#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_23
#Writer_NOVA
দুপুরের কাঠফাটা রোদে ছাতা মাথায় এক আগন্তুকের দেখা মিললো। ঝুমুর তখন উঠোন ঝাঁট দিয়ে কলপাড়ের বালতিতে পানি ভরছে। সে এসেই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘চেয়ারম্যান সাহেব বাড়ি আছেন?’
ঝুমুর ওড়নার গিট খুলতে খুলতে লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালো। কচ্ছপের মতো মাথা বের করে উত্তর দিলো,
‘না, চাচায় বাড়িত না। একটু পর আইয়া পরবো।’
‘ওহ, আমাকে একটু পানি দিতে পারবেন মা? তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো লোকটা। মা ডাক শুনে ঝুমুর আবেগে আপ্লূত হয়ে গেলো। চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠলো। ভেজা গলায় উত্তর দিলো,
‘খাড়ান দিতাছি। ভেতরে আইয়া বহেন।’
‘না মা, আমি এখানেই ঠিক আছি।’
ফের মা ডাক শুনে চোখের কোণ মুছে ভালো করে তাকালো। চেহারাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। কার সাথে যেনো মিল। কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। এরপর দৌড়ে পানি আনতে চলে গেলো।
পানির মগ হাতে ফেরার পথে ফুলের সাথে দেখা। ফুল সদ্য গোসল সেরে জামা-কাপড়ে ধুয়ে গোসলখানা থেকে বেরিয়েছে।
‘পানি নিয়ে কোথায় যাও ঝুমুর আপা?’
‘ওহ ফুল তুমি! আমি তোমারেই খুজতেছিলাম।’
‘কেন?’
‘বাইরে একটা লোক আইয়া খাড়ায়া রইছে। চাচারে খুজতাছে।’
‘কত মানুষ তো খুঁজে।’
‘হো, তয় হের চেহারা না আমি কার লগে জানি মিল পাই। তুমি একটু আহো তো দেহো কে।’
‘চলো।’
ঠোঁট দুটো বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই আরেকবার জিহ্বা দিয়ে চেটে ভিজিয়ে নিলো। ততক্ষণে ঝুমুর মগ হাতো হাজির।
‘পানি এনেছো মা?’
‘এই যে নেন।’
এক নিঃশ্বাসে মগের সবটুকু পানি শেষ করে দিলো। আড়াল থেকে ফুল সবটাই লক্ষ্য করছিলো। ঝুমুর সামনে থেকে সরতেই লোকটার মুখমণ্ডল ফুলের চোখে পরলো। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে অভিমানি গলায় বললো,
‘আব্বাজান তুমি আসছো?’
বসার ঘরে মনোয়ার সর্দারকে নিয়ে ছোটখাটো জটলা বেঁধে গেছে। সুফিয়া বিবি এখনো ছেলেকে ধরে গুনগুন করে কাঁদছে। ফুল বাবার সাথে অনেকটা লেপ্টে আছে। সোহেলী বেগমের মুখ ভার। অভি, আনোয়ার সর্দারের ভাবভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না। নীরবতা প্রথমে আনোয়ার সর্দার ভাঙলেন।
‘একা আসছোত কেন? ফুলের মা রে ছোট ভাতিজী দুইডারে লইয়া আইতি। কয়েকদিন বেড়ায় যাইতো নে। ওরা তো জন্মের পর একবারও আহে নাই।’
সোহেলী বেগম উত্তর দেওয়ার আগেই সুফিয়া বিবি তেতিয়ে উঠলেন।
‘ঐ ছেমরি এই বাড়িতে ঢুকতে পারবো না। আমি ওরে মাইনা নিমু না। গত তেইশটা বছর আমার পোলারে আমার থিকা আলাদা কইরা রাখছে। ওর এই বাড়িতে কোন জায়গা নেই।’
শাশুড়ীর উত্তরে মনে মনে খুশি হলেন সোহেলী বেগম। তবে বেশিখন সেই খুশি স্থায়ী হলো না। আনোয়ার সর্দার বললেন,
‘তোমার পোলাও তো সমান দোষ করছে৷ তারে জড়ায় ধইরা বইয়া রইছো কেন? পরের মাইয়ার ওপর সব দোষ দিতে পারলেই বাইচা যাও।’
অভি বাপের কথার পিঠে বললো,
‘এসব কথা এখন না তুললে কি হতো না?’
‘তোর দাদীরে জিগা।’
রাগত্ব স্বরে উত্তর দিলো আনোয়ার সর্দার। মনোয়ার সর্দার একদম চুপচাপ। বহুদিন পর বাচ্চা ছেলে মায়ের সন্নিধি পেলে যেমন চুপ করে মায়ের গায়ের উষ্ণতা নেয়। সে তেমন নিচ্ছে। এসব ঝামেলায় কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই।
‘হুহ, ঢং দেইখা বাঁচি না। আম্মা আপনেও পারেন। এহন তো ঠিকই পেলারে কাছে টাইনা নিলেন। অন্য সময় তো আমার ছোড পোলার লগে লাইগা থাকেন। বুঝলেন তো পোলার অভাবটা।’
সোহেলী বেগম আক্রোশের সহিত বললো। আনোয়ার সর্দার ধমক দিয়ে বললেন,
‘চুপ করো। আগুন নিভতাছে নিভতে দাও। আর ঘি ঢাইলো না।’
‘মা, দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখো।’
‘আমি তো বন্ধই রাখছি অভি। তয় মাঝে মাঝে কিছু কথা মুখ ফসকে বাইর হইয়া যায়।’
‘আহ, থাক না সেসব কথা।’
‘তোর মা কে বলেও লাভ নেই।’
চোখ লাল করে উত্তর দিলো আনোয়ার সর্দার। এতোকিছুর মধ্যে ভাবান্তর নেই শুধু ফুলের মধ্যে। সে পা দিয়ে মনোযোগ সহকারে মেঝে খুটছে। সুফিয়া বিবি তাড়া দিয়ে বললেন,
‘ঝুমুর কই? ওরে ডাইকা ভাত দিতে ক। আমার পোলাডা কতদূর থিকা আইছে। নিশ্চয়ই খিদা লাগছে।’
সোহেলী বেগম গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,
‘ঝুমুর খাওন বাড়।’
আনোয়ার সর্দার এগিয়ে এসে ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘এই হানে বইয়া থাকলে হইবো? বাপে আইছে তার খাওন দাওনের বেবস্থা করতে হইবো না?’
ফুল মাথা ঝাকালো। এরপর দ্রুত উঠে খাবারের কামরার দিকে ছুটলো। কত কাজ তার বাকি। সবার খাবার বেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো তারই।
বিকেলে মনোয়ার সর্দার চলে যেতে চাইলেও যেতে পারলো না। সুফিয়া বিবি কিছুতেই ছেলেকে যেতে দিবে না। রাতটুকু থাকতেই হবে৷ মা কে নারাজ করতে মন চাইলো না মনোয়ার সর্দারের। তাছাড়া বড় ভাইয়ের সাথে কথার দরকার আছে। তাই জোড়াজুড়িতে রয়ে গেলো। ছেলের জন্য পিঠে তৈরি করবেন সুফিয়া বিবি নিজের হাতে৷ তাই রমিজ মিয়াকে গোয়ালাদের থেকে তাজা দুধ আনালেন। তা দেখে সোহেলী বেগম জিজ্ঞেস করলো,
‘দুধ দিয়া কি করবেন আম্মা?’
‘দুধের পুরের পাটিসাপটা পিঠে মনোয়ার অনেক পছন্দ। তাই ভাবলাম ওরে দুইডা পাটিসাপটা বানায় দেই। আবার কবে না কবে দেহা হয়। তহন বাইচা থাকি কিনা তাও সন্দেহ।’
শাশুড়ীর কথা শুনে বিস্ময়ে সোহেলী বেগমের মুখ হা হয়ে গেলো। যেই মানুষ কখনও চুলোর সামনে ভিড়ে না। সে আজ নিজের হাতে পিঠে বানাবে। এই বুঝি মায়ের ভালোবাসা। পৃথিবীর সবাই রাগ করে থাকতে পারলেও মা কখনো সন্তানের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। ঝুমুর অদূরে বসে আতপ চাল পাটায় বাটছে। ফুল বসে বসে দুধ জ্বাল দিচ্ছিলো। খুন্তি দিয়ে বারবার নেড়ে দিচ্ছে। যাতে নিচে লেগে না যায়। দাদির কথা শুনে এই প্রথম ফুলের মনে হলো দাদীকে সে যতটা খারাপ মনে করে ততটা খারাপ সে নয়। সুফিয়া বিবি আজ খোশ মেজাজে আছেন। নাতনিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা শাসনের সুরে বললেন,
‘এমনে চাইয়ানা থাইকা চটি (খুন্তি) চালা। নয়তো দুধ উতলায় পইরা যাইবো।’
ফুল মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। অন্য দিকে ঝুমুর তো বিস্ময়ে হতভম্ব। আজ যেনো নতুন কোন মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখছে। মুখ ফসকে বলেই ফেললো,
‘তুমি আসলেই আমগো দাদী তো?’
সুফিয়া বিবি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘চুপচাপ হাত চালা। বেশি কথা কয়।’
বসার কামরায় বসে গল্প করছিলো অভি, মনোয়ার সর্দার। ঠিক গল্প নয়। ভাব জমানোর প্রচেষ্টা আরকি। আনোয়ার সর্দার ভেতরে এসে অভিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘তুই একটু বাইরে যা তো।’
‘কেন আব্বা?’
‘তোর চাচার লগে আমার কথা আছে।’
‘যা বলা আমার সামনে বলো।’
‘তোর সামনে কইলে কি তোরে বাইরে যাইতে কই।’
‘কি এমন কথা যা আমার সামনে বলা যায় না?’
‘অভি!’
ধমকে উঠলেন আনোয়ার সর্দার। অভি মুখ কালো করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। অভি বের হতেই মুখ খুললো মনোয়ার সর্দার।
‘আমি এসেছিলাম ফুলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে।’
‘অন্য কোনহানে বিয়া ঠিক করছোত নাকি।’
‘না, তবে সম্বন্ধ দেখতেছি। ভালো ছেলে পেলে চুপিসারে বিয়েটা সেরে ফেলবো।’
‘আমিন জানলে কি করবো তার ধারণা আছে তোর?’
‘হুম আছে। কিন্তু আমি আমার মেয়েটার জীবন ঐ নরপশুর হাতে তুলে দিতে পারি না।’
‘ফুল কোনহানে যাইবো না। ওরে আমার বাড়ির বউ কইরা রাইখা দিমু।’
চকিতে তাকালো মনোয়ার সর্দার। অবাক জিজ্ঞেস করলো,
‘কিন্তু কিভাবে? আমি তো অভির হাতে ওকে তুলে দিবো না। একবার আমার মেয়েকে অসম্মান করেছে। দ্বিতীয়বার একই কাজ হোক আমি চাই না।’
অভির লিগা ওরে নিমুও না। আমি ভাবতেছি শুভর লিগা ফুল মারে বউ করমু। বিশ্বাস কর তোর মেয়ে আমার কাছে অনেক ভালো থাকবো। আমার ছোড পোলায় একটু উগ্র স্বভাবের। কিন্তু মনডা পরিষ্কার। মনে যা থাকে মুখে তাই বইলা ফেলে। তুই জাইনা অবাক হবি। শুভ ফুলের কথা ছাড়া আর কারো কথা হুনে না। ওরে যদি কেউ মানুষ করতে পারে হেইডা একমাত্র ফুল মা।’
‘কিন্তু আমি তো…..’
ভাইকে থামিয়ে দিয়ে আনোয়ার সর্দার বললেন,
‘তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি গেরান্টি দিতাছি। তোর মাইয়া শুভর সাথে ভালো থাকবো৷ আর আমিনের লগে মোকাবিলা একমাত্র শুভই করতে পারবো৷ তুই অমত করিস না। তুই মত দিলে এই মাসেই ওগো বিয়াডা দিয়া দিমু। আমি বেশি দেরী করতে চাইতাছি না।’
‘দেখি তাহলে। আমি একা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। ফুলের মা কে সব বলে তার মতামত নেওয়া উচিত।’
‘যা মত নেওয়ার তাড়াতাড়ি নিস। দেরী হইলে সর্বনাশ হইয়া যাইতে পারে।’
আড়াল থেকে সব শুনে বুক ধ্বক করে উঠলো ফুলের। সে এসেছিলো বাপ-চাচাকে পাটিসাপটা পিঠে দিতে। এখন লজ্জায় সে সামনে এগুতে পারছে না।
‘কিরে কইতরির মা, হেনে কি করোস?’
শুভর গলা শুনে ফুল চমকে উঠলো। লজ্জায় ওড়নাটা দাঁত দিয়ে কামড়ে সেখান থেকে পালালো। ফুলের লাজুক ভঙ্গি দেখে শুভ আহাম্মক বনে গেলো। বিড়বিড় করে বললো,
‘এই কইতরির মায়ের আবার কি হলো?’
বসার রুমের ভেতরে ঢুকে বাপকে উদ্দেশ্য করে শুভ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
‘শুনলাম, ছোট কাকায় আইছে।’
‘তুই কি করে জানলি?’
‘সারা গেরামের খবর আমার কাছে থাকে। আর নিজের বাড়ির খবর থাকবো না? শুভ সব খবর রাখে। কাকায় যে দুপুরবেলা আইছে আর রাইতে থাকবো এডাও আমার অজানা নয়।’
মনোয়ার সর্দার প্রশংসার গলায় বললো,
‘ভালো খবর রাখছিস দেখছি।’
‘আসসালামু আলাইকুম কাকা। কেমন আছেন?’
এগিয়ে গিয়ে মনোয়ার সর্দারকে জড়িয়ে ধরলো শুভ। মনোয়ার সর্দার সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। তুই কেমন আছিস? ওমা! কতবড় হয়ে গেছিস। সেই ছোট দেখেছিলাম।’
চাচার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শুভ উত্তর দিলো।
‘এহন কি আর ছোড আছি কাকা? দুদিন পর আপনের মাইয়ারে বিয়া করমু।’
মনোয়ার সর্দার অবাক হয়ে আনোয়ার সর্দারের দিকে তাকালো। আনোয়ার সর্দার মাথা নাড়ালেন। যার অর্থ সে কিছু জানে না। শুভ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বললো,
‘যা কওনের আমি সামনাসামনি কই। আগে-পিছে আমার কোন কথা নেই। আপনের মাইডারে আমার ভীষণ পছন্দ হইছে কাকা। বিয়ে করলে ওরেই করমু। এহন আপনের মাইডারে কি সসম্মানে আমার হাতে তুইল্লা দিবেন কিনা সেটা আপনের ইচ্ছা। তা না হইলে আপনের মতো আপনের মাইডারে নিয়া আমি পালামু। এহন কি করবেন আপনেই সিদ্ধান্ত নেন।’
আনোয়ার সর্দার ধমকে উঠলেন,
‘লজ্জা শরমের মাথা কি খাইছোত নাকি?’
শুভ একটু ভাবার ভঙ্গি করে বললো,
‘আমার লজ্জা শরম আছিলো কবে? যাইহোক, কাকা যাকইলাম মনে রাইখেন। খাওনের সময় আবার দেহা হইবো।’
বসার রুম ছেড়ে “কইতরির মা” বলে ডাকতে ডাকতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো শুভ। তার এখন ফুলকে প্রয়োজন। দুই ভাই হতবিহ্বল হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। মনোয়ার সর্দার চোখ গোল গোল করে বললো,
‘প্রস্তাব দিলো নাকি হুমকি দিলো বুঝলাম না।’
‘দুটোই দিছে। একেবারে তোর পদ হইছে। তুই তো এমনি করতি।’
আনোয়ার সর্দারের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো মনোয়ার সর্দার। ভাইয়ের চোখ পাকানো দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন চেয়ারম্যান।
[আমার মোবাইল নষ্ট হয়ে গেছে। আগে এই এক পর্ব লিখে ফেসবুকে সেভ করে রেখেছিলাম। তাই ছোট বোনের মোবাইল দিয়ে পোস্ট করতে পেরেছি। এরপর আবার কবে গল্প দিতে পারবো জানি না।]
#চলবে