গাংচিল পর্ব ৮

#গাংচিল
#৮ম_পর্ব

লোকটাকে দুদিন আগে আগের বই টা পড়তে দিয়েছে মৌপ্রিয়া। তার কোনো রেসপন্স এখনো পায় নি। হয়তো পড়া শেষ হয় নি তার। মৌপ্রিয়াও কোনো প্রশ্ন করে নি। হঠাৎ সীমান্ত গভীর চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“নায়ক-নায়িকাকে সবসময় সুন্দর কেনো হতে হয় মৌপ্রিয়া। আমি, তুমির মতো সাধারণ মানুষ হলে ক্ষতি কি? ধরো গল্পের নায়ক আমি, নায়িকা তুমি। গল্পটা কি খুব বেমানান হবে?”

সীমান্তের প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে যায় মৌপ্রিয়া। তড়িৎ গতিতে তার দিকে তাকালো সে। বেশ স্বাভাবিকভাবেই এমন সাংঘাতিক প্রশ্নটি করলো সীমান্ত। সীমান্তের কন্ঠে কোনো জড়তা নেই, বরং তাকে বেশ সিরিয়াস ই মনে হলো মৌপ্রিয়ার। তার দৃষ্টি মৌপ্রিয়ার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। মৌপ্রিয়ার খানিকটা অস্বস্তিবোধ হলো, “ধরো গল্পের নায়ক আমি, নায়িকা তুমি” কথাটা ভাবতেই বুকের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। মাথাটা ভনভন করছে। মস্তিষ্কে যেনো এই একটা কথাই ঘুরছে। তাড়াতাড়ি সীমান্তের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দিলো সে। নিজের লাজুক মুখটা যেনো সীমান্ত না দেখে তাই মাথাটা নিচু করে ল্যাপটপে কাজ করার ভং ধরে সে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
“বই টি পড়েন না নাকি? আপনি নাকি ১২৬ জন লেখকের বই পড়েছেন। নায়ক নায়িকা কি অসুন্দর হয় নাকি?”
“সৌন্দর্য তো চোখে, আমার মতে সব স্রষ্টার সব মানুষ সুন্দর। এই যে দেখো, তুমি লিখেছো “অদ্রিজা পুতুলের মতো সুন্দরী। দুধে আলতো গায়ের বর্ণ”। কথাটা ঠিক নয়। বাঙ্গালীদের সাথে দুধে আলতো কথাটা যায় না। বরং তুমি যদি অদ্রিজাকে শ্যামবর্ণের লিখতে ইট উড বি রিলেটেবল। আর দুধে আলতো হলেই সুন্দরী হয় কে বলেছে তোমায়? তাহলে তো আফ্রিকাতে কোনো সুন্দরী নারী ই নেই। ওরা তো সবার কৃষ্ণবর্ণ। তোমার এই বই এর প্রথম ভুল ই এটা।”
“আমি এগ্রি করতে পারছি না। বাংলাদেশের আশি শতাংশ মানুষের কাছে ফর্সা মানেই সুন্দর। গায়ের বর্ণ কালো যেনো তাদের কাছে অভিশাপ। যদি তাই না হতো তবে কালো মেয়েদের বিয়ে হবার সময় এতো খোঁচা খেতে হতো না। এই আমাকেই ধরুন। বাবা যখন নবজাতক আমাকে দাদীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন দাদীর মুখ পাতিলের তলার মতো কালো হয়ে গিয়েছিলো। সবাইকে আদর করে ফুলবানু, রসগোল্লা, কমলাপরী নাম দিলেও আমার নাম দেন “কালাবানু”। আমার চামড়া পরিষ্কারের পদ্ধতিগুলো আর নাই বলি। তাহলে কেনো আমার নায়িকা দুধে আলতো হবে না? দুধে আলতা না হলে তো সে কারোর ভালোবাসাই পাবে না। আর এসব না মুখের কথা, আপনিও মনে মনে সেই ক্যাটরিনা, কারিনার মতো সুন্দরী রমনীকেই নিজের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে চান। পুরুষের কালো হলে দোষ নেই, নারীর হতে হবে দুধের ন্যায় ফর্সা।“

মৌপ্রিয়ার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো সীমান্ত। মৌপ্রিয়া এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শান্ত করে গেলো। তার কথা ধরে এসেছে পানি খেতে পারলে ভালো হতো। নীলুকে ডাক নিতে নিবে তখন ই সীমান্ত বলে উঠলো,
“সুন্দরী মেয়েরা মায়াবতী হয় না; তাদের চেহারায় থাকে রুপের দাম্ভিকতা। সেই দাম্ভিকতা তাদের মায়াকে গ্রাস করে। আমার শ্যামলী ভালো লাগে, মায়াবতী শ্যামলী। যাকে আমি ডাকবো কাজললতা।“

জানালার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো সীমান্ত। তার কন্ঠে এক অন্যরকম নেশা উপছে পড়ছে। ক্ষণিকের জন্য মৌপ্রিয়া থমকে গেলো। তার মস্তিষ্কে একটা শব্দ ঘুরতে থাকলো, “কাজললতা” “কাজললতা”। এই সীমান্তফোবিয়ার একটি উপসর্গ হলো সীমান্তের প্রতিটি কথা নিউরণে যেনো ছাপ ফেলে যায়। চাইলেও অন্য কিছু স্মরণে থাকে না মৌপ্রিয়ার। এই যেমন ভুলেই গিয়েছে সে নীলুকে পানি আনার জন্য ডাকতে যাচ্ছিলো। তার মাথায় এখন সীমান্তের “কাজললতা” বিস্তার লাভ করেছে। সীমান্ত জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। তার চাহনিতে মনে হচ্ছে সে কোনো খুব চমৎকার কিছু একটা দেখছে। ছোট বাচ্চারা বিষ্ময়কর জিনিস দেখলে যেমন তাদের চোখ জ্বলজ্বল করে, সীমান্তের চোখটাও ঠিক তেমন ই চকচক করছে। আর মৌপ্রিয়া সে তো সুগাঢ় নজরে সীমান্তকেই দেখে যাচ্ছে। রাসেলভাইকে দেখতে যদি এই পুরুষটির মতো হতো তবে কি খুব খারাপ হতো! কে জানে!

দুপুরে খেতে বসার সময় ইফতেকার সাহেবকে দেখা গেলো না। সীমান্ত জিজ্ঞেস করলে মৌপ্রিয়া বলে,
“আজ বাবা বাসায় খাবে না, বছরের এই দিনটা বাবা বাসায় খান না।“

সীমান্ত আর কোনো প্রশ্ন করলো না। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ঔষধের পাতা করলো। নীলুকে বললো,
“আমাকে একটু গরম পানি দিবে, কুসুম গরম হলেই চলবে নীলাঞ্জনা।“

নীলু খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। বিব্রত গলায় বললো,
“আপনি আমারে নীলাঞ্জনা কয়ে ডাকতেছেন কেন? আমার নাম তো নীলু।“
“নীলাঞ্জনা নামটা তোমাকে বেশ মানায়। সুন্দর নামে ডাক শুনতে সবার খুব ভালো লাগে। তোমার ও লাগে, তাই তো মৌপ্রিয়া তোমাকে ডাকলে তুমি খুব দ্রুত উত্তর দাও। তাই না?”
“জে, আপনি ঠিক ধরছেন। এই নামটা আমার হেবি লাগে”
“তাহলে এবার আমাকে একটু গরম পানি এনে দাও।“

নীলু ছুটে গেলো রান্নাঘরে। মৌপ্রিয়া হেসে বললো,
“বাহ, নীলাঞ্জনার সাথে বেশ খাতির হয়েছে দেখছি। সে গরম পানি করে খাওয়াচ্ছে। অন্য কেউ হলে তার কথার বান ছুটতো”
“মেয়েটা ভালো, আদর পেতে ভালোবাসে। আদর করে কথা বললেই তার ভক্ত হয়ে উঠে। যেমনটা তোমার ভক্ত হয়ে উঠেছে। তুমি ওকে বকলেও খুব আদর করো। তাইতো তোমার সব কথা শুনে।“
“আমি মোটেই ওকে আদর করি না। আর মাত্র যে বললেন আমি ওকে সুন্দর নামে ডাকি বলে আমার কথা শুনে।“
“আদর করো বলেই তো সুন্দর নামে ডাকো তাই না। বাহিরে কঠোরতা দেখালেও মনের দিক থেকে তুমি অনেক স্বচ্ছ, নরম। নয়তো এক অজানা মানুষের পাঞ্জাবী ধুয়ে সেটাকে ইস্ত্রী করে দিতে না।“

সীমান্তের কথার উত্তর দিলো না মৌপ্রিয়া। সে কথা ঘোরানোর জন্য বললো,
“এটা কিসের ঔষধ? জ্বর টর বাধালেন বুঝি?”
“ওরকম ই কিছু, এটা আমার নিত্যদিনের ঔষধ। ছোট বেলা থেকেই খেতে হয়। আমার শরীরটা বেশ দূর্বল তো তাই।“

মৌপ্রিয়ার ইচ্ছে হলো জানতে “কিসের দূর্বলতা?” কিন্তু সে কোনো প্রশ্ন করলো না। অহেতুক বন্ধুত্ব বাড়িয়ে কি লাভ। মাস্টার মাস্টার ই থাক। এর মধ্যেই ফোন বেজে উঠলো মৌপ্রিয়া। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে ফোনটা উলটে রাখলো সে। বাজতে বাজতে এক সময় থেমে গেলো ফোনটি। মৌপ্রিয়া ভেবেছিলো হয়তো মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু না, অক্লান্ত ভাবে ফোনটা বেজে যাচ্ছে। না পেরে মোবাইলটাই বন্ধ করে রাখলো মৌপ্রিয়া। মৌপ্রিয়ার কাজে সীমান্ত ধীর স্বরে বললো,
“ফোনটা ধর, হয়তো কেউ দরকারেই ফোন দিয়েছে।“
“সিমের কোম্পানির ফন, অহেতুক। তাই ধরার প্রয়োজন নেই।“

মৌপ্রিয়ার কোমল কন্ঠ শক্ত হয়ে গিয়েছে। খানিকটা বিরক্তবোধ ও করেছে সে সীমান্তের প্রশ্নে। তাই কথা বাড়ালো না সীমান্ত। চুপচাপ খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো সে। ক্ষণে ক্ষণে মৌপ্রিয়াকে দেখতে লাগলো সে। সে খাচ্ছে না, শুধু ভাত গুলো নাড়ছে। আর এক দৃষ্টিতে প্লেটে চেয়ে কিছু একটা ভাবছে। হুট করেই সীমান্তের মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিলো
“কে ফোন করেছে?”

কিন্তু মুখে প্রশ্নটি করার সাহস হলো না। অযাচিত মানুষ হবার ইচ্ছেটা নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখলো সে।

খাওয়া শেষে ছাতি হাতে বেড়িয়ে গেলো সীমান্ত। নেমে পড়লো বৃষ্টিস্নাত পিচের রাস্তায়। তার যে অনেক কাজ, বসে থাকলে চলবে না। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে ছাতার উপর। ভাগ্যিস মৌপ্রিয়া ছাতাটা দিলো নয়তো আজ আর বের হওয়া হত না। বৃষ্টির মাঝে রিক্সার আকাল পড়ে। এটা যেনো ঢাকা শহরের চিরাচরিত নিয়ম। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে হেটেই গন্তব্যে যেতে হবে সীমান্তের। নিকুঞ্জ থেকে মিরপুর হেটে যাবার মতো মহাপুরুষ সে এখনো হয়ে পারে নি। তবে মাঝে মাঝে হিমু হবার প্রবল ইচ্ছে তাকে ঝেকে ধরে। একবার মৃত্যুর আগে এই কাজটি সে করবেই করবে; হলুদ পকেট বিহীন পাঞ্জাবী পড়ে, খালি পায়ে ঢাকা শহর পরিদর্শন করবে। তাহলে হয়তো এই আক্ষেপটার অবসান ঘটবে। একটা অসাধারণ চরিত্র। সত্যি ই একটা অসাধারণ চরিত্র। চাইলেও কোনো মানুষ হিমু হতে পারবে না। হিমুর স্থান বইতেই সীমাবদ্ধ। এর মাঝেই একটি সিএনজি দেখে থেমে গেলো সীমান্ত। সিএনজি চালক আরামে সিএনজি এর ভেতর পর্দা টেনে ঘুমোচ্ছে। অবশ্য আজকের আবহাওয়া ঘুমানোর জন্য একেবারেই উপযুক্ত। সীমান্ত ধীর স্বরে বললো,
“ভাই কি যাবেন?”

লোকটা এখনো ঘুমোচ্ছে। ক্লান্তির ঘুম গভীর হয়, ক্ষুধার ঘুম হয় পাতলা। সীমান্ত তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“ভাই যাবেন?”

লোকটার ঘুম ভাঙ্গায় তিনি বেশ বিরক্তই হলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
“কই যাবেন?”
“মিরপুর ১, যাবেন?”
“না যামু না”
“কেনো যাবেন না?”
“আমার ইচ্ছে, যামু না”
“আমি আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দিবো। এই বৃষ্টিতে যাবার উপায় নেই। আমার তাড়াও আছে। মানা করবেন না”
“ঠিক আছে, হাজার দিবেন।“

লোকটার ভাড়া শুনেই বোঝা যাচ্ছে তার আজ সিএনজি চালাবার মুড নেই। সে ভেবেছিলো সীমান্ত হয়তো মানা করবে। কিন্তু লোকটিকে অবাক করে সে বসে পড়লো সিএনজি তে। চালক মহাশয় খানিকটা অবাক হলো, তার চাহনী আপাদমস্তক সীমান্তকে দেখতে লাগলো। সীমান্ত বললো,
“কি হলো ভাই, চালান”

চালক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিএনজি স্টার্ট দিলো। বেঁচারা হয়তো মনে মনে নিজেকে শান্তনাই দিলো, ঘুম ভেংগেছে তো কি, হাজারটাকা কামাই তো হচ্ছে। এক ঘন্টা বাদে সিএনজি থামলো মিরপুর ১ এর গন্তব্যস্থলে। বাহিরে সাইনবোর্ড ঝুলছে “অনুপমা প্রকাশনী”

বারান্দায় আবছা মুখে দাঁড়িয়ে আছে মৌপ্রিয়া। আকাশের মতো আজ মনেও হাজারো কালো মেঘ ভর করেছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কাঁদতে পারছে না। আকাশের কি শান্তি তা না! যখন খুশী কাঁদতে পারে, কেউ টের টুকু পায় না। আজ সে যদি কাঁদতে পারতো হয়তো শান্তি লাগতো। এমন সময় নীলু ছুটে এলো। হাতে কডলেস ফোন টি। কাঁপা স্বরে বললো,
“আফা, খালাম্মায় ফোন দিছে”

কথাটা শুনে নীলুর দিকে তাকালো মৌ। রাগে, অভিমানে তার মুখ লাল হয়ে আছে। শক্ত কন্ঠে বললো,
“তোর খালাম্মাকে বল, আমি ব্যস্ত।“
“খালাম্মায় কইছে, অতি জরুরী। খালুর ব্যাপারে।“

বাবার কথা শুনে চোখ কুচকে আসলো মৌপ্রিয়ার। ফোনটা নিয়ে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“বলো মা………………

চলবে

[পরবর্তী পর্ব ইনশাল্লাহ আগামীকাল বিকেলে দিবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here