কোন_এক_শ্রাবণে❤ পর্ব ২১+২২

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২১

সোমবারের সেই অলস বিকালে হুট করেই ঘটে গেলো এক অদ্ভুত ঘটনা।
নিজের মা-বাবা সমেত সরাসরি তোহার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে অনন্ত।বড় মেয়ের শশুরবাড়ির মানুষ দেখে তাদেরকে মুখের উপর না ও বলতে পারছেনা তোহার বাবা আরমান সাহেব।অগত্যা বসার ঘরে বসানো হয়েছে তাদের।নাস্তার ব্যবস্থা করে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে।
চরম অনিচ্ছা সত্তেও মায়ের কড়া আদেশে গায়ে কালো রংয়ের শাড়ি জড়িয়ে তৈরি হয়েছে তোহা।জেদের বসে মুখে কোনরকম প্রসাধনী না মেখেই বের হয়ে এসেছে সে।তবে বড়দের সামনে বেয়াদবি করার পারিবারিক শিক্ষা তার নেই।তাই যথেষ্ট বিনয়ের সহিত অনন্তের বাবা-মা কে সালাম দিয়ে বাবার পাশে বসলো সে।
অনন্তর জ্বলজ্বল করা লোভাতুর দৃষ্টির বিপরীতে লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছেনা তোহা।ড্রইংরুম জুড়ে একটা ভ্যাপসা পরিবেশ।অনন্তর মা আগ বাড়িয়ে বললো,
—“দেখুন ভাই,আপনার মেয়েকে তো আমার আগে থেকেই পছন্দ।নিশার বিয়ের সময়ই মনে গেঁথে ছিলো অনন্তর জন্য।এখন ছেলেরও যখন পছন্দ তাই আর কোনো সমস্যা দেখছিনা।তাইনা?”

বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আরমান সাহেবের।নিশার বিয়ের সময়তো মহিলার মুখ দিয়ে মধু ঝরতো।হঠাৎ ভাবনা এলো..আচ্ছা,তার বড় মেয়েটা আদৌ শান্তিতে আছেতো ওই বাড়িতে?
বিরক্ত হলেও মুখে হাসি নিয়ে যথেষ্ট সাবলিলভাবে উওর দিলেন উনি,
—“দেখুন আমার কাছে আমার মেয়ের মতামতই শিরধার্য।তাছাড়া আমার ছোট মেয়ে তোহা।এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ের কথা আমি তেমন ভাবছিনা।”

—“আমরাও তো বলিনি এখনই বিয়ে হচ্ছে।শুধু আংটি টা পরিয়ে রাখি।পরে যখন আপনাদের ইচ্ছা হয় তখন নাহয় কাবিন হলো।তাছাড়া আপনাদের আরেক মেয়েও তো আমাদের বাড়িতেই আছে।”

আরমান সাহেব হাসিমুখে মাথা নাড়ালেন শুধু।এই অপ্রস্তুত পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।ওনাদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে ওনারা সাথে আংটি নিয়েই এসেছেন।ঠান্ডা মাথায় কিছুক্ষণ ভাবলেন উনি।কোনোক্রমেই খারাপ ব্যবহার করা যাবেনা।এর প্রভাব তার বড় মেয়ের সংসারে পরতে পারে।আবার বড় মেয়ের জন্য তার ছোট মেয়ের উপরও কিছু চাপিয়ে দিতে পারেননা উনি।মাথা এলোমেলো লাগছে।প্রেসার বোধহয় বেড়ে যাচ্ছে।
____________________
বারান্দায় মৃদু মৃদু হাওয়া।চুলগুলো হাল্কা উড়ছে তোহার।সেগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতেই কাঁচের চুড়িতে রিনঝিন আওয়াজে পরিবেশ সচল হয়ে উঠলো।চুড়িগুলো তিহানের দেয়া।কানের দুলজোড়াও তিহানের দেয়া।শাড়িটাও তিহানের দেয়া উপহার।এগুলো পরে অনন্তের সামনে দাড়াতেই একটা অজানা অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তোহাকে।
অনন্তর সংস্পর্শে থাকাটাই দমবন্ধকর লাগছে।

—“অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে তোহা।”

কেন যেন প্রশংসা টাও তেঁতো ঠেকলো তোহার।নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলো সে।কোনরকম উওর দিলোনা।
তাকে চুপ থাকতে দেখে কয়েককদম এগিয়ে এলো অনন্ত।তোহার সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে নিজের থুতনিতে হাত রেখে বললো,
—“ইউ আর সাচ্ আ বিউটি।”বলে আচমকাই তোহার শাড়ি গলিয়ে উন্মুক্ত কোমড়ে হাত চালিয়ে দিলো অনন্ত।মুহুর্তেই এক বাজে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে চলে গেলো তোহার কিশোরী মন।ছিঁটকে সরে যেতে চাইলেও অনন্তর বেষ্টনী থেকে মুক্ত হতে পারলোনা সে।ঠিক সেই মূহুর্তে তিহানের সেদিনের কথাগুলো মনে পরতেই একটা আলাদা শক্তি চলে এলো তোহার মনে।শক্তহাতে অনন্তর হাতটা ঝামটা মেরে সরিয়ে দৃঢ় কন্ঠে সে বললো,

—“গায়ে হাত দিবেন না।”

অনন্ত হাসলো।বিশ্রি সেই হাসি।বললো,
—“তোমার সাথে তো আমারই বিয়ে হবে তোহা।এতো লজ্জার কি আছে?”

—“বিয়ে হয়নি এখনো।আমি না”বললে বাবা কখনো জোর করবে না।”

মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো অনন্তর।কটমট করে সে বললো,
—“তারমানে তুমি “না” করবে?নিজের বড়বোনের সংসারের কথা ভাববেনা?”

আর শুনলেনা তোহা।একছুটে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো।
________________
তোহাকে এহেন সাজসজ্জায় দেখে বসার ঘরের এককোণে বজ্রহতের ন্যায় আহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তিহান।একবার তার চোখের দিকে তাকালো তোহা।রক্তলাল ভয়ঙ্কর চোখজোড়া দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো মন।তন্মধ্য একটা কথাও বের হলোনা তার মুখ থেকে।

অনন্তের বাবা-মাকে বেশ বুদ্ধিমানের ন্যায় সামাল দিচ্ছে আরমান সাহেব।ঠান্ডা মাথায় তাদেরকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করেছে।
তারা চলে যেতেই জামাকাপড় না বদলেই আফিয়ার সাথে তাদের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে তোহা।
তাদের বসার ঘরে বসতেই আফিয়া যেয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিলো তাকে।ঢকঢক করে সেটা গিলে নিতেই মেইন দরজা দিয়ে তিহানকে ঢুকতে দেখতে পেলো সে।থমথমে চেহারা তার।আফিয়া তখন তোহার মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।মেয়েটার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে আজ।

তোহা পানির গ্লাসটা সামনে টেবিলের উপর রাখতেই তুমুল গতিতে দরজা লাগানোর শব্দ কানে এলো।কাঁচের টেবিলের উপর গ্লাসটা হাল্কা একটু কেঁপে উঠলো বোধহয়।হতভম্ব দৃষ্টি তিহানের রুমের দরজার দিকে চোখ যায় তোহার।আফিয়া হতাশ শ্বাস ছাড়ে।ছেলের রাগের কারণ অজানা নয় তার।

তিহানের সাথে কথা বলার জন্য মন উশখুশ করছে তোহার।আফিয়া বুঝতে পারে তোহার অস্থিরতা।পানির গ্লাসটা নিয়ে পাশ থেকে উঠে সে বলে,
—“রান্নাঘরে একটু কাজ আছে মা।তুই বস আমি আসছি।”

তোহা মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললে,”আচ্ছা খালামনি।”
আফিয়া চলে যেতেই উঠে দাড়ালো তোহা।ধীরপায়ে তিহানের রুমের দরজা খুলতেই একরাশ কালো অন্ধকারে দৃষ্টি ডুবে গেলো তার।নক করলোনা সে।অন্ধকারেই ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দেয়াল হাঁতরে মৃদু আলোর নীল লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো।তিহান উল্টো হয়ে ঘুমোচ্ছে।ফর্সা পিঠ উপরদিকে।
তবে তোহা জানে সে ঘুমোচ্ছেনা।অতি রাগে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে শুধু।সে কাছাকাছি যেয়ে পিঠের উপর আলতো করে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে ডাকলো,
—“তিহান ভাই”

উওর দিলোনা তিহান।তোহা আবার ডাকলো,
—“তিহান ভাই,আপনি…”

—“এখান থেকে যা তিহু।এখনি যা।”শক্ত কাঠকাঠ কন্ঠে বললো তিহান।

তোহা পিঠের উপর রাখা হাতটা এগিয়ে তিহানের গালে রাখলো।অপরাধী মিনমিনে কন্ঠে বললো,
—“আপনি ভুল বুঝছেন তিহান ভাই।”

শক্ত করে ধরে গাল থেকে তার হাতটা সরিয়ে দিলো তিহান।একটু লজ্জা পেলো তোহা।তিহান চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই বললো,
—“তোকে ভুল বা ঠি ক বোঝার অধিকার আমার নেই তিহু।অযথা কারো উপর অধিকার আমি ফলাই না।যা প্লিজ।”

গলা ভিজে এলো তোহার।সিক্ত কন্ঠে সে বললো,
—“তিহান ভাই,আমি কি করতাম বলেন?”

—“আমি কি তোকে কিছু বলেছি তিহু?অযথা মাথা ঘামাচ্ছিস কেনো?আমি এতো ইম্পোর্টেন্ট কেউ নই,তোর এত ভাবতে হবেনা।শান্তিতে থাক আমাকেও শান্তিতে থাকতে দে।”

উওরে দমে গেলোনা তোহা।তিহানের রাগের বশে বলা কথা গুলো কোনরকমে হজম করে নিলো।উপরন্তু শক্ত করে তিহানের বাহু আঁকড়ে ধরে বললো,
—“আপনি এতো রাগ করছেন কেনো?বিয়েতে তো আমি হ্যাঁ বলিনি।”

চোখ মেলে তাকালো তিহান।এতোক্ষনের চাপা রাগটা হঠাৎই নগ্ন ভাবে প্রকাশ হয়ে গেলো।তোহাকে একটানে বিছানার উপর ফেলে তার উপর চড়াও হলো সে।তোহা মূর্তির ন্যায় চেয়ে আছে।আকস্মিক ঘটনাটা মেনে নিতে পারেনি তার কিশোরী মন।
বুকে হাল্কা ধাক্কার আভাস পেতেই হিতাহিতজ্ঞান শুন্য তিহান বিছানায় হাতদুটো চেপে ধরলো তোহার।
রাগে কটমটে কন্ঠে বললো,
—“আমার অনুভূতির একরত্তি মূল্য নেই তোমার কাছে?আমার দেয়া ভালবাসার জিনিসগুলো পরে তুমি অন্যর সামনে নিজেকে প্রদর্শন করছো?তাও আবার এমন একটা ছেলের সামনে যে কিনা তোমাকে বিন্দুমাত্র সম্মান করেনা?যার চোখে শুধু মাত্র তোমার জন্য কামনাই আছে?তোমাকে সেদিন বলেছিলাম আমি,নিজের গুরুত্বটা বুঝো।তুমি অনেক বড় কিছু।অন্তত আমার কাছে।তোমার কি মনে হয়?বারান্দা থেকে আসার পর তোমার চেহারার অবস্থা দেখে কিছুই আঁচ করতে পারিনি আমি?এতোটা অধম না আমি।ও যে আজও তোমার সাথে আপত্তিকর কিছু করেছে তা বুঝতে একটা সেকেন্ডও লাগেনি আমার।তুমি কি পারতেনা খালুকে তখনই বলে দিতে?তখনই মুখের উপর তাদের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে?বলতে পারতেনা?বলো?কিন্তু তুমি কি করলে?তুমি চুপ ছিলে।কেনো চুপ ছিলে বলো?কেনো চুপ ছিলে?”

—“আমি তখন এসব বললে আমার বোনের সংসারে কি হত আপনি বুঝতে পারছেন?মাত্র বিয়ে হয়েছে ওর।অনন্তর বাবা-মা আদৌ তাকে শান্তিতে সংসার করতে দিতো?”রাগ দু:খে অভিমানে চোখের জল ছেড়ে দিলো তোহা।

—“আমি শুধু তোমারটা জানি।আর কার কি হলো সেটা আমার দেখার বিষয় না।গট ইট?”সজোরে চিল্লিয়ে কথাটা বলেই হাতের উপর চাপ দিলো তিহান।ফলস্বরুপ কয়েকটা চুড়ি ভেঙে তার হাতেই পাল্টা আঘাত করলো।বেরিয়ে এলো রক্ত।তোহার হাত অক্ষত।চুরি ভাঙার মটমট শব্দ হতেই তোহাকে ছেড়ে দিলো তিহান।জোরে শ্বাস ছেড়ে যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে বলল,

—“যাও,এখান থেকে যাও।আর আসবেনা আমার সামনে।”

উঠে গেলো তোহা।শাড়ির আচঁল সামলে বিছানা থেকে নেমে একদৌড়ে বেরিয়ে গেলো।সাথে করে নিয়ে গেলো এক সমুদ্র অভিমানের পাহাড়।সে বেরিয়ে যেতেই চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো তিহান।চুড়ির টুকরো গুলো পরে আছে মাঝখানটায়।সেগুলো হাতে নিয়ে মুচরে মুচরে আরো কয়েক টুকরো করলো তিহান।ঠোঁট কাঁপছে তার।চোখ জ্বালা করছে।নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে হঠাৎ করেই।
______________
সেদিন রাতটা কোনরকমে পার হলো তোহার।অসহ্য মানসিক যন্ত্রনায় ছটফট করলো সে।মস্তিষ্কে জট বাঁধানো হাজারো চিন্তায় রীতিমত মাথা ভনভন করতে শুরু হলো একপর্যায়ে।তবুও সে নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়েছিলো।
তবে পরের দিন সকালেই মাথাটা আবারো লন্ডভন্ড হয়ে গেলো তার।তাকে কলেজে নেয়ার জন্য তিহান আসেনি।
এতটুকু হলেও ঠি ক ছিলো কিন্তু প্রচন্ড অস্থির লাগাটা তখনই শুরু হলো যখন সারাদিনেও তিহানের দেখা মিললোনা।না নিজের বাসায় না তাদের বাসায়।লজ্জায় মুখ ফুটে খালামনির কাছে তিহানের খোঁজও নিতে পারলোনা তোহা।রাতের প্রায় দুটো পর্যন্ত বারান্দায় অপেক্ষা করেছে।সদর দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে।কিন্তু না তিহান ফিরেনি।তিহান নেই।তার আশেপাশে কোথাও নেই।
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২২

আধভাঙা মন নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে তোহা।ঘরের বাতি নিভানো।জানালায় ভারি পর্দা টেনে দেয়া।
ফলস্বরূপ দুপুরের সময় হওয়া সত্ত্বেও ঘরের আলোর ছিঁটেফোটাও নেই।বালিশে মুখ গুঁজে স্বশব্দে ফোঁপাচ্ছে তোহা।সেদিন তিহানের ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে তিহান কাঠ কাঠ কন্ঠে স্পষ্টভাষায় তাকে বলে দিয়েছিলো,”অনন্তের ব্যাপারটায় আমার কাছ থেকে কোনরকম এক্সপেক্টেশন রাখবানা।যা করার নিজে করতে পারলে করবা নয়তো না।কিন্তু এটা ভাববানা যে আমি খালুকে যেয়ে বলবো বা এরকম কিছু।”এতটুকু শোনার পর আর শোনেনি তোহা,ছুটে বেরিয়ে এসেছিলো।পুরো একটা দিন কেটে গেলো অথচ তিহান সত্যিই তার সাথে কোন কথা তো দুর সে তো চলেই গেছে কোথায় যেন।এতো রাগ কেনো?তার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা করলোনা তিহান?তার পরিস্থিতি,তার মনের কষ্টটা বুঝলোনা?আবারো হুহু করে উঠলো তোহা।
ব্যাথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে রীতিমত।

দুপুরের খাওয়া শেষে ধীরপায়ে বাবার রুমের দরজায় টোঁকা দিলো তোহা।মা এখন রুমে নেই,সে রান্নাঘরে।আরেকবার টোঁকা দিতেই ভেতর থেকে আরমান সাহেবের গম্ভীর কন্ঠের অনুমতি পেয়ে মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে জোরে একটা শ্বাস ছাড়লো তোহা।খাবার টেবিলে আরমান সাহেব বিয়ের ব্যাপারে তোহার মতামতের ব্যাপারে শুনতে চেয়েছিলেন তবে তোহা তখন কোনো উওর দেয়নি।চুপ করে ছিলো।
গুটিগুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করলো তোহা।দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়ালো।আরমান সাহেব বিছানায় বসে আছেন।তোহা এগিয়ে যেতেই তাকে হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন তিনি।কোনো কারণ ছাড়াই তার ছোট মেয়েটা তাকে ভয় পায়।কখনো সন্তানদের সাথে উচ্চস্বরে ধমকাধমকি করেননি তিনি।আর ছোট মেয়েকে তো আরো মাথায় তুলে রেখেছেন তবুও ছোট মেয়েটা তাকে ভয় পায়।মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেনা।
মেয়ে কিছু একটা বলতে এসেছে তবে তার আড়ষ্টতা বুঝতে পারলো আরমান সাহেব।মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন উনি।বললেন,
—“কিছু বলবে?”

উপরনিচে মাথা নাড়লো তোহা।তবে মুখ দিয়ে কথা বের হলোনা তার।খানিকবাদে আরমান আবারো বললেন,
—“নির্দিধায় বলো,তোমার কি উনাদের প্রস্তাব টায় মত নেই?আমি তাহলে তাদের মানা করে দিব।”

—“উনি আমার সাথে অসভ্য আচরণ করেছেন আব্বু।আমার গায়ে হাত দিয়েছেন।”মাথা নিচু করে কথাটা বলেই একপ্রকার মিইয়ে গেলো তোহা।

মেয়ের কথায় যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো আরমান সাহেবের।তার মেয়ের সাথে এমন কিছু হয়েছে কাল ঘুনাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি তিনি।পারলে তখনই মুখের উপর তাদের বিদায় করে দিতেন।
মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার।চোখে ক্ষোভ।তোহার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বজ্রকন্ঠে উনি বললেন,

—“তুমি আমাকে আগে বলোনি কেনো?”

একটা ফাঁকা ঢোক গিললো তোহা।বললো,
—“উনি বলেছেন আমি বিয়েতে “না” করলে আপুর সংসারে ঝামেলা হবে।সেজন্যই…”

—“এতো বড় সাহস।কোনো কাপুরুষের সাথে নিশার বিয়ে দেইনি আমি,যে এই ঠুনকো বিষয়ে তার সংসারে ঝামেলা হবে।”বলে ফোনটা হাতে নিলেন উনি।সৌহার্দ্য কে ফোন করে কড়া শব্দে কিছুক্ষণ কথোপকোথন চালিয়ে ফোনটা রাখতেই ফুঁপিয়ে উঠলো তোহা।নিজেকে আটকাতে না পেরে উচ্চশব্দে কান্না করে দিলো।
আরমান সাহেব ভাবলেন না।মেয়ের বুকে টেনে নিয়ে স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
_________________
বিকেলের পরে গিয়েছে।কলিংবেলের শব্দে বুকটা ধক্ করে উঠলো তোহার।নিশা,সৌহার্দ্য,অনন্ত উনাদের বাবা-মা সবাইকে বাসায় আসতে বলেছেন আরমান সাহেব।তাঁরাই হয়তো এসেছে।বাড়ির উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাবে তা জানেনা তোহা।ভয়ে হাত পা কাঁপছে কার।

দরজায় কান লাগিয়ে ড্রইংরুমের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো তোহা।কিছু বুঝতে না পেরে বিছানায় এসে বসতেই দরজা খুলে প্রবেশ করলো আতিয়া।দরজার সামনে দাড়িয়েই বললো,
—“তোমার বাবা যেতে বলেছে তোমাকে।যাও।”

মায়ের মুখে “তুমি” সম্মোধনটা ঠি ক মানতে পারলোনা তোহা।টলমলে পায়ে ড্রইংরুমে উপস্থিত হলো সে।গুটিগুটি পায়ে বাবার সোফার পাশে যেয়ে দাড়ালো সে।
পরিবেশ থমথমে।অনন্তর মা বলে উঠলেন,
—“আমার ছেলে তোমার সাথে অসভ্য আচরণ করেছে কোন প্রমাণ আছে?”

—“প্রমাণ থাকার তো কথা নয় আন্টি।আমি তো জানতাম না আপনার ছেলে এমন করবে।”সাবলিলভাবে উওর দিলেও মাথায় রাগ চেপে বসেছে তোহার।

অনন্তর ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—“আপনার মেয়ে মিথ্যা বলছে।আমি এমন কিছু করিনি।”

মাথায় রক্ত উঠে গেলো তোহার।দু’কদম এগিয়ে যেয়ে আচমকাই সজোরে অনন্তের গালে চড় বসিয়ে দিলো সে।হঠাৎই চুপ হয়ে গেলো সবাই।অনন্তের গালে হাত।চোখে বিস্ময়।একটা মেয়ের হাতের চড়ের তীব্র অপমানটা সহজে হজম করতে পারলোনা সে।
খানিকবাদে আরমান সাহেব উঠে দাড়ালেন।তোহার হাত টেনে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন,
—“দেখুন আমার মেয়েকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি আমি।আপনারা হয়তো নিজেরাও জানেন আপনাদের ছেলে কেমন।শুধু শুধু দোষ ঢেকে লাভ নেই।আপনাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনারা ছেলের দোষ স্বীকার করেছেন।যাই হোক,আমার মেয়ে চড় মেরেছে সেজন্য আমি দু:খিত নই।চড়টা আপনাদের ছেলের প্রাপ্য ছিলো।আর সৌহার্দ্য তুমি যদি এই ঘটনার রেশ ধরে নিশার…”

—“নিশা আর আমার সংসারে এর প্রভাব পরবেনা বাবা।আমি নিজেই লজ্জিত আমার ভাইয়ের কর্মকান্ডে।আপনি দয়া করে এসব বলে আমাকে আর ছোট করবেন না প্লিজ।”

আরমান সাহেব একটু হাসলেন।দুই ভাই অথচ কত পার্থক্য।তবে মেয়ের বাবা হওয়া সোজা না।কথাটার মর্মার্থ আজ উপলদ্ধি করতে পারছেন তিনি।
_______________
ফোনের ডায়াল লিস্টে শুধুই তিহানের নাম্বার।বারান্দায় বসে একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে তোহা।তিহান রিসিভ করেনি একবারও।চোখে আবারো পানি এসেছো তোহার।আরো দু’চারবার রিং হয়ে ফোন কেটে যাওয়ার পর তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সে।লাজ-লজ্জা ভুলে আরেকবার ফোন দিলে এবার ফোনটা বন্ধ শোনাচ্ছে।তারমানে তার ফোন করায় বিরক্ত হয়ে তিহান ফোন বন্ধ করে দিয়েছে?এতটা রাগ?আজ সারাদিনে ওই ফ্ল্যাটে যায়নি তোহা।তিহানের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতেও শোনেনি।

একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পাশের বারান্দার দিকে চেয়ে রইলো তোহা।তিহানের অনুপস্থিতি বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে।বড্ড বেশিই পোড়াচ্ছে।হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।দু’হাটুতে মুখ গুঁজে কান্নাজড়ানো কন্ঠে আর্তনাদ করে বললো,”আপনি কোথায়?আমার যে ভালো লাগছেনা।একা একা লাগছে খুব।ফিরে আসুননা প্লিজ।”

~চলবে~
~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here