কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -২০

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_20
#Writer_NOVA

‘কোন কাম কাইজে মন নাই। হারাক্ষণ ধ্যান মা’ইরা বইয়া থাকে। কহন থিকা ডাকতাছি হেই দিকে খেয়াল আছে? পুকুর থিকা কলস ভইরা পানি আনতে কইছিলাম। আমি গোসল করমু। কিচ্ছু করোস নাই।’

দাদীর ভৎসনায় চোখ তুলে তাকালো ফুল। চোখ দুটো টলমল করছে তার। আড়ালে চোখ মুছে মিনমিনে গলায় বললো,

‘মনে ছিলো না দাদী।’

‘মনডা কোন নাগরের কাছে থাকে? যেই কিছুই মন থাকে না। কি হইছে তোর? এতো কুয়ারা (ঢং) করোস কেন? বাপের মান-সম্মান খাইয়া কি হয় নাই? এহন চাচারডা খাইতে উইঠা পইরা লাগছোত?’

শুভ রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। সুফিয়া বিবির চেচামেচি শুনে উল্টো ঘুরে সেদিকে এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হইছে বুড়ি? এতো চিল্লাও কেন?’

শুভর কথায় বুড়ি সত্যি চিল্লিয়ে উঠলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

‘আইয়া পরছে ছেমরির চামচা। জীবনে আমগো লিগা একটা কথা কয় নাই। এই ছেমরিরে কিছু কইলে দৌড় পাইরা আহে। ঐ ছেমরা কে বুড়ি হ্যাঁ?’

‘কেডায় আবার তুমি? সত্তর বছরের মহিলারে বুড়ি কমু না তো কচি খুকি কমু নাকি?’

‘তোর থিকা এহনো ভালা শক্তি আছে আমার। বাপের ঘাড়ে বইয়া বইয়া খায়। আবার মুখে চটাং চটাং কতা।’

‘খবরদার, কথাবার্তা সাবধানে কইয়ো। আমি কারো ঘাড়ে বইয়া খাই না। দুইডা ক্লাব চালাই আমি। আমগো ক্লাব থিকা প্রতিদিন কাবাডি, কেরাম বোর্ড, ক্রিকেট, ফুটবল খেলা হয়। ঐডা থিকা আমি বইয়া বইয়া যা আয় করি তোমার বড় পোলা হারা মাস দৌড়ায় তা আয় করতে পারে না।’

সুফিয়া বিবি চুপ হয়ে গেলো। শুভর কথা মিথ্যে নয়। তার আময় রোজগারের প্রধান উৎস ক্লাব। তাদের ক্লাবের খ্যাতি দশ গ্রামে আছে। থাকতেই হবে। দায়িত্ব যে শুভর হাতে৷ শুভ যেই দায়িত্ব নেয় তার যথাযথ মর্যাদা রাখে। গ্রামের মানুষের কাছে বাউণ্ডুলে পরিচিতি পেলেও এলাকার ছোকরাদের কাছে খেলার বিষয় শুভ আদর্শ।

‘কি কইলাম হুনোস নাই? কলস ভইরা পানি আইনা রাখিস আমি গোসল করুম।’

সুফিয়া বিবির কথায় শুভর ললাট কুঞ্চিত হয়ে এলো। এক পলক ফুলের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বললো,

‘ও পানি আনবো কেন? তুমি গোসল করবা তুমি পানি আনবা। আনতে না পারলে পুকুর থিকা গোসল কইরা আইবা। না পারলে বুড়ি রংতামাশা করবা না। কলসে দড়ি বাইন্ধা পুকুরে ডুইবো। আমরা বাঁইচা যাই তাইলে। ঢং এর পেচাল লইয়া আইছে। এতোদিন কলের পানি দিয়া গোসল করছে। এহন ঢং কইরা আবার পুকুরের পানি লাগবো। বুড়া বয়সে কলা করে।’

সুফিয়া বিবি হুংকার দিয়ে উঠতে চেয়েছিলো। তার আগেই অভির আগমন।

‘কি হচ্ছে এখানে?’

‘তোরে কমু কেন?’
শুভর ত্যাড়া উত্তর।

‘তোরে কিছু জিজ্ঞেস করিনি আমি। দাদী তুমি বলো কি হয়েছে?’

সুফিয়া বিবি সমর্থন পাওয়ার মানুষ পেয়ে মিছে কান্না শুরু করলো। সব শুনে অভি বললো,

‘তুই কাজটা ঠিক করিসনি। ক্ষমা চা, দাদীর কাছে।’

‘ঠিক ভুলের হিসাব আমি তোর থিকা নিমু না। তোর যদি দরদ উথলায় পরে তুই নিজেই ক্ষমা চা।’

ফুলের হাত টেনে বেরিয়ে গেলো শুভ। অভি, সুফিয়া বিবি রাগে গজগজ করতে লাগলো। সেদিকে তোয়াক্কা করলো না শুভ।

‘দেখছোত, দেখছোত! কি বেদ্দব। আমার মনে হয় এডা তোর ভাই না।’

‘আমারো তাই মনে হয় দাদী।’

শুভ ফুলের হাত ছাড়লো নিজের রুমে এসে। ফুলের মন খারাপ থাকায় কোন কিছু বলেনি। তার বলতে ইচ্ছে করেনি।

‘এরপরের থিকা হুদাহুদি চোখে পানি দেখলে আছাড় দিয়া পেটি গাইল্লা ফালামু। চুপ কইরা হেনে বয়। আমি আইতাছি।’

শুভ বেরিয়ে গেলো। ফুল বিস্মিত হয়ে শুভর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। শুভ কি করে বুঝলো সে কাদছিলো? একেই কি বলে ভালোবাসার মানুষের যত্ন? দ্বিধা দ্বন্দের দেয়ালে আবারো আটকে পরলো ফুল।

‘তুই আজকাল বড়সড় মানবি না?’

‘মানছিলাম কবে?’

‘শুভ, আমি তোর মা। আমার লগে ত্যাড়া উত্তর দিবি না।’

‘আমি ত্যাড়া উত্তর দেই না। আমার কথার ধরণ এমন। উচিত কথা কারো ভালো লাগবো না এডাই স্বাভাবিক।’

ছেলের গালে কষিয়ে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সোহেলী বেগম। এতে মনে মনে ভীষণ খুশি হলো সুফিয়া বিবি ও অভি। ঝুমুর চমকে উঠলো। সুফিয়া বিবি গলা ঝেড়ে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

‘আরো দুইটা দে। ছোড বেলা থিকা যদি এমনি মারতি তাইলে আজকে আমগো মুখে মুখে কথা কওনের সাহস পাইতো না।’

‘বড়-ছোট কাউকে মানে না। আমি যে ওর বড় ভাই জীবনে স্বীকার করছে? মুখে যা আসে তাই বলবো।’

অভি আক্রোশ নিয়ে বললো। শুভ চোখ লাল করে সুফিয়া বিবি, অভির দিকে তাকালো। কপালের রগ রাগে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। দাঁত দাঁত চেপে রাগ সংবরনের বৃথা চেষ্টা অবহ্যত রেখেছে। এই মুহুর্তে তার মা না থাকলে খুনাখুনি হয়ে যেতো। সোহেলী বেগম আবারো রাগী গলায় বললেন,

‘অপয়া মাইয়ার লিগা দরদ বাইয়া চাইয়া পরে। নিজের দাদী, ভাইয়েরে অপমান করতে পিছপা হয় না। মায়ের মুখে মুখে কথা কয়। ঐ মুখপুড়ি এডিই শিখাইতাছে। মা আছিলো কামের বেডির মাইয়া। এগুলি ছাড়া কি শিখাইবো?’

‘মা, মানা করছি ওর মা কে নিয়ে আজেবাজে কথা কইবা না। ওর বাপ কিন্তু এই বংশের পোলা। ও এই বংশের মাইয়া। ওর মা কি আছিলো ঐডা নিয়া ওরে কথা হুনাও কেন?’

‘আবারো দরদ দেহাস? কি জাদু করছে তোরে? নাকি মন্ত্র পরা জল খাওয়াইছে। সারাদিন ফুল, ফুল কইয়া নাম জপোছ।’

শুভ হাত মুঠ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। এরপর আঙুল উঠিয়ে শাসিয়ে বললো,

‘ওর নামে যে উল্টাপাল্টা কথা কইবো কাউরে আমি ছাইড়া কথা কমু না। হোক সে আমার বাপ, মা, দাদী কিংবা ভাই।’

হনহন করে বেরিয়ে গেলো বসার ঘর থেকে। যাওয়ার আগে কাঠের দু পাটের দরজাটাকে জোরে লাথি মারতে ভুললো না। সোহেলী বেগম হা করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন কিছু আশা করেনি সে।

ঝুমুর চুপিসারে ওপরের তলায় উঠে গেলো। ফুল তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পা টিপে ভেতরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে ফেললো। ফুলের কাছে গিয়ে গা ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো।

‘ফুল, ফুল উডো। এদিকে বহুত কাহিনি হইয়া গেছে।’

‘হু!’

ঘুমন্ত অবস্থায় ফুলের উত্তর শুনে নিরাশ হলো ঝুমুর। পূর্বের তুলনায় আরো বেশি জোরে ধাক্কা মারলো। আচানক এমন হওয়ায় ফুল হকচকিয়ে উঠে বসলো। সামনে ঝুমুরকে দেখে বুকে ফুঁ দিয়ে বললো,

‘কি হয়েছে ঝুমুর আপা?’

‘তুমি পইরা পইরা ঘুমাইতাছো? ঐদিকে বহুত ঘটনা ঘইটা গেছে।’

ফুলের চোখের ঘুম উবে গেছে। নড়েচড়ে বসে চোখ দুটো বড় করে বললো,

‘কি ঘটনা?’

ঝুমুর একে একে সব খুলে বললো। সব শুনে ফুল থুম মেরে বসে রইলো। শুভ থাপ্পড় খেয়েছে শুনে তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ঝুমুর আশেপাশে চোরা দৃষ্টি দিয়ে সাবধানী গলায় বললো,

‘তুমি আইজ ঘরের থিকা বাইর হইয়ো না। তোমারে দেখলে চাচী আরো চেতবো। তহন রাগে মারতেও পারে। আমি তোমার সব কাম কইরা দিমুনে।’

ঝুমুর এক বিন্দুও ভুল বলেনি। সোহেলী বেগম আসলেই ফুলের ওপর সকল ঝাঁঝ উঠাবে।কৃতজ্ঞতায় ফুলের চোখ ভিজে উঠলো। হাসি দিয়ে ঝুমুরের হাত দুটো নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে ফেললো।

“একদিন তোমায় না দেখিলে,
তোমার মুখের কথায় না শুনিলে
পরাণ আমার রয় না পরাণে।”

পড়ন্ত বিকেল। মিষ্টি রোদের লুকোচুরি খেলা। রেডিওতে গান বাজছে। আনোয়ার সর্দার চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। কোলের ওপর উপন্যাসের বই। অবসর সময়ে বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন। রেডিও এর যুগ যদিও চলে যাওয়ার পথে। বাজারে সাদা কালো টিভিকে ছাড়িয়ে রঙিন টিভি জায়গা করে নিয়েছে। তবুও পুরনো রেডিও এর মায়া ছাড়তে পারেননি তিনি।

সোহেলী বেগম একবার উঁকি দিয়ে গিয়েছিলেন। স্বামী চোখ বন্ধ করে আছে দেখে ঘুমিয়ে রয়েছে ভেবেছেন। তাই এমুখো হোননি। হলে ফুলের নাম কালারিং করে যেতেন। শুভ ফুলের নাম নেয় দেখে ফুলের প্রতি আরো বেশি ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার। সেই ক্ষোভ সবাইকে জানাতে উঠেপড়ে লেগেছে।

সোহেলি বেগম যেতেই চোখ খুললেন আনোয়ার সর্দার। স্ত্রীর হাঁটার গতি চিনেন। সে যে কোন বাহানায় ফুলের নামে যা-তা বলতে এসেছিলো তাও টের পেয়েছেন। চেয়ারম্যান তো এমনি এমনি হননি। কার মতিগতি কেমন চোখ, মুখ দেখে বলে দিতে পারেন। স্ত্রীর সাথে চালাকিতে জিততে পেরে মুচকি হেসে আবারো চোখ বুজলেন আনোয়ার সর্দার। এবার মৌনতায় ব্যাঘাত ঘটালো রমিজ মিয়া। দরজা দিয়ে ঢুকে মাথা নিচু করে বললো,

‘চেয়ারম্যান সাব কি ঘুমাইছেন?’

নীরবতায় ঘাটা পরায় চোখ কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে চোখ মেললেন।

‘কিছু কবি?’

‘হো চেয়ারম্যান সাব।’

হাত দিয়ে রেডিও বন্ধ করে উত্তর দিলো,
‘যা কওনের কইয়া ফালা।’

‘আপনের লগে একজন দেহা করতে আইছে।’

‘কে?’

‘কইতে পারতাছি না। বাড়িত আইলো না। বাইরে দাঁড়ায় রইছে। কইলো অনেক দরকার। এহনোই যাইতে।’

‘আমগো গেরামের কেউ হইলে পরে আইতে ক। আজকে কোন কাম করতে মন চাইতাছে না।’

‘আমগো গেরামের না। আগেও দেহিও নাই। কইলো অন্য হেরাম থিকা আইছে।’

চিন্তায় কপাল কুঁচকে গেলো আনোয়ার সর্দারের। কে হতে পারে? অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আরামের চেয়ার থেকে উঠে পরলেন। রমিজ মিয়াকে যেতে বলে ধীরেসুস্থে বাইরের পথ ধরলেন।

[আপনাদেরকে বলেছি আমি অসুস্থ। তাই এতো অনিয়মিত হচ্ছে। এতটুকু লিখতে পারছি তাই ঢেঢ়। কেউ ছোট বলে অভিযোগ করবেন না।]

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here