পড়ে। বলা হয় যে সাইরু সেখান থেকে আর কোনদিন ফিরেনি। সাইরু হিল রিসোর্ট এর কাছেই মুকুট পাহাড় নামে পরিচিত একটি জায়গায় দুটি গাছ রয়েছে যা সাইরু আর ঐ যুবকের ভালবাসার স্মৃতি বহন করে চলেছে আজও। এখন সেই জায়গাটি অবশ্য সাইরু পয়েন্ট হিসাবে পরিচিত। রহস্যময় এবং অদ্ভুত প্রেমের এই গল্পের চরিত্রের নামেই সাইরু হিল রিসোর্ট এর নামকরণ করা হয়।এটাকে ভালোবাসার রিসোর্টও বলা চলে।”
“ তারপর!তারপর কি হলো??সাইরু কই গেলো??” তুতুল মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।কন্ঠে একটা চাপা কষ্টের ছাপ খুঁজে পাচ্ছে রিঝ।মেয়েরা ইমোশনাল খুব।কিছুর থেকে কিছু হলেই তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না।সব কিছুতেই নিজেকে ডুবিয়ে নেয় এরা।রিঝ যখন প্রথম শুনেছিলো তখন হালকা খারাপ লেগেছিলো মেয়েটার জন্য।তবে এতো সিরিয়েসলি নেয় নি সে।রিঝ স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“ তারপর আর কি,সাইরু হারিয়ে যায়।তার অসমাপ্ত ভালোবাসা নিজের মাঝে নিয়েই।”
“ এটা একদম উঁচিত হয়নি তার সাথে।একদম না।এটা কোনো ভালোবাসা হলো??পূর্নতা না থাকলে ভালোবাসাই হয় না।” তুতুলের কন্ঠে রাগ।চোখে পানি।রিঝ বিরক্ত হলো।তুতুল চোখ মুছে নিতেই বার বার চোখে পানি চলে এসছে।অযথা কাঁদার কোনো অর্থ হয় না।রিঝ একমুঠো পানি তুতুলের মুখে ছিটিয়ে দেয়।তুতুল তরিৎ করে মুখ মুছে।রিঝ বলল,
“ ভালোবাসায় পূর্নতা পাওয়ার অর্থই যে ভালোবাসা এমন আজব কথা তোমাকে কে বলল??”
“ আমি নিজেই বলছি।কি খারাপ ওই ছেলে।পাইলে এখনই খুন করবো।হারামি।”
“ তুতুল কুল।শান্ত হও।ভাবটা এমন যেন আমিই সেই।আর যেসব ভালোবাসা পূর্নতা পায় না সে সব ভালোবাসার জায়গা হয় ইতিহাসে।যেমন সাইরুর ভালোবাসা হয়েছে।”
“ কেনো?? পূর্ণতা পেলে কেনো হয় না??”
“ পূর্ণতাকে মানুষ ভুলতে সময় নেয় না।কিন্তু অপূর্নতাই মানুষের মনে সব সময় থাকে।একটা দাগ হয়ে।যেমন সাইরু যদি সেই যুবককে বিয়ে করতে পারতো তাহলে সে আর হারিয়ে যেত না।হারিয়ে না গেলে সাইরু নামের যে কেউ ছিলো সেটা মানুষ মনে রাখতো না।আর মনে না রাখলে সাইরু হিল রিসোর্টও হতো না।তুমি আমিও বসে তার গল্প করতাম না।তাহলে সব মিলিয়ে কি হলো?”

তুতুল মুখটা কালো করে বলল,
“ বিচ্ছেদটা ভালোই হলো।ইতিহাস হয়ে গেলো।”
“ হুম।এটাই বিচ্ছেদের,কষ্টের পাওয়ার।তবে হ্যাঁ দু’জনের মধ্যে ভালোবাসায় কমতি ছিলো।তা না হলে বিচ্ছেদ হতো বলে আমার মনে হয় না।”
“ আপনার কাছে প্রেম ভালোবাসা মানে কি??”
তুতুল গভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে।রিঝ বিচলিত হয়।প্রশ্নটা সত্যিই তার জন্য কঠিন!
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-২১.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
আসমার ঘুম গভীর।দ্রুত চলমান নিঃশ্বাসের শব্দ পাতলা কম্বলের নিচ থেকে ভেসে আসছে।দরজায় শব্দ হয়।আসমা টের পায় না।সে তো ঘুমে বিভোর।রিঝ যাওয়ার সময় দরজা লক করতে ভুলে গেছে সে।তাই যে কেউ সহজেই ঢুকতে পারছে।রামিম রুমে ঢুকে বিস্মিত হলো।আসমা উঁপুত হয়ে ঘুমচ্ছে।রামিম পাশে এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।তারপর কটকট গলায় আসমাকে ডাক দিলো।বলল,
“ আসমার বাচ্চা তুই রুম লক না করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস???”

আসমা আবছা কিছু শুনে।একপাশ থেকে আর একপাশ হয়ে ঘুমায়।রামিম রাগে ধাক্কা মারে।আসমা পড়ে যেতে নেয়।পড়তে পড়তে নিজেকে বাঁচায়।ধড়পড়িয়ে উঠে বসে।শরীর কাঁপছে তার।হৃৎপিন্ড শব্দ করছে জোড়ে।ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে সে বলল,
“ কে কে??কে এখানে??”

রামিম ধপ করে পাশের সোফায় বসে।আশেপাশের জিনিস নাড়াচাড়া করে দেখে।তারপর বলে,
“ বাহ্ তোগো রুম তো সেই।”

আসমা বুকে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে।শরীর কাঁপছিলো তার।হঠাৎ করে ধাক্কা পড়ায় সে তাজ্জব হয়ে গেছে।রামিম উঠে রুমটা নিজের মতো ঘুরে ঘুরে দেখে।আসমা নিজের পিছনের বালিশ নিয়ে ছুঁরে মারে।রামিম চমকায় প্রথমে।তারপর দ্বিতীয় বালিশটা ধরে।হেসে উঠে বলল,
“ ইচ্ছা করে কিছুই করি নাই।তুই মরার মত ঘুমাইতস কা??তাও রুম খোলা রাইক্ষা?”

আসমা রাগে খিটখিট করে উঠলো।বলল,
“ হারামজাদা তুই আমার রুমে ক্যান আইছোস??”

রামিম দু’হাতে তওবা করে বলল,
“ আস্তাগফিরুল্লাহ!কি বাজে ভাষা ব্যবহার করতাছস তুই?এটা কোনো ভাষা হইলো??ছিঃ ছিঃ।”

রামিম মজা নিচ্ছে।আসমার রাগ বারে।রামিম কাছে এগিয়ে আসে।বুঝতে পারে আসমার শরীর এখনো কাঁপছে।ধাক্কা দেওয়া উঁচিত হয় নি।রামিম আসমার বাহুতে হাত রেখে একটু ঝুঁকে বলল,
“ ঠিক আছিস??”

আসমা হাত ঝেড়ে চোখ তুলে তাকায়।লাল চোখ!রামিম ছোট হয়ে যায়।নরম গলায় বলল,
“ স্যরি দোস্ত।আমি এতোটা ভেবে ধাক্কা দি নি।রাগে দিয়েছিলাম।তুই দরজা বন্ধ করেও তো ঘুমাইতে পারতি??এভাবে দরজা খোলা রাখা উঁচিত না।তাই!!”

কথার মাঝে থামিয়ে আসমা বলল,
“ চুপ কর শালারপুত।তোগো আর কোনো কম কাইজ নাই??দুইডা মিলে জীবন শেষ করে দিছস।বাল ভাল্লাগে না।”

আসমা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ে।কম্বল টেনে নিয়ে বলল,
“ ভুলেও আর ডিস্টার্ব করবি না।খুন কইরা দিমু কই দিলাম।”

রামিম ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তারপর আস্তে করে গুটি সুটি মেরে আসমার পাশে এসে শুয়ে পড়ে।কম্বলটা টানতেই আসমা লাফিয়ে উঠে বসে।রাগে ফঁস করে উঠে বলল,
“ মানে কি??এমন করতাছস ক্যান??”

রামিম ভারী অবাক হওয়ার ভান করে বলল ,
“ আমি আবার কি করলাম??”
“ কি করলি তুই জানছ না??পাগল না কি তুই??শুধু তুই না রিঝও।দুইডা মিলে আমার ঘুমের পিছনে পড়ে আছস ক্যান ভাই??যা না গার্লফ্রেন্ডের কোলে শুয়ে আরাম করে প্রকৃতি দেখ যা।”

আসমা আবার শুয়ে পড়ে।রামিমও পাশে শুয়ে পড়ে।আসমার রাগ তুঙ্গ!কম্বল নিয়ে টানাটানি লেগে যায় দু’জনের মধ্যে।রামিম নিজের দিকে টানতে টানতে বলল,
“ একটু দিলে কি তোর জাত চল্লা যাইবো??দে না।”

আসমা নিজের দিকে টানতে টানতে বলল,
“ তুই কি পাগল হই গেছস? নিজের রুম রাইক্ষা আমার রুমে কি তোর??”
“ তোর রুমটা অনেক সুন্দর তাই আইছি।তুই এমন করছ ক্যা??”
“ আমি এখন ঘুমামু।”
“ আর কত ঘুমাবি??এবার যা না ভাই।”
“ না না না আমি আরো ঘুমামু।তুই যা ভাগ।”
“ তো ঘুমা।মানা করছি??”
“ মানে কি??তোর লগে ঘুমামু??পাগল না কি??
“ না আমি এখনএখানে ঘুমামু।”
“ তো আমি কই ঘুমামু??”
“ একসাথে ঘুমাইলে কি হইবো??তুই তোর পাশে আমি আমার পাশে।মাঝখানে চাইলে ভারত বাংলাদেশ বর্ডার দিতে পারছ।”
“ আমি আর তোর সাথে!!পাগল না কি?মরে যামু তবুও তোর লগে ঘুমামু না।সর।”
“ আরে তুই এতো ছোট কলিজার মানুষ ক্যান??মায়শা তো ওর প্রিয় লিপস্টিকও দান করতে দুইবার ভাববে না।আর তুই একটু কম্বল শেয়ার করতে পারবি না??কেমন বন্ধু তুই??”

আসমার রাগ হয়।রাগ চেপে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“ তো যা না তোর গার্লফ্রেন্ডের কাছ।”
“ যামু না।কি করবি??”
“ আমি তোরে লাথ্থি মাইরা বাইর করে দিমু।”
“ সাহস থাকলে দে??”

আসমা উঠে বসে।রামিম কম্বল দেয় একটান।আসমা জোড়ে টেনে ধরেনি।তাই এক টানে দু’জনেই ধপ করে বিছানার আর একপাশে পড়ে যায়।রামিম নিচে পড়ে।মাথায় বেশি ব্যথা পায় না।নিচে কার্পেট ছিলো।আসমা পড়েছে একদম রামিমের বুকে।দু’জনেই এক সাথে চেঁচিয়ে উঠে।দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকায়।আসমা ক্ষেপে আছে।সে উঠতে চায়।রামিম দু’হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে।আসমা চোখমুখ কুঁচকে তাকায়।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এসে পড়ে রামিমের মুখের উপরে।চুলের ভাঁজ থেকে আসমার চঞ্চলতা দেখে রামিম।আসমার প্রতি সে দুর্বল না।আসমাকে সে মোটেও পছন্দ করে না।দু’জনই দু’জনকে পছন্দ করে না।বাম পন্থি কিছু মেয়ে থাকে না আসমা ঠিক তেমন।ছেলেদের মতো জামাকাপড় পড়া তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ঘুড়াঘুড়ি,আড্ডা ,মাস্তি,করতেই সে বেশি পছন্দ করে।বাইক চালানো, ছেলেদের কাধে হাত রাখা,তাদের সাথে মারামারি সবই তার সখের কাজ।রামিমের বরাবরিই এমন মেয়ে পছন্দ না।তার পছন্দ শান্ত।চুপচাপ।মুচকি হাসি।কোমল কথার মেয়েদের।মায়শা তেমনই।তাই মায়শা যখন বলেছে সে তাকে পছন্দ করে তখন রাজি হয়ে যায় রিলেশনে যেতে।আর আসমা!!আসমাকে ভারী অদ্ভুত আর বিরক্তিকর মেয়ে মনে হয় তার কাছে।সব সময় ছেলেদর সাথে গায়ে গা লাগিয়ে ঘুরবে।প্রথম প্রথম তো সে সহ্যই করতে পারতো না।কিন্তু রিঝ বাঁধা দিতো।সব সময় বলতো ও মেয়ে হিসেবে অনেক ভালো।রামিম তো প্রথম দিকে কথাই বলতে চাইতো না।আসমার কোনো বন্ধু ছিলো না।তাই সে সব সময় ভালো বন্ধু চাইতো।রিঝের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই সব সময় লেগে থাকতো।কিন্তু রিঝ দূরত্বে থাকে সব সময়।গায়ে পড়া মেয়ে বা ঘেঁষাঘেঁষি করা একদম তার পছন্দ না।তাই তার থেকে দূরেই থাকতো আসমা।কিন্তু রামিমের খুব কাছে একদম ঘেঁষে থাকতো।যেটা রামিমের সবচাইতে অপছন্দ ছিলো।রিঝ মুখের উপরেই বলে দিতো দূর হ।রামিম ঠিক তেমন ভাবে বলতে পারতো না।তবে অপছন্দ বরাবরই।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভালো লাগা কাজ করেছে।জন্ম নিয়েছে এক অজানা অনুভুতির!কি এই অনুভুতি???কখনো ভাবে নি সে।এই বিরক্তি কর মেয়ের সঙ্গ একসময় অসহ্য লাগতো আর এখন অদ্ভুত আনন্দ অনুভব হয়।রামিম মুচকি হাসি ঠোঁটে আঁকে।আসমা খুব অবাক।রামিম তোলপাড় করা আবেগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে।এক হাত কোমড়ে রেখে আর এক হাতের আঙ্গুলে আসমার সোজা চুল বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে ধরে।আসমা সীমাহিন আশ্চর্য!!রামিম হাত গালের কাছে নেয়।ঠান্ডা হাত!আসমার গরম শরীর মুহূর্তে কম্পিত হয়ে উঠে।রামিম চুলগুলো কানের কাছে গুঁছিয়ে রেখে বলল,
“ তোর চুল সুন্দর!

কিছুক্ষণ থেমে ভালো করে দেখার ভঙ্গীতে বলল,
“ না তুই সত্যিই সুন্দর।”

আসমা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।বাতাসের ঝাপটাতে জানালা খুলে যায়।শব্দ হয় জোড়ে!আসমার হুশ হয়।রামিম এখনো তাকিয়ে আছে।আসমা ইচ্ছে মত বুকে কিলঘুঁষি মারে।রামিম দ্রুত উঠে বসে।আসমাও বসে।রাগে খিটখিট করে বলে উঠে,
“ রামিম্মার বাচ্চা তোরে আমি ছাড়মু না।হারামি একটা।এমন করে ফেলে দিলি ক্যান??”

রামিম উঠতে উঠতে বলল,
“ আমি কি ছাড়তে কইছি না কি??ধরে রাখ যত পারছে।তুই তো এমনেই চিপকু।”
“ দুর হ।”

আসমা সরে আসে।রামিম কম্বল মুড়ি দেয়।আসমা একদম রামিমের উপড়ে ধপ করে শুয়ে পড়ে।রামিম নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠে,
“ বাবা গো কি মুটকি!!আমি শেষ!”

আসমা খিলখিল উগ্র হাসি হাসে।হাসির শব্দ কড়া।সে শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।রামিম কান খাড়া করে এই ঝন ঝন হাসির শব্দ মুগ্ধ হয়ে শুনে।একটা সময় সত্যি তার খুব বাজে লাগতো এই হাসি।কিন্তু কি যেনো হলো??এই মেয়েটার সবই ভালো লাগে তার।সবই।
“ তোরে আইজকা মাইরাই হালামু।”

আসমা ইচ্ছা মতো রামিমের উপরে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।লাথ্থি দিচ্ছে কিল দিচ্ছে।রামিমও কম না ছুটে পালাতে সে মাহির।কিন্তু আজকে পালাবে না।কেনো??সে জানে না।কিছু কথা জানলে ক্ষতি বেশি।থাকনা কিছু অজানা।অজানার মাঝে ভয় কম।আনন্দ বেশি!!
_______________________
পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে মিষ্টি হাওয়া উড়াল চণ্ডির মত ছুঁটে আসছে।গিরী পথ ধরে ছুঁটে আসা সেই বাতাস দোল খাইয়ে দিচ্ছে সুইমিংপুলের পানিকে।তুতুল পানিতে পা নাচায়।সন্ধ্যা নেমেছে শীতের আকাশ বেয়ে।কুয়াশারা ধৌয়া হয়ে উড়ছে।ঝিঝি পোকা ডাকছে।পাখির শব্দ ভেসে আসছে।তুতুল তাকিয়ে আছে দূরের পাহাড়ের দিকে।কালো হয়ে আসা পাহাড়ের বুকে গুঁচ্ছ গুঁচ্ছ সাদা কুয়াশা।তুতুলের পা টা পানির নিচেই রিঝের পা ছুঁয়ে দেয়।পাটা গরম।উত্তপ্ত মনে হচ্ছে।যেনো গরম পানি।তুতুলের পা বরফ।রিঝ পায়ের পাতা দিয়ে তুতুলের পা জড়িয়ে নেয়।তুতুল হাসে।রিঝের গালে দু হাত দিয়ে হেঁসে উঠে বলল,
“ ঠান্ডা লাগে??”

রিঝ পাশ ফিরে তাকায়।তুতুলের মুখ ভর্তি হাসি দেখে সেও হাসলো।বলল,
“ ঠান্ডা হাত গরম গালে লাগালে ঠান্ডা লাগার কথা??না কি গরম??”

তুতুল শুধু হাসলো।রিঝ চোখ সরিয়ে নিলো।সামনে তাকিয়ে বলল,
“ এত ঠান্ডা কেনো তোমার হাত??”
“ আমি কুল মাইন্ডের তাই।”

রিঝ কথাটা হেঁসে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল,
“ মোটেও না।”
“ ভাবটা এমন নিচ্ছেন যেনো আমার দাড়ি কমা সব আপনি জানেন??”
“ অবশ্যই জানি।এবং তোমাকে তোমার থেকেও ভালো চিনি।”

তুতুল উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠলো।চোখের উপরে চলে আসা এক গুঁচ্ছ কোঁকড়া চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলল,
“ এটা সত্যি নয়।”
“ এটাই সত্যি।তুমি কেমন তুমি নিজেও জানো না।তবে আমি সুযোগ দিচ্ছি বলো।দেখি মিলে কিনা??”

তুতুল সোজা হয়ে বসে।ভিঁজা পা উপড়ে উঠাতে উঠাতে বলল,
“ আমি শান্ত চুপচাপ টাইপের মেয়ে।খুবই ভালো।আরো ভালো।আপনার থেকে তো হাজার গুনে বেশি ভালো।হুহ্।”

রিঝ পিছনের দিকে দু হাত রেখে হেলে তাকায়।তুতুলের ভাব উপরে।সে খুবই মুড নিয়ে আছে।রিঝ বলল,
“ তুমি খুব ইমোশনাল মেয়ে।কাউকে বিবেচনা না করেই তাকে নির্ণয় করো।কোনো মানুষের একটা ভালো কিছু দেখলেই বলো সে ভালো।অনেক ভালো।পরক্ষণেই তার খারাপ গুণ দেখে বলে ফেলো সে খারাপ।কাউকে নিয়ে তুমি ভাবো না।ভাবার সময় যেনো নেই।খুব দ্রুত না বুঝে সিদ্ধান্ত নেও।আর কেউ ইমোশনালি কিছু বললে অনেক ঝুঁকে পড়ো।সামান্য কথায় কাঁদো।ভয়ে কাঁপো।এগুলো সব তোমার দূর্বলতা।আর যার দূর্বলতা জানি তার মানে তাকে কতটুকু চিনি বুঝতে পারছো??”

রিঝ থাকে।তুতুল মানতে নারাজ সে এমন।রিঝ আবার বলল,
“ আর হ্যাঁ তুমি খুব নরম তুলতুলে মেয়ে।তুলোর মতো হৃৎপিন্ড।”

রিঝ উঠে দাঁড়ায়।তুতুল হাতটা টেনে ধরে বলল,
“ আমি কিন্তু আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম??সেটার উত্তর কই??”

রিঝের ভ্রু জোড়া ধনুকের মতো বেঁকে যায়।এক চোখ ছোট করে সে বলল,
“ কোন প্রশ্ন??”
“ আগে বসেন।” তুতুল রিঝের হাত টেনে বসায়।তারপর বলে,
“ ওই যে আপনার কাছে প্রেম ভালোবাসার মানে কি??”
“ তুমি কথাটা ভুলোনি??” রিঝ কপাল কুঁচকে নেয়।তুতুল ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ মোটেও না।”
“ সব কথার উত্তর জানার কি প্রয়োজন।”
“ আছে বলেন প্লিজ প্লিজ??”
“ তুমি খুব বিরক্তিকর তুতুল।”
“ আই নো।” তুতুলের কন্ঠে অহংকার বোধ।
“ আমি জানি না।”
“ আপনি কখনো প্রেমে পড়েন নি??” তুতুলের রিঝের চোখে চোখ রাখে।রিঝ মুখ ঘুরিয়ে নেয়।সামনে তাকিয়ে বলল,
“ হাজার বার প্রেমে পড়েছি।হাজার বার।”

তুতুল বিস্মিত।হতবাক কন্ঠে সে বলল,
“ সিরিয়েসলি!!আপনার ক্যারেক্টার এতো খারাপ।ছিঃ।তা কার কার প্রেমে পড়েছেন??স্যরি মানে আপনি তো বছরে ১২ মাসে যত দিন আছে সব দিনই প্রেম করেন।মোট কয়টা??”
“ ভুল বললা।আমি প্রতিদিনই হাজার বার প্রেম পড়ি।”

“ প্রতিদিন!!তুতুলের মুখটা হা হয়ে যায়।চোখ গোল গোল হয়ে যায়।চারপাশের লাইট জ্বলে উঠে।রিঝকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।সে হাসছে।প্রেমের কথা বলার সময় সব ছেলেই হাসে।আশ্চর্য!!তুতুলের খুব রাগ হয়।সব ছেলেই এমন।প্রেম ছাড়া দুনিয়া চোখেই পড়ে না।যতসব।যেনো প্রেমই সব।একটা দিয়ে হয় না হাজারটা লাগে।রিঝ ভাইকে সে এমন ভাবে নি কিন্তু এতো দেখছে সবার থেকে খারাপ!রিঝ তুতুলের ঠান্ডায় লাল হয়ে উঠা নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বলল,
“ আমি অনেক কিছুর প্রেমে পড়ি।যেমন আমি এই পৃথিবী যিনি তৈরি করেছে সেই স্রষ্টার প্রেমে পড়ি।প্রতিদিন সকালে আমি যখন নতুন সূর্য দেখি তখন আমি রোজ তার প্রেমে পড়ে যাই।ইশ্ কত সুন্দর না জানি উনি।যার সৃষ্টি এতো সুন্দর সে কত সুন্দর!!আমি তার সৃষ্টির প্রেমে পড়ি রোজ।আমি পাহাড়ের প্রেমে পড়ি।সবুজ রঙ্গের প্রেমে পড়ি।নবীর প্রেমেও পড়ি।যখন শুনি তিনি আমাদের না দেখে না জেনে এতো ভালোবাসতো।কিভাবে??তখন আমি ও না দেখে নতুন করে তার প্রেমে পড়ি।আমি সূর্যের প্রেমে পড়ি।চন্দ্রের সাদা আভার প্রেমে পড়ি।লতার ভাজে ভাজে প্রেম খুঁজি।আমি আমার মায়ের প্রেমে পড়ি।যখন রোজ আমার বোনকে তার ছেলে জ্বালায়।তখন ভাবি আমিও তো মায়ের সাথে এমনটাই করেছি।যেখানে আমার একটুতেই রাগ উঠে।তুলে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করে সেখানে কিভাবে এতো শান্ত থাকে মায়েরা!আমি প্রতিটা মানুষের প্রেমে পড়ি।কারণ সবার মাঝেই প্রেমে পড়ার মতো কিছু না কিছু স্পেশাল থাকেই।আর প্রকৃতি তো নিজেই প্রেম।আমি পাহাড়ের বুকে ঘুমিয়ে তার সাথে প্রেম করি।এটাই প্রেম।তাই আমি অসংখ্য বার প্রেমে পড়ি।আমার প্রেম ভিন্ন।”

রিঝ আকাশে দিকে তাকায়।কুয়াশা নয় মেঘ দৌড়ে বেড়াচ্ছে।বর্ষা কালে মেঘ কোলে এসে বসে থাকে।হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়।তুতুল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে পাশের মানুষটার দিকে।কেউ এতো সুন্দর করে কিভাবে প্রেমে পড়তে পারে??কিভাবে??কিঝের কথায় যেনো গভীর কিছু থাকে।সামান্য কথাই সুন্দর।এতো সুন্দর করে কেউ কিভাবে কথা বলতে পারে??তুতুল রিঝের কালো সানগ্লাসের মাঝের সেই চোখ দেখতে চায়।কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।কিছুক্ষণ চুপ থেকে তুতুল বলল,
“ আর ভালোবাসা??আপনি কাউকে ভালোবাসেন না??মানে যেমন আপনার গার্লফ্রেন্ডকে??”

রিঝ হেঁসে উঠে।হু হা করে শব্দ করে।সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুঁটে বেড়ায় পাহাড় থেকে পাহাড়ে।কি চমৎকার হাসির শব্দ!!সাধারনের উর্ধ্বে।তুতুল মুখটা চেপে ধরে রিঝের।মুখে বিরক্তি ভাব নিয়ে বলে,
“ এভাবে হাসবেন না।”

মুখ থেকে হাত সরাতেই রিঝ বলল,
“ প্রেম প্রেম লাগে!!”
“ ছিঃ আমি আপনার বোনের মতো।আর ভাইয়ার প্রেমে পড়তে যাবো কোন দুঃখে।বলেন আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডকে ভালোবাসেন না??”
“ না।কারণ আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।এসব সময় নষ্ট করা কাজে আমার কোনো আগ্রহ নেই।যত সব ফালতু কাজ।”

রিঝ উঠে যেতে নেয়।তুতুল ধরে বেঁধে আবার বাসায়।
“ সমস্যাটা কি তোমার??আজকে সারা রাত এখানেই কাঁটাবে??আর কিসব প্রেম ভালোবাসা নিয়ে পড়ে আছো??ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতো থাকো।চলো।”
“ না আগে বলেন ছবির মেয়েটা কে??”

রিঝ প্রচন্ড বিরক্ত।রাগ রি রি করে উঠছে মাথায়।মেরুদন্ড ঠান্ডা হচ্ছে।তুতুল ঘ্যান ঘ্যান করেই চলেছে।বিরক্ত হয়ে সে বলল,
“ ও আমার ভালোবাসা।যাকে আমি ভালোবাসি।মারাত্নক ভালোবাসি।যার জন্য আমি পাগল।সব করতে পারি।সব।মারাত্নক বুঝো??এই মারাত্নক ভালোবাসা তার জন্য।শুধু তার জন্য!কিন্তু তাকে বলা হয়ে উঠেনি।”

তুতুল উত্তেজিত হয়ে বলল,
“ কেনো??কেনো??”
“ ভালোবাসা মনে আমার কাছে একান্ত নিজের।তাই বলিনি।যখন দু’জনের হবে তখন বলবো।তোমাকে এটা নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।চলো পাগল।”
“ আমি পাগল না??” তুতুলের কন্ঠে রাগ।
“ ও স্যরি পাগলি।”

রিঝ হাঁসতে হাঁসতে উঠে দাড়ায়।তুতুল একমুঠো পানি নিয়ে মারা শুরু করে।খিলখিল হাসির শব্দে চারপাশ মুখরিত হয়।দু’জনের হাসি পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেপ্টে যায়।পানি সেই সাথে তাল মিলিয়ে সুর তুলে।যোগ হয় বাতাস শব্দ ভান্ডার!উড়ন্ত ঢেউ খেলানো কুয়াশা!শীত খুঁশিতে নেচে উঠে।সত্যি কারের প্রেম তো প্রকৃতি শিখায়।সবাই এক সাথে থাকে কত প্রেম নিয়ে।এসব প্রেমই ছড়িয়ে দেয় মানুষের মাঝে।কত সহস্র প্রেম লুকানো এদের মাঝে!কতই না বেশি!”
_______________________
সকালের নাস্তার টেবিলে তুতুল ভারি অবাক।বাঁশের তৈরি প্লেট,বাসের তৈরি গ্লাস,এমন কি বাঁশের তৈরি চামুচ।রিঝ ভেজিটেবল সুপ খাবে।তুতুল মুখটা বাঁকিয়ে নেয়।সে বুঝে না এসব পানি টানি মানুষ কিভাবে খায়।তার উপরে আবার সবজি!ঘাঁসপুঁস।ছেঃ ছে।খেতে হবে রাজার মতো।একদম রাজা রাজা ভাব নিয়ে।বাঁশের জিনিসে খেতে একটা অদ্ভুত ফিলিংস হয় সবার।বাঁশ বান্দরবানের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে।বাঁশের ভিতরে মাংস পুরেও এরা রান্না করে।প্রকৃত পাহাড়িরা সাধারন বাঙ্গালির মতো জিনিস ব্যবহার করে না।এরা সব নিজেদের মতো ব্যবহার করে।যেমন বাঁশের তৈরি জিনিস।সকালের নাস্তা শেষে সবাই নীলগিরির দিকে যাত্রা শুরু করে।এবারও সেই চাঁদের গাড়ি।চাঁদের গাড়ির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন সুবিধা হচ্ছে চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।অনেক বাতাস উপভোগ করা যায়।গাড়ির দ্রুত ছাড়ে।গতি বরাবরের মতোই দ্রুত।রিঝ এবার তুতুলকে নিজের পাশে নিয়ে বসেছে।তুতুলের পরনে সাদা প্যান্ট,স্লিভলেস ডেনিম শার্ট,লেদারের কালো জ্যাকেট।পায়ে হাই নেক কার্ডস।সকালটা আসলেই ঠান্ডা আজ।চারপাশ কুয়াশার সাদা চাদরে ডুবে আছে।দেখে মনে হবে এটা সাদার দুনিয়া।শুধু সাদা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে সবুজ পাহাড়ের উপরে।তুতুল আজকে নামবে।পাহাড়ের একদম কাছে যাবে।তাই গাড়ি থামাতে বলল।রিঝ জানে এ মেয়ে পাগল।তুতুল পাহাড়ের উপর থেকে সাদা পাতা ছিড়ে ছিড়ে নেয়।তিনটা পাতা এক সাথে করে মাথায় ক্লিপ দিয়ে আটকে দেয়।রিঝকে দেখিয়ে বলল,
“ কেমন লাগছে??”

রিঝ রসিকতা করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ একদম জঙ্গলের মতো।”
“ ফালতু লোক একটা।”

তুতুল বিরক্তি নিয়ে সামনে থেকে সরে যায়।রিঝ মুচকি হাসে।তারপর খাদের দিকে আসে।সবাই আসে।নিচে ধৌয়া।কুয়াশার ধৌয়া।ছোট ছোট পাহাড়।যেনো তারা কত বড়।একটার উপরে আর একটা পাহাড়।হাজার পাহাড়ের মেলা।চিকন নদীর উপরেও ধৌয়া।কত সুন্দর নদীটা!একদম শান্ত নদী!তুতুল মুগ্ধ!এই চমৎকার সৃষ্টির বর্ণনা করার মতো ভাষা তার নেই।শুধু চোখের আছে সহ্য শক্তি।চোখ শুধু দেখবে।পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট বসতি।যাকে বলে মাচাংঘর।এক্স আকৃতির ছোট ছোট খুটির উপরে দাড়িয়ে আছে অসাধারন ভাবে।দূরের গুলো দেখে যায় না।একটু কাছের একটা পাহাড়ের উপরে ঘর দেখে বুঝতে পারছে আকৃতি।রেয়ানা ভীতু ভীতু হয়ে একটু এগিয়ে দেখে।নিচের গর্তটাই তার চোখে ধরা পরে আগে।দ্রুত সরে আসে।আসমা লাফিয়ে শুধু বলছে,
“ ওয়াও এতো সুন্দর কেনো সব!কেনো কেনো??

তুতুল অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে।আকাশ রিঝের কানের কাছে এসে বলল,
“ বালডা এসব পরে দেখিছ আমি পেঁপে খামু চল চিম্বুক যাই।তাড়াতাড়ি।”

“ এতো খাই খাই করছ কা??” রামিমের কন্ঠে রসিকতা।

আকাশ কটকট করে তাকিয়ে বলল,
“ তোরা যেনো খাছ না।দেখা যাইবো।লুফে যদি না খাছ আমার নাম পাল্টাই দিমু।”
“ লাগবো না তোর নাম পাল্টানো।আমরা জানি বান্দরবানের জাতীয় ফল লুফে খাওয়ার মতই।”

পাহাড়ে পাহাড়ে হাজার গাছ।নিচে নেমে যাওয়া পাহাড়ের গায়েও গাছ।কলা গাছ।দূরে দেখা যাচ্ছে পেঁপে গাছ,কলা গাছ,ধান গাছ সব এক সাথে এক বাগানে।তুতুল আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ এটা কেমন বাগান??”

রিঝ বলল,
“ জুম চাষ /ঝুম চাষ এমনই হয়।পাহাড়িরা আমাদের মানে বাঙ্গালিদের মতো আলাদা আলাদা করে চাষ করে না।ওরা সব এক সাথে চাষ করে।আর পাহাড়েই করে।সমতলে জুম চাষ করে না ওরা।পাহাড়ের গায়ে ঢালু জমিতে করে।অনেক রকমের জিনিস ওরা এক সাথে করে।
“ কেনো??”
“ কারণ এক একসময় এক এক ফল ,এক এক সবজি পাওয়া যায়।আর আলাদা করে করা লাগে না।আর ওরা পাহাড়েই থাকে।তাই সুবিধা।ওই যে এদের ঘর।”

রিঝ দুরে একটা পাহাড়ের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।তুতুল হতভম্ভ গলায় বলল,
“ এসব জঙ্গলে ওরা থাকে কিভাবে??সাপ টাপকে ভয় করে না ওদের??”

রিঝ কিঞ্চিত হাসলো।বলল,
“ না ওরা কিছুকেই ভয় পায় না।ওদের মহিলারা বেশি সাহসি।ওই যে দেখো আসছে।উনি এখন চাষ করতে যাবে।পাহাড় থেকে সবজি ফল নিয়ে বাজারে বিক্রি করবে।”

তুতুল দেখে একজন ঈষৎ হলদে বর্নের রমনি।নাক চ্যাপ্টা,গায়ে লুঙ্গীর মতো কিছু একটা পড়েছে উপরে ফতুয়া।মাথায় ঝুড়ি।বুকে একটা ছোট কিউট বাচ্চা কাপড় দিয়ে বাঁধা।তুতুল আঁতকে উঠে মহিলার কাছে যায়।বলে,
“ আপনি আপনার বাবু নিয়ে পাহাড়ে উঠবেন??আর ইউ সিরিয়েস??”

দ্রুত বলায় মহিলা তুতুলের কথার কিছুই বুঝলো না।রিঝ এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বলল,
“ ও বলছে আপনি বাচ্চাকে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে পারবেন??”

মহিলাটা হেঁসে উঠে।তুতুল অবাক চোখে তাকিয়ে সে হাসি দেখে।কত সুন্দর হাসি!প্রকৃত হাসি এমনই।এরা ছবি তোলার জন্য হাসে না।নিজেরাই ছবির মতো জীবন্ত।হাসিও জীবন্ত এদের।বাচ্চাটাও মায়ের মত হাসে।তুতুলের তো কোলে নিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু ভয়ে বলল না।মহিলার পিঠের ঝুড়িতে ছুরি,ধামা,অনেক কিছু আছে।মহিলাটা হাতের লাঠি নিয়ে বেয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“ পালবো পালবো।আমলা চব পালি।”

সবাই তাকিয়ে থাকে।মহিলা সত্যিই পাহাড়ে উঠে যায়।উপর থেকে হাত নাচিয়ে দেখায় তারা পারে।তুতুল সত্যি চমকিত।রিঝ মুখের উপরে হাত নাচিয়ে বলল,
“ কথা গুলো সুন্দর না??”
“ এভাবে কথা বলে কেনো??”
“ এরা বাংলা ভালো বলতে পারে না।পাহাড়ে যারা থাকে তারা তো আরো কম বলতে পারে।শহরের সবাই পারে মোটামুটি।কিন্তু বেশির ভাগই উচ্চারন ঠিক করে করতে পারে না।এটা ওদের সেকেন্ড লেঙ্গুইজ।উনি চাকমা।”
“ কিভাবে বুঝলেন।”
“ ওরা বেশির ভাগ হলদে বর্ণের হয়।মারমারা মানুষের চোখে বেশি সুন্দর বা ফর্সা হয়।”
“ ওয়াও ওরা কত পাওয়ার ফুল মহিলা।আর দেখেন কিভাবে নিজেদের বাচ্চাকে সব জায়গায় নিয়ে যায়।কি পাওয়ার ফুল মা।”
“ সব মা পাওয়ার ফুল হয় তুতুল।তবে হ্যা এরা খুব পরিশ্রমী।তাই অনেক বয়স হওয়ার পরেও এদের চামড়া কুঁচকে যায় না।বৃদ্ধা লাগে না।তবে ছেলেরা এই দিকে একটু অলস।মদ খেয়ে পড়ে থাকে বেশির ভাগ সময়।তবে হ্যা সবাই না কিন্তু কেউ কেউ।”

রামিম আকাশকে উপরের দিকে দেখিয়ে বলল,
“ শুন দোস্ত এমন একটা মাইয়া পটা তারপর বিয়া।জীবন খুলে যাইবো।”
“ কেমনে??” আকাশের কন্ঠে কৌতুহলি ভাব।
“ আরে ভাই বাঙ্গালী গুলা সাজার জন্য যে টাকা নষ্ট করে সেটা দিয়ে পৃথিবীর কোণায় কোণায় ঘুরা যাবে।”
“ তো! এরে বিয়ে করলে লাভ কি??মানে বাঙ্গালী গুলাও মাইয়া এরাও তো মাইয়াই।”
“ মোটেও এক না।বাঙ্গালী গুলা আটাময়দা আর ফালতু জিনিস কিনতে অনেক টাকা খরচ করে।আর লোভ জিনিসটিও অনেকের মধ্যে কাজ করে।কিন্তু এরা একদম পিত্তর।তোর টাকা নিয়া বেশি উড়বে না।নিজের মতো চলবে।আর মেকাপ তো করেই না।দেখ কত ন্যাপারাল।ওয়াও।একদম প্রকৃতির সাথে মিল রেখে প্রকৃতিকন্যা।বাচ্চাদেরও কত আগলে রাখে।দেখ কিভাবে বুকে বেঁধে নিয়েছে।বাঙ্গালি হলে কি কইতো জানছ??ট্রলি কই,তুমি কই,জামাই বাবু সাথে আমার ব্যাগটাও নেও।জানু না!বাবু না! আরো কত নাটক করে তোরে খাটাইবো।কিন্তু কতক্ষণ পরেই ভুল্লা যাইবো।তোর কত টাকা বাঁচবো দেখ।আমি কিন্তু ভালোর জন্যেই কইতাছি।তোর খারাপ কি আমরা চাইতে পারি ক??”

রামিম ঠোঁট টিপে হাসে।রিঝ শব্দ করেই হাসে।আকাশ ভাবুক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে তারপর বলে,
“ সত্যি তো! উনারে ডাক আমি বিয়া করমু।”

সবাই হেসে উঠে।তুতুল খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ সত্যি!!চলেন চলেন আমরা যাই উনার কাছে।আজকেই বিয়ে হবে।”

রিঝ হাত টেনে নিজের কাছে আনে।শান্ত কন্ঠে বলল,
“ তুমি আসলেই পাগল।”

“ কেনো??” ঠোঁট উল্টে বলল তুতুল।
“ ওই মহিলার হাজবেন্ড আছে বাচ্চা আছে আর আকাশ তুই ও কি পাগল না কি?রামিম মজা করছে।তুই সিরিয়াস হয়ে গেলি।চল সব গর্ধব।”

আকাশ মাথা চুলকায়।তারপর আবুল মার্কা হাসি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।

বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান।চম্বুক পাহাড় চুড়াতেই রয়েছে চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র।সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ২৫০০ ফুট উঁচু চিম্বুক পাহাড়।এটি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম পাহাড়।আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই পাশে প্রকৃতির রূপ ছড়িয়ে আছে।চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সর্পিল সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌছায় সেই চম্বুকের দর্শন করতে।গাড়ি থেকে নেমেই আকাশ পেঁপের দোকানে ভির করে।সাথে আছে পাহাড়ি কলা।জাম্বুরা,পেয়ারা,ডাব,বিজ্ঞাত তেঁতুল।পেঁপের ভিতরের রং দেখে আকাশ আরো পাগল হয়ে উঠে।তুতুল বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ এতো লাল!!রং ঢেলে দিয়েছে মনে হয়।”

রিঝ একটা টুকরো এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ না।এগুলো সব গাছের এবং অরজিনাল।”
“ আরে যান।এতো সহজ না কি?বোকা পাইছেন??এগুলো কালার করা।”
“ খেয়ে দেখো তারপর বকবক করো।”

তুতুল প্রথমে খেতে চায় নি।পরে খায়।এটা যেনো দোকানের মিষ্টির চাইতেও মিষ্টি।অদ্ভুত মিষ্টি।যেনো স্বর্গীয় কোনো ফল।তুতুল কথা না বলে পরপর অনেক গুলো পেঁপে গিলে নেয়।সে এমন একজন মেয়ে যে কখনো ফল খেতে পছন্দ করে না সে এতো এতো পেঁপে খেয়ে নিজেই অবাক।রিঝ হাসতে হাসতে বেঞ্চিতে বসে পরে।পেঁপে খেয়ে সবাই কিছুক্ষণ বসে থাকে।এতো এতো খেয়েছে যেনো জীবনেও পেঁপে নামক কোনো ফলের নাম শুনেনি।চুম্বক পাহাড়ে উঠে সবাই মিলে।তুতুল একটু উঠেই হাঁপিয়ে যায়।রিঝ টেনে টেনে তাকে উপরে তুলে।মেয়েদের অবস্থা বেশি খারাপ।রেয়ানার আরো বেশি কারন সে হিল পড়েছে।আকাশ তো রেয়ানার এলোমেলো হাঁটা দেখে হাসতে হাসতেই ফিট।কয় বার যে রাস্তায় বসেছে খবর নাই।তুতুল পিঁচ ঢালা রাস্তার মাঝে বসে পরে।এতো কষ্ট পাহাড়ে উঠতে???আর ওই মহিলা যে এতো সহজে উঠে গেছে??তাও এতো উঁচু পাহাড়ে??কিভাবে??তুতুলের সব অদ্ভুত লাগে।মনে মনে ভাবে অদ্ভুত সব জিনিস কি এই শহরেই আছে??কিভাবে??রাস্তার রং সুন্দর।কুয়াশায় ভিজে কালো হয়ে আছে।শুকনো পাতায় শিশির জমা হয়েছে।রামিম ছবি তুলছে সব কিছুর।সে ভালো ছবি তুলতে পারে।ফটোগ্রাফার বলা চলে।সখের বসে করা।সবাই জায়গায় জায়গায় বসে পরে।এখানে অনেক জায়গা আছে বসার মতো।পর্যটন কেন্দ্র এটাকেই বলে।তুতুল উঠে দাড়ায় চারপাশ দেখে।প্রকৃতি দেখতে আর দূরে যেত হবে না এখানেই সব রূপ ঢালা আছে।যেনো নতুন এক পৃথিবী।এর রূপে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে।তুতুল উঠে কিনারে দাড়ায়।রিঝ এদিকেই দাড়িয়ে ছিলো।সে কিছু একটা দেখছে।তুতুল সব দেখছে আর বলছে,
“ এই রূপে পাগল হয়ে যাওয়াও কম হবে।এতো রূপ কেনো এই শহরের??”
“ তুমি কি পাহাড়ের প্রেমে পড়ছো??”
“ হয় তো।”
“ হয় তো বলতে কোনো বাক্য নেই।”
“ তাহলে হ্যাঁ।আমি পাহাড়ের প্রেমে পড়ে গেছি।ঠিক আপনার মতো।”
রিঝ হাসলো।পাশে তাকাতেই তুতুল পাহাড়ের দিকে মুখ করে দেখতে শুরু করলো। সবাই ঘুড়াঘুড়ি শেষ করে গাড়িতে উঠলো।তুতুল আর রিঝ বিলুপ্ত।রেয়ানা মায়শার কানের কাছে এসে বলল,
“ তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো ভাবছিলাম কিন্তু বলা হয়ে উঠে নি এখন বলি??”

মায়শা সারাদিন নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে।এটা ছাড়া তার দুনিয়া ভালো লাগে না।রেয়ানার কথা শুনে সে মাথা তুলে তাকিয়ে বলল,
“ হুম বলো আমি শুনছি।”
“ আসলে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।তুমি কিছু মনে করবা না তো??”
“ আরে মনে করতে যাবো কেনো??বলো।”

রেয়ানা কাচুমাচু করে বলল,
“ আই লাইক রিঝ।”

মায়শা হাসলো মনে মনে।মুখে বলল,
“ হুম সেটা তো জানিই।কারন সবাই ওকে পছন্দ করে ।এটা স্বাভাবিক।”

রেয়ানা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ আরে এই পছন্দ সেই পছন্দ না।”
“ তাহলে??”
“ আমি ওকে অনেক পছন্দ করি।”
“ ভালো তো ভালো না চায়ের দামে সরবত।যদিও তুমি পাবে না।”

আসমার কথায় দুজনেই চমকে উঠে।আসমা শয়তানি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
“ রিঝের কাছে যাও আর বলো।আমাদের বলে তো লাভ নেই তাই না।”
“ তুমি লুকিয়ে অন্যের কথা শুনো??এতো সাহস।”রেয়ানার কন্ঠে রাগে।
আসমা হেঁসে উঠে বলল,
“ লুকিয়ে কই শুনলাম??তোমার পাশেই তো দাড়িয়ে ছিলাম তুমি দেখনি এতে আমার দোষ কি।তোমার দোষ।শুধু শুধু আমার দোষ দেও কেনো?”
“ তুমি কি ঝগড়া করতে চাও??”

আসমা মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
“ চুড়েইল তোর লগে ঝগড়া না চুল ছিড়াছিড়ি করমু।চিপকালি একটা।”
“ কিছু বললে??” রেয়ানা ভ্রু তুলে তাকায়।
“ না না।বললাম তুমি রিঝের কাছে যাও আর এগুলো বলো।”
“ কাছে যাওয়ার সুযোগ কই পাই ওই তুতুল তো চিপকাই থাকে।”
“ ও হ্যালো রিঝের সামনে যাও আর এগুলো বলো কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করো না প্লিজ।”

মায়শার ডিস্টার্ব হচ্ছে।আসমা চুপ করে যায়।রিঝ আর তুতুল আসে।তুতুলের হাতে বন্য ফুল।গাড়িতে এবার সে বসবে না।দাড়িয়ে দাড়িয়ে যাবে।একুই খাঁজে তুতুলের পিছনে দাড়ায় রিঝ।তুতুল রাগে আগুন হয়ে পিছনে তাকায়।বলে,
“ এগুলো কি??এভাবে দাড়ালেন কেনো??দূর হন।”

রিঝ এক বিন্দুও সরলো না।গাড়ি স্টার্ট দিতেই তুতুল পিছনে হেলে পড়ে।একদম রিঝের বুকে।রিঝ শক্ত হয়ে দাড়িয়ে বলে,
“ এখনই তো পড়তে।আর তুমি পড়লে তোমার বাপ ভাই!!”

তুতুল কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ থাক আর বলতে হবে না।আমার বাবা আর ভাইয়া আমাকে অনেক ভালোবাসে।আমি জানি।”

সবাই এক এক করে দাড়ায়।মায়শা দাড়ায় না।রামিম দাড়ায় আসমার পিছনে।পিছন থেকে কিছুক্ষণ পর পর সে চুল টেনে ধরে।আসমা তখন বিরক্ত চোখে তাকায়।কিছু বলে না।রামিমের সাথে সে মাতে না।যাকে বলে কথা নাই।তুতুল প্রজাপতির মতো হাত মেলে ধরে।দাড়িয়ে যাওয়ার সময় সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে পিঠে অনেক ব্যথা লাগে।প্রথমে টের পাওয়া যায় না।কিন্তু পরে পরে প্রচন্ড ব্যথা হয়।রিঝ জানে তাই সে তুতুলের পিছনে দাড়িয়েছে।ছেলেরা শক্ত হয়।মেয়েদের চেয়ে।গাড়ি উপরের দিকে উঠছে।তুতুল একদম রিঝের পিঠের সাথে লেগে আছে।রিঝ না থাকলে কয়বার যে সে পড়তো তার কোনো ঠিক নেই।আসমা চুল সামনে টেনে নিয়েছে।রামিম এবার ঘাড়ে চিমটি বসিয়ে দেয়।আসমা রাগে চেঁচিয়ে বলল,
“ থাপ্পড় খাবি রামিম্মা।”
“ তো দে না।মানা করছি না কি??”
“ তুই কিন্তু ! যা বাল তোর লগে কথা কওয়াই বেকার।”

রিঝ কড়া চোখে পাশ ফিরে তাকায়।আসমা ঢোগ গিলে চোখ ছোট করে বলল,
“ স্যরি।”

সামনে থেকে গাড়ি আসে।দুটি গাড়ি যাওয়ার জায়গা থাকলেও তিনটি গাড়ির নেই।রিঝদের গাড়ি একদম পাহাড়ের খাদের কিনারের দিকে এসে চলছে।একটুর জন্য পড়ে যাবে যাবে ভাব।তুতুল পাশে তাকায়।আৎকে উঠে।ভয়ে চোখমুখ খিঁচে চেঁচিয়ে উঠে,
“ আল্লাহ্!”

রিঝ দু’হাতে জড়িয়ে নেয়।সবাই আতঙ্কে আছে।মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করছে।তিনটি গাড়িতেই মানুষ ভর্তি।পিছনে যাওয়ার বা সামনে যাওয়ার জায়গা মিলাতে পারছে না ড্রাইভার।এখনি যেনো ২৫০০ ফুট নিচে পড়বে।তুতুল ভয়ে,উত্তেজনায় রিঝের শার্ট খামচে ধরে।রিঝ সবাইকে কড়া কন্ঠে বলল,
“ নিচের দিকে কেউ তাকাবি না।”

ভয়ে সবার আত্না শুকিঁয়ে কাঠ।রিঝের বুকটাও টিপটিপ করছে।তুতুল সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে।রিঝ সহজে ভয় পায় না।এটা ভয়ঙ্কর!এমন মারাত্নক অভিজ্ঞতা তার আছে।তবুও ভয় করছে।নিজের একার বেলায় সে লাফিয়ে নেমে যেতো।এমন বহুবার করেছে সে।কিন্তু সবাইকে ফেলে যেতে পারবে না।অন্য গাড়ি গুলোর ছেলেরা লাফিয়ে নেমে গেছে।মেয়েরা চিৎকার করছে।রিঝ সবাইকে শান্ত হতে বলল।তুতুল ভয়ে কাঁদছে।ভয় জিনিস তুতুলের মাঝে বেশি।রিঝ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ শান্ত!শান্ত হও।কিছুই হয় নি।মাথা তুলবে না।”

রিঝ তুতুলের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে।
রামিম সবাইকে ছেড়ে আসমার হাতটা শক্ত করে ধরে।আসমা ভীতু না।সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না।মৃত্যুকে সে ভয় পায় না।কিন্তু সে অবাক ।এই জীবনে তার প্রথম মনে হচ্ছে একটা ভরসার হাত তার হাতের মুঠোয় এসেছে।এটা সত্যিই ভরসার হাত।” আমি আছি ভয় নেই!” টাইপের ভরসার হাত।কে না চায় এমন একটা হাত!

#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here