গোধূলির রাঙা আলোয় পর্ব -১০

#গোধূলির_রাঙা_আলোয়
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১০

উৎসা বললো, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো ডাক্তার সাহেব ?

উৎসার মুখে ডাক্তার সাহেব ডাকটা কোথাও লাগলো শুদ্ধর। অনেকেই শুদ্ধকে ডাক্তার সাহেব বলে ডেকেছে, তবে উৎসার মুখে ডাকটা অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছে তাকে।

শুদ্ধ নিজেকে সামলে বললো, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে সেটা তোমার ভাবতে হবে না। তুমি ওভাবে কাঁদছিলে কেনো গতরাতে ?

উৎসা থতমত খেয়ে বললো, এ,,এমনি।

শুদ্ধ আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না উৎসার দুবাহু চেপে ধরে বললো, এমনই এমনই কেউ ওভাবে কান্না করে না।

শুদ্ধর স্পর্শে কেঁপে উঠলো উৎসা, ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বললো, মন খারাপ ছিলো তাই, বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছিল।

শুদ্ধ উৎসাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে আঙ্গুল রেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো। হ্যাঁ অস্থিরতা কিছুটা কমেছে তার। কোনো মারাত্মক বিষয় নয়, সেটা ভেবে।

ব্যাগটা নিচ থেকে হাতে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, খাবার দিতে বলো কাউকে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

শুদ্ধ ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। উৎসা থম মেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কী হলো তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। শুদ্ধ হঠাৎ এমন কেনো করলো তাই মাথায় ঢুকছে না। পরক্ষণে মনে পরলো শুদ্ধ খাবার দিতে বলেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বুঝলো সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কাউকে না ডেকে নিজেই কিচেনে গিয়ে ওভেনে খাবার গরম করতে লাগলো। শুদ্ধ এমন কেনো করলো সেই চিন্তা কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না। খাবার গরম হয়ে গেলে আনমনে বের করতে গিয়ে ছেঁকা খেলো বা হাতে। প্রচন্ড জ্বালা করতে লাগল, ছেঁকা খেয়ে চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে পানির নিচে ধরলো হাত। জ্বালা কিছুনা কমে গেলে খাবার বের করে টেবিলে নিয়ে সাজিয়ে রাখলো।

সব টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে আনমনে বললো, আমি হয়তো বেশি চিন্তা করছি। যেভাবে কেঁদেছিলাম হয়তো তাই চিন্তা হয়েছিলো।

উৎসা নানা চিন্তা ভাবনা করতে লাগলো টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে৷

শাওয়ারের নিচে দেয়ালে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে শুদ্ধ। হ্যাঁ উৎসাকে দেখে তবেই তার অস্থিরতা কমে গেছে। এখন অনেকটা শান্তি লাগছে ভেতর থেকে। মনটা শান্ত হতেই বুঝতে পারলো তার খিদে পেয়েছে। টেনশনে সারাদিন খাবারও নামেনি গলা দিয়ে।

শুদ্ধ বিড়বিড় করে বললো, এ কেমন অস্থিরতা আবার এই বা কেমন স্বস্তি ?

শুদ্ধ চেঞ্জ করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। সিঁড়ি থেকে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো উৎসা টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুদ্ধ গিয়ে উৎসার ঠিক সামনে দাঁড়ালো। শুদ্ধ চুল মুছেনি ভালো করে, গাল বেয়ে একফোঁটা পানি উৎসার গালে পড়তেই উৎসা ফট করে তাকালো। শুদ্ধকে নিজের এতো কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গেলো।

শুদ্ধ পাশের চেয়ার টেনে বসে বললো, তুমি বসে আছো কেনো ? সার্ভেন্ট একজনকে ডেকে দিলেই হতো।

উৎসা দাঁড়িয়ে প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললো, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তো জেগেই ছিলাম তাই আর কাউকে ডেকে ঘুম নষ্ট করিনি।

তোমরা সবাই খেয়েছো ?

সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

শুদ্ধ চুপচাপ খাবার খেতে লাগলো। মাঝে মাঝে আঁড়চোখে উৎসার দিকে তাকাচ্ছে, উৎসা অবশ্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। উৎসা ডান হাতে গ্লাস ধরে বাম হাতে পানির জগটা ধরতে গিয়ে ছেঁকা খাওয়া জায়গায় লাগতেই আহ্ করে উঠলো। তখন জ্বালা করে আস্তে আস্তে কমে গিয়েছিলো তবে লাল হয়ে আছে এখনো।

শুদ্ধ খাবার রেখে উৎসার দিকে তাকিয়ে বললো, কী হলো ?

উৎসা জোরপূর্বক হেসে বললো, তেমন কিছু না।

হাত সরিয়ে নেওয়ার আগেই লাল হয়ে জায়গাটা শুদ্ধর চোখে পরে গেলো।

বা হাতে খপ করে হাতটা ধরে বললো, এটা কীভাবে হয়েছে ?

আবারও কেঁপে উঠে উৎসা আর আমতা আমতা করে বললো, ওভেন থেকে খাবার বের করতে গিয়ে একটু লেগে গেছে।

শুদ্ধ চোখ গরম করে বললো, এ জন্য বাচ্চা মেয়েদের কিচেনে যেতে নেই।

উৎসা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো, কে বাচ্চা ?

শুদ্ধ উৎসার কথা উপেক্ষা করে বললো, এখানে বসে থাকো আমি ক্রিম নিয়ে আসছি।

শুদ্ধ খাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে হাত ধুয়ে রুমের দিকে গেলো। উৎসা সেদিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে টেবিলের বাকি খাবার নিয় ফ্রিজে রাখলো। একটু পরই শুদ্ধ এসে পাশে বসতে বললো। উৎসা কথা মতো শুদ্ধর পাশে বসতেই শুদ্ধ হাতটা ধরে নিজের কাছে এনে সযত্নে ক্রিম লাগিয়ে দিতে লাগলো। উৎসা মৃদু কাঁপছে সেটা অনুভব করতে অসুবিধা হলো না শুদ্ধর। দোতলায় দাঁড়িয়ে কেউ দেখছে সবই। কপাল কুঁচকে দু’জনকেই লক্ষ্য করছে তখন থেকে।

ক্রিম লাগানো শেষে শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অনেক রাত হয়েছে যাও ঘুমিয়ে পড়ো।

উৎসা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ডাক্তার সাহেব ?

শুদ্ধ থমকে দাঁড়ালো আবার সেই ডাক শুনে। আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। হার্টবিট হঠাৎই বেড়ে গেলে শুদ্ধ বুকের পা পাশে হাত রাখলো। মুখে কিছু না বলে ঘুরে তাকালো উৎসার দিকে।

উৎসা মুচকি হেসে বললো, ধন্যবাদ।

আবার সেই হাসি শুদ্ধকে এলোমেলো করে দিলো, ছোট করে হুম বলেই দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। শুদ্ধকে দেখে দোতলায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আড়ালে চলে গেলো। শুদ্ধ নিজের রুমে চলে যেতেই সে ধীরে ধীরে নিচে এসে উৎসার পিছনে দাঁড়ালো। উৎসা তখনো মুচকি হেসে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে উৎসার কাঁধে হাত রাখতেই উৎসা চমকে পেছন ফিরে তাকালো।

সমুদ্র সৈকতে চাঁদের আলোতে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন কপোত-কপোতী। যে কেউ দেখে বলবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ তারা। রাত গভীর হওয়ায় আশেপাশে মানুষের দেখা নেই।

তিয়াসা মুগ্ধর কাঁধে মাথা রেখে বললো, আমাকে যদি খোঁজে না পেতেন তাহলে কী করতেন ?

মুগ্ধ তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো, সেটা ভেবেই দেখিনি।

তিয়াসা মাথা তুলে মুগ্ধর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো, কেন ?

মুগ্ধ সুন্দর করে হেসে বললো, কারণ আমার বিশ্বাস ছিলো আজ হোক বা কাল তোমাকে আমি খোঁজে পাবোই।

তিয়াসা আবার মুগ্ধর কাঁধে মাথা রেখে বললো, এতো বিশ্বাস নিজের উপর ?

না নিজের উপর নয়। তোমার আর আমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস ছিলো আমার।

তিয়াসা মুগ্ধর কাঁধে মাথা রেখেই মুগ্ধর দিকে তাকালো আর মুগ্ধ মুচকি হেসে তিয়াসার কপালে নিজের অধরপল্লব ছুঁইয়ে দিলো। তিয়াসা লাজুক হেসে আবার নিচের দিকে তাকালো।

মুগ্ধ তিয়াসার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আমার একটা রাজকন্যা চাই, দেবে ?

তিয়াসা লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালে, মুগ্ধর হাসির রেখা প্রশস্ত হলো।

১৫.
এভাবেই কেটে গেছে অনেকটা সময়। দিন, সপ্তাহ, মাস শেষে পেরিয়ে গেছে প্রায় দেড় বছর। গভীর রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে উৎসা। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মুচকি হাসি। যে হাসিতে খুন হয় মাত্র কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রেমিক পুরুষ, আজও তা অজানাই উৎসার কাছে। সত্যি কী সে উৎসার প্রেমিক পুরুষ ? মাঝে মাঝে প্রশ্নটা খুব করে ভাবায় উৎসাকে, তবে উত্তরের খাতা বারবার শূন্য পড়ে থাকে।

শুদ্ধ সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, ঘুমাতে যাও অনেক রাত হয়েছে।

উৎসা তাকালো শুদ্ধর দিকে। মানুষটাকে অসম্ভব ভালোবাসে উৎসা কিন্তু মুখে বলা হয়ে উঠেনি। এই যে রোজ রাতে কিছুটা সময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দু’জনে নিরব সময় পার করে কফির কাপে সুর তুলতে তুলতে। গত দেড় বছরে হয়তো হাতে গোনা কয়েকটা দিনই সেটা বাদ গেছে। শুদ্ধর ছোট ছোট কেয়ারে উৎসার মনে হয় সেও উৎসাকে ভালোবাসে আবার মাঝে মাঝে মনে হয় এটা তার মিথ্যা কল্পনা। তবে উৎসার কাছে তো সে প্রেমিক পুরুষ, তার জীবনের এক টুকরো সুখ।

শুদ্ধ উৎসার দিকে তাকিয়ে বললো, শুভরাত্রি।

উৎসা বিনিময়ে মুচকি হেসে বললো, শুভরাত্রি।

বরাবরের মতোই কিছুই সময় মুগ্ধ হয়ে সে হাসি দেখলো শুদ্ধ আর নিজের রুমে চলে গেলো। উৎসা আবার সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাঁধে কেউ হাত রাখলে পেছন ফিরে তাকালো তামান্নার দিকে।

তামান্না গম্ভীর গলায় বললো, কেনো আগুন নিয়ে খেলায় মেতেছিস ?

উৎসা মুচকি হেসে বললো, মনটা আঁটকে রাখার জিনিস নয় তাম্বু। যদি আঁটকে রাখা যেতো তাহলে অবশ্যই আঁটকে রাখতাম।

তামান্না দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, যাকে পাবি না তাকে ভালোবেসে কেনো নিজের কষ্ট বাড়াচ্ছিস ?

উৎসা বললো, আমার জীবনটাই ডুবে আছে কষ্টের সাগরে, সেখানে নাহয় আরো একটু যোগ হলো।

পাগলামি করিস না উৎসা আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই এরিশা আপুরা দেশে ফিরছে আর তারপরই বিয়ে।

উৎসা বরাবরের মতো মুচকি হেসে বললো, এটা যদি আমার একতরফা ভালোবাসা হয় তবে আমি নিঃশব্দে সরে দাঁড়াবো উনার জীবন থেকে।

তামান্না বললো, আর যদি ভাইয়াও তোকে ভালোবেসে থাকে।

বিয়ের এক সেকেন্ড আগে পর্যন্ত আমি তার অপেক্ষায় থাকবো। যদি সে আমাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে অন্য কাউকে কবুল বলতে পারবে না।

খালামুনি তোকে কখনো মেনে নিবে না উৎসা। আমি আমার খালামুনিকে খুব ভালো করে চিনি।

উৎসা আর কিছু না বলে রাতের শহর দেখতে লাগলো। সে রাতে তামান্নাই দেখেছিলো তাকে আর শুদ্ধকে। তারপর থেকেই উৎসাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে শুদ্ধকে নিয়ে স্বপ্ন না সাজাতে। উৎসা চেষ্টা করেছে শুদ্ধকে ভালো না বাসতে কিন্তু ঐ যে মন আঁটকে রাখার জিনিস নয়। উৎসা ভুলতে বেসেছে তার চাওয়া গুলো কোনোদিন পূর্ণতা পায় না, এবার কীভাবে পাবে ?

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here