#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০২
খালামনি এটা কি বললো,আমার আবার বিয়ে মানে!
আমার কি একবার বিয়ে হয়েছে নাকি!আজব তো!
মাথায় কিছুই ঢুকছিল না।চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে রুমের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
সবাই কাজ করছে,এক আহিল ভাইয়াই কাজ ফাঁকি দিয়ে সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে।
উনাকে পাশ কাটিয়ে রুমে আসার সময় উনি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই আমাকে ডাক দিলেন।
–তনু এক গ্লাস পানি দিয়ে যা তো।
“আহিল,তোকে কতবার বলেছি তনয়াকে তুই তুকারি করে না বলতে!অভ্যাস পরিবর্তন কর।”
রান্নাঘর থেকেই সোহেলী খালামনি আহিল ভাইকে কড়া গলায় ডাক দিয়ে কথাটা বললেন ।
মায়ের ডাকে আহিল তটস্থ হয়ে উঠলো।আমতা আমতা করে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
–না মানে তনু আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো তো।
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম।এই গম্ভীর রোবট প্রকৃতির মানুষটা যখন কোনো কারণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়,চেহারাটা তখন বেশ দেখার মতো হয়।
আহিল ভাই আমাকে সব সময় তুই তুই করেই বলতেন।কিন্তু কি জানি এবার দেশে আসার পর খালামনি বারবার আহিল ভাইকে নিষেধ করে দিচ্ছেন যেনো আমাকে তুই না বলে!
আর “তুমি” করে বলতে গিয়েই আহিল ভাই “তুই-তুমির” মাঝে সব উল্টাপাল্টা করে ফেলছেন।
আমাকে হাসতে দেখে আহিল ভাই কড়া গলায় বললেন,
–কি হলো হাসছো কেন?পানি আনতে বললাম না?
উনার মুখে আবারও “তুমি” শুনে আমার আরো হাসি পেতে লাগলো। মুখ চেপে হাসি আটকে কোনোরকমে বললাম,
— আহিল ভাইয়া, প্লিজ আমাকে তুমি বলতে যাবেন না। কি অদ্ভুত শোনায় এটা আপনার মুখে….
হিহিহি
আহিল ভাই মাথা তুলে আমার দিকে কড়া চোখে তাকাতেই আমার হাসি একবারে বন্ধ হয়ে গেল।কিরকম রাক্ষসের মতো তাকায় বাবাহ!
মিনমিন করে বললাম,
–আচ্ছা যাচ্ছি যাচ্ছি।এভাবে তাকানোর কি আছে?যাচ্ছি তো….
———————-
দুপুরের আগেই পাত্রপক্ষের লোকজন চলে এলো।আহিল ভাইয়া নিজের তত্ত্বাবধায়নে মেহমানদের খাওয়ালো।
তারপর সবাই ড্রয়িং রুমে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুই পক্ষ বিয়ের আলাপ-আলোচনা করতে লাগলো।
আমরা বাসার মোটামুটি সবাইই এখন ড্রয়িং রুমে উপস্থিত আছি।বাসার যেকোনো আলাপ-আলোচনায় ছোটবড় সবাই উপস্থিত থাকি আমরা,এটাই আমাদের পরিবারের নিয়ম।খালামনি যে সোফায় বসে আছে তার পাশেই সোফার গা ঘেঁষে আমি দাঁড়িয়ে সকলে কথা শুনছিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি,আপুর চাচাতো দেবর অর্থাৎ সাগর ভাইয়ের কাজিন আমার দিকে আড়চোখে দেখছে বারবার।উনি কি আসলেই আমার দিকে তাকাচ্ছে নাকি আমি ভুল দেখছি।
পরীক্ষা করার জন্যই আমি সরে গিয়ে খালামনির পিছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এখনো উনি এদিকেই তাকাচ্ছেন,তারমানে আমাকেই দেখছেন উনি!
আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে থাকি।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই আমার বিপরীত পাশে সোফায় বসে থাকা আহিল ভাইয়ের চোখে চোখ পড়ে গেল।উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে,একটু পর আমার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সাগর ভাইয়ের কাজিনের দিকে একপলক দেখলেন।
একটুপর আহিল ভাই সোফা থেকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। এমন ভাবে দাঁড়ালেন যে আহিল ভাইয়ের দেহের কারণে সাগর ভাইয়ের কাজিন এখন পুরোপুরি আড়ালে পড়ে গেল আমার।
আমিও এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
কেন জানি না আহিল ভাইয়ের এই কান্ডটা হুট করেই আমার খুব ভালো লেগে গেল।
সংক্ষিপ্ত আলাপ-আলোচনা শেষে আগামী সপ্তাহে বিয়ের ডেইট ফাইনাল করা হলো।
সব কথা ফাইনাল করে সন্ধ্যার দিকে যখন মেহমানরা চলে গেল।আমি আমার রুমে রুমে চলে আসলাম বিশ্রাম নিতে।অসম্ভব দকল গিয়েছে আজ সবার উপর দিয়ে।
বিয়ের এক সপ্তাহ আগেই যদি এমন খাটুনি খাটতে হয়,বিয়ের দুইদিন আগে কি হবে সেটাই ভাবছিলাম।
বিছানায় চিতপটাং হয়ে শুয়ে আছি হা-পা ছড়িয়ে,হুট করেই আহিল ভাই ঢুকে গেলেন আমার রুমে।
আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে জামাকাপড় ঠিক করতে লাগলাম।মনে মনে প্রচন্ড বিরক্তও হলাম।এভাবে অনুমতি ছাড়া কেউ কারো রুমে ঢুকে নাকি!
আমাকে অগোছালো ভাবে দেখে আহিল ভাইও কেমন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।তাড়াতাড়ি আমার উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেলেন।
একটু পরেই বাহিরে থেকে ডাক দিলেন,
–তনু!
–শুনতে পাচ্ছি বলুন।
–আমরা বাহিরে যাচ্ছি ঘুরতে,যাবি তুই?
–কে কে?
–“আমি” একাই,তুই সাথে গেলে “আমরা” হবো আর কি!
–আমি যাব না,এখন ক্লান্ত।আপনি যান।
আস্তে আস্তে বললাম”আপনার মতো নিরামিষের সাথে ঘুরতে বের হবো, মাথা খারাপ নাকি!”
–কিছু বললি?
–না,না কিছু বলিনি।আমি ঘুমালাম।যান আপনি এখন…।
আহিল ভাইয়ের ছায়াটা সরে গেল দরজার সামনে থেকে।আমি গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
মনে মনে ভাবলাম,বাহ্!আহিল ভাই নামক রোবট আবার ঘুরতেও যায় নাকি!আবার কিনা আমাকে নিতেও এসেছিল।
একচোট ঘুমিয়ে রাত ১১টার দিকে উঠলাম।
কি ব্যাপার বাড়িটা এমন নীরব নীরব লাগছে কেন!কোথাও কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না।
সবাই কি ঘুমিয়ে গেল নাকি!প্রতিদিন এই সময়ে তো পুরো বাড়ি হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকে।
ধীর পায়ে রুমের থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে আসলাম।সারা বাড়িতে অন্ধকার,কোনো রুমেই বাতি জ্বলছে না।
ড্রয়িং রুমে শুধু টিমটিম করে একটা ডীম লাইট জ্বলছে।
আশ্চর্য তো!এতো নীরব কেন বাসা!আর লাইটই বা সব অফ কেন?আমি ড্রয়িং রুমের বড় লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আম্মুকে ডাকতে লাগলাম।
আমার ডাক শুনে আম্মু এলো না,তবে আহিল ভাই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো তার ঘর থেকে।
–কিরে কখন উঠেছিস?ভয় পেয়েছিস নাকি?আমাকে ডাকলি না যে?আমি তো এতোক্ষণ এখানেই ছিলাম,তুই উঠে আবার ভয় পাস কিনা তাই।
এইমাত্রই রুমে গেলাম।
–বাসার সবাই কই আহিল ভাইয়া?
–নেই।
–নেই মানে?
–সবাই মিলে মেলায় গেছে।তুই তো পরশুদিন গেলিই মেলাতে।তাই তোকে রেখে যেতে বলছি।ঐ ভীড়ের মধ্যে তোর যেতে হবে না।আর আমারও কাজ আছে,আমিও যাইনি।
–সবাই মেলায় গেছে মানে?কোন মেলায়?মেলা শেষ না?
–না,দুইদিন বাড়াইছিল শুনলাম।
–কি বলেন?সবাই গেল কিন্তু আমাকে নিয়ে গেল না!আমার তো অনেক পছন্দ মেলায় যাওয়া।আমাকে রেখেই চলে গেল?
আমার কান্না ঠেলে চলে আসছিল।আমাকে ফাঁকি দিয়ে সবাই চলে গেল। আর আমাকে একবার বলেও গেলো না।আমি হতভম্ব হয়ে চুপ করে রইলাম।
–তোকে নিয়ে যেতে আমিই না করেছি।কি দরকার শুধু শুধু ঐ ভীড়ের মধ্যে গিয়ে।তোর যাতে মন খারাপ নাহয়,তাইতো তোকে অন্য কোথাও ঘুরাতে নিয়ে যেতে চাইলাম। তুই-ই তো বললি তুই যাবি না,ঘুমাবি।
এবার আমি বুঝলাম,কেনো আহিল ভাই এমন আদিখ্যেতা দেখিয়ে তখন ঘুরতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।আমি চেচিয়ে উঠলাম,
–আপনাকে কে বলছে, আমাকে নিয়ে যেতে নিষেধ করতে হ্যাঁ?আর আপনি আমার উপর এমন অধিকার দেখান কেন সবসময়? আমি কি চেয়েছি মেলায় না গিয়ে আপনার সাথে ঘুরতে যেতে?আমার ব্যাপারে আপনি আর নেক্সট টাইম কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না।
আসুক আজকে খালামনি।
ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যান করতে করতে আমি আমার রুমে চলে আসলাম।প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার নিজের উপরেই।কেন যে আমি ঘুমিয়ে গেলাম,কেন যে কোনো খবর রাখলাম না!তারা কখন চলে গেল আমায় রেখে!
আর এই আহিল ভাইটা!উনিই তো আসল ক্রিমিনাল,আমাকে রেখে যেতে বলছে,কত্ত সাহস।
মেলায় ঘুরে,মার্কেট থেকে কেনাকাটা করে সবাই বাসায় ফিরলো প্রায় রাত ১টা বাজে।সবার মুখ হাসি হাসি,কে কি কিনছে বাসায় এনে একজন অন্যজনকে দেখাচ্ছে।বাহ্,সবাই কত্ত খুশি!
আমি সবার সামনে থেকে আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসলাম।আম্মুর পিছন পিছন খালামনিও আসলো।
খুব করে চিল্লাফাল্লা করলাম আম্মুর সাথে,কেন তারা আমাকে সাথে নিয়ে যায়নি।কেন একা বাসায় রেখে গেল আমায়?
সোহেলী খালামনি আমাকে ধরে নিয়ে একপাশে বসিয়ে বললেন,
–আরে আরে আমার সোনা মেয়েটা তো দেখছি একদম রেগে গেছে!আমরা তো তোকে ইচ্ছে করেই রেখে গেলাম। আহিলের সাথে ঘুরতে যাবি তাই।আর আহিল তো ছিলই তোর সাথে,তুই একা কই রে মা!
–মানে,আমি বুঝলাম না।তোমরা আমার সব কিছুর সাথে শুধু আহিল ভাইকেই জড়িয়ে দাও কেন?আমি তোমাদের সাথে ঘুরতে না গিয়ে,আহিল ভাইয়ার সাথে কেন ঘুরতে যাব আশ্চর্য!
মা আর সোহেলী খালামনি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।আমার আরও বেশি বিরক্তি উঠে গেল।ধুরর কাউকে কিছু বলে লাভ নাই।
না খেয়েই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।একটা পর সাইকা আসলো আমাকে ডাকতে,ও কি কি জিনিস কিনেছে আমাকে দেখাবে।
সাইকাকেও ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।
সবার উপরেই বিরক্তি দেখাচ্ছি,সবাইকেই অসহ্য লাগছে এই মুহুর্তে। সবাই খারাও,আমাকে না নিয়েই চলে গেছে।অভিমানে বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইলাম
।
————————–
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো আম্মুর স্পর্শে।তিনি শিয়রে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।পাশেই বসে আছেন,সোহেলী খালামনি।
দুজনেই কিছুটা সিরিয়াস মুখ করে বসে আছেন।তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চান।
–কি ব্যাপার এতো সকাল সকাল আমার রুমে যে?সব ঠিক আছে তো?আম্মু কিছু বলবা?
আম্মু কিছু বললেন না,বললেন সোহেলী খালামনি।
উনার কথার সারমর্ম ছিল এই,
“আহিল ভাই নাকি আমার স্বামী!খুব ছোট বেলায় আহিল ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল!
নানা মৃত্যুশয্যায় যাওয়ার আগে আম্মু আর আম্মুর বান্ধুবীর দুই ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যান।
এখন আমার বয়স ১৮ হয়ে গেছে।তিন্নি আপুর বিয়ের পরপরই, খালামনি চাইছেন অনুষ্ঠান করে সামাজিকভাবে বিয়ে পড়িয়ে আমাকে নিয়ে যাবেন।আমাদের ছোটবেলার বিয়ের কথা বাড়ির বড়রা সবাই জানে।এমনকি আহিলও জানতো শুধু আমিই জানতাম না।তাই এখন উনারা আমাকে জানাতে এসেছেন।”
সব কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।এটা কি শুনছি আমি!আহিল মানে রোবটটা আমার স্বামী হবে!
উনাকে বিয়ে করার চেয়ে তো চিরকুমারী থাকা অনেক ভালো।আর বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি।ছোটবেলার বিয়ে আবার কি!আমার না জানিয়েই
আমার বিয়ে? নাহ্ এটা তো অসম্ভব!
আমি আম্মুকে সরাসরি জানিয়ে দিলাম,
–“এই বিয়ে আমি মানি না।করবো না বিয়ে আহিল ভাইকে।”
#চলবে