গুমোট অনুভুতি পর্ব ৪৮

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৮

সায়ান নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতের ফসকে ফোন পড়ে গিয়েছে কতোক্ষণ হলো।ও সারা শরীর যেনো অসাড় হয়ে আছে,বেলেন্স রাখতে না পেরে বসে গিয়েছে।মিটিং রুমের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,সায়ান জামিল খানের অসহায় অবস্থা আগে কোনদিন দেখেনি।সায়ান থরথর করে কাঁপছে, রুশি কি বললো ওগুলো! কি হয়েছে ওর? কোথায় ও?সায়ানের অবস্থা দেখে সাহিল দৌঁড়ে এলো,কোনমতে সায়ানকে দাঁড় করালো। সায়ান অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো

“র্ রুশি!রুশির কাছে যাবো”

এটা বলেই সায়ান ছুটা শুরু করলো, লিফটের বাটন ক্লিক করার পর তা কাজ করছে না। সায়ান সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করলো, বিশতলা ওর কাছে যেনো কষ্টের মনে হচ্ছে না। সাহিলও বসের পিছু ছুটলো, কয়েকমুহুর্ত পুর্বে ড্রাইভার ফোন করে রুশির ক্রিটিকাল অবস্থার কথা বলেছে আর তাকে এপোলো হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কথাও । ও সায়ানকে এই খবর দিতেই মিটিং রুমে ঢুকেছিলো কিন্তু ঢুকে বুঝতে পারে সায়ান অলরেডি জেনে গেছে তাই দেরি না করে ড্রাইভারকে ফোন করে বললো গাড়ি রেডি করতে। সায়ান অফিস থেকে বেরিয়েই দ্রুত গাড়িতে উঠলো, ভয়ে শরীর ঘামছে! ও কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা,হসপিটালের সামনে আসতেই সায়ান দৌড়াতে শুরু করলো তারপর রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলো কিছুক্ষণ পুর্বে কোন ক্রিটিকাল রোগি ভর্তি হয়েছে কিনা! রিসেপশনিস্ট ইমার্জেন্সি সেক্টরের কথা বলতেই সায়ান দৌঁড়ে গেলো সেদিকে আর গিয়েই অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হতে দেখলো। ও তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“হাউ ইজ মাই ওয়াইফ?কি হয়েছে ওর!ও ঠিক আছে তো?”

“মিস্টার খান প্লিজ কাম ডাউন!”

সায়ান হুট করেই এগ্রেসিভ হয়ে পড়লো, ডাক্তারের কলার চেপে ধরে বললো

“আপনি আমাকে শান্ত হতে বলছেন?কি করে শান্ত হবো আমি?আমার ওয়াইফ ওইখানে আছে!”

সাহিল দ্রুত সায়ানকে ছাড়িয়ে ডাক্তারের কাছে ক্ষমা চাইলো। ডাক্তার ধীর স্বরে বললো

“আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি!কিন্তু এতো উত্তেজিত হয়ে কোন কিছুর সমাধান সম্ভব নয়। এই মুহুর্তে আমার কথা আপনার শোনা খুব জরুরী! আপনার স্ত্রীর জন্য হলেও আপনাকে শান্ত মাথায় সবটা শুনতে হবে। আপনি নিজেকে প্রস্তুত করুন”

সায়ান হুট করেই শান্ত হয়ে গেলো, মাথা গরম করে কোন কিছুর সমাধান হবে না। ওকে ডাক্তারের কথা মানতে হবে, সাহেল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ও ডাক্তারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো

“আপনি বলতে পারেন যা বলার, আমি প্রস্তুত!”

ডাক্তার অবাকই হলো পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো

“আপনার ওয়াইফের শরীরে পয়জন পাওয়া গেছে আর সেটা সেবন করার মাধ্যমে ওনার শরীরে যায়নি বরং সেটা তার শরীরে লাগার কারণে এমন হয়েছে!এটা খুব রেয়ার একটা ড্রাগ যেটা আমাদের দেশে লিগাল নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এটা হিউমেন ড্রাগ নয় বরং এনিমেল ড্রাগ। এই ড্রাগ প্রানীদের মিস ক্যারেজে ভুমিকা রাখে,কিন্তু এটা হিউমেন বডিতে গেলে ইন্টারনাল ব্লিডিং ক্রিয়েট করে আর তাতে মিস ক্যারেজের সম্ভাবনা থাকে। আপনার ভাগ্য ভালো যে তার শরীরে কম পরিমাণ ড্রাগ পড়েছে কিন্তু তা ইফেক্টিভ! এইজন্য আপনার ওয়াইফের হাল্কা ব্লিডিং হয়েছে আর মিস ক্যারেজ আপাদত হয়নি তবে আপনাদের কাছে মাত্র কয়েকঘন্টা আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই ড্রাগটাই আরো কিছু আননোন কেমিক্যাল ইউজ করা হয়েছে যা আমাদের জানা নেই, ল্যাবে পরীক্ষা করার সময়ও আপাদত আমাদের নেই”

সায়ান ডাক্তারের কথা শুনেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়লো, ঢুকেই রুশিকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পেলো। চোখে মুখ কেমন যেনো সাদা হয়ে আছে,যেনো শরীর রক্তশুন্য!ও আৎকে উঠলো আর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো

“ওর এই অবস্থা কেনো?কি হয়েছে ওর?”

“ওনার শরীরে ব্লাড ট্রান্সফিউশন হচ্ছে,ওই ড্রাগের কারণে রক্ত বিষাক্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন অংশে, তা যাতে পুরো শরীরে না ছড়ায় তাই সেটা ধীরে ধীরে শরীর থেকে সরিয়ে নতুন করে ব্লাড দেয়া হচ্ছে। এতে করে পয়জন একসময় শরীর থেকে চলে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সাইড ইফেক্ট, সেটা শরীরের যা ক্ষতি করার করে ফেলেছে!আমাদের কাছে এই ড্রাগের সঠিক এন্টিডোর নেই কিন্তু যেটা আছে তাতে আমরা যেকোন একজনকে বাঁচাতে পারবো”

“আপনি রুশিকে বাঁচান, আমার সন্তান দরকার নেই। ভবিষ্যতে বেঁচে থাকলে সন্তানের অভাব হবে না। আর যদি নাহয় তবুও কোন সমস্যা নেই, আমরা বেবি এডপ্ট করে নিবো। আপনি জাস্ট আমার ওয়াইফকে বাঁচান ”

“যদি আপনার ওয়াইফকে বাঁচান তবে তার ভবিষ্যতে মা হওয়ার চান্স মাত্র ৩০% যেটা অনেক কম।আমরা তাহলে…”

“স্ সায়ান!”

রুশির কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনে সায়ান ফিরে তাকালো আর রুশির পাশে গিয়ে বললো

“তুমি ঠিক আছো?চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে আমি আছিতো!”

সায়ান রুশির হাত চেপে ধরতে নিলে রুশি তা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো আর কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো

“আপনি আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে চান?দয়া হলো না একটু ওর উপর? কেমন বাবা আপনি?”

“আমি আমাদের বেবিকে অনেক ভালোবাসি রুশি কিন্তু তার থেকে অনেকগুন বেশি তোমাকে!কোন কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাতে পারবো না,প্লিজ এমন কিছুনা বলোনা”

“আমি এই বেবিটাকে পৃথিবীতে আনতে চাই সায়ান, ওকে আমি সাড়া আটমাস ধরর গর্ভে ধারণ করছি!ধীরেধীরে নিজের মাঝে ওকে বেড়ে উঠতে দেখেছি, আমি কি করে ওকে ছেড়ে দিবো তাও নিজে বাঁচার লোভে?আমি পারবো না, কক্ষনো না। আমি মরে যাবো সায়ান, দয়া করে আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দিন। এটা আমার শেষ ইচ্ছে ধরে নেন!”

“তুমি আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো কেনো?মরে যাবো তোমাকে ছাড়া, এরচেয়ে ভালো আমাকে মেরেই ফেলো। জিন্দা লাশ হয়ে থাকার চেয়ে এটাই ভালো! আমি তোমাকে ছাড়া বড্ড অসহায় রুশি, এই অন্যায় আমার প্রতি করোনা”

সায়ানের চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করলো, বুকের বাঁ পাশে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। রুশি এই অসহায় অবস্থা মেনে নিতে পারলো না তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো! তারপর চোখ মুখে খিঁচে বললো

“আমার সন্তান আমার কাছে বেশি ইম্পর্টেন্ট, ও আমার জীবনে প্রথম এসেছে তারপর আপনি। আমি কোনকিছুর মুল্যে ওকে হারাতে পারবো না, আপনার জন্যও না। আমি ওকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চাই, সায়ান আমার আর আপনার মাঝের সম্পর্কের মুল ভিত্তি আমাদের সন্তান! ওকে কি করে হারাতে পারি আমি, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ও! আমি বেঁচে যদি নাও থাকি আমাদের সন্তান তাও বেঁচে থাকবে!আমি জানি আপনি অনেক ভালো বাবা হবেন,আমাদের সন্তানকে আমি ছাড়াও বড়ো করতে পারবেন!”

“আমি সন্তান চাইনা রুশি, শুধু তোমাকে চাই তুমি কি বুঝতে পারছোনা?আমার শুধু তোমাকে লাগবে আর কাউকে না, আমার মনের ভিতর জমিয়ে রাখা #গুমোট_অনুভুতি তুমি,আমার প্রথম ভালোবাসা!আমি তোমাকে হারাতে পারবো, তুমি আমার জীবনটা চাইলেও আমি তোমাকে দিয়ে দিবো কিন্তু তার বিনিময়ে তোমাকে দিয়ে দাও প্লিজ!আই বেগ ইউ রুশি ডোন্ট লিভ মি!আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাবো সত্যি বলছি, ডোন্ট লিভ মি!”

সায়ানের কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনে রুশি নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা, সায়ানের ওর কাছে যেনো নিজের জীবন ভিক্ষা চাইছে! এতো ভালোবাসে কেনো ওকে?ও যে কঠোর হতে পারছে না, ও নিজেও যেতে চায়না কিন্তু এটাই ওর নিয়তি। ও সায়ান হয়তো একসাথে বাঁচার ভাগ্য নিয়ে আসেনি,ও বাঁচতে চায় খুব করে বাঁচতে চায়। সায়ানের জন্য হলেও কিন্তু ওর হাতে সময় নেই। ও কঠোর গলায় বললো

“আপনাকে আমার কসম সায়ান আমার বেবিকে বাঁচিয়ে দেন!প্লিজ”

সায়ান কিছু বলতে পারছেনা, সকল শব্দ গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে! ও বুঝতে পারছেনা কি বলবে, রুশির হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে!বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“আমি পারবো না,কিছুতেই পারবো না”

“আমার শেষ ইচ্ছে সায়ান রাখবে না?”

রুশির মুখে তুমি শুনে সায়ান ওর দিকে তাকালো, রুশি মলিন হেসে বললো

“তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো সায়ান! তোমার ছোট্ট পরীর খোঁজ পেয়েছি আমি কিন্তু আফসোস তার হাতে বেশি সময় নেই তাই তোমাকে বলার সুযোগ পাচ্ছে না।সে খুব করে চেয়েছিলো তোমাকে বলতে কিন্তু বলতে পারেনি। জানতে ইচ্ছে করছে না সে কে?”

“না করছে না, আমার কোন কিছুর দরকার নেই শুধু তোমাকে চাই”

“তুমি অনেক বদলে গেছো মিস্টার খান!,পরীকে এতো সহজে ভুলে গেলে?সে তোমার জীবন বাঁচিয়েছে, তার মানে তোমার জীবনটা তোমার নয় বরং তার।”

বলেই রুশি নিজের গলার ভেতরের চেইনসহ লকেট বের করে দেখালো,এটা হসপিটাল থেকে বেরিয়েই পরে নিয়েছিলো। সায়ান এটা দেখে চমকে গেলো, ও জানেনা কিভাবে কি হয়েছে শুধু রুশির কথা শুনে এইটুকু বুঝতে পারছে ওর ছোট্ট পরী আর কেউনা রুশি!ওর মাথায় যেনো সব হিসাব মিলাতে শুরু করলো, রুশি অনাথ আর ও মাধবপুর ছিলো। ওকে ছয়বছর থাকতে সেখান থেকে এডপ্ট করা হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা ওর তারাদের সাথে কথা বলা মানে ইন্ডিরেক্টলি ওর সাথে কথা বলা, ওর আগুনে ভয় পাওয়া যার সবচেয়ে বেশি পসিবিলিটিস সেই মেয়ের যে ওর প্রান বাঁচিয়েছিলো। এতো ক্লু সামনে থাকা সত্ত্বেও ও বুঝতে পারেনি যে রুশি ওর ছোট্ট পরী!ও এতোটা কেয়ারলেস কি করে ছিলো?ও বলতে শুরু করলো

“রুশি আমি সত্যিই স্যরি, আমাকে তোমাকে খুঁজে পাইনি। সব আমার জন্য হয়েছে, আজ আমি কোম্পানিতে না গেলেই এমন হতোনা। আমি অনেক বাজে একজন স্বামী!”

“আপনার জন্য কিছু হয়নি বরং আমার বোকামির জন্য হয়েছে! আমার আপনাকে জানিয়ে বডিগার্ড সহ যাওয়া উচিৎ ছিলো! বা আপনার সাথে।না আমি বাইরে যেতাম আর না এমনটা হতো আমার সাথে।”

“তোমার কোন দোষ নেই, আমারই দোষ আমি আগে তোমায় খুঁজে পাইনি।”

“আমাদের বাবুটার খেয়াল রাখবেন আর বিয়ে করবেন না। আমি আমার স্থান কাউকে দিতে পারবো না,সায়ান জামিল খানের ওয়াইফ একমাত্র আমিই থাকবো আর কেউনা।রুশি তার জিনিসে কারো ভাগ দেয়না!বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে মিস্টার খান!”

এরপর রুশির ইশারায় ডাক্তার সায়ানকে বের করে দিলো আর ওটির রুমের দরজা বন্ধ করার আগে বললো

“চিন্তা করবেন না দোয়া করেন, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো দুজনকে বাঁচানোর।আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী বেঁচে থাকবে, সিচুয়েশন অতো ক্রিটিকাল না”

এই কথাটি সায়ানকে আশ্বাস দিলো কিছুটা, রুশি মরবে না, ও বেঁচে থাকবে!ও দেয়ালে ঘুষি মারা শুরু করলো, হাত ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। ও বিড়বিড় করে বলতে থাকে

“তোমাকে ফিরতে হবে রুশি, ফিরতে হবে তোমাকে!”

সায়ান স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো ওই মুহুর্তে ওর পরিবারের সবাই আসে সাথে ওর খালা খালুও এমনকি রুশির বাবাও সাথে ছিলো আর ওকে প্রশ্ন করা শুরু করে কিন্তু ও ঠাঁয় হয়ে বসে থাকে! কারো কথা ওর কানে যাচ্ছে না, শুধু ওটির দরজার দিকে চেয়ে আছে! এমন সময় সায়ানের ফোন বেঁজে উঠে, সায়ান পিক না করাতে সাহিল তুলে আর কিছুক্ষণ পর বলে উঠে

“স্যার আপনাকে চাইছে”

“বলো আমি এখন কথা বলতে পারবো না”

“স্যার মেডামের ব্যাপারে কিছু বলবে বলছে!”

সায়ান দ্রুত ফোন তুলে আর বলে উঠে,,,

“কে তুমি?রুশির ব্যাপারে কি বলতে চাও”

“সায়ান আমার কাছে বেশি সময় নেই, রুশির এন্টিডোর আমার কাছে। বহুকষ্টে নিয়েছে তুমি তাড়াতাড়ি হসপিটাল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কাউকে পাঠাও। আমি লুকিয়ে আছি কোন মতো!আর মনে রেখো এই সব কিছুর পেছনে সামাদ খান দায়ী!তুমি সাবধানে থাকো আর রুশিকে সাবধানে রাখো!”

“সামাদ খান?কে সে?”

এটা শুনেই সবার মুখে যেনো আতঙ্ক দেখা দিলো বিশেষত রুশির বাবার চেহারায়!
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#রহস্যউম্মোচন_পর্ব

রুশির বাবার মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে সায়ান অবাক হলো না, ওর আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো রুশির বাবা রুশির অনেক কিছু জানে কিন্তু প্রকাশ করছে না। তবে নিজের পরিবারের বড় সদস্যদের ভয় দেখে ও চমকে গেলো, বিশেষত প্রিয় আন্টির চেহারায় অন্যরকম ভয় ফুটে উঠেছে!তারমানে এটা শুধু রুশির সাথে জড়িত না বরং ওর সাথেও জড়িত। ও সবার দিকে তাকিয়ে বললো

“কি হচ্ছে সবাই কি আমাকে বলবেন প্লিজ?আমি বুঝতে পারছিনা এই সামাদ খান কে আর তার সাথে আমার কি সম্পর্ক!”

রুশির বাবা হুট করেই চেঁচিয়ে উঠলো আর বললো

“আমি এই জন্যই সত্যটা বলতে চাইনি আর না চেয়েছি কেউ সত্য জানুক। কিন্তু নিয়তির থেকে কেউ ফিরতে পারেনা। আমি এই খান পরিবার থেকে রুশিকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও সেই পরিবারেই আছে এখন। আমি যদি জানতাম তুমি এই খান পরিবারের সন্তান তাহলে কখনোই রুশিকে তোমার কাছে বিয়ে দিতাম না আর না এই পরিবারের ছায়া পড়তে দিতাম ওর উপর! রুশি আমার আপন মেয়ে না হলেও আমি ওকে নিজের মেয়ে হিসেবে দেখি, যদি তোমার সাথে ওর বিয়ে না হতো তবে না সামাদ খানের নজরে আসতো আর না ওর আজকে মুমুর্ষ্য অবস্থায় থাকতো!”

“কে এই সামাদ খান?আর আমাদের সাথে তার কিসের সম্পর্ক!”

সায়ানের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ওর মা বলে উঠলো

“সামাদ খান তোমার বাবার ভাই, মানে তোমার আপন চাচা!”

“আমার চাচা?তাহলে আমি কেনো তার সম্পর্কে জানিনা আর আমাদের সাথে তার কিসের শত্রুতা?”

“সামাদ খান জামিলের ছোট ভাই হলেও সে জামিলের বিপরীত ছিলো সম্পুর্ণ। মানুষের ক্ষতি করে সে পৈশাচিক আনন্দ পেতো সবসময়, বিনা কারণে ক্ষতি করতো সবার। তোমার দাদা সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন আর কোম্পানির কথা চিন্তা করে তোমার বাবাকে কোম্পানির সিইও বানান। এটা তার সহ্য হয়নি তাই নানা ভাবে তোমার বাবা আর আমার ক্ষতি করতে চাইতো কিন্তু আমরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। এরপর তার নজর পড়ে প্রিয়ানার উপর কিন্তু ততদিনে প্রিয় আর শাহিন একে অপরকে পছন্দ করতো তাই আমরা তাদের বিয়ে ঠিক করি। এটা সে সহ্য করতে পারেনি তাই প্রিয়কে রেপ করতে চায় কিন্তু আমরা বুঝে গিয়ে বাঁচিয়ে ফেলি। তোমার দাদা তখনো বেঁচে ছিলো, তিনি সামাদকে কিছু সম্পদ দিয়ে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেয় কিন্তু সামাদ আমাদের পেছনে পড়েই ছিলো।আর তোমার বাবাকে ড্রাগস দিয়ে এক নারীর সাথে মিথ্যে স্ক্যান্ডালে ফাঁসিয়ে দেয়, ওই মেয়ে তোমার বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করতো আর তোমার বাবা কিছুই করতে পারতো না”

“তুমি বিষয়টি জানতে?”

“হুম জানতাম! সেই ছবির সবার আগে আমার ফোনেই এসেছিলো আর আমাদের মাঝে ঝামেলা হয় এটা নিয়ে খুব বেশি। আমি তাকে ভুল বুঝি আর এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দেইনি। তার মধ্যে তুমি হঠাৎ হারিয়ে গেলে, সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে সেদিন তারা সেই আশ্রমে তোমাকে মারতে চেয়েছিলো কিন্তু একটা মেয়ে তোমাকে বাঁচায়!তোমাকে বাঁচানোর জন্য মেয়েটিকে সাথে নিয়ে আসতে পারিনি কিন্তু মেয়েটির জন্যই তুমি বেঁচে আছো!”

“আর ওই মেয়েটি হচ্ছে রুশি!ওই আশ্রমে ওই ছিলো সেদিন যে আমাকে বাঁচিয়েছে!”

“সেটা রুশি ছিলো?যাক এতো বছর আমরা তাকে খুঁজে পেয়েছি! তোমার বাবা শুনলে খুব খুশি হতেন। আমি তার প্রতি বড্ড অন্যায় করেছি সায়ান, সামাদ আমাদের মাঝে ভুলবুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে চেয়েছে আর আমি সেই সুযোগ তাকে দিয়েছি। তোমার বাবা সব প্রেশার নিতে না পেরেই ওপারে চলে গেছে! আমি বড্ড অন্যায় করেছি তার সাথে”

সায়ান মাথানিচু করে ফেললো, ওর বাবার আসলে কোন দোষ ছিলো না। সে পরিস্থিতির স্বিকার ছিলো আর আমি তাকে ভুল বুঝেছি!আমি আমার বাবাকে অসম্মান করেছি, তাকে ঘৃণা করেছি। বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি তার সাথে! আমি সত্যিই স্যরি বাবাই!”

সায়ানের ভাবনার মাঝেই ওর প্রিয় আন্টির ধরা কণ্ঠে বললো

“ওই সামাদ খান শুধু এইটুকু করে ক্ষান্ত হয়নি!বিশবছর পুর্বে ও আমার সন্তান কেড়ে নিয়েছে আমার থেকে। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে, নাহয় আজ আমার সন্তান বেঁচে থাকতো আর কতো বড় হয়ে যেতো!”

প্রিয়ানা ঢুকরে কেঁদে উঠলো আর শাহিন জামান তাকে সামলে নিলো। রুশির বাবা এতোক্ষন সব শুনার পর মুখ খুললো আর বললো

“আপনি সামাদ খানের ভাইয়ের শালিকা তাহলে!আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার সন্তান আপনার থেকে দূরে যাওয়ার একটা কারণ আমি!রুশি সায়ানের বউ,ওর পরী এইসব বাদেও আরেকটা পরিচয় আছে তার!সে সামাদ খানের ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে মানে আপনাদের মেয়ে। পরী জামান!”

সবাই যেনো শকের মধ্যে চলে গেছে! রুশি ওর খালাতো বোন!সায়ান কি করবে বুঝতে পারছেনা, এতোগুলো সম্পর্ক ওর সাথে রুশির!ও হঠাৎ করেই রুশির বাবার দিকে তাকিয়ে বললো

“আপনি এতোকিছু কি করে জানেন আর সামাদ খানকে কি করে চিনেন?”

“আমি তার অফিসের এমপ্লয়ি ছিলাম একসময় কিন্তু স্বল্প বেতনে। আমার বউ বড্ড বিলাসিতা করতো কিন্তু তা মেনেজ করতে আমি হিমশিম খেতাম! তাই সামাদ খানের ইল্লিগাল কাজে জড়িয়ে পড়ি। যখন বুঝতে পারি তখন বের হওয়ার রাস্তা ছিলো না, একদিন সে আমাকে ফোন করে হসপিটালের সামনে যেতে বলে আর আমি গেলে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দেয় আর বলে মেরে ফেলতে। আমি চমকে উঠি, নিজেকে সামলে বলি যে কে এই বাচ্চাটি? তখন সে বলে তার ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে, আমি আর জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি। কিন্তু বাচ্চাটিকে মারার ক্ষমতা আমার ছিলো না, আমি তাকে শহর থেকে দূরে মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারে রেখে আসি তার গলায় থাকা লকেট সহ যাতে লিখা ছিলো ছিলো পরী!আমি প্রায়ই খোঁজ নিতাম সেখানে গিয়ে, একসময় সেই আশ্রমের সংকট দেখে পরীকে নিজের মেয়ে রুশি বানিয়ে নিয়ে আসি!তারপর ও আমার মেয়ের পরিচয় বড় হয়।আমি চেষ্টা করেছি সামাদ খানের ছায়াও যেনো ওর উপর না পড়ে কিন্তু সেই না চাওয়া ঘটনাই ঘটলো!

প্রিয় আন্টি তখন কাঁপা গলায় বলে

“তাহলে আমার ছেলে?আমার ছেলে কোথায়?”

“আপনার ছেলে কে?আমি এই ব্যাপারে কিছু শুনিনি”

“আমার সেদিন জমজ বেবি হয়েছিলো আর তখনি সামাদ খান হসপিটালে এটাক করে আর দুটো বেবিকেই নিয়ে যায়।ওর গলায়ও একটা লকেট ছিলো যাতে ওর নাম লিখা ছিলো শাহেদ জামান।ও কোথায় তাহলে? ওকেও কি মেরে ফেলেছে?”

সায়ানের কথার মাঝেই চন্দ্রিকা ঢুকলো, ওর গায়ে রক্ত লেগে আছে।ও তাড়াহুড়া করে সায়ানের দিকে এগিয়ে এসে বললো

“সায়ান এটা হচ্ছে এন্টিডোর, জানিনা কতোটুকু কাজ করবে এখন কিন্তু তাও ডাক্তারদের দাও। ”

সাহিল দ্রুত সেটা নিয়ে সেখানে ছুটলো এদিকে সায়ান চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো

“তুমিও সামাদ খানকে চিনো”

“নিজের জন্মদাতাকে কি করে না চিনবো বলো?”

“তুমি সামাদ খানের মেয়ে?”

“হুম! আমার মাকে বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যায় আর আমাকে অনাথ বানিয়ে দিয়েছে। আমার বয়স যখন সাড়ে চার তখন সে আমাকে এসে ভুলভাল বুঝায় আর নিজের সাথে নিয়ে যায়। আমিও অন্ধ ছিলাম তার কথা বিশ্বাস করি! এরপর তোমাকে ফাঁদে ফেলে আর আমাকে মিথ্যে পরী বানিয়ে তোমার কাছে পাঠায় যা আমি নিজেও জানতাম না। নিজের কাজের জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করে, যখন বুঝতে পেরে ফিরে আসতে চাই তখন অন্ধকার রুমে আমাকে কুকুরের মতো আচরণ করে রাখে। আর ব্লেকমেইল করে আমার সেই ছবি ভাইরাল করে দিবে, আমি ভয় সে যা করতে বলে তাই করি। তুমি আমার খোঁজ কখনোই নিতে না তাই তুমি জানো না কিছুই! এরপর আমি যখন প্রেগন্যান্ট থাকি তখন আমার বেবিকে মেরে ফেলেছে, আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে ওই জঘন্য লোকটা। কিন্তু রুশির সাথে একই কাজ হোক আমি তা চাইনি, অন্তত এইটুকু করেও যদি নিজের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি!”

#চলবে

(স্যরি আর বড়ো করে লিখতে পারিনি আর লেট করে দিয়েছি তাই)
#চলবে

(রাতে হয়তো আরেকটা পার্ট দিবো আর সেখানে সব রহস্য খুলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here