#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_21
#Writer_NOVA
পুকুর ঘাট থেকে কলস ভরে পানি নিলো ফুল। পা ধুয়ে কলস কোমড় তুলে পিছু ঘুরতেই চমকে উঠলো। অভি হাত গুজে ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল বিব্রতবোধ করলো। দ্রুত সেখান থেকে সটকে পরতে চাইলো। কিন্তু অভি তা হতে দিলো না। হাত মেলে পথ আটকে বললো,
‘আমাকে দেখলে এতো পালাই পালাই করো কেন?’
ফুল মুখ থমথমে করে কঠিন স্বরে বললো,
‘পথ ছাড়েন অভি ভাই।’
‘আমার উত্তর না দিলে ছাড়বো না।’
‘আপনার কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’
অাহত হলো অভি। কথার আঘাতের থেকে ফুলের এড়িয়ে যাওয়ার দৃষ্টি তার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হচ্ছে। ছোট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। যাতে বিষাদের ছাপ ছিলো। ফুল বুঝেও বুঝলো না। অভিকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় তার হাতে নেই। অভি এক ঝাটকায় সকল আঘা ঝেড়ে ফেললো। চোখ নাচিয়ে স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘শুভকে তুমি বলো, আমাকে আপনি বলো কেন?’
অভির প্রশ্নে ফুলের নকশা বদলে গেলো। রাগ হলেও নিজেকে শান্ত রাখলো। তবে বিরক্তির ছাপ মুখে প্রকাশ পেলে। কিছুটা বিদ্রুপের স্বরে বললো,
‘আমি যাকে তাকে তুমি বলি না।’
‘তাহলে শুভকে বলো কেনো?’
‘আপনাদের মধ্যে তফাৎ যে আকাশ-পাতাল তাই।’
‘কোনো সম্পর্ক আছে নাকি?’
চোখ রাঙিয়ে তাকালো ফুল। অভি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো। মোক্ষম জায়গায় আঘাত করেছে৷ এবার ফুল কি উত্তর দেয় তাই দেখার পালা। কিন্তু অভির ভাবনায় এক গামলা পানি ঢেলে সেখানে উপস্থিত হলো ঝুমুর।
‘ফুল তোমারে চাচী ডাকে। কহন পানি আনতে পাডাইছে। তুমি এইহানে খাঁড়ায় রইছো। চাচী দেখলে আঙ্গারের মতো জইলা উঠবো।’
অভি বিরক্ত হলো৷ ঝুমুরের আগমন একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিলো। কোথায় ভেবেছিলো এতদিন পর ফুলকে পেয়ে আচ্ছা করো আঘাত করে কতগুলো কথা শুনাবে। তাকে দেওয়া আঘাতগুলো ফেরত দিবে। সেখানে বা হাত ঢুকালো ঝুমুর। চাপা ক্ষোভে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
‘অভি ভাইয়ের কি হইলো ফুল? এমন কইরা গেলো গা কেন?’
‘কে জানে ঝুমুর আপা। মানুষের মতিগতি বুঝি না আমি।’
‘আর বুঝতে হইবো না। এহন জলদী কইরা লও। নইলে কুরুক্ষেত্র বাইধা যাইবো। কলসিডা আমারে দাও।’
‘না, লাগবে না। আমি পারবো।’
‘বেশি কথা কইয়ো না।’
ঝুমুর জোর করে ফুলের থেকে পানি ভর্তি কলসটা নিয়ে নিলো। ফুল বারণ করা সত্ত্বেও শুনলো না। তারা চলে যেতেই শুভ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে মোটা গাছের গুড়ির আড়াল থেকে বের হলো। ঝুমুরকে এখানে সেই পাঠিয়েছে। নাগ বারান্দা থেকে সে সবটাই দেখেছে। অভি যখন ফুলের পথ আটকিয়েছে তখনই বুঝে ফেলেছে কোন ঘাপলা আছে। তাই ঝুমুরকে ডেকে পাঠিয়ে দিলো। মুখে থাকা ফেনা দূরে ছুঁড়ে ফেলে মুচকি হাসলো শুভ। ছোট সর্দার নামটা তো সে এমনি এমনি পায়নি।
‘অভি তোরে কি কইছে রে?’
ফুলের হাত থেমে গেলো। চোখ সরু করে শুভর পানে তাকালো৷ এক মুহুর্তে নিজেকে সামলে বললো,
‘কি বলবো?’
‘তাই তো জানতে চাইতাছি।’
‘কিছু না।’
‘আমার লগে মিছা কতা শিইখা গেছোত?’
ফুল উত্তর দিলো না। পাতিল থেকে এলুমিনিয়াম বোলে ভাত বেড়ে নিলো। ঘরের ধানের চাল হওয়ায় ভাতের রংটা ভিন্ন। লালচে রংঙের মোটা ভাত দেখে ফুল প্রথম দিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। তার মনে হয়েছিলো এই ভাত গলা দিয়ে নামবে না। ওর আৎকে ওঠা দেখে সুফিয়া বিবি ভেংচি কেটে বলছিলো,
‘কুয়ারা করে৷ এই ভাত খাইতে পারবো না। জীবনে এই চাউল দেখছোত? এডার স্বাদ কি বুঝবি? আমার ভোলাভালা পোলাডার টেকা তো মিনিকেট চাউল কিনতে কিনতে ফুরাইতাছোত।’
দাদীর কথায় চোখ টলমল করে উঠেছিলো ফুলের। এই কথায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলো আনোয়ার সর্দার স্বয়ং নিজেই। সেদিন বিকেলেই ভাতিজীর জন্য পঞ্চাশ কেজি বস্তার মিনিকেট চালের বস্তা কিনে এনেছিলো। সেটা নিয়ে সোহেলী বেগম কম ঝামেলা করেননি। এরপর থেকে অল্প অল্প করে খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ফুলের এই মোটা চালের ভাত ভালোই লাগে।
‘কিরে কই হারালি কইতরির মা?’
ফুল চমকে সজ্ঞানে এলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘কোথাও না।’
শুভর ফুলের কথা পছন্দ হলো না। কিছুটা রুক্ষ ভাষায় বললো,
‘কি হইছে তোর ক তো? তহন থিকা না, না উত্তর দিতাছোত। আমার মেজাজ গরম হইলে দিমু নে এক চটকনা। তহন এমনি ঠিক হইয়া যাবি।’
ফুল দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। তার এখন কোন কিছু ভালো লাগে না। যেদিন থেকে বাবার চিঠি পরেছে সেদিন থেকে মানসিক চাপে আছে। আশেপাশের সবকিছু বিরক্ত লাগে৷ শুভ যে বিষয়টা খেয়াল করেনি তা নয়। ফুলকে চুপচাপ দেখতে তার ভালো লাগে না। ফুল প্রাণোচ্ছল ভাবে বাতাসের তালে তালে দুলবে। সেটাই যেনো শুভর চোখের প্রশান্তি।
‘তোমার ভাত বেড়ে দিছে। খেয়ে নাও।’
‘তুই খাইছোত?’
‘না, পরে খাবো।’
‘কোন পরে টরে নাই। এহন আমার লগে খাইতে বইবি।’
ফুল চোখে চোখ রেখে বললো,
‘জেদ করো না শুভ ভাই।’
‘আমার জেদ দেহস নাই তুই। হের লিগা ভালো কইরা কইতাছি আমারে জেদ করতে বাধ্য করিস না। চুপচাপ প্লেট লইয়া ভাত বাড়। আমার লগে বইয়া খাবি।’
ফুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে ভাবলো এই ছেলেটা এতোই যখন ভালোবাসে তাহলে বলে দেয় না কেনো? সে কি জানে ফুল তার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে কতোটা উৎকন্ঠিত হয়ে আছে।
‘চাইয়া না থাইকা খাইতে বয়।’
‘কারো যখন আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই, তোমার এতো চিন্তা কেন শুভ ভাই?’
শুভ উত্তর দিলো না। এক পলক ফুলের দিকে তাকিয়ে বিষম খেলো। ফুল দ্রুত উঠে স্টিলের জগ থেকে মগে পানি ঢেলে শুভর দিকে বাড়িয়ে দিলো। ঢকঢক করে আধা মগ পানি খেয়ে শুভ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো।
‘শুক্কুরবার আমগো ক্লাবের ক্রিকেট খেলা আছে। দেখতে যাবি?’
রাত বাজে এগারোটার বেশি। আনোয়ার সর্দারের চোখে ঘুম নেই। হাসফাস করছেন তিনি। এপাশ ওপাশ করে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। এক সময় উঠে বসলেন। ঘুলঘুলি দিয়ে চাঁদের আলো এসে সারা কামরা মোহনীয় করে তুলেছে। পূর্ণিমার আলো। সারা কামরার কানায় কানায় বিস্তার করছে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে পাশ ফিরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আনোয়ার সর্দারের চোখ দুটো আজ বেইমানি করছে৷ ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। অতিরিক্ত চিন্তায় চোখের ঘুম উবে গেছে। চোখ দুটো বন্ধ করলেই ছোট ভাইয়ের অসহায় মুখটা ভেসে উঠে। সেদিন মনোয়ার সর্দার এসেছিলো।
রমিজ মিয়া যখন বললো আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে তখন আনোয়ার সর্দার দেরী করেনি। ধীর পায়ে বাড়ির বাইরে চলে গেছে। উঠোনে কাউকে না পেয়ে বড় রাস্তার দিকে গেলো। সেখানেই মনোয়ার সর্দার দাঁড়িয়ে ভাইয়ের অপেক্ষা করছিলো। ভাইকে দেখে চোখ দুটো টলমল করে উঠলো৷ আনোয়ার সর্দার সবুর করতে পারলো না। ভাইকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো। তারপর সেখান থেকে আড়ালে গিয়ে সুখদুঃখের কত গল্প করলো। মনোয়ার সর্দার একে একে সব খুলে বললো। আমিন, মারুফের ঘটনাও বাদ দিলো না। সব শুনে আনোয়ার সর্দার একটু চমকে উঠলো। মারুফকে চিনে না এমন মানুষ তাদের উপজেলায় খুব কম মানুষ আছে। মারামারি, খুনাখুনি, কাটাকাটির জন্য মারুফ শেখের নাম সারা উপজেলায় কুখ্যাত। তার সাথে লাগতে যাওয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷ ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেও সে শান্ত হতে পারছে না।
এক গোলক ধাঁধাঁয় আটকে গেছে। এক পাশে বড় ছেলে, আরেক পাশে ছোট ছেলে আর বিপরীতে আমিন দাঁড়িয়ে৷ কোন কাননে ফুটিবে ফুল?
[আলহামদুলিল্লাহ, অসুস্থতা থেকে সেরে উঠেছি। কিন্তু এবার মানসিক ডিপ্রেশনে পরে গেছি। এতবড় একটা শর্কড পেয়েছি যে কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। অনিয়মিত হওয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার জন্য দোয়া করবেন। যাতে আমি সব কিছু কাটিয়ে উঠতে পারি।]
#চলবে