কোনো_এক_বসন্তে পর্ব ১

–“আহিল ভাই আপনি একটু সরে দাঁড়াতে পারেন না?

–কেন,যাতে অন্য কেউ এসে তোর গা ঘেঁষে দাঁড়াতে পারে?

–দাঁড়ালে দাঁড়াবে তাতে আপনার কি?আমি তো আর আপনার বিয়ে করা বউ না যে আমার পাশে কেউ দাঁড়ালে আপনার এতো গায়ে লাগবে।

–মিস তনয়া,যদি বলি তুমি আমার বিয়ে করা বউই!

–কিহ্!

–নাহ্,কিছু না।তুমি কেনাকাটা শেষ করে আসো,আমি ঐখানটাতে অপেক্ষা করছি।

আহিল মুচকি হেসে ভীড় ঠেলে দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আহিলের মা আহিলকে দায়িত্ব দিয়েছেন এই মেয়েটিকে নিজের গাড়িতে করে নিরাপদে মেলায় এনে ছেড়ে দেওয়া এবং এই মেয়েটির যখন বাসায় ফেরার ইচ্ছা জাগবে, ঠিক তখনই আবার নিরাপদে বাসায় নিয়ে আসতে হবে।

আজই মেলার শেষ দিন ছিল । মেলায় নানান রকম শৌখিন জিনিস পাওয়া যায়, যা তনয়ার খুব খুব খুবই পছন্দের।
বাসার অন্য কাউকে না জানিয়ে, শুধুমাত্র সোহেলী খালামনিকে রাজী করিয়ে তবেই তনয়া সুযোগ পেয়েছে এখানে এসে কেনাকাটা করার।

আহিল ভাইকে একদম পছন্দ না তনয়ার,তবুও বাধ্য হয়েই তার সাথেই আসতে হয়েছে।আর যাইহোক সোহেলী খালামনি তাকে একদম একা ছাড়বেন না।
কেনাকাটা শেষ করে সন্ধ্যার একটু আগেই সে বাসায় ফিরে আসে আহিল ভাইয়ের সাথে।”

————————–
দুইটা কুচকুচে কালো সাপ আমাকে তাড়া করছে আর আমি প্রাণপনে দৌঁড়াচ্ছি বাঁচার জন্য। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আমি দৌড়াচ্ছি কিন্তু আমার পা চলছে না!অর্থাৎ একই জায়গায় আটকে আছি।
দৌঁড়াতে গিয়ে একসময় মুখ থুবড়ে পড়েও গেলাম আর সাপ দুটো আমাকে নাগালে পেয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেললো।একটা সাপ তো আবার আমাকে খাওয়ার জন্য ইয়া বড় হা করলো……”

জোরে চিৎকার করতে করতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে সারাঘরে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করে দিলাম আমি।
গায়ের জামাকাপড় সব ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে।
প্রচন্ড ভয়ে আমার গলা আর ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।
যাক বাবাহ,এটা তাহলে স্বপ্ন ছিল!

তবুও স্বপ্নটা এতোই বাস্তব লাগছিল যে ঘুম থেকে জেগেও সেটা আমি অনুভব করছিলাম।আমার হাত-পা রীতিমতো কাঁপাকাঁপি করছে।আমি স্থির হতে পারছি না।

আমার চিৎকার শুনে মা,শুভ,রনি ভাইয়া,বড় ফুপি,সোহেলী খালামনি, আহিল ভাইয়া সবাই একযোগে হুড়মুড় করে আমার রুমে চলে আসলো।
এসেই রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে একেকজন একেক প্রশ্ন করতে লাগলেন।

সবাই যখন নিশ্চিত হলেন,আমি শুধুমাত্র একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি আর কিছু নয়!শুভ আর রনি ভাইয়া তো আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে শুরু করে দিল।
তারা দুজন আমার ভয়ার্ত অবস্থা দেখে একজন আরেকজনের উপর হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে।

তাদের হাসি দেখে আমার ভীষণ রাগ লাগছিল।বড় ফুপি আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেই হয়তো শুভ আর রনি ভাইয়াকে একটা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
চেয়ে দেখলাম তিনি নিজেও মুখে কাপড় চেপে হাসি আটকাচ্ছেন।

দুঃস্বপ্ন দেখে আমার এভাবে ভয় পাওয়াতে সবাই দেখি আমাকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে।
আমি আর সহ্য না করতে পেরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম।

আহিল ভাইয়া এতোক্ষণ প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সবটা।আমার কান্না শুরু হতেই উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।

এই একটা মানুষ আমি দেখলাম জীবনে,পুরাই রোবট!তাকে এখন পর্যন্ত দাঁত বের করে হাসতে দেখিনি আমি,যা একটু মুচকি হাসেন সেটাও একদম মেপে মেপে।তার হাসি দেখলে মনে হবে ঠোঁটটা আরেকটু প্রসারিত হলেই বুঝি দুনিয়া কেয়ামত হয়ে যাবে;এর চেয়ে বেশি হাসা যাবে না!
তবে মুচকি হাসলে উনার ডান গালে একটা টোল পড়ে আর ঐটা খুবই আকর্ষণীয়।

আহিল ভাই চলে যেতেই তার পিছু পিছু শুভ আর রনিও হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
তাদের যাওয়ার একটু পরেই বড় ফুপিও চলে গেলেন।তার নাকি অনেক ঘুম পাচ্ছে।

এতোক্ষন সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিচ্ছিলেন।সকালে আমার ক্লাশ থাকায় আমি আগে আগে ঘুমিয়ে গেছিলাম।
আড্ডা শেষে যে যার মতো করে ঘুমাতে যাবে আর তখনি আমার চিৎকার শুনে সবাই আমার রুমে চলে আসেন।

আমার রুমে এখন আছেন,সোহেলী খালামনি অর্থাৎ আহনাফ ভাইয়ার আম্মা আর আমার মা।
খালামনি আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আছেন আর মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমাকে শান্ত করছেন।

স্বপ্নটা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে,আমি চাইলেও শান্ত থাকতে পারছি না।শরীরের লোমগুলো একটু পরপর কাঁটা দিয়ে উঠছে।
খালামনি একসময় মাকেও পাঠিয়ে দিলেন ঘুমাতে।
মা প্রথমে আমাকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে চাইলেন না।খালামনি বললেন, তিনি নিজে আজ রাতটা আমার সাথে ঘুমাবেন।চিন্তার কোনো কারণ নেই।

মা চলে যেতেই আমি খালামনি কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম।

সোহেলী খালামনি আমার বাবার দূর সম্পর্কের বোন হয় আর মায়ের ছোট বেলার বান্ধুবী।বান্ধুবীও আবার যেমন তেমন বান্ধুবী না!একদম কলিজার বান্ধুবী। মা আর সোহেলী খালামনি তো দুজন দুজনকে বোনই মানেন।
আমার মা ছাড়া নানা-নানীর আর কোনো সন্তান না থাকায়,নানা বেঁচে থাকতে সোহেলী খালামনিকে মেয়ে ডেকেছিলেন।
তাই আমরা এখন সোহেলী খালামনিকে নিজের আপন খালা হিসেবেই দেখি।
আমি খেয়াল করে দেখেছি আমার অন্যসব ভাইবোনদের থেকে সোহেলী খালামনি আমাকে একটু বেশিই আদর করেন।
আমি খালামনির কোলে মাথা রেখে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।

——————-

সকালে ঘুম ভাঙলো সূর্যের ঝলমলে আলো চোখের পড়ে।উঠে দেখি পাশে খালামনি নেই।আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে চলে গেছেন হয়তো।
টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,
সকাল-৭ঃ০৫
তুলনামূলক ভাবে আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙেছে আমার।কলেজে যাওয়ার জন্য হাতে এখনো প্রচুর সময় আছে।

রাতের স্বপ্নটার কথা চিন্তা করতেই আপনমনে হেসে উঠলাম।রাতের আঁধারে তখন কি ভয়টাই না লাগছিল।
আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।শীতের সকালের এই মিষ্টি রোদটা বেশ লাগছে।
রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলেও ভোর সকালের দিকে ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়েছিল বিধায় শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে।

আমি আরশী শেহেরীন তনয়া।সবাই তনয়া নামেই ডাকে।উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছি।
তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি মেঝো।
আমার বড় আপু তিন্নি,গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করে ফেলেছে। আপুর পছন্দ করা ছেলের সাথেই আর কিছুদিন পরে আপুর বিয়ে হতে যাচ্ছে।

আমার ছোট ভাই শুভ,অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
আমার মা একজন গৃহিণী আবার একজন সমাজসেবিকাও আর বাবা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একজন শেয়ার হোল্ডার।
বাবা-মা ভাইবোন ছাড়াও আমার ফ্যামিলিতে আর অনেকেই আছে।আমরা সবাই যৌথ পরিবারে বাস করি।এছাড়াও…..

–তনয়া, এই তনয়া?
কিরে এখানে কি করছিস?কলেজে যাবি না আজ?

সাইকার ডাকে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে গেল।
সাইকা আমার চাচাতো বোন।আমরা একই ক্লাশে একই কলেজে পড়ি।সে কলেজ ড্রেস পরে পুরোদমে তৈরি হয়ে আমাকে ডাকতে এসেছে।
বেশ বিরক্ত হয়েই সাইকাকে বললাম,

–এতো সকাল সকাল কেউ এভাবে চেঁচায়?কত সুন্দর প্রকৃতি দেখছিলাম।আর দিলি তো পরিবেশটা নষ্ট করে।

–প্রকৃতি দেখছিলি মানে?কলেজে কি যাবি না নাকি?আজ ফিন্যান্স স্যারের কত ইম্পোর্ট্যান্ট ক্লাস জানিস তুই?কিছুতেই মিস দেওয়া যাবে না।

–এই থাম তো।আমি কখন বললাম যে আজ কলেজে যাব না?এখনো অনেক সময় হাতে আছে।একটুপর রেডী হয়ে নিচে নামবো।তুই যা এখন।

–কয়টা বাজে দেখেছিস?হাতে সময় নেই একদমই আর তুই বলছিস অনেক সময়!

সাইকা ওর হাত ঘড়িটা আমার চোখের সামনে এনে ধরলো।
ঘড়িতে সময় ৮:২৫! সময় দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ।
একটু আগেই তো দেখলাম ৭ঃ০৫ বাজে, এতো তাড়াতাড়ি সময় যায় কিভাবে!

দ্রুত রুমে এসে টেবিল ঘড়িটা দেখলাম,সেখানে এখনো ৭ঃ০৫ দেখাচ্ছে।খেয়াল করে দেখলাম,সেকেন্ডের কাটা চলছে না।

ওহ মাই গড ঘড়ির ব্যাটারি তাহলে ৭ঃ০৫ এ ডেড হয়ে গেছিল।
আর এখন বাজে ৮ঃ৩০!ঠিক ৯টায় আমার ক্লাশ।
আজ প্রথমেই ফিন্যান্স ক্লাশ।ইম্পোর্ট্যান্ট লেকচার মিস হয়ে গেলে আমার নিজেরও ক্ষতি তাছাড়া বলা তো যায় না স্যার যেরকম একরোখা মানুষ, ভরা ক্লাশে অপমানও করে বসতে পারেন।

আমি তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে রেডী হয়ে যখন নিচে নামলাম।সাইকার ততক্ষণে সকালের নাস্তা শেষ প্রায়।
সবাই খাবার টেবিলে বসে নাস্তা করছিল।বিশাল লম্বা খানদানি ডাইনিং টেবিল আমাদের।পরিবারে মানুষ বেশি হওয়ায় দাদাভাই বিশেষ অর্ডার দিয়ে এরকম সাইজের ডাইনিং টেবিল বানিয়ে নিয়েছেন।
ডাইনিং রুমে গিয়ে সাইকাকে তাড়া দিলাম,জলদি নাস্তা শেষ করে আসার জন্য।

আমাকে দেখেই মা তাড়া দিলেন,

–তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?দেরী না হয়ে যাচ্ছে তোদের?জলদি বস,আমি আগে থেকেই নাস্তা রেডি করে রেখেছি তোর।

–মা আজ খাওয়ার সময় নেই।ইম্পোর্ট্যান্ট একটা ক্লাশ আছে।জলদি যেতে হবে,রিকশা সময় মতো না পেলে আবার আরও ঝামেলা হয়ে যাবে।

–আরে তুই খালি পেটে বের হবি নাকি!

–মা আমি ক্লাশ শেষে ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নিব।প্লিজ আজ জোর করো না প্লিজ মা।
এই সাইকা হয়েছে তোর?রেখেই চলে গেলাম কিন্তু..

তনয়ার মা রাহেলা বেগম,জানেন যে মেয়ে যেহেতু একবার বলে দিয়েছে খাবে না। এখন হাজার জোর করলেও সে খাবে না।তনয়ার প্রত্যেকটা মতিগতি আর কথার ভঙ্গি দেখেই তিনি বুঝতে পারেন তনয়ার কোন কথায় জোর কতটুকু।আর বুঝতে পেরেই তিনি আর জোর করলেন না।
কিন্তু সোহেলী বেগম তা বুঝতে চাইলেন না,তিনি কিছুতেই তনয়াকে না খেয়ে কলেজে যেতে দিবেন না।

–তনয়া মা তুই খেয়েই যাবি।এক আধটু দেরী হলে হবে।আমরাও তো আগে কত ক্লাস মিস করেছি।না খেয়ে যেতে হয় না মা।

–খালামনি,এটা একটা ইম্পোর্ট্যান্ট ক্লাস।আমাকে সময় মতো পৌঁছাতেই হবে।খেতে বসলে দেরী হয়ে যাবে।আর ঠিক সময়ে রিকশা না পেলে তো আরও দেরী হবে।

–তুই খেতে বস মা।তোদের রিকশায় যেতে হবে না।
আহিল তোদের ওর গাড়িতে করে কলেজে পৌঁছে দেবে ঠিক সময় মতো।
ওদের নিয়ে দিয়ে আসতে পারবি না আহিল বাবা?

আহিল এতোক্ষণ মাথা নিচু করে বসে চুপচাপ নিজের নাস্তা করছিল। মায়ের কথা শুনে এবার মাথা তুলে একবার তনয়া ও একবার সাইকার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিল,

–পারবো।

কেন জানি আহিল ভাইয়াকে আমার একদমই পছন্দ লাগে না।মনে মনে ভাবলাম,এমন একটা রোবটের সাথে যাওয়ার চেয়ে তো পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো।
সাইকার দিকে চেয়ে দেখলাম,এই অফারে সে খুশিতে বেশ গদগদ করছে।সাইকা কিছু বলে উঠার আগেই আমি বললাম,

–না,না খালামনি তার কোনো দরকার নেই।আমরা চলে যাব রিকশাতেই আর কিছু খেয়েও নিব কলেজে গিয়ে,প্রমিজ।
এই চল চল সাইকা এইবার যেতে হবে।।.

আমি আর সাইকা বাসা থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে এসে দাঁড়ালাম রিকশার জন্য।
বাড়িতে দুই দুটো গাড়ি থাকার পরেও আমাদেরকে বেশিরভাগ সময় রিকশা করেই কলেজে যাওয়া আসা করতে হয়।
বাবা আর চাচ্চু খুব সকাল সকাল উঠেই দুজন দুটো গাড়ি নিয়ে দুইদিকে ছোটে।কাজ আর কাজ,কাজ ছাড়া তাদের জীবনে যেনো আর কোনো লক্ষ্যই নেই।

যেদিন বাবা বা চাচ্চুর কোনো একজনেএ অফিসের কাজের চাপ একটু কম থাকে সেদিন হয়তো একটা গাড়ি ভাগে পাওয়া যায়।অন্যথায় রিকশাই সম্বল।

অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও রিকশা না পেয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কলেজ এখান থেকে বেশি দূর না,হেঁটেও যাওয়া যায়। হাঁটতেও আমাদের সমস্যা নেই, তবে এই মুহুর্তে সময় খুবই কম।
হাঁটতে হাঁটতে সাইকা বেশ তেজের সাথে বললো,

–খুব ভাল্লাগছে এখন হাঁটতে তাইনা?খালামনি যে বললো,আহিল ভাই আমাদের কলেজে পৌঁছে দিবে,তো তুই রাজী হলি না কেন?এখন তো আরামেই আহিল ভাইয়ের গাড়িতে বা বাইকে করে কলেজে যেতে পারতাম।

–চুপ,রাজী হইনি বেশ করেছি।ঐ রোবটটাকে দেখলেই আমার বুকের পানি শুকিয়ে যায়।আর উনার সাথেই উনার পাশে বসে কিনা আবার কলেজে যাব!
তোর এতো শখ থাকলে তুই আমার সাথে আসলি কেন?উনাকে বলতি যে তোকে নামিয়ে দিতে।

–আরে আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো,আমি তো এমনি বললাম।আর আহিল ভাইয়ের প্রতি তোর এতো রাগ কেনো বলতো?হুম মানছি যে উনি তুলনামূলক ভাবে একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু আহিল ভাইয়ের ব্যাক্তিত্ব দেখেছিস তুই?জাস্ট ওয়াও!
এমন হ্যান্ডসাম আর গুড পারসোনালিটির পুরুষ তো আমি আমার জীবনে এর আগে কখনো দেখিনি আর যাই বলিস না কেনো তনয়া।

সাইকার এই আজাইরা বকবক শুনতে খুবই বিরক্ত লাগছিল।ওকে পেছনে ফেলেই আরও জোরে পা চালিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলাম।

সোহেলী খালামনি তার দুই ছেলে-মেয়ে আহিল ও আয়রাকে নিয়ে UK থাকেন।
আহিল পড়াশোনা শেষ করে সেই দেশেই বিজনেস স্টার্ট করে দিয়েছে।আর আয়রা,যে কিনা আহিল ভাইয়ার থেকে প্রায় ১৮ বছরের ছোট সে এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে।

খালামনিরা বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন প্রায় ১৫দিন যাবৎ।

১০ বছর পূর্বে আয়রা যখন খালামনির পেটে,খালু তখন ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যান।
আহিল ভাইয়া তখন পড়াশোনার জন্য নতুন নতুন UK তে গিয়েছিল।বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে তিনি আর তার মাকে একা এই অবস্থায় দেশে রাখতে সাহস পাননি।আত্মীয়স্বজনদের নিষেধ না মেনে নিজের সাথেই UK নিয়ে গিয়েছিল।সেই থেকেই খালামনি UK থাকেন।সেখানেই আয়রার জন্ম হয়।

‌ঢাকাতে খালামনিদের নিজেদের বাড়ি-গাড়ি সবই আছে।বছরের পর বছর বাড়ি খালি পরে থাকলেও,ঐ বাড়ি বেচার কথা খালামনি চিন্তাও করতে পারেন না।খালুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে সেই বাড়ির সাথে।

একজন কেয়ারটেকার খালামনিদের সকল সহায় সম্পত্তি দেখাশোনা করে রাখেন।
‌১ বছর পর পর খালামনিরা কিছুদিনের জন্য এসে তাদের ও আমাদের বাসায় থেকে যান।

‌গত ৬মাস আগেই মাত্র তারা এসে গেছেন একবার।আবারও আসতে হলো,কি একটা জরুরি কাজ নাকি পড়ে গেছে বাংলাদেশে তাদের।তাছাড়া তিন্নি আপুর বিয়েও সামনে তাই কিছুদিন আগেই চলে এসেছেন।

‌হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে কলেজে চলে এসেছি।
‌৯ঃ০৫ বাজে, ক্লাসে গিয়ে দেখি স্যার এখনো ক্লাসে আসেননি।আমি আর সাইকা দুজনেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম,যাক বাবাহ বাঁচা গেল।

——————–

পরদিন সকাল থেকেই বাসায় ঘর সাজানোর তোড়জোড় পড়ে গেল।
তিন্নি আপুর হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবে,বিয়ের দিন তারিখ সব ফাইনাল করতে।এর আগেও ছেলেপক্ষ ও মেয়েপক্ষ বেশ কয়েকবারই নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ আলাপ-আলোচনা করেছে।তবুও বিয়ে বলে কথা,আয়োজন করেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা ভালো।

যেদিন থেকে UK তে সাগর ভাইয়ার জবটা কনফার্ম হয়ে গেল,সেদিন থেকেই তারা বিয়েটা যেনো দ্রুত হয়ে যায় তার জন্য চাপ দিতে লাগলো।কারণ সাগর ভাইয়ার হাতে সময় খুব কম।
বিয়ে করে একবারে বউকে নিয়েই UK চলে যেতে চায় সে।

সবার সাথে হাত মিলিয়ে আমিও কাজ করছি।মোটামুটি ভূতের খাটনী খাটছি বলা চলে।দাদুর এতো বড় বাড়ির প্রতিটা ঘর দরজা নাকি ঝকঝকে তকতকে হওয়া চাই,তিন্নি আপুর অর্ডার এটা!
এই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা!

দুইদিনের মেহমান বলে,মা আপুকে কোনো কাজেই হাত লাগাতে দিচ্ছে না।সব কাজ আমাদেরই করতে হচ্ছে।ইশশ,তিন্নি আপুর তো আরামই আরাম!
মনে মনে বললাম,শুধু একবার আমার বিয়েটা আসুক,তারপর আমিও আরাম করবো।

আমার ঘরটা পরিষ্কার করে কিছু হাবিজাবি অতিরিক্ত জিনিস স্টোররুমে গিয়ে রেখে আসলাম।আসার সময় রান্নাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম,তখনই মা’র মুখে তনয়া নামটা শুনে আমি একটু কৌতুহলী হয়ে কান পাতলাম।
রান্নাঘরে মা আর সোহেলী খালামনি মিলে রান্না করছে।পাশেই চাচী আর বড় ফুফু কাটাকাটি করছে।

সোহেলী খালা মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–ভালোয় ভালোয় তিন্নির বিয়েটা হয়ে গেলেই কিন্তু আমরা আর দেরী করবো না রে রাহেলা।
এইদিকে আয়রার স্কুল মিস যাচ্ছে আর আমার কাজ পাগল ছেলেটাও তো অস্থির হয়ে গেছে বাসায় ফেরার জন্য।

তনয়াকে আবার বিয়ে পড়িয়ে সামাজিকভাবে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাব সোজা UK। তিন্নির জামাইর চাকুরিটা UK হওয়াতে কিন্তু বেশ ভালোই হলো,দুইবোন একই দেশে থাকতে পারবে।

–সেটা নাহয় ঠিক আছে।কিন্তু আমি ভাবছি তনয়া তো এখন পর্যন্ত কিছুই জানে না।ও শোনার পর কি রিয়েক্ট করবে সেটা নিয়েই চিন্তা।

–তুই কোনো চিন্তা করিস না রাহেলা,ঐটা আমি ম্যানেজ করবো।তনয়া লক্ষ্মী মেয়ের মতো সব কথা শুনবে আমার দেখিস।

মা আর খালা মনির আর কোনো কথা আমার কানে
ঢুকছে না আপাততঃ।
আমার মাথায় ঘুরছে শুধু,
আমাকে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করছে মা তাহলে?এতো তাড়াতাড়ি? আমি কি বোঝা হয়ে গেছি নাকি যে এখনো কলেজ লাইফটাই শেষ করলাম না আর এখনি বিয়ের কথা বলছে।তিন্নি আপু তো মাস্টার্স কমপ্লিট করে তারপর বিয়ে করছে।তাহলে আমার বেলায় এতো তাড়াহুড়ো কেনো?

কিন্তু খালামনি এটা কি বললো,আমার আবার বিয়ে মানে!
আমার কি একবার বিয়ে হয়েছে নাকি!আজব তো!

#চলবে

#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০১

(#আমার_মেয়ে গল্পটির শেষ পর্ব আজ রাতেই দিব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here